মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে ফরিদা বেগমের। গত দু’দিনে তিনজন নিয়েছে সবিতাকে। তিনজনই একই অভিযোগ করেছে। আজ মেয়েটা এলে একচোট নিতে হবে। ঘোমটা টানতে চাইলে নাচতে নামিস কেন?
তিনজনেরই একই অভিযোগ। মেয়েটা অন্য সবদিক থেকেই ভালো, কিন্তু কিছুতেই চুমো খাবে না। আশ্চর্য! কাপড় খুলবে, শোবে অথচ চুমু খাবে না। ফরিদা প্রথমে ভেবেছিল হয়তো তসলিমের মুখে দূর্গন্ধ ছিল তাই সবিতা চুমু খেতে রাজি হয়নি। এমনটা অনেকেরই হয়। কিন্তু সমীর আর মামুনেরও একই অভিযোগ। সবারতো আর মুখে দূর্গন্ধ থাকে না। আসুক আজ সবিতা, ওর একদিন কী আমার একদিন!
সবিতা ফরিদা বেগমের আশ্রয়ে এসেছে তিনদিন। এই লাইনে বেশি দিন হয়নি। আগে ছিল উত্তরায় সঞ্চিতা আলমের আশ্রয়ে। সেখানে ওকে টাকা পয়সায় ঠকানো হতো, দু’একবার গায়ে হাতও তোলা হয়েছে। সবিতা তাই ওখান থেকে ধানমন্ডির এই ঠিকানাকে নতুন আশ্রয় করেছে। বাড়তি কোনো আবদার নেই, বকশিসও চায় না আলাদা করে। যদিও এখনো জড়তা পুরোপুরি কাটেনি, তবুও চেষ্টা করে ক্লায়েন্টদের কো-অপারেট করতে, কেবল ওই একটা বিষয় ছাড়া। কাউকেই চুমু খাবে না।
সুবীরের সামান্য চাকরিতে সংসারটা টেনেটুনে চলে যাচ্ছিল। সবিতা ঘরকন্না ছাড়া তেমন কিছুই শিখেনি। সারাদিন তাতেই মনোযোগ। বিকেল হলে ব্র্যাক স্কুল থেকে কবিতা আর অসিতের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা, সন্ধ্যায় অপেক্ষা সুবীরের ফিরে আসার। সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেলে সুবীরের এক্সিডেন্টের পর। বাসায় ফেরার পথে বাস থেকে নামতে গিয়ে পেছন থেকে আসা আরেক বাসের নিচে পড়ে গিয়ে শুধু পা দুটোই হারায় নি, মেরুদন্ডে আঘাত পেয়ে কোমরের নিচ থেকে অবশও হয়ে গেছে। যে মার্কেটে চাকরি করতো সেখান থেকে নগদ বিশ হাজার টাকা আর একটা হুইল চেয়ার দিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা করাতে গিয়ে এদিক সেদিক থেকে ঋণও হয়েছে বিস্তর।
তিনমাস এখানে সেখানে ঘুরে একটা চাকরিও জোটাতে পারেনি, গার্মেন্টেসেও না। জমানো সবকিছুই যখন শেষ তখন অনন্যোপায় হয়েই এই লাইনে নামতে হয়েছে। সুবীর আর ছেলেমেয়েরা জানে সবিতা গার্মেন্টেসে কাজ করে। কখনো দিনের শিফট, কখনো রাতের। গোপনে অশ্রু ঝরালেও চারটে মুখে দুটো ডাল ভাত জোগানোর সংগ্রামে সবিতা অদৃষ্টকে মেনে নিয়েছে।
যখন বাসায় ফিরে আসে সুবীরের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হয়। শুধু অন্ধকারেই সুবীরের ঠোঁটে চুমু খায়। ওর বুকে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। সুবীর সবিতার মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয় আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
আজ বিকেলে সবিতা আসতেই ফরিদা বেগম সবটুকু ক্ষোভ উগরে দেন।
এই মাগী, তোর সব কাস্টমারের মুখেই কি দূর্গন্ধ নাকি?
কেন আপা?
বুঝিস না? ন্যাকামি করিস? তোর কাস্টমারদের কাউকেই চুমু খাস না কেন তাইলে? সবাই তো নালিশ করছে। নাচতেই যদি নামবি ঘোমটা কেন দিচ্ছিস?
আপা, ওই একটা বিষয় ছাড়া আর কোনো বিষয়ে কেউ কিন্তু নালিশ করতে পারবে না।
ওই একটা বিষয় মানে কী? এটাই তো বড় বিষয়। কাপড় খুলবি, শুবি, কিন্তু চুমো খাবি না এটা কেমন কথা! তোর সমস্যা কী?
আপা, দরকার হলে আমাকে সুলতানা আর পাপিয়ার চেয়ে টাকা কম দেবেন। কাস্টমারদের আগে বলে নেবেন। কিন্তু আমাকে এটা করতে বলবেন না। আপনার দোহাই লাগে।
তাইলে তুই নিজের পথ দেখ। আমাকে তো কাস্টমারদের ইচ্ছা অনিচ্ছা দেখতে হবে, তাই না?
সবিতার অসহায় লাগে। এই কাজটা চলে গেলে তো না খেয়ে মরতে হবে। সে ফরিদা বেগমের পায়ের কাছে বসে পড়ে।
আপা, আপনিতো আমার জীবনের সব কথাই জানেন। কেন এই কাজে নেমেছি তাও জানেন। পেটের দায়ে যাই করি না কেন, কবিতার বাবার জন্য আমার ভালোবাসায় তো কোনো ফাঁক নেই। মানুষটার চোখের দিকে তাকাতে পারি না। কষ্ট হয়, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। কিন্তু কী করবো! অন্য কোনো উপায় তো পেলাম না। আপনার এখানে যারা আসে টাকার জন্য তাদের কাছে শরীর বিক্রি করি। ভালোবাসা তো বিক্রি করি না। আর তারাও ভালোবাসা কিনতে আসে না। এই চুমুটাই আমার ভালোবাসার প্রকাশ। সুবীর এখন আর কিছুই পারে না। শুধু চুমু খেতে পারে। তাই এইটুকু তার জন্য তুলে রাখি। এইটুকু শুধু সুবীরের। আর কাউকে দিতে পারবো না আপা। যদি ওরা অন্য কিছু চায়, যেভাবে চায় সেভাবেই হবে। শুধু বলবেন, চুমুটা পারবো না। আমাকে শুধু এইটুকু স্বাধীনতা দিন। মানুষটার জন্য বড় কষ্ট হয় আপা, বড় বেশি মায়া হয়।
সবিতার চোখ থেকে ফোঁটায় ফোটায় জল গড়িয়ে পড়ে। এই প্রথম কোনো প্রমোদবালিকার জন্য ফরিদা বেগমের অপত্য স্নেহ জেগে উঠে।