সানজিদা এনাম সুপ্রা
লেখনী পর্যালোচক
সানজিদা এনাম সুপ্রা

গল্প পাঠপ্রতিক্রিয়া: পিন্টু রহমানের 'কৃষ্ণকলি'

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

গল্প পাঠপ্রতিক্রিয়া: পিন্টু রহমানের 'কৃষ্ণকলি'

সানজিদা এনাম সুপ্রা


(পিন্টু রহমানের 'কৃষ্ণকলি' গল্পটি দর্পণে ২০১৮ সালের ৬ নভেম্বর প্রকাশিত হয়)

মানুষের পাতে বিয়োগাত্মক গাঁথা হিসেবে বারংবার সাজিয়ে গেলানো মুঘল শাহজাদা সেলিম ও আনারকলির প্রণয়-পরিণতি ‘কৃষ্ণকলি’ গল্পটির মূল বিষয়বস্তু। মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারি আকবরপুত্র সেলিম আর তাঁরই পিতার উপপত্নী নাদিরা বেগম ওরফে আনারকলি এর কৃষ্ণলীলার রঙে গল্পটির মূল পট রাঙানো হয়েছে।

আনারদানার মত রক্তিমরঙা বরণের আর ফুলের কলির মত নূতন যৌবনা আনারকলি’র পরিণতি উল্টো যেন তিমিরমাখা কালোই বটে। তাই হয়তো গল্পের নাম হয়েছে ‘কৃষ্ণকলি’। যুক্তিযুক্ত কারণেই তাই নামকরণ সার্থক মনে হয়েছে।

রাভি নদীর নির্জনতায় আবেগঘন প্রেম আর খাজানসারার উদ্বিগ্নতার আবেশে যে টানটান উত্তেজনা দিয়ে গল্পের শুরু, মাঝপথে প্রিকুয়েল ধারাভাষ্যে আনারকলি-সেলিমের পরিচয় মুহূর্তের বয়ানে এসে লেখকের লেখনীর প্রতি প্রত্যাশা কিছুটা ভাটা পড়ে যায়। যুগ যুগ ধরে আনারকলি নির্ভর গল্পে তার রূপমাধুর্যের একই বয়ানে একই বুনটের শব্দে যে একঘেয়ে বিবরণ শুনে এসেছি, তার আক্ষরিক কপি-পেস্ট যেন। ভাটা পড়াটা তাই জায়েজই বলতে হয়।

তবে এর পরপরই যেন লেখক আবার কলমের মোড় নিজের সৌন্দর্যে ফিরিয়ে আনেন। তিনি মেপে বুঝে গল্পে প্রেমরস এনেছেন, পাঠককে অনিশ্চয়তার গরল গিলিয়েছেন, চাবুকাঘাতে আনারকলির সাথে সাথে পাঠকমনকেও রক্তাক্ত করেছেন, তারপর গল্পের নায়ককেই পরিত্রাণকর্তা হিসেবে দাঁড় করিয়ে আশার দৈব মরীচিকা সাজিয়েছেন। বুনন প্রকৌশলে যেমন ধাপে ধাপে মেপে এগিয়েছেন, গল্পের ভাষাশৈলী আবার যেন ভেবেচিন্তেই সরল রেখেছেন। বেশ ভাল এবং সাদামাটা ভাষা গল্পটাকে আরও আকর্ষনীয় করেছে। অনেক লেখক জটিল গল্প ফেঁদে তারপর সরলীকরণের পেছনে দৌড়ান। এখানে লেখক খুব সরল গল্প টেনে এনে রোম্যান্স আর পারিবারিক দ্বন্দ্বের সরল মারপ্যাচে ভালো ক্লাইম্যাক্স বুনেছেন।

মুঘল শাহেনশাহ আকবর আর শাহজাদা সেলিমের অন্তর্দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান এক প্রণয়গাথার পরিণতি কি নিয়তি আশ্রিত কোনো ধাঁধা নাকি শাহেনশাহের বিচারে অধরা হৃদয়ক্ষত হয়ে রয়ে যাবে চিরকাল– জানা এ প্রশ্নের উত্তর আবারও নতুন করে খুঁজতে পাঠকমনকে ব্যস্ত রেখে, আবারও রাভি নদীর মতোই প্রেমরস বইতে দেন লেখক। জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে উজানমুখী পানসিতে সেলিম-আনারকলির প্রেমেও জোয়ার আসে বাঁধাবিপত্তির পরোয়া ভুলে। পরক্ষণে উড়ন্ত মনে টান ফেলে গল্পে আগমন ঘটে আকবরের সৈন্য-সামন্তের। এখানে আরও উল্লেখ্য প্রচলিত ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হয়ে অতিরিক্ত নাটকীয়তা যোগের মোহ ত্যাগ করে বেশ সরল পথে গল্পকে হাঁটিয়ে নিয়ে গেছেন লেখক। তবে তাতে গল্পের জমে ওঠা থেমে থাকেনি– এখানে কৌশলী আনুপূর্ব গল্প চয়নের সাফল্য রয়েছে।

তাছাড়া, আব্দুল হালিম শারা’র যুগ থেকে শুরু করে আজ অবধি পাঠকমন যোগানো সেলিম-আনারকলি পট আবারও বেছে নেয়ার ব্যাপারটা নিয়ে বলতে গেলে এটুকু বলতেই হয়। এক দেড় পাতায় এত স্বল্প আখ্যান আর বয়ানে গল্প জমানো বেশ কঠিন। তাই লেখক যখন পাঠকের খুব বেশি জানাশোনা পটে স্কেচ করতে বসেন, অল্প আঁচড়ে আবেগঘন মহল তৈরি সহজসাধ্য হয়ে ওঠে।

সবমিলিয়ে ইতিহাস আশ্রিত গল্প হিসেবে এবং অল্প সময়ের পাঠ হিসেবে লেখকের লেখনী পাঠকপ্রিয়তা লাভের জন্য যথেষ্ট। লেখকের সরল আলাপী লেখনী আর তৃতীয়পক্ষ হিসেবে ধারাভাষ্যের মতন করে সাবলীল বিবরণ আমাকে পাঠক হিসেবে বারবার জানা একটা গল্প পড়তে কয়েক মিনিটের জন্য আটকে রাখতে পেরেছে।

"তা কিয়ামাত শুকর গুইয়াম কারদিগারি কিশ রা
আহ, গার মান বাজ বিনাম রু ইয়ার-ই-খুশ রা "

(“আমি রোজ কিয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করবো।
আহ, আমি কি একবার আমার প্রিয়তমার মুখ দেখতে পাবো?”)

লাহোরে আনারকলির সমাধিসৌধে খোদিত সেলিমের এ আকুতি-আবেদন আজও মুছতে পারেনি যুগ-কালের ফের। হাতে অল্প কিছু সময় থাকলে খুব ছোটখাট একটা ইতিহাস রাইড চড়ে মধ্যযুগীয় এই লাইলী-মজনু গাঁথায় ডুব দিয়ে ঘুরে আসতে আপনারাও পড়তে পারেন পিন্টু রহমানের ‘কৃষ্ণকলি’ গল্পটি। একেবারে হতাশ হবেন না আশা করছি।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu