মেহেদী ধ্রুব
কথাসাহিত্যিক। প্রকাশিত গ্রন্থ: মেঘ ও মানুষের গল্প।
মেহেদী ধ্রুব

উপন্যাস পর্যালোচনা: মাওলা প্রিন্সের ‘বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি’

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

উপন্যাস পর্যালোচনা: মাওলা প্রিন্সের ‘বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি’

মেহেদী ধ্রুব


শিল্প-সাহিত্যের বিষয় নির্বাচনে শিল্পী জীবনাভিজ্ঞতা ও কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করেন, তবে সেই কল্পনা কোনো ওহি নাজিল হওয়ার মতো ব্যাপার নয় কিংবা আসমান থেকে আসে না, বরং সেই কল্পনাও বাস্তব জীবনের আরেক চিত্র; কারণ, মানুষের কল্পনা সৃষ্টি হয় বাস্তব জগতের সঙ্গে তুলনা কিংবা প্রতিতুলনা করেই। ফলে প্রাচীন যুগ থেকে কালে কালে শিল্পীরা সাহিত্যের বিষয় হিসেবে যেসব বিষয়-আশয় তুলে ধরেছেন সেসব বিষয়ে নতুনত্ব আনা যায় না খুব একটা। কারণ, মোটাদাগে বিষয় হিসেবে আসে ব্যক্তির অন্তর্গত টানাপোড়েন, জটিল-কুটিল-সরল মনস্তত্ত্ব, পারিবারিক সংকট-সম্ভাবনা, সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাত, ইতিহাসের বাঁকবদল, আন্দোলন-সংগ্রাম, দৈশিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক গ্যাঁড়াকল, আনন্দ-বেদনা, বিরহ-মিলন-যৌনতা, খুন-ধর্ষণ, অন্যায়-অত্যাচার-অপরাধ, প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, হিংসা-বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, শোষণ-নির্যাতন, রোগ-শোক-মহামারি ইত্যাদি। প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান যুগের শিল্প-সাহিত্যের বিষয় লক্ষ্ করলে দেখা যাবে এগুলোর বাহিরে খুব বেশি বিষয় নেই। বন্তুত মানব জীবন এসব বিষয়ের মধ্যেই আবর্তিত হয়। তারপরও যুগে যুগে শিল্প-সাহিত্যের বদল ঘটে, সেসব বদল মূলত শৈলীর দিকে থেকে। অর্থাৎ, একজন শিল্পী কতটা নতুন করে কতটা অভিনব করে চেনা কথাগুলো নতুন করে বলতে পারেন সেটাই আসল ব্যাপার। ব্যাপারটা একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। প্রাচীন কালে স্থাপনা নির্মাণ করা হত ইট দিয়ে, বর্তমান সময়েও স্থাপনা নির্মিত হয় ইট দিয়ে, কিন্তু প্রাচীন কালের নকশা কিংবা ডিজাইন এখন আর চলে না এবং বর্তমান সময়ের নকশা বা ডিজাইনও ভবিষ্যতে চলবে না, এটাই নিয়ম, এটাই রীতি। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, বিষয় এক হলেও কে কতটা নতুন করে বলতে পেরেছেন সেটাই বড় কথা। বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রেও এই থিউরি প্রযোজ্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কিংবা মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্করদের যুগ আর নেই। এঁদের অভিজ্ঞতায় ভর করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিংবা শহীদুল জহিররা নতুন নতুন পথ সৃষ্টি করেছেন। এই অভিজ্ঞতায় দাঁড়িয়ে বর্তমান সময়ের ঔপন্যাসিকরা নিজ নিজ পথ খুঁজে চলেছেন, নতুন নতুন পথ নির্মাণ করার চেষ্টা করছেন, কেউ পারছেন, কেউ পারছেন না। তবে এই কথা এখানে স্বীকার করা যায় যে ২০২২ সালে প্রকাশিত মাওলা প্রিন্সের প্রথম উপন্যাস ‘বেঁচে থাকাই যুদ্ধ এবং শান্তি’-তে নতুন পথ নির্মাণের প্রচেষ্টা প্রবল মাত্রায় ধরা পড়েছে। মহামারি করোনাকে কেন্দ্রে রেখে কিংবা বর্তমানে রেখে উপন্যাসটি লেখা হলেও ঔপন্যাসিকের বৌদ্ধিক ও সামগ্রিক চেতনায় ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, ভূগোল, ভাষা, ভূমি, প্রেম-প্রণয়, যৌনতা, স্বপ্ন, ধাঁধা, রাশিফল, প্রকৃতি, সভ্যতা, শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, চিকিৎসা, দুর্যোগ-দুর্নীতি-মহামারি, নাটক-সিনেমা-সাহিত্য, মিডিয়া, মুক্তিযুদ্ধ ধরা পড়েছে। ঔপন্যাসিক অভিজ্ঞ পরিব্রাজকের মতো ভ্রমণ করেছেন হাজার বছরের বাংলার আলপথে; পায়ের ছাপ ফেলেছেন আবহমান বাঙালির জয়-পরাজয়, অর্জন ও বিসর্জনের সৌধে; একটু একটু করে ছুঁয়ে গেছেন বাঙালির অস্তিত্বের মিনারগুলোকে।

উপন্যাসের কথক কে এটা প্রথমে বোঝা না গেলেও আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের প্রফেসরের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বর্ণিত হয়েছে করোনাকালীন আবন্ধ জীবনের সংকট, জীবনাভিজ্ঞতা, স্মৃতির কোলাজ, অতিমারি করোনার দাপটে ঘরবন্দি মানুষের উৎকণ্ঠা, স্মৃতি-বিস্মৃতি, সামসময়িক চাকরি বা কোটা আন্দোলন প্রসঙ্গ, মধ্যবিত্ত জীবনের খুটিনাটি, শিক্ষক ও শিক্ষা দর্শন, নম্বর রাজনীতি, শিক্ষা পদ্ধতি, ব্যক্তিপ্রেম, ভার্সিটি লাইফ, বিশ্বরাজনীতি, করোনার কেনাকাটায় দুর্নীতি, কথকের বাবার অফিস, বিশ্বসাহিত্যের কথকতা, লাতিন আমেরিকার ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, রুশ ঔপন্যাসিক ম্যাক্সিম গোর্কি, বাংলা সাহিত্যের বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শওকত আলী ইত্যাদি লেখকের প্রসঙ্গ, সাহিত্যের আলোচনা; আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ নিয়ে লেখা প্রবন্ধ, ময়মনসিংহ শহর, কুষ্টিয়া শহর, রাজশাহী শহর, লালমনিরহাট জেলা, ত্রিশাল, সিনেমা দর্শন, এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, ক্রিকেট অভিজ্ঞতা, রেমিট্যান্স, ভৌগোলিক অবস্থা, তিস্তা নদী, দিদি, মা, আব্বু, নানি, নানু, স্কুল জীবন, স্ত্রীর জবানিতে স্ত্রীর শৈশব, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন, প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য, ছিটমহল, জ্যোতিষবিদ্যা, মহাভারত, হিন্দু পুরাণ, মুসলিম পুরাণ, ফেসবুক-টুইটার, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘গাভী বৃত্তান্ত’ ও ‘শ্রীমতি ক্যাফে’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, প্রাচীন বাংলার জনপদের বিবরণ, প্রাচীন রাজাদের আমল, পুরাকীর্তি: পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, সোমপুর বিহার ইত্যাদি। উল্লিখিত কন্টেন্ট থেকেই বোঝা যায় এটি মহাকাব্যিক কলেবরে লিখিত হয়েছে, যার পরতে পরতে স্থান পেয়েছে ঔপন্যাসিকের শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা ও গবেষণা লব্ধ জ্ঞান, মূল্যবোধ ও দর্শন। উপন্যাসটি ঘরবন্দি সময়ে লেখা বলে সংসার জীবনের খুটিনাটি স্থান পেয়েছে নানা মাত্রিকতায়। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ২৮৮ পৃষ্ঠার বিশাল কলেবরের উপন্যাসে কথকের নাম বা অন্য কোনো চরিত্রের নাম পাওয়া যায় না। টানা গদ্যে লেখা উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে দীর্ঘ বাক্য, কথকের অবস্থান ও ঘটনা অনুযায়ী প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ। এই টানা গদ্য পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে পড়বে শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাস কিংবা ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পের কথা, কিংবা সামসময়িক মামুন হুসাইনের টানা গদ্যের কথাও মনে পড়তে পারে। বস্তুত টানা গদ্যের প্রবণতা বর্তমান সময়ের অনেকেরই মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু মাওলা প্রিন্স উত্তম পুরুষের মারপ্যাঁচে, ক্রমাগত পয়েন্ট অব ভিউ পরিবর্তন করে স্মৃতি-বিস্মৃতির আড়ালে দীর্ঘ বাক্যের যে গদ্য খাড়া করেছেন সেটি একান্ত তাঁর। এই গদ্যের টান আছে, কিন্তু তা জমাটবদ্ধ কাহিনিময় নয়, ফলে জনপ্রিয় ধারার পাঠক হাঁপিয়ে যেতে পারেন, তবে এই উপন্যাস যে জনপ্রিয় ধারার পাঠকের জন্য নয় তা ঔপন্যাসিক নিজেও হয়ত জানেন।

এখানে আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করার মতো, উপন্যাসটি কথকের জবানিতে অর্থাৎ উত্তম পুরুষে লেখা হলেও সেটা তথাকথিত চমকপ্রদ ঘটনা বর্ণিত হয়নি, সেটা কখনও কখনও ড্রামাটিক মনোলগের মতো শোনায়, যেখানে ক্রিয়াপদের মুহুর্মুহু পরিবর্তনে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত একাকার হয়ে যায়, অর্থাৎ চেতনা প্রবাহরীতি প্রবলভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো ২৮৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসে এই রীতি জরুরি ছিল কি না? কেন ঔপন্যাসিক সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ নিয়ে নাম পুরুষে বর্ণনা করেননি? এক্ষেত্রে সময়টি বুঝতে হবে, বস্তুত করোনার সময় মানুষ যখন ঘরবন্দি হয়ে আছে যখন বেঁচে থাকার নিশ্চিয়তা নেই, যখন মিডিয়াতে ভয়ংকর সব খবর প্রকাশিত হয় তখন প্রতিটি মানুষের মনে দারুণ উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা ও মৃত্যু-ভয় কড়া নাড়ে, অসংখ্য স্মৃতি-বিস্মৃতি নাড়া দিয়ে যায়, ফলে মানুষের মনের কোনায় জমে থাকা জলে বুদবুদের মতো টগবগ করতে থাকে জীবনের নানা স্মৃতি-বিস্মৃতি-আবেগ-অনুভূতি। সময়ান্তরে মানুষের মনে বাড়তে থাকে মৃত্যু ভয় ও স্মৃতিকাতরতা, চারদিকে প্রিয়জন হারানোর সংবাদ, পরিবারের বয়স্কদের হারানোর ভয়, সব মিলিয়ে অনিশ্চিত এক ভবিষ্যতের হাতছানি। ফলে ঘরবন্দি মানুষের অন্তরাত্মার যে কথাগুলো বাহিরে আসতে পারেনি, যে কথাগুলো মগজের কোণায় ধাক্কা দিয়ে গোপনে মিলিয়ে যায়, যে কথা বা স্মৃতিগুলো প্রিয়জনকে মনে করিয়ে দেয়, কাছের মানুষকে মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে পরক্ষণেই মনের মধ্যে যে আশঙ্কা ঘাই মারে সেই কথাগুলো ঔপন্যাসিক লিখে রেখেছেন। অস্থির ও উৎকণ্ঠিত মানুষের স্মৃতি-বিস্মৃতি ও আবেগের জায়গাগুলো যে এখানে ধারাবাহিকভাবে আসবে না সেটাই স্বাভাবিক, সেখানে যে চেতনা প্রবাহিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। কথক যাবিত জীবনে থেকে সংসার জীবনে থেকে যেহেতু ভেবেছেন, যেহেতু বাঙালি মধ্যবিত্তের স্মৃতিচারণ করেছেন, আশি-নব্বই দশকের আর্থ-সামাজিক-রাজনীতিক ঘটনাপ্রবাহ স্মরণ করেছেন, প্রতিনিয়ত নস্টালজিক হয়েছেন, যেহেতু স্ত্রী ও ছেলেদের নিয়ে দারুণ উৎকণ্ঠায় দিনানিপাত করেছেন সেহেতু তাদের পয়েন্ট অব ভিউ কিংবা তাদের স্মৃতি-বিস্মৃতি, আবেগ-অনুভূতি ও কর্মকাণ্ড আসাও স্বাভাবিক। ফলে পাঠক পয়েন্ট অব ভিউ-এর ভ্যারিয়েশন পায়। তাই বলা যায় পয়েন্ট অব ভিউ পরিবর্তন হয়ে যাওয়া কিংবা ড্রামাটিক মনোলগ কিংবা অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কথার মিশ্রণ তথা চেতনাপ্রবাহ রীতি যুক্তিযুক্ত ও লাগসই হয়েছে। কথকের সমগ্রজীবনের ঘটনা ও সমগ্র জানা ইতিহাস, জ্ঞান ও দর্শন স্থান পেয়েছে বলে সেখানে জীবনানন্দ দাশের কবিতার মতো সুদূরের ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতিষ বিজ্ঞান, বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, ভাষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শিক্ষা, প্রকৃতি কোনোকিছুই বাদ যায়নি।

জনপ্রিয় ধারার পাঠক এই উপন্যাস পাঠ করতে গেলে হোচট খাবেন; কারণ, প্রচলিত ধারার উপন্যাসে যেখানে নির্দিষ্ট বা নিটোল কাহিনি বা আখ্যান থাকে, উত্থান-পতন থাকে, টুইস্ট থাকে, পাঠককে ধরে রাখার কসরত থাকে এই উপন্যাসে তা নেই। এখানে ঔপন্যাসিক সতত নিরীক্ষাপ্রবণ। এটি বিরাট এক রিস্কি কারবার, ঔপন্যাসিক আদৌ জানেন না এটি পাঠক গ্রহণ করবে কি না, তবে সচেতন পাঠক কিংবা অনুসন্ধানী পাঠক ও গবেষক যে এই উপন্যাসটিকে আতশি কাঁচের নিচে রাখবেন, পোস্টমর্টেম করবেন কিংবা করাতকলের নিচের রাখবেন তাতে সন্দেহ নেই। তাই আমাদের বিশ্বাস বাংলা সাহিত্যের ধারায় এই উপন্যাস গুরুত্বপূর্ণ কন্টেন্ট হিসেবে জায়গা করে নেবে।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu