সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

সৎকার

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

বাংলাদেশের ছোট্ট একটি জেলা মাগুরা। নবগঙ্গা বিধৌত অসম্ভব সুন্দর জেলা। মাগুরা জেলার ছোট্ট একটি সবুজে ঘেরা ছায়া ঢাকা গ্রাম বাগডাঙা। ওয়াপদা-মাগুরা হাইওয়ের পাশে রামনগর বাজার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে হিন্দু অধ্যুষিত এ গ্রামের এক অখ্যাত নামহীন বাউলকবি হারান মন্ডল। গ্রামের হাট-বাজারে গান গেয়ে যা পায় তাই দিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে কোনমতে কষ্টে-ক্লেশে দিন চলে যায়।

এটাই ওর একমাত্র পরিচয় নয়। হারান মন্ডল একজন যুদ্ধাহত কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে সেই কিশোর বয়সে দেশকে স্বাধীন করতে ঘর ছেড়েছিল। খুব ভালো বাঁশি বাজাতো। বাঁশের বাঁশির বদলে ছোট্ট হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল। হারান মন্ডল মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু সার্টিফিকেট নেই। সার্টিফিকেট নেই বলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ওর স্বীকৃতিও নেই। সার্টিফিকেট নেই মানে ও নেয়নি। মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরেও ও জানতে পারেনি যুদ্ধের বিনিময়ে একটা কাগজের সনদ দেয়া হয়েছিল। সেদিন যারা যুদ্ধ করেছিল তাদের কেউ-ই সনদ বা কোন প্রাপ্তির আশায় যুদ্ধ করেনি। সবার একটাই লক্ষ্য ছিল, দেশ স্বাধীন করা। বিনিময়ে কী পাবে কী পাবে না– সে ভাবনা কারো মাথায় আসেনি।

দেশ স্বাধীনের অনেক বছর পর সার্টিফিকেট বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর ততদিনে সার্টিফিকেট নামের বস্তুটি সোনার হরিণে পরিণত হয়ে যায়। তখন তা ওর মতো গরিব মানুষের ধরাছোঁয়ার নাগালের বাইরে। একে-ওকে ধরেও কোন কাজ হয়নি। অনেক মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায় অ-মুক্তিযোদ্ধা, আর– অনেকে মুক্তিযুদ্ধ না করেও হয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করেও হারান মন্ডল আর মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেনি। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে গান নিয়েই মেতে থাকতে চায়। গানের মধ্যেই তুলে ধরে ওর মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী দিনগুলোর কাহিনী।

সেদিন শনিবার। রামনগরের হাটবার। প্রত্যেক শনিবারে রামনগরে বড় গরুর হাট বসে। ষাটোর্ধ হারান মন্ডল গাছ থেকে গোটা চারেক কাঁঠাল কেটে ঝাঁকায় করে শেষ দুপুরে রামনগর হাটের উদ্দেশে রওনা হল। সপ্তাহের সব বজার-সদাইও এ হাট থেকেই করতে হয় ।

হাটে যাবার আগে হারান মন্ডল স্ত্রী মালতী বালাকে বলে গেল– বউ, চুলোয় জল গরম দিয়ে রাখিস, হাট থেইক্যা চাইল আনলি ভাত বসায় দিস।

এটা ওদের নিত্যদিনের বিষয়। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ ওরা। ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘হ্যান্ড টু মাউথ’। এভাবেই ওদের দিন চলে। চলে যায়। হারান মন্ডল হাটে রওনা হল। ও  যাবার পর মালতী বালা জল ফুটাতে থাকে। হাট থেকে চাল এলে ভাত চড়িয়ে দেবে। তাতে করে ভাত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।

বাগডাঙা থেকে রামনগর হাট তিন কিলোমিটারের পথ। ওদের মতো গরিব মানুষের জন্যে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হাঁটা। গ্রামের কাঁচা মাটির পথ ছেড়ে ঢাকা-খুলনা হাইওয়ের বড় রাস্তা ধরে দেড় কিলোমিটারের মতো যেতে হয়।

কাঁঠালের ঝাঁকা মাথায় নিয়ে বৃদ্ধ হারান গান ধরল– ‘গুরু উপায় বলো না, কপাল পোড়া জনম দুখী গুরু আমি একজনা…’

আপন মনে গাইতে গাইতে হাইওয়ে ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে থাকে হারান মন্ডল। মুক্তিযুদ্ধে ওর একটা পায়ে গুলি লাগে। পরে গোড়ালিতে একটা অপারেশন করতে হয়। ফলে, ওর একটা পা একটু ছোট হয়ে যায়। এ কারণে, রেক খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে হয়। এ জন্যে গ্রামের মানুষ ওকে ‘হারান খোঁড়া’ বলে ডাকে। আগে শুনলে মন খারাপ হলেও এখন আর তাতে ও কিছু মনে করে না। শুনতে শুনতে গা সওয়া হয়ে গেছে।

গান পাগল মানুষ হারান। গানই ওর জীবন। গান নিয়েই বেঁচে থাকতে, সব ভুলে থাকতে চায়। কে কী বলল, কে কী ভাবল তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করার কোন ইচ্ছে বা সময় কোনটাই ওর নেই।

একটার পর একটা গান গাইতে গাইতে আপন মনে হাইওয়ের সাথের কাঁচা মাটির পথ ধরে আনমনে হাঁটছিল হারান। প্রায় এসে পড়েছে। মোড় ঘুরলেই সামনে রামনগরের হাট।

অপত্যাশিতভাবে ঘটে গেল ঘটনাটা। হঠাৎ করে একটা গরু মেইন রাস্তায় চলে যায়। গরুটাকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রাক ব্রেক ফেল করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হারান মন্ডলকে চাপা দিয়ে রাস্তার পাশের খাদে গিয়ে পড়ে।

হারান মন্ডলের মাথা থেকে কাঁঠালের ঝাঁকা ছিঁটকে পড়ল দূরে। বেচারা হারানের নাকমুখ এমনভাবে থেতলে গেল যে চেনার কোন উপায় থাকল না। লোক জড় হতে সময় লাগল না। সবাই মিলে ধরাধরি করে ওকে রিক্সাভ্যানে করে মাগুরা সদর হাসপাতালে নিয়ে গেল। হাসপাতালে নেবার আগেই সবার অগোচরে হারানের প্রাণ-পাখিটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

হাসপাতাল থেকে লাশ থানায় গেল। থানা থেকে মর্গে। লাশ কাটাছেঁড়া হল। লাশের ওয়ারিশের খোঁজ পড়ল। কোন খোঁজ মিলল না। লাশের পকেটে একটা চিরকুট পাওয়া গেল। তাতে একটা গ্রামীণ কবিতা লেখা ছিল। তাতে করে মাগুরা সদর থানার ওসি শামসুল আরেফিন ধরে নিলেন লাশটি একজন কবির।

আর তাই ওসি সাহেব সাথে সাথে মাগুরা জেলা কবিতা পরিষদের সভাপতি কবীর আনোয়ারকে ফোন করলেন। কবিতা পরিষদের সভাপতি কবীর আনোয়ার হন্তদন্ত হয়ে থানায় এলেন। ওসি সাহেব তাকে লাশটি বুঝে নিয়ে সৎকার করার জন্যে অনুরোধ করলেন

কবীর আনোয়ার ওসি সাহেবের কথা গ্রাহ্য করলেন না। তিনি বললেন– আপনি বললেই তো আর লোকটা কবি হয়ে যাবে না, ওসি সাহেব। ধরুন, আমার পকেটে যদি একটা কানের দুল থাকে তাহলে কী বলবেন আমি একজন মহিলা? আগে তো প্রমাণ করতে হবে লোকটা সত্যি সত্যি কবি কিনা। কী নাম, কতদিন লিখছে, ক’টা বই বেরিয়েছে, ক’টা পুরস্কার পেয়েছে; সে পুরস্কারের মান কী এ সব তথ্য আগে জানতে হবে তারপর তো সৎকার!

কবীর আনোয়ারের কথা শুনে ওসি সাহেব তো হতবাক! এ সব এখন কে প্রমাণ করবে? তা করতে গেলে তো লাশ পঁচা গন্ধে টেকাই দায় হয়ে যাবে। যে প্যাচ কষার কথা পুলিশের সেটা কষছে কবি। তাজ্জব ব্যাপার!

এটা তো আর ঢাকা-কলকাতা নয় যে হাসপাতালের হিমঘরে মাসের পর মাস লাশ রাখা যাবে । আর সেটাও তো এ হতদরিদ্রের জন্যে নয়। অনেক অনুরোধ করার পরও লাশের দায়িত্ব নিতে রাজি না হওয়ায় অগত্যা সভাপতি কবীর আনোয়ারকে বিদায় করলেন ওসি শামসুল আরেফিন।

বসে বসে ওসি শামসুল আরেফিন ‘কী করা যায়, কী করা যায়’ ভাবছিলেন। এমন সময় হাবিলদার রমেশ শীল এসে বলল–স্যার, লোকটা কিন্তু হিন্দু ।

ওসি সাহেব বললেন– তাই নাকি ? তা কী করে বুঝলে?

– ওর ধুতি-ফতুয়া দেখে। হিন্দুরা ছাড়া তো এখন কেউ ধুতি পরে না ।

শুনে একটু ভাবলেন শামসুল আরেফিন। কথাটা যুক্তিসঙ্গত মনে হল। হাবিলদার রমেশ শীল বললেন– ঠিক আছে তুমি এখন যাও।

রমেশ শীল চলে যেতেই ওসি শামসুল আরেফিন ফোন দিলেন বিশ্বহিন্দু পরিষদের মাগুরা শাখার সভাপতি পরেশ পোদ্দারকে।

সব শুনে হিন্দু পরিষদের সভাপতি পরেশ পোদ্দার বললেন– একটা বিষয় বুঝতে পারলাম না ওসি সাহেব, কেবল ধুতি-ফতুয়া দেখেই রায় দিয়ে দিলেন লোকটা হিন্দু। ধুতি-ফতুয়ার সাথে ওর পকেটে যদি একটা টুপি থাকতো তাহলে কী বলতেন, হিন্দু না মুসলমান? কী নাম, বাড়ি কোথায়, কোন জাত এ সব আগে জানতে হবে। তারপর তো সৎকার। আপনি স্যার মুসলমান মানুষ, সৎকারের নিয়ম-কানুন জানেন না। আপনি বললেই তো আর সৎকার হবে না। নিয়ম-কানুন মেনে তবেই তো আমাকে সৎকার করতে হবে।

ওসি সাহেব দেখলেন, এখানেও আরেক বিপদ।

– তার মানে আপনি সৎকার করতে পারবেন না? সরাসরি জানতে চাইলেন ওসি সাহেব ।

– সরি স্যার, পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে আমার পক্ষে এ দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। আমাকেও তো সমাজের দশজনকে নিয়ে থাকতে হয়। সবাই প্রশ্ন করবে। কী উত্তর দেব? আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি পারব না, স্যার। চলি, নমষ্কার ।

বলে ওসি সাহেবকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন পরেশ পোদ্দার।

এরপর ওসি শামসুল আরেফিন ফোন করলেন স্থানীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি সুশান্ত গোমেজকে। তিনি বিষয়টি ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছেন। আর তাই ওসি সাহেবের ফোন ধরেই বললেন– স্যার, আমি তো মাগুরাতে নেই। কাল ঢাকায় এসেছি। মাগুরা এসে আপনার সাথে দেখা করব।

বলে ওসি সাহেবকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয় কল কেটে দিলেন সুশান্ত গোমেজ। পাছে আবার তার মিথ্যে ধরা পড়ে যায়। পুলিশ বলে কথা!

এ হেন ঘটনায় যারপরনাই হতাশ হলেন ওসি শামসুল আরেফিন। অগত্যা মাগুরা বার্তার সম্পাদককে ফোন করলেন। তিনি একজন রিপোর্টার পাঠিয়ে দিলেন। তিনি এসে ছবি-টবি তুলে নিয়ে গেলেন। আজই একটা নিউজ করে দেবেন বলে আশ্বস্ত করে গেলেন।

একে একে তিন দিন পার হয়ে গেল। লাশ নেয়ার জন্য কেউ এল না। ওদিকে লাশে গন্ধ ধরে গেছে। ফুলতে শুরু করেছে। লাশ আর রাখা সম্ভব নয়। ওসি শামসুল আরেফিন নিজ উদ্যোগে লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করলেন। জাত-টাত না জানা থাকায়, কে মুখাগ্নি করবে সে সবের ঝামেলায় না গিয়ে লাশ দাহ না করে সমাধিস্থ করা হলো। এভাবেই সমাপ্ত হল একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের শেষ অংক।

লাশ সৎকারের দিন তিনেক পরে মাগুরা বার্তায় হারান মন্ডলের ছবি ও খবর দেখে স্ত্রী মালতী বালা থানায় ছুটে এলো। কাপড়-চোপড় দেখার পর সনাক্ত হল লাশটি বাগডাঙা গ্রামের বাউল কবি হারান মন্ডলের ছিল। যিনি একজন যুদ্ধাহত কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যার বাড়িতে চুলোয় জল ফুটতে দিয়ে কাঁঠাল নিয়ে হাটে এসেছিল হারান। স্ত্রী মালতী বালা তখনও অপেক্ষা করছিল স্বামীর চাল নিয়ে আসার। স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে আসেন মাগুরা থানায়।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu