দীলতাজ রহমান
জন্ম ১৯৬১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ জেলার চন্দ্রদিঘলয়া গ্রামে। কবিতা দিয়ে লেখালিখি শুরু করলেও পাঠকদের কাছে গল্প দিয়েই বেশি সমাদৃত। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: তারান্নুম (গল্পগ্রন্থ), গল্পসমগ্র-১
দীলতাজ রহমান

স্পিড ব্রেকার

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ঘুম থেকে বেলা করে উঠলো নার্জিস। অভ্যাস বলে তার নির্দিষ্ট কিছু নেই। তবে আজ ও গোসলটা সেরে এসেছে। তারপর মুখে একটু হালকা প্রসাধনী লাগাতেই নিজের কাছে নিজেকে ওর কেমন উজ্জ্বল মনে হলো। এরকম তার প্রায়ই হয়। আর তাতেই ও বিভোর হয়ে থাকে সারাদিন। এমনকি সে বিভোরতা অনেকদিন ধরেও রাখতে পারে। গোলাপি জর্জেট শাড়ি। কালো ব্লাউজ। চোখে সুরমা রঙের ধূসর কাজল। টিপ ওর পছন্দ নয়। কিশোরী বেলাতেও ছিলো না। যারা কপালে টিপ পরে খোঁপায় ফুল গোঁজে তাদেরকে কেমন ন্যাকা ন্যাকা মনে হয় ওর কাছে। নার্জিসের গায়ের রং কালো। ওকে যারা চেনে তারা অবশ্য শ্যামলা বলতে বাধ্য হয়। যে যেভাবে দেখে আর কী!

ড্রেসিং টেবিলটির সামনে থেকে আজ ও নড়ছে না। এভাবে নিজেকে দেখে কেউ? আশ্চর্য! নিজের বোকামিতে নার্জিস নিজেই হেসে ফেলে, তবু তন্ময়তা ছাড়ে না। শেষে আঁচল ঠিক করতে করতে ড্রয়িং রুমে ঢুকে       সুমন্তকে ফোন করলো, ‘সুমন্ত আসবি?’

– কোথায়? আচমকা ডাক শুনে চমকে উত্তর দেয় সুমন্ত।

– আয় না একটু ঘুরে বেড়াই!

– এই ঠাঠা রোদের ভেতর?

– রোদ দেখলি কোথায়? তা হলেও হোক! আমরা কি আর রোদে ঘুরবো! কোথাও গিয়ে বসবো।

– তুই অফিসে যাবি না?

– এ বেলা না গেলেও চলবে। বিকেলে যাবো রাত অব্দি কাজ করবো।

– এ হাল তোর দৈনিকের?

– আমার কাজটি আর প্রতিদিনের নয়!

– বুঝেছি। দেখি, ভাইয়ার আসার সময় হয়ে গেছে। ও এসে গেলে আমি তোকে ফোন করছি, তৈরি হয়ে থাক। বলছিস যখন না এসে কী করি!

সুমন্তর বড় ভাই অনন্ত কবির। ইলেক্ট্রনিক্সের এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ওদের বাবার। আর সেই সূত্রে দুভাইয়ের সমান মালিকানা। কিন্তু সুমন্ত বাবা ও ভাইয়ের অনুগত পুত্র ও ভাই ছাড়া আর কোনো প্রভাব খাটাতে যায় না। এ নিস্পৃহ ভাবটি হঠাৎ এসে ভর করেছে। সবকিছুতেই সে এখন পিছুটানহীন।

নার্জিসের মামাতো-ফুফাতো-খালাতো মিলে প্রায় দুডজন ভাইবোন। তারা সবাই বন্ধুর মতো এবং তাদেরও সবার বন্ধুরা মিলে ওরা অন্তরঙ্গতায় বিরাট একজোট। সুমন্ত সৌমিকের বন্ধু। একদিন ওকে সঙ্গে করে এনে সৌমিক ওদের সবার ভেতর ছেড়ে দিয়েছিলো। ও সৌমিকের অনেক দিনের বন্ধু একই সঙ্গে কলেজে এবং ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। পাস করার পর দু’জনের পথ ভিন্ন হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগটা কমে গেছে। সৌমিক চাকরি খোঁজার সঙ্গে সঙ্গে দু’বার বিসিএস দিলো। একবারও পাস করতে পারেনি। আরেকবার রেজাল্টের অপেক্ষা চলছে।

সুমন্ত ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে এবং সে মেধার চেয়ে ব্যক্তিত্বেই জিনিয়াস। অনেককে টপকে সে নজরে পড়ার মতো। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে ওর উন্নাসিকতাই স্পর্শ করেছিলো নার্জিসকে। আর কেউ নয়। সম্ভবত নার্জিসই ইনসাল্ট ফিল করেছিলো সুমন্তর আচরণে। রমরমা আড্ডার মাঝখানে হঠাৎই উঠে দাঁড়িয়ে ‘যাই’ বলে আর ফিরে তাকায় না। এতে কেউ কেউ তার পিছন পিছন কয়েক কদম এগিয়ে দিতে গিয়ে ফিরে এসে আবার ভাঙা আসরটিতে বসে। আবার কেউ কেউ বসে থেকেও চেয়ে থাকে সুমন্তর গমন পথে। তাতে হয়তো ওর চকচকে জুতোয় কোনো তরুণী, যুবতীর হৃদয়ও চ্যাপ্টা হয়ে যায়। কেউ হয়তো ওকে এগিয়ে দিতে গিয়ে নিজের পথও ধরে, আর ফিরে না এসে। না, নার্জিস মানতে পারে না, ওর অহংকারে লাগে। কিন্তু ওর সঙ্গে এতটা জমে ওঠেনি, যাতে করে ঠাট্টা করেও কিছু বলে মনঃপীড়া কমাতে পারে।

তবে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছে, এটা কীকরম হলো? হঠাৎ-ই একজন রোজ এরকম করবে আর তার পিছনে সুরসুর করে রওনা দেবে আরো কেউ? কার্টিসি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। গৌতম রায় এরকম অবস্থায় কষে ধরলো, ‘শালা ফাজলামি পেয়েছিস? রোজ আগে কেটে পড়িস? যাই বলে আর দাঁড়াস না।’

– হ্যাঁ তাই তো! যাই বলে দাঁড়াতে নেই! যেতে যেতে পিছনে ফিরে তাকাতে নেই।

হেয়ালি করে উত্তর দিলো সুমন্ত কবির। বিত্তবান পিতার বিত্তের প্রশয় ছাড়াও খানদানি রক্তে গড়া সে এক উন্নত শির, দম্ভটাও যেন তাকে মানিয়ে যায়। কারণ সে-দাম্ভিক সে নয় বলে। আর এটা যারা বোঝার তারা বুঝে ফেলেছে।

কিন্তু সুমন্ত’র কথা শুনে রক্ত চনমন করে ওঠে নার্জিসের। মনে মনে সে প্রতিজ্ঞা করে, ‘তোকে আমি ফেরাবোই, মনে রাখিস।’ আজ গটগট করে চলে গেল নার্জিস। এমনকি তা সুমন্তরও সামনে দিয়ে। আর তাতেই সবার চোখ কপালে উঠল। দৃষ্টি বিস্ফোরিত হলো ওর পায়ে, চোয়ালে। আপাদমস্তক দেখার সুযোগ অবশ্য কেউ পেলো না। কিন্তু এর কারণটা কী? একটা খটকা সবার বুকে বিঁধলো। সুমন্তরও। সুমন্তর খটকা খুব বেশিক্ষণ থাকে না। অথবা ও কোনো কিছু নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবে না। অথবা ওর ভাবনার বিষয় অনেক।

গৌতম রায় শিপলুর বন্ধু। আর শিপলু নার্জিসের মামাতে ভাই। কিচলু শিপলুর ছোট ভাই। এখানে ছোট-বড়র ভেদাভেদ নেই। ছেলেমেয়ের ভেদাভেদ নেই। সবাই ওরা একসঙ্গে তাস পেটায়। পিঠ চাপড়ে গল্প করে। দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়, বেসুরে গান গায়। উচ্ছ্বাসের সব মাতামাতিতে তারা একসঙ্গে ধেইধেই করে। এখানে সবার কাছে তারা সবাই সমান। কেউ কারো বিশেষ বন্ধু নয়। আবার হতেও কতক্ষণ!

লিলি-মিলি দু’বোন সৌমিকদের পাশের বাড়ির মেয়ে ওরা। মিজান, সাজ্জাদ, রূপা অবশ্য আসে আরেকটুকু দূর থেকে। রোমেল মিলি-লিলির বন্ধু। বাংলায় পাস করেছে। এখন একটা কলেজে পড়ায়। এখানে সেও ওদের সবার বন্ধু। কেউ কেউ যেমন এখানে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে চেষ্টা কর। কবিতা-গল্পও এখানে শোনানোর জন্য চেষ্টা করে কেউ কেউ। উৎকর্ষ সাধনের এ-যেন এক শক্ত-পোক্ত জোট। পৃথিবীর সবটাই যেন তাদের মুক্ত মঞ্চ। এক একদিন এক-এক বাড়ি, বনে-বাদাড়ে। যেখানে সেখানে জোটবদ্ধ হয়ে চাঁদা তুলে এক-আধটু মদ, তাড়ি, গাঁজার নেশায়ও হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধায়।

বড়রা এসব ক্ষমা করতে পারে না যদিও। আবার রক্ষাও করতে পারে না। সেদিন ওরকম দুর্ঘটনাটি ঘটেছিলো শিপলু-কিচলুদের বাড়ি অর্থাৎ নার্জিসের মামার বাড়ি। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কম-বেশি প্রভাব ওদের সবার উপরেই পড়েছে।

এরপর থেকে নার্জিস মিলনমেলায় ইচ্ছে করে দেরিতে যেত। উঠে আসতো সবার আগে। সুমন্তর যেদিন আসার কথা থাকত, সেদিন সে এমনটি করবেই করবে। তাহলে কি সুমন্ত’র ভূত নার্জিসকে চেপে বসেছে! সুমন্ত বুঝেও কিছু বলে না। কৌতূহল সে চাপতে জানে। ওখানেই সে ভীষণরকম স্বতন্ত্র। আর এই স্বাতন্ত্র্যের জের টেনে চলে বহু মেয়ে। কিন্তু রাশটি অবশ্য কেউ নাগাল পায় না সুমন্তর।

নার্জিসরা তিন ভাইবোন। ঘর-সংসার করতে চাওয়া মেয়েদের যে দম্ভটুকু ঝেড়ে বিসর্জন দিতে হয় নার্জিস সেটুকুতেই ভরে আছে টায় টায়। শেষে হলো কী? ওর ছোট বোনটিকেই আগে বিয়ে দিতে হলো। ওর জন্য তারও বয়স বেমানানভাবে বেড়ে যাচ্ছিলো। ওর জন্য আর অনিশ্চিত অপেক্ষা করা গেলো না। ডাক্তার বড় ভাইও পছন্দের মেয়েটিকে আর মুলো ঝুলিয়ে রাখতে পারছিলো না। অবশেষে নার্জিস একাই অনূঢ়া অবস্থায় গাম্ভীর্য আরো জ্বলজ্বল করে বহাল তবিয়তে চলছিলো। শক্ত হাতে পিতাই তাদের সংসারের হাল ধরে আছেন। মাও আগলে আছেন কর্তৃত্ব। নার্জিস পিতার ধাঁচটিতে গড়ে উঠেছে। অনমনীয় মনোভাব তার। এতে বোধহয় রাশভারী পিতা মনে মনে আহ্লাদিত হন নিজের প্রভাবটি উত্তরসূরি কেউ ধারণ করে আছে ভেবে। কিন্তু আইবুড়ো হয়ে থাকা মেয়ের এতটা স্বাধীন চলাফেরা মার কাছে ভালো ঠেকে না। তাতেই-বা কী? কারো ভালো লাগা না-লাগার মূল্য কেইবা কতটা দেয়!

সুমন্তর সঙ্গে নার্জিসের পরিচয়টা তাদের দুজনেরই মনে মনে ভিন্নখাতে বইতে থাকে এবং একসময় তারা দুজনেই বোঝে একটা কিছু ঘটে যাচ্ছে অন্তরের নিভৃতে। দুজনের কাছে দুজনই কখন নিজেকে অসহায় করে ফেলে। অন্যরা বোধহয় গা করতে পারে না। অথবা এ আকাশ কুসুম কেউ কল্পনা করতে যায়নি।

লিলি-মিলি আগে পরে দুজন গুনগুন করে ওঠে, হয়তো কিছু নাহি পাবো, তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাবো... সুমন্তর চোখ চলে যায় নার্জিসের মুখে, নার্জিসেরও সরাসরি সুমন্তর মুখে...। হঠাৎই ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো। নার্জিস আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে ভ্যানিটি ব্যাগটি পিঠে ঝুলিয়ে চলে যেতে পা বাড়ালো তখনি। ঝড়ের গতিতে লিলি ছুটে এসে পথ আটকালো- ‘না এভাবে যাওয়া চলবে না। আজ লিওন সবাইকে থাকতে বলেছে, ও গজল গাইবে পঙ্কজ উদাসের... শুনে শুনে শিখেছে আর কি!

-আমি এখনই ফিরে আসবো। অফিসে যেতে হবে। জরুরি একটা লেখা জমা দিতে হবে। সবাইকে তাক লাগিয়ে দ্রুত চলে গেল নার্জিস। মাত্র ক’মিনিটের ব্যবধানে ‘আসছি’ বলে চলে গেলো সুমন্তও। এতে কারো কারো মনে হলো পাতানো খেলা! ‘এ অবস্থা কতদিন চলছে? তোরা কেউ কিছু টের পেলি?’ কেউ একজন এ ধরনের মন্তব্য করে হালকা হলেও প্রতি উত্তর করে আর নিজের ছ্যাবলামি বা নির্বুদ্ধিতার দেখালো না।

সুমন্ত সরাসরি হাজির সেগুনবাগিচায় নার্জিসদের ফ্ল্যাটের দরজায়। এই প্রথম তার আগমন। এক দঙ্গল জাঁহাবাজের উৎপাতে অভ্যস্ত নার্জিসের মা টোকা শুনে দরজা খুলে দিয়ে নার্জিসকে দেখতে বললো, যে এলো, কে সে?

নার্জিস ড্রয়িং রুমের পর্দা সরিয়ে মুখ ঠেলে যাকে দেখলো, কিন্তু একটুকুও চমকালো না।

সুমন্ত এতে কিছুটা মিইয়ে গেলো। নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে হলে তার। সে উঠে দাঁড়াতেই আরেকটু এগিয়ে গেলো নার্জিস, বললো, এভাবে যাবেন বলেই বুঝি এসেছেন? সুমন্তকে এর আগে ওর তুই, তুমি কিছুই বলা হয়নি। আর হবেইবা কী করে? ও দলে এসেই তো প্রথমেই নার্জিসের মেজাজ বিগড়ে রেখেছে!

সুমন্ত বসলো আবার। নার্জিসও বসলো খানিকটা দুরত্ব রেখে। ইতোমধ্যে ভাবী হাজির একগাদা নাস্তা সাজিয়ে নিয়ে। বেচারী ঘরে ঢুকে তবে বুঝলো ও নার্জিসের বন্ধুদের কেউ নয়। অতঃপর নিজে উৎসাহী হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে জানতে পারলো আগন্তুকের পরিচয়। ক্রমে সময়টি ভালোই কাটাতে লাগলো তিনজনের। হাসপাতালে চাকরি করেন ডাক্তার মনিরা খান। আজ রাতে ডিউটি। অতএব তাড়া নেই। চা হয়ে গেলো আরো এক পর্ব। নার্জিস ভেবেছিলো উঠে এসে শয়তানটাকে জব্দ করে। শেষে নিজের ভাবী ইনসাল্ট ফিল করে। তাই ভেবে শেষ অব্দি কাটাতে হলো গুম হয়ে বসে থেকে। তারপর থেকে ওকে কে রোখে! যেন ননদিনী নয়-ভাবীর টানেই ওর ছুটে আসা। হয়তো অনেকটা তাই। তবু সুমন্ত-নার্জিস কখন যে তুই করে বলতে শুরুকরেছে, তা ওরা নিজেরাও বোঝেনি।

একঘণ্টা পর সুমন্ত স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে ফোন করলো– আমি আসছি, তুই প্রেসক্লাবের সমানে এসে দাঁড়িয়ে থাক। নার্জিস রাস্তার এপার থেকে দেখলো সুমন্ত সানগ্লাস চোখে রিকশায় বসে আছে। ও কাছে গিয়ে পৌঁছতেই সুমন্ত বললো, কোথায় যাবি?

– চল, পাবলিক লাইব্রেরি আর চারুকলার ছায়ায় হাঁটাহাঁটি করি।

সুমন্ত সরে বসে নার্জিসকে জায়গা করে দিলো। নার্জিস উঠে বসলে চালক দ্রুত চালিয়ে যেতে লাগলো। কিছুদূর যেতেই স্পিড ব্রেকারে রিকশার ঝাঁকুনিতে দুলে উঠলো নার্জিসের শিথিল হয়ে আসা স্তন। বিষয়টি সুমন্তর নজর এড়ায়নি। পরে আড়ষ্ট নার্জিস সুমন্তর দিকে তাকাতেই দু’জনে চোখাচোখি হলো। নার্জিসের মুখখানা তাতে যতটা না লজ্জায় তার চেয়ে বেশি অভিমানে ফুলে উঠলো। যেন এমনটির জন্য সুমন্তরই দোষ। গলা থেকে বেশ নিচে একটি কালো তিল চকচক করে নার্জিসের। শাড়ি পরলে বেশিরভাগ সময়েই তা ব্লাউজের বাইরে পড়ে যায়। সুমন্তর নজরও আজ আরো আবাধ্য হচ্ছে। ভ্রমরের মতো উড়ে উড়ে নার্জিসের বুকের তিলে বসছে। ফিনফিনে কালো ব্লাউজ ভেদ করে ব্রার লাল রংটি কেমন টকটকে ঠেকে। পুরু ব্রার আয়ত্তের বাইরে যেটুকু, মনে হচ্ছে মেঘ-গলানো চাঁদের আলোর রং। অসম্ভব এক আলো-ছায়াময় করে রেখেছে দেখা না-দেখার একটা অংশ। মাথাটা ঝিমঝিম করে সুমন্তর!

এভাবে তো সে কখনো নার্জিসকে দেখেনি! নাকি রুমালের মতো নজর ভাঁজ খেলেছিলো। সুমন্ত কিছু বলতে চেয়ে টের পেলো তার নিজের কণ্ঠ নিজের কাছে কেমন ভার লাগছে। এটাই পৌরুষ। কিন্তু তা নার্জিসের কাছে ফলানো? দ্বিধায় কুঁচকে থাকে সে। শেষে কিল-ঘুষি খেতে হয়। এমিনতে রিকশা চারুকলার গেটে পৌঁছাতে নার্জিস বলে উঠলো, ‘নামতে ইচ্ছে করছে না।’

– তা হলে?

– অন্য কোথাও চল!

– উদ্দেশ্যহীন ঘুরবো? রগচটা উত্তর।

– জা-নি-না! শ্যামলা মুখখানায় ঊষার লালিমা ফোটে নার্জিসের।

– তুই একা, নাকি আমিও? সাহসে ভর করে বললো সুমন্ত।

রিকশাওয়ালা ওদের হেঁয়ালি বুঝে রিকশাটা টেনে একপাশে রেখে গামছায় শরীর মুছতে মুছতে পানের দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো।

নার্জিস আদুরে স্বরে বললো, চল অন্য কোথাও যাই।

– সেই কোথাওটা কোথায় বলবি তো?

– তোদের ফ্ল্যাটটা কেমন সাজিয়েছিস দেখে আসি।

– ওটার কাজই তো শেষ হয়নি। তো আবার সাজানো! ভাইয়া একটা রুমে তার জন্য একটু বিশ্রামের ব্যবস্থা রেখেছে। কাজের তদারকিটা করতে এলে যেন বিশ্রাম নিতে পারে।

– তবু চল ওখানে গিয়ে বসি।

– এক কাপ চায়ের ব্যবস্থাও কিন্তু নেই। পরে এ নিয়ে কথা বলতে পারবি না।

নার্জিসের মুখের এই থমথমে ভাবটি সুমন্তর একেবারে অচেনা। গাম্ভীর্য ভেদ করে যেন সে কূলউপচানো এক পদ্মদীঘি। দুবছরে এ রূপটি সুমন্তর নজরে একবারও পড়েনি। নাকি এমনটি ঘটেনি। অবশ্য একনাগাড়ে শুধু দুজনে তারা একসঙ্গে এভাবে কোনোদিন কাছাকাছি থাকেওনি। যদিও দেখাটা হরহামেশাই হয়। সুমন্ত রিকশাওয়ালাকে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে রিকশা ঘোরাতে বললো।

এখন আর ‘যাই’ বলেই হাঁটা শুরু করে না সুমন্ত। এখন সে চলে গিয়েও ফেরার ছুতো খোঁজে। বন্ধুরা এ কৃতিত্বের সবটুকুই নার্জিসকে দেয়। বেয়াড়া ছেলে কারো কথা শোনে না। কাউকে সে পছন্দ করতে পারেছে না! ওর মা তো বলেন, অবশেষে যা-ও একটা পছন্দ করে বসলো তাও বয়সে সমান, কালো, ধুমসি।

‘মা ওভাবে বলো না, ওই ধুমসিই তোমার এই টকটকে হ্যান্ডসাম ছেলেকে থোড়াই কেয়ার করে। আর কাউকে পছন্দ হলেই বউ করতে হবে কেন? ও মেয়েকে সংসারে টেনো না মা! ছারখার করে দেবে।’ মায়ের মন আবার শঙ্কা বাজে, পেয়ে হারানোর।

নার্জিস যদিও সুমন্তর জন্য অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি টান অনুভব করে কিন্তু কাউকে নিয়েই সংসার গড়া পর্যন্ত আর ভাবে না। ও মনে করে একজন স্বামীকে থাকতে হবে বয়স, বুদ্ধি, শিক্ষা, ধৈর্য স্থিরতায়- সবকিছুতেই স্ত্রীর চেয়ে এগিয়ে। তাহলেই বোধহয় মানায়, অথবা এভাবেই দেখতে দেখতে বা ভাবতে ভাবতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে তাদের ধারণা। শুধু তৈজসপত্রে সুনশান সাজানো ফ্ল্যাট মানেই কী সংসার? তাহলে আর একা কাটানোর দোষ কী? তার তো একা একা খুব খারাপ লাগে না।

নার্জিসের মা মাঝে মাঝে বিগড়ে ওঠেন, সোমত্ত মেয়ে...।

নার্জিসের মায়ের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে, ‘অ্যাঁ সোমত্ত মেয়ে? তোমার মেয়ে এখনো সোমত্ত আছে! শোনো মা, সাংবাদিকতা বলে কথা! তুমি কি চাও না তোমার মেয়ে ক্যারিয়ারিস্ট হোক! ঘর-সংসার তো কপালে ঘটলোই না!’

– ঘর-সংসার ঘটলো না মানে? তোর জন্য কি কম সম্বন্ধ এসেছিলো?

– এসেছিলো কিন্তু এখন তো আর আসছে না।

– ওই সুমন্তর সঙ্গে তোর বিয়ে হোক! তোর বাবাও তাই চাইছেন। কাল দেখলাম বউমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেছেন।

– হ্যাঁ, ওর সঙ্গে বিয়ে হয়ে পিঠেপিঠি ভাইবোনের মতো সারাদিন মারামারি করি আর কি? ও আমার সঙ্গে সংসার করবে আর প্রেম করবে ওর চেয়ে কমবয়সী কারো সঙ্গে, সেটা খুব ভালো হবে, না! একটি বাচ্চা হতে না হতে ওর সঙ্গে বেড়াতে গেলে মানুষে ভাববে ও আমার ছোট ভাই, অথবা দেওর... সরো তো মা, অফিসে যেতে দাও। কথার চোটে নাকানি-চুবানি খাওয়া মাকে অতঃপর দুহাতে ঠেলে সরিয়ে রিস্ট ওয়াচটি বাঁধতে বাঁধতে পায়ের শব্দ তুলে কেটে পড়ে নার্জিস।

সুমন্তর জ্বর। ক্রমে তা বাড়ছে। টেলিফোনে রোজই কথা হচ্ছে নার্জিসের সঙ্গে। একসময় টের পেলো অনেকদিন দুজনের দেখা হয়নি। নার্জিস সুমন্তর বাড়ি যায়নি কখনো। সুমন্তও বলেনি ওকে যেতে। কারণ ও আবার কী ভেবে বসে। নার্জিসকে নিয়ে সুমন্তর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কীধরনের আলোচনা হতো, সুমন্ত তার প্রায় সবই বলে দিতো ওকে। তাই এখনো ওর অহংকারে লাগছে। ওরা নাকি আবার ভেবে বসে হবু বরের বাড়ি এসেছে সবাইকে মন গলানের চেষ্টা করতে! আসলে ওরকম যদি হতোও তবু কথা ছিলো... বন্ধুরা অবশ্য সুমন্তকে দেখে এসে বর্ণনা করেছে। ডাক্তার খারাপ কিছু আশঙ্কা করছে তাকে নিয়ে।

অবশেষে সুমন্ত নার্জিসকে বলেই ফেললো-এ জন্যই চাইনি কেউ আমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ুক! কেন যে তুই আমাকে নিয়ে বাজি ধরতে গেলি? এখন আমার জন্য তোর কষ্ট ছাড়া আমার আর কেন কষ্ট নেই। আর পরিবারের সবার যে কষ্ট এটা তো তাদের নিয়তি। এত আমার খণ্ডন করার উপায় ছিলো না! আমি একজনের অনুরোধে রক্ত দিতে গিয়ে জেনেছিলাম আমার এ রোগের আশঙ্কা আছে। তারপর গোপনে চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে আছি। সুখের সংসারটি আমার কষ্টে বিধস্ত করতে চাইনি। দেখ, এখন সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। কারো চোখে ঘুম নেই। আমার মা সারাক্ষণ ডুকরে কাঁদছেন। বাবা উদ্বিগ্ন্। কখন তারই কী দুর্ঘটনা ঘটে?

নার্জিস এখন সব ফেলে হাসপাতালে সুমন্তর কাছে পড়ে থাকে। ওর সেবা নিজেই করছে। সুমন্তর মা তো আহাজারি ছাড়া আর কিছু পারেন না এ বয়সে। ছেলের শিয়রে তিনি সারাক্ষণ পড়ে আছেন। আর এই দুর্যোগে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওদের দুজনের সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলো কতটা হৃদয়।

সুমন্তর ব্লাড ক্যান্সার। এখানকার সব চিকিৎসা শেষ। আয়ুর শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো সে। তবু সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার কথা ভাবছে ওরা। ওখানে নিতে পারলে আরো উন্নত চিকিৎসা পাওয়া যাবে। তাতে সুমন্ত হয়তো টিকে যাবে। হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে তাকে বাড়িতে নেয়া হলে দু-একদিনের মধ্যে বড় ভাই অনন্ত নিয়ে যাবে সুমন্তকে।

মুহুর্মুহু বজ্রপাত চমকে যাচ্ছে নার্জিসের পাঁজরের নিচে। ওর পায়ের নিচের মাটি ক্রমশ সরে যাচ্ছে। চোখের নিচে ঘন কালি। পরিশ্রম ও দুশ্চিন্তার ক্লান্তি ছাপিয়েও ভাবী আশংকা করল অন্য কিছু। নিজের বিদ্যে ফলাতে গিয়ে চমকে উঠলেন মনিরা খান। আগে কিছু টের পায়নি নার্জিস। ভাবীর মুখে প্রথম জানতে পারলো। কিন্তু ননদিনীর এতটুকু শংকা এ ব্যাপারটিতে টের পেলেন না। তাই আশ্চর্য হয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, সুমন্ত যদি আর ফিরে না আসে?

– পৃথিবীটা খুব ছোট নয় ভাবী! কোথাও লুকানোর একটু জায়গা জুটে যাবেই।

– ভয় কী শুধু আশ্রয়হীনতার?

– এছাড়া আর কোনো ভয় আমি দেখছি না।

ননদের স্পর্ধায় আর হেনস্থা হতে চাইলেন না বলেই মনিরা খান ফ্যাকাসে মুখে সরে পড়লেন।

সুমন্তকে নিয়ে যাচ্ছে অনন্ত। বিমানবন্দরে সবাই ওকে এগিয়ে দিতে গেছে। হয়তো মনে-প্রাণে এটাকে সুমন্তর শেষযাত্রা জেনেই গেছে অনেকে। শুধু ওর মা-বাবাকে নেয়া হয়নি। এছাড়া বাদ যায়নি আর কেউ। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। যাত্রীদের উদ্দেশে অ্যানাউন্স করা হচ্ছে ইমিগ্রেশানে ঢোকার। বড় ভাইয়ের কাঁধে ভর করে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায় সুমন্ত। নার্জিস এলো না! থমকে দাঁড়িয়ে আবার এগোতে থাকে ক্ষীণ-দুর্বল সুমন্ত, পা টেনে।

আর দ্রুত পায়ে সবাইকে সরিয়ে দৌড়ে ছুটে আসে নার্জিস। কিছুটা চিৎকার করেই ডাকতে থাকে-সুমন্ত! সুমন্ত!

সুমন্তকে ছেড়ে দিয়ে একটু সরে দাঁড়ায় অনন্ত। সুমন্ত টলোমলো চোখে তাকিয়ে থাকে নার্জিসের মুখে। বেঁচে থাকার সবটুকু ইচ্ছে আরো তীব্র হয়ে ওঠে সুমন্তর। পৃথিবীটাকে তার দু’হাতে টেনে ফেরাতে ইচ্ছে করে। নার্জিসের কালিপড়া দু’চোখে দৃষ্টি একাকার করে দিয়ে ভীষণভাবে মনে হয় বেঁচে থাকার মতো সুন্দর আর কিছুই নেই!

– জ্যামে আটকা পড়ে দেরি হয়ে গেলো। তাছাড়া শরীর ভালো নেই... আমি তোর সন্তানের মা হতে যাচ্ছি সুমন্ত! ধারে কাছে কেউ আছে কি না, না দেখেই অকপটে কথাগুলো বলে দিলো নার্জিস।

– তুই আমাকে ফেরালিই! যদি আর ফিরে না-ও আসি তবু আমাদের সন্তান বৈধতার স্বীকৃতি পাবে। আমি বলছি তোকে! কারণ নার্জিস একটি স্বর্গীয় ফুলেরও নাম! শুধু ওকে তুই বাঁচিয়ে রাখিস।

আর অবকাশ নেই। অনন্ত এসে সুমন্তকে ধরে নিয়ে হাঁটতে থাকে। ইমিগ্রেশনে ঢুকে যতক্ষণ দেখা যায়, কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ফিরে ফিরে দেখে সুমন্ত ক্লান্ত, শ্রান্ত, অবসন্ন নার্জিসকে। এতে উদ্বিগ্নতার মধ্যে সবার দৃষ্টি আড়াল হওয়ার আগেই প্রসন্ন বিষণ্ণতায় একাকার একঝলক দৃষ্টি অনন্তও বুলিয়ে গেলো নার্জিসের মুখে। নার্জিস স্থানুর মতো দাঁড়িয়েই আছে ভেজা চোখে। আত্মীয়-স্বজনের কেউ কেউ এসে ওকে ঘিরে দাঁড়ালো। সুমন্তর ভাবী অর্থাৎ অনন্তর স্ত্রী ফিসফিস করে ওর কানে বললো, অনন্ত তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছে। চলো!

নার্জিস চমকালো না। শুধু ধীরে ধীরে হেঁটে এসে ভাবীর পাশে গাড়িতে গিয়ে বসলো।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu