ড. মোঃ আব্দুর রশীদ

গবেষণাধর্মী গল্প পর্যালোচনা: চন্দন আনোয়ারের ‘ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ’

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

 


গবেষণাধর্মী গল্প পর্যালোচনা: চন্দন আনোয়ারের ‘ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ’

ড. মোঃ আব্দুর রশীদ


“রাত্রির ঘননীল আকাশপথে অবিশ্রান্ত গতিতে উড়ে যাচ্ছে খণ্ড খণ্ড শাদা মেঘ। যেন অতিকায় ম্যাজিক লণ্ঠনের ছবি। বিরামহীন, গত দুরাত ধরেই চলেছে এই মেঘের দল। যেন ৪৭ সালের সীমান্ত-পেরিয়ে-আসা উদ্বাস্তুদের মিছিল। ঐ লম্বাটে মেঘটি আমার ঠাকুরর্দা, ঐ দ্রুতগামী মেঘটি আমার বাবা, ঐ পিছিয়ে-পড়া ক্লান্ত মেঘটি আমার মা।” – কবি রণজিৎ দাশ                                                                                          

বাংলাদেশের নাটোর জেলায় জন্মগ্রহণকারী চন্দন আনোয়ার [জ. ৮ জানুয়ারি, ১৯৭৮] বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত-সৃষ্টিশীল একজন লেখক। মেধা এবং নিরন্তর শ্রমের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় চন্দন আনোয়ারের কথাসাহিত্য। তাঁর পেশা অধ্যাপনা কিন্তু চিন্তাচতেনার বিচরণক্ষেত্র লেখালেখি। তিনি বাংলা সাহিত্যে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সম্পাদক হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও ছোটগল্পের ক্ষেত্রে অধিকতর সৃজনশীলতা এবং মননশীলতার সাক্ষর রেখেছেন। বিপুল অভিজ্ঞতা না হলেও গভীর জীবনবোধ ও সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তির সমবায়ে তিনি তৈরি করেন তাঁর গল্পের ভূমি। চন্দন আনোয়ার লেখকের সাহিত্যিক নাম। তাঁর পৈতৃক নাম মোঃ আনোয়ার হোসেন। সর্বমহলে চন্দন আনোয়ার নামে পরিচিত হয়ে উঠলেও পেশাগত জীবনে তিনি সমস্ত কার্যাদি সম্পন্ন করেন মোঃ আনোয়ার হোসেন নামে। নতুন নামে সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ তাঁর লেখাকে যেমন উজ্জীবিত করেছে, তেমনি বিষয় বৈচিত্র্যের সাথে সাথে স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণ এবং শিল্প-নৈপুণ্যের সার্থকতা তাঁকে নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্য জগতে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। গল্প-রচনার উন্মেষলগ্নে চন্দন আনোয়ারের সাহিত্যিক মন আবর্তিত হয়েছে এদেশের সমাজ-ইতিহাস ও তার পরিপার্শ্বকে ঘিরে। ফলে, স্বদেশের সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ সুস্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে তাঁর গল্পে।

চন্দন শুধু সাহিত্য-রচনার জন্য লেখালেখি করেন না– এ-লেখায় সক্রিয় আছে তাঁর সমাজশোধন, কল্যাণকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক শুদ্ধাচার এবং ব্যক্তিজাগরণের চিন্তা। এ-সম্পর্কে লেখক নিজেই বলেছেন– “ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমি কিছু করতে পারছি না, কিন্তু প্রতিবাদ তো জানিয়ে রাখতে পারি। কে জানে, কোনো একদিন হয়তো আমার কাঙ্ক্ষিত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।” আর এ কারণেই বলা সঙ্গত হবে যে– চন্দন তাঁর কথাসাহিত্যে বাদ-মতবাদ-তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেন না– সমাজসত্য-বাস্তবসত্য প্রতিষ্ঠাই তাঁর অন্বিষ্ট। আর একই কারণে তিনি আশাহীন সমাজ-সময়ের মধ্যে হয়ে ওঠেন আলোকপিয়াসী– ইতিবাচক কথাসাহিত্যিক। এদেশের সমাজ-জীবন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদের গভীরে প্রোথিত চন্দন আনোয়ারের শিল্পী-মানস। গল্পকার জানিয়েছেন–

একথা বলতে দ্বিধা নেই, আমার লেখকসত্তা বাঙালির একক অখণ্ড জাতীয়তার প্রতি নির্দ্বিধায় ও নিঃশর্তে আজীবন নতজানু। তাই আমি যখন লিখতে বসি, তখন বাংলা ভাষার বাঙালি লেখক হিসেবেই লিখতে বসি। …আমি যেখানে লেখক, সেখানে বাঙালি জাতিসত্তায় বিভক্তি নেই, সীমানা পিলার নেই, কাঁটা তারের বেড়া নেই, পাসপোর্ট ভিসা নেই। (চন্দন আনোয়ার: নির্বাচিত ৩০ : ২০১৭ : গ্রন্থের প্রসঙ্গত অংশে উল্লিখিত)

আর এসব কারণেই চন্দন আনোয়ারের ছোটগল্পের জমিন ধারণ করে আছে বাংলা-বাঙালির জাতিসত্তার নির্মেদ দলিল। তাঁর লেখার প্রাথমিক পর্ব থেকেই তিনি এদেশের বিভিন্ন জনপদ, সমাজ-জীবনের ও ঘটনা-প্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী। যে-সব ঘটনা-প্রবাহ তাঁকে আন্দোলিত করেছে– তা তিনি অবলীলায় তুলে ধরেছের কথসাহিত্যের শিল্পভাষ্যে। জীবন কিংবা জীবিকার প্রয়োজনে তিনি যেখানেই অবস্থান করেন না কেন তাঁর মনোবীণায় সব সময় বাঙালি জাতিসত্তা তথা স্বদেশ-ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে লালন করেন। সাহিত্য-সাধনার সূচনা থেকেই স্বদেশ-ভাবনা এবং স্বদেশের মূল্যবোধ তাঁকে সাহিত্য-রচনাতে প্রেরণা যুগিয়েছে। স্বদেশ-বিনির্মাণ এবং স্বদেশ অন্বেষা তাঁর শিল্পীমানসের প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি আপন অস্তিত্বে দেশ এবং দৈশিক ঐতিহ্য সম্পর্কে যে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন তা ছোটগল্পের সংক্ষিপ্ত কলেবরে উপস্থাপন করেছেন।

চন্দন আনোয়ারের জন্মের বত্রিশ বছর আগেই ভারতবর্ষীয় সমাজে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। লেখক খুব সচেতনভাবেই দেশভাগের ইতিহাস নয়– দেশভাগ পরবর্তী মানুষের জীবনে এর অভিঘাত তুলে এনেছেন শিল্পের জাল ফেলে। তাই চন্দন আনোয়ারের ছোটগল্পে, নতুন প্রজন্মের লেখক হিসেবে, দেশভাগ পরবর্তী সময়ের সামগ্রিকতা অনুবীক্ষণে দেখার নতুন ইতিহাসপাঠ। উল্লেখ্য– ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ তথা বাংলাভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাংলাভাগের মূলে ছিল সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অভিশাপ এবং ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকচক্র তাদের বিভাজনমূলক শাসনের প্রয়োজনে যে ‘দ্বি-জাতি তত্ত্বে’র বীজ বপন করে, তারই ফল হিসেবে বাংলাভাগের আত্মপ্রকাশ। যুক্তি-বুদ্ধিহীন আবেগসর্বস্ব বাংলাভাগ দু-অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের ভাগ্যে তীব্র আতঙ্ক ও অস্বস্তি বয়ে নিয়ে আসে। বাংলাভাগ ছিল “একই সাথে Triumph ও tragedy। সেই শোনিতলিপ্ত ঘটনাপরম্পরার সর্বাপেক্ষা বিয়োগান্তক পর্যায় ছিলো বাংলাদেশ ভূখণ্ডের পাকিস্তান অন্তর্ভুক্তি।” (রফিকউল্লাহ খান, ১৯৯৭ : ৪৩) বাঙালির জীবনে বাংলাভাগের প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী বেদনাবহেরই আখ্যান হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। ১৯৪৭ সালে বাংলাভাগে ভারতীয় কংগ্রেস এবং ভারতীয় মুসলিম লীগের যে ভূমিকা ছিল শওকত ওসমান তাকে “বানরের পিঠা ভাগ” (শওকত ওসমান, ২০০৭ : ২০৮) -এর সাথে তুলনা করেন। কেননা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির পাতা ফাঁদে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়ই ধরা দিয়ে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মাধ্যমে বাংলাভাগের গতিকে ত্বরান্বিত করেন। মূলত সম্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন মানসিকতা এবং রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তের শিকার ১৯৪৭ সালের বাংলাভাগ। বাংলাভাগের কথা বলতে গেলেই একটি কথা বারবার মনে আসে : “Difficult to forget, painful to remember”। আসলে ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট এক ঝটকায় বদলে গিয়েছিল ‘স্বদেশ’। ‘চৌদ্দ পুরুষ, যেথায় মানুষ’ সেই ভিটেমাটি, জন্মভূমি ছেড়ে অসংখ্য মানুষকে পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছে চেনা মাটি, চেনা আকাশ, অনুভবের বাতাস, স্মৃতিঘেরা শৈশব-কৈশোর-যৌবন, ঘরবাড়ি, চিরচেনা পরিবেশ-প্রতিবেশ ছেড়ে। কেউ পূর্বে, আবার কেউ পশ্চিমে– বড়ই আশ্চর্য, বড়ই বেদনার; মানুষের ‘জন্মভূমি’ এবং ‘স্বদেশভূমি’ মানচিত্রের কাঁটাছেঁড়ায় কীভাবে আলাদা হয়ে গেল আলাউদ্দীনের আশ্চর্য প্রদীপের ছোঁয়ায় (!) এ-সময় বাতাসে কান পাতলেই শোনা যেতো একটি চিৎকার : ‘আমরা কারা? বাস্তুহারা’। এ-সম্পর্কে সুনন্দা মল্লিকের মন্তব্যটি উদ্ধৃত করা যায়–

দেশভাগে মানুষের শুধু স্থানটুকু তো বদল হয়নি– বদল হয়ে গেছে সন্তান, হারিয়ে গেছে বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী, নিরুদ্দেশ ভাই-বোন; পেছনে থেকে গেছে ছেলেবেলার খেলার সঙ্গী, খেলার মাঠ, ছোট্ট স্কুল ঘর, চেনা-মুখ, জানা পরিপার্শ্ব– আরো কত কি! দ্বি-জাতি তত্ত্ব এবং সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভক্ত ভারত ও পাকিস্তানের অসংখ্য সহজ সাধারণ উদ্বাস্তু মানুষগুলি সেদিন কাটা দেশের যন্ত্রণায় কাতর হলেও দেশভাগের জটিল রাজনীতিটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেননি। (সুনন্দা মল্লিক, ২০১৬ : ৭৫)

সাতচল্লিশের নির্মম দেশভাগের নির্মম সাক্ষ্য আজও বহন করে চলেছে ভাষা ও সাহিত্য।  ঔপনিবেশিক-শাসন পরবর্তী বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি, উর্দু সাহিত্যে দেশবিভাগ এক অপরিহার্য উপাদান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণভাবে উপস্থাপিত। শিল্পী-সাহিত্যিকগণ তাঁদের মনের তাগিদেই হোক, কিংবা শিল্প সৃষ্টির প্রেরণায় হোক– তাঁরা দেশভাগকে কেন্দ্র করে অজস্র কবিতা গল্প-উপন্যাস-নাটক রচনা করেছেন। ফলে, শিল্পী সাহিত্যিকদের রচনায় দেশভাগের চিত্র নানামাত্রিক আয়োজনে উপস্থাপিত। সাদাত হোসেন মান্টো [১৯১২-১৯৫৫] ‘টোবা টেক সিং’, ‘খোল দো’, ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’; কৃষণ চন্দর [১৯১৪-১৯৭৭] ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’; খুশবন্ত সিং-এর [১৯১৫-২০১৪] ‘এ ট্রেন টু পাকিস্তান’ ভীষ্ম সাহীন হিন্দি-উর্দু ভাষায় আন্তর্জাতিকমানের ছোটগল্প রচনা করেছেন। তাছাড়া ছোটগল্পের বিষয় দেশভাগের চিত্র ফুটে উঠেছে জ্যোতির্ময়ী দেবীর [১৮৯৪-১৯৮৮] ‘সেই ছেলেটা’; মনোজ বসুর [জ. ১৯০১] ‘এপার ওপার’, ‘দিল্লী অনেক দূর’; অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের [১৯০৩-১৯৭৬] ‘দেশের মাটি’; সতীনাথ ভাদুড়ীর [১৯০৬-১৯৬৫] ‘গণনায়ক’; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের [১৯০৮-১৯৫৬] ‘ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই’, ‘পাষণ্ড’; প্রতিভা বসুর [১৯১৫-২০০৬] ‘দুকূলহারা’, ‘অপরাহ্ণে’; নরেন্দ্র মিত্রের [১৯১৬-১৯৭৫] ‘পালঙ্ক’; শওকত ওসমানের [১৯১৭-১৯৯৮] ‘চুহা-চরিত’, ‘আলিম মুয়াজ্জিন’, ‘আখেরী সংক্রান্ত’; নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের [১৯১৮-১৯৭০] ‘ইজ্জৎ’, ‘তিতির’, ‘বিদিশা’, ‘শ্বেত কমল’; সরদার জয়েনউদদীনের [১৯১৮-১৯৮৬] ‘ইতিহাসের ছেঁড়া পাতা’; সিকানদার আবু জাফরের [১৯১৯-১৯৭৫] ‘ঘর’; আবু রুশদের [১৯১৯-২০১০] ‘হাড়’; মির্জা আ. মু. আবদুল হাই-এর [১৯১৯-১৯৮৪] ‘তবু ভরিল না চিত্ত’; সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর [১৯২২-১৯৭১] ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’; আবু ইসহাকের [১৯২২-২০০৯] ‘বনমানুষ’, ‘হারেম’; সমরেশ বসুর [১৯২৪-১৯৮৮] ‘আদাব’, মহিন্দর সিং সরনার [জ. ১৯২৫] ‘লধ্বেওয়ালা বড়ৌচ’; আশরাফ সিদ্দিকীর [১৯২৭-২০২০] ‘পুকুর ওয়ালা বাড়ী’; হাসান হাফিজুর রহমানের [১৯৩২-১৯৮৩] ‘মানিকজোড়’; আলাউদ্দিন আল আজাদের [১৯৩২-২০০৯] ‘ছুরি’, ‘শিকড়’; দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় [১৯৩৩-১৯৭৯] ‘জটায়ু’; আবদুল গাফফার চৌধুরীর [জ. ১৯৩৪] ‘অনুধ্বনি’; প্রফুল্ল রায়ের [জ.১৯৩৪] ‘মাঝি’; অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের [১৯৩৪-২০১৯] ‘মানিক লালের জীবনচরিত’, ‘কাফের’; শওকত আলীর [১৯৩৬-২০১৮] ‘দিনগুজরান’; বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের [১৯৩৬-২০২০] ‘চিন্তামণি’; দেবেশ রায়ের [১৯৩৬-২০২০] ‘জননী ! জন্মভূমি!!’, ‘নাগিনীর উপমেয়’, ‘সাত হাটের হাটুরে’; হাসান আজিজুল হকের [জ.১৯৩৬] ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘পরবাসী’, ‘খাঁচা’, ‘একটি নির্জল কথা’ প্রভৃতি গল্পে। “ছোটগল্প সমকালের স্বপ্ন, সংকট, সংকল্প, সংঘাত ও সংগ্রামের প্রতি সংসক্ত আপন স্বভাবধর্মেই। ফলে বাংলা ছোটগল্পের শতধা মুকুরে দুই বাংলাতেই বিম্বিত হয়েছে দেশবিভাগের অনিবার্য অভিঘাত।” (সানজিদা আখতার, ২০০২ : ৭)। দেশবিভাগের প্রত্যক্ষদর্শী না হলেও সমাজ-পরিবেশ দেশভাগের যে অভিঘাত আজও বয়ে চলেছে তা যুগযন্ত্রণার লেখক হিসেবে চন্দন আনোয়ারে শিল্পিমানসে বাংলাভাগের অন্তর্যন্ত্রণা নিদারুণভাবে প্রভাব ফেলে। তাই, তাঁর রচিত কথাসাহিত্যের অন্তর্বুননে সহজেই উপস্থাপিত হয়েছে বাংলাভাগজনিত যুগযন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি হিসেবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাস্তবতা ও মনস্তত্ত্ব। উনিশশত সাতচল্লিশে বাংলাভাগজনিত রাজনৈতিক ঘুর্ণাবর্তের শিকার হয়ে যারা নিজদেশে পরবাসী কিংবা জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হন অথবা শত অত্যাচার-নিপীড়ন ও আতঙ্কের মধ্যেও সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে স্বভূমে অবস্থান করেছেন, তাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতার নিখুঁত সন্নিবেশ ঘটেছে চন্দনের কথাসাহিত্যে। এ-জাতীয় রচনার মধ্যে ‘অনিরুদ্ধ টান’ [ইচ্ছামৃত্যুর ইশতেহার], ‘ইচ্ছামৃত্যু’ [ইচ্ছামৃত্যুর ইশতেহার], ‘ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ’ [ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ] গল্পগুলো উল্লেখযোগ্য।

চন্দন আনোয়ারের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত গল্পের মধ্যে ‘ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ’ গল্পটি অন্যতম। এ-গল্পে তিনি পৌরাণিক অনুষঙ্গ যুক্ত করে বাংলাভাগ তথা দেশভাগের অভিঘাতকে উপস্থাপন করেছেন। গল্পালোচনার পূর্বে পৌরাণিক বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি। বিষ্ণু [নারায়ণ, কৃষ্ণ] ব্রহ্মাদি ত্রিমূর্তির একতম এবং ত্রিকালদর্শী [অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ]; তাঁর দুই স্ত্রী– লক্ষ্মী ও সরস্বতী। মহাভারত ও পুরাণে বিষ্ণু প্রজাপতি এবং শ্রেষ্ঠ দেবতা হিসেবে চিহ্নিত। প্রজাপতি হিসেবে তাঁর তিনটি [সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, সংহারকর্তা] রূপের কথা উল্লেখ আছে। পৃথিবীর কল্যাণের জন্য, দেবতাদের সাহায্যের জন্য বিষ্ণু যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করেন। পুরাণে এঁর দশ অবতারের কথা উল্লেখ আছে; যথা– মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুদ্ধ ও কল্কি। বিষ্ণুর বামন অবতার রূপে তাঁর তিনটি পা ছিল। সনাতন ধর্মানুসারে বিষ্ণু ত্রিপদে জগৎ ব্যাপিয়া আছেন। এ-গল্পের চরিত্র বিষ্ণু কামারের সাথে ঈশ্বর বিষ্ণুর সমান্তরাল ভাবনা গল্পটিকে অভিনবত্ব দান করেছে।

‘ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ’ গল্পে সমকালীন সমাজ-প্রেক্ষাপট প্রচ্ছন্ন আবরণ মাত্র; গল্পের সমাপ্তিতে নিজবাসভূমে দেশভাগের ফাঁদে পড়া একটি হিন্দু পরিবারের মর্মযন্ত্রণার তীব্রতম প্রকাশ ঘটেছে। দেশভাগের ফলে সংখ্যালঘু পরিবারে নেমে এসেছে অসীম নৈরাশ্য, হতাশা, নিরাপত্তাহীনতা, বেঁচে থাকার আর্তি। তাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যই মানসিক বৈকল্যের শিকার; ফলে দেশভাগের মধ্য দিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে বিষ্ণু কামারের পরিবার। তার পরিবারের যে রূপ তা যেন দেশভাগের পরিণামেরই প্রতীকরূপ। বিষ্ণু কামার তার জীবন-ইতিহাসে দেশভাগ, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরবর্তী স্বদেশের ঘটনাপ্রবাহের প্রত্যক্ষ সাক্ষী। পঁচাত্তর-এর মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের ঘটনার পরবর্তী ১৫ বছরের অধিককাল সামরিক, আধা-সামরিক বা ছদ্ম সামরিক শাসনে দেশ পরিচালিত হয়েছে। আদর্শগত দিক থেকে শাসকশক্তি সুচতুরভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। তাছাড়া পেশীশক্তি, ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতির অঙ্গীভূত করা হয়েছিল। ক্ষমতার সিংহাসনে দুনীর্তিবাজ-সম্পত্তিলুণ্ঠনকারীদের দৌরাত্ম্য। এসব কিছু বিষ্ণু কামারকে প্রবলভাবে নাড়া দেয় তার মনোজগতে। সে প্রত্যক্ষ করেছে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি মুক্তবুদ্ধি-মুক্তচিন্তা-মুক্তমনের কণ্ঠকে স্তব্ধ করেছে বার বার। নব্বই বছরের অভিজ্ঞ বিষ্ণু কামার নিজের সম্পর্কে বলে– “হামার তিন চোখ– এক চোখে পিছনে দেখি, এক চোখে সামনে দেখি, এক চোখে নিচে-উপরে দেখি।” (চন্দন আনোয়ার, ‘ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ’, ২০১৮ : ৩১) বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিষ্ণু কামার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ অর্থাৎ ত্রিকালদর্শী পুরুষ। তাই শহরে তথা দেশে কী ঘটেছে, কী ঘটছে এবং কী ঘটতে পারে তা বলতে  পারে। সে আঠার/উনিশ বছরের পঙ্গু আজাদের কাছে বলেছেÑ “শহরের বাতাস গরম, শরীরে কাঁটা দিয়া উইঠাছে, এ বাতাস শহরে ঘুরে বেড়াইতেছে।” (পূর্বোক্ত, ২৭) বিষ্ণু কামারের এই ভবিষ্যৎ বাণীর পরেই দেখা যায় শহরে দিনদুপুরে বোমা ফাটিয়ে স্বর্ণের দোকানে লুটপাটের দৃশ্য, চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য, অন্ধগায়ক হাকিম শাহ’র খুন হওয়ার চিত্র। গান-পাগল মানুষটির হত্যাকাণ্ডের বিষয়টিকে লেখক এভাবে বর্ণনা করেছেন–

হাকিম শাহর বুকের হৃৎপিণ্ড-ফুসফুস ছ্যাদা করে বেরিয়ে গেছে ৩/৪টা গুলি, মৃত্যুনিশ্চিত হলে অথবা প্রাণ থাকতেই কণ্ঠনালি টেনে ছিঁড়ে বের করে এনেছে দানবীয় ক্রোধ আর উন্মত্ততায়; একটি বিচ্ছিন্ন লতার মতো হাতের কাছে পড়ে আছে খণ্ড-বিখণ্ড বেহালাটা; আলোহীন অন্ধ ঘোলাটে দুটি চোখের পাতা খোলা। (পূর্বোক্ত, ৩৭)

আলোচ্য উদ্ধৃতাংশ থেকে বোঝা যায়– কণ্ঠনালি ছিঁড়ে নেওয়ার অর্থ বাকস্বাধীনতা-হরণ অথবা মুক্তকণ্ঠস্বরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া। হাকিম শাহ খুন হওয়ার পরে উন্নয়ন-সন্ত্রাসের কালো থাবা পড়ে বিষ্ণু কামারের জীবন-পরিবারে। দেশভাগের ফলে সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়া বিষ্ণু কামারের নিশ্চিহ্ন হওয়া ক্ষমতালোভী-ক্ষমতাভোগীদের জন্য খুবই জরুরি ছিল। এর পূর্বে এদেশে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ করে সংখ্যালঘুদের জীবন-সম্পত্তি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। উন্নয়ন সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভীতসন্ত্রস্ত করা হয়েছে সংখ্যালঘু পরিবারটিকে। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা প্রভাবশালীরা বিষ্ণু কামারের জিভ কিনে নিতে চায় অর্থাৎ এ যেন তার জানা-সত্যকে মুখ ফুটে বলার পথ-রুদ্ধ করার অভিনব প্রয়াস। জিভ অধিগ্রহণের বিনিময়ে তারা বিষ্ণু কামারকে বিভিন্ন সুবিধা দিতে চায়; এ সুবিধাগুলোর মধ্যে বিষ্ণু কামারের পৈতৃক ভিটার পাঁচকাঠা জমিতে ওয়ার্ড অফিস করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার ও জীর্ণ পোড়োবাড়ি ভেঙে টু-ইউনিটের একটি দোতলা বাড়ি নির্মাণ, মানসিক রোগী চিরকুমারী মেয়ের চিকিৎসা, প্যারালাইস ছেলেকে শহরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা পদে চাকরির ব্যবস্থা, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে অনুবাদ করে তাদের মুক্ত-স্বাধীন-গণমাধ্যমে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার প্রভৃতি। বলা নিষ্প্রয়োজন– বিষ্ণু কামারকে সপরিবারে তার পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার জন্য এ প্রচ্ছন্ন হুমকি। সম্পত্তি অধিকগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্নচাপে চাপ সৃষ্টি– সংখ্যালঘুত্বের ভয়ানক চাপ। ভূ-সন্ত্রাসীদের হুমকির ধরনেও আছে কূটকৌশলের ছোঁয়া–

সরকারের জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেবার পরে মালিকের কিছুই করার থাকে নেই, কিছুই বলার নেই, তার মতামত জানতেও চাওয়া হয়নি, শত শত বছরের পৈতৃক ভিটা ছেড়ে  দিতে হয়; ঠিক তেমনি বলতে পারেন, আমাদের বৃহত্তম স্বার্থে আপনার ৯০ বছর বয়সী জিভ আমরা অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছি, জমির মূল মালিক যেমন রাষ্ট্র/সরকার, এ ভূখণ্ডে আপনার জিভের মালিক আপনি কোনোদিনই ছিলেন না, তাই আমরা শুধু আপনাকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাতে এসেছি। (পূর্বোক্ত, ২৯)          

অভিজাত জমিদারের ক্ষয়িষ্ণু উত্তরাধিকারী বিষ্ণুকামার সংখ্যালঘু, ইতিহাসের স্বাক্ষী– তাদের পিছনে লেগে সম্পত্তি-হরণকারীরা; তাদের সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি তাদের কৌশলমাত্র। বিষ্ণু কামারের অভিজ্ঞতার মনোজগতের ব্যাপ্তি বিশাল– সেই অভিজ্ঞতা থেকে সে নির্বাচন করে আধুনিক সমাজ-ইতিহাস-চেতনার ধারক প্রগতিশীল ড. ফেরদৌসকে। বিষ্ণু কামার এবং তার স্ত্রী লক্ষ্মী আটচল্লিশ বছরের ড. ফেরদৌসের হাতে আগামী দিনের আদর্শিক চেতনা বহন করার জিভ তথা কণ্ঠস্বর বা বাকস্বাধীনতার কর্মভার ধরে রাখার দায়িত্ব অর্পণ করে। ক্ষমতার নরখাদকরা কেন বিষ্ণু কামারের জিভ কিনে নিতে চায় তার প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয় ড. ফেরদৌসের কাছে–

আমার চোখে আলো, আমি সব দেখি, আমি সব শুনি। নদীর পাড়ে শহরের অলিগলি-মোড়ে দাঁড়িয়ে আমি প্রাণখুলে সশব্দে হাসতে চাই। আমার নব্বই বছরের প্রৌঢ় জিভ পাথর নয়, নড়ে উঠতে মরিয়া। এ শহরের ইতিহাস আমি জানি, আমার দশ পুরুষের ইতিহাস আমি জানি; দেশভাগের ইতিহাসে যৌবনে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি; পাকিস্তানের দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীকে বিবস্ত্র করার মতো বাংলাকে উলঙ্গ-ন্যাংটা করে দিচ্ছিল, সেখানে আমি ছিলাম। শত্রুর অপবাদ নিয়ে চোখের রক্তজল ফেলে হিন্দুরা এদেশ ছেড়ে পালিয়েছে। মাতৃভূমি পৈতৃক ভিটা-বাড়ি-সম্পত্তিতে এরা নিজেরাই শত্রু! ওদের সম্পত্তি শত্রুর সম্পত্তি! ওদের ভিটে-সম্পত্তি দখলের মহোৎসবের প্রত্যক্ষদর্শী আমি। এ শহরের অর্ধেক সম্পত্তির দলিল আছে আমার কাছে। তাই ওরা আমার জিভ কেটে ফেলতে মরিয়া, দলিলগুলো পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলতে মরিয়া। মুক্তিযুদ্ধে যারা হিন্দুর সম্পত্তি-লুট করে ভিটে-বাড়ি দখলে নিয়েছে, তারাই আমার মৃত্যুর অপেক্ষায়, আমার জিভ কেটে নিয়ে আপাত নিরাপদ হতে একাট্টা।

আমি তোমাকে আবারও বলছি, আমার কোনো দিব্যজ্ঞান নেই, আমি স্বর্গ-মর্ত-পাতাল বিচরণ করি না, আমি বিচরণ করি আমার অতীত পদচিহ্নে, আমি বিচরণ করি আমার পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটায়।

হঠাৎ অন্ধকার কেঁপে ওঠে। ধাবমান পদশব্দ প্রবেশ করে অন্ধকারের ভিতরে। হাত-পা বাঁধা দানবীয় শক্তির জন্তুর মতো অন্ধকার কাঁপিয়ে অবোধ্য গর্জন করে ওঠে বিষ্ণু কামার। বিষ্ণু কামার আর মানুষের আকৃতিতে নেই; হঠাৎ আলোর ঝলকানি এল, বিষ্ণু কামার নিজের জিভ টেনে ছিঁড়ে ছুঁড়ে মারল ড. ফেরদৌসের হাতে। (পূর্বোক্ত, ৪১)

‘ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ’ গল্পে বিষ্ণু কামারের আতঙ্ক এবং ভীতির সমান্তরালে বিন্যস্ত হয়েছে বিপর্যস্ত একটি পরিবারের অক্ষম-অসহ অর্ন্তজ্বালা। দেশভাগজনিত সংখ্যালঘু একটি পরিবারের মর্মঘাতী যন্ত্রণার তীব্রতম প্রকাশ ঘটেছে। ‘জিভ’ মূলত মানুষের কণ্ঠ, বাক-স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তার প্রতীক; আলোচ্য গল্পে কণ্ঠরোধের বিষয় প্রধান হয়ে উঠেছে বিষ্ণু কামারের জীবন-পরিক্রমায়। বিষ্ণু কামারের জিভ যেন হয়ে ওঠে তিনকালের সংগ্রামী-মুক্তিপিয়াসী-স্বাধীনচেতা মানুষের বাক-স্বাধীনতার প্রতীক। বিষ্ণু কামার নিজের জিভ ছেঁড়ার মাধ্যমে ড. ফেরদৌসের হাতে সঁপে যায় তার প্রতিবাদের উত্তরাধিকার হিসেবে কিংবা দেশভাগজনিত সংখ্যালঘু মানুষের মর্মযন্ত্রণার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে।

দেশভাগের সমকালের এবং পরবর্তীকালের ঘটনাপঞ্জি কেবল আবেগ-উচ্ছ্বাস ছিল না; ছিল গণহত্যা ও ধ্বংসলীলার রক্তাক্ত উপাখ্যানের আলোকপঞ্জি। এ-ঘটনায় চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল মানবিকতাবোধ– বিপন্ন হয়েছিল মানুষের জীবন ও সম্পত্তি। লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজের বাস্তুভিটা ছেড়ে, নিজেদের শিকড় ছিন্ন করে, কাঁটাতারের বেড়া-ইমিগ্রেশনের খাতা পেরিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত-অপরিচিত এক নতুন দেশে। যাঁরা দেশভাগের অভিঘাতে জীবন-বাঁচিয়ে কোনো রকমে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছিল কিংবা নিজদেশেই থেকে গিয়েছিল– তাঁদের অভিজ্ঞতাও মোটেও সুখকর ছিল না। চৌদ্দ-পুরুষের ভিটেমাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া কিংবা নিজভূমে সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়া, মনুষ্যত্বের অকল্পনীয় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে তাঁরা চরম হতাশ ও বেদনাকাতর হয়ে পড়ে; যা তাদেরকে আজীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হয়েছে। উত্তর-প্রজন্মের লেখক হিসেবে দেশভাগের কোনো প্রত্যক্ষ-স্মৃতি লেখক চন্দন আনোয়ারের নেই; কিন্তু দেশভাগের অভিঘাত মাথায় নিয়ে যারা আজও সেই দেশভাগের জলছবিকে (?) জ্বলন্ত করে রেখেছেন– তাঁদের সাথে কিন্তু চন্দনের যোগ নিবিড়– তাঁদের যন্ত্রণা গভীর মমতায় চন্দনকেও চিন্তাবিষ্ট করে; আর চন্দন তখন হয়ে ওঠেন সেই প্রত্যক্ষদর্শীর একজন। গ্রাম-শহর, পাড়া-মহল্লায়, চায়ের আড্ডায়, চলতি-পথে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন-সমীকরণ-ইতিহাসের চোরাস্রোতে, আত্মপরিচয়ের শিকড়-সন্ধান, উত্তেজক সমষ্টিবোধ, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প চন্দনকেও পোড়ায়। সে পোড়া-ক্ষতের প্রলেপ হিসেবে চন্দন তুলে নেন কলমকে– যতক্ষণ পোড়ার-যন্ত্রণা উপশম না হয়– ততক্ষণ তাঁর কলম থামে না; কলমের ঠোঁট গেয়ে যায় দেশ-বিভাগের অভিঘাতের করুণ সুর। আর এরই ফলে চন্দনের গল্পে অনিবার্যভাবে উঠে এসেছে দেশভাগের অভিঘাতে বিপর্যস্ত মানবিক গ্লানি এবং জীবনপঞ্জি।


সহায়ক রচনাপঞ্জি (বর্ণানুক্রমিক):


চন্দন আনোয়ার (২০১৭)। ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ। ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা।
(২০১৭)। চন্দন আনোয়ার : নির্বাচিত ৩০।  একুশ শতক, কলকাতা।
রফিকউল্লাহ খান (১৯৯৭)। বাংলাদেশের উপন্যাস : বিষয় ও শিল্পরূপ। বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
শওকত ওসমান (২০০৭)। রাহনামা ১ : ছেলেবেলা ও কৈশোর কোলাহল, সময় প্রকাশন, ঢাকা।
সানজিদা আখতার (২০০২)। বাংলা ছোটগল্পে দেশবিভাগ। বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
সুনন্দা মল্লিক (২০১৬)। ‘দেশ থেকে দেশান্তর : ছিন্ন শিকড়ের সন্ধানে’। পার্টিশন : মানবাধিকার : গণতন্ত্র ও সাহিত্য সংখ্যা। [সম্পা. উত্তম পুরকাইত]  উজাগর প্রকাশন, হাওড়া, কলকাতা।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu