রাশেদ আহমেদের গল্প
‘চলে যাওয়া প্রেমিকার আবেগ নিয়ে দেখতে হবে। ছেড়ে আসা আত্মীয় সবার অনুভূতি এক করে দেখতে হবে। বরং তারও চেয়ে বেশি। কারণ প্রেমিকা নেই, আত্মীয় নেই– তুমি আছ, তুমি থাকতে পারছ– তাও হলে চলবে না। হতে হবে তার চেয়েও প্রগাঢ়, বেগবান। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বাঁধতে হবে। একাত্ব, লিন হতে হবে। এর বাইরে তুমি নেই এমন হতে হবে অথবা সব আছে, সবই থাকবে শুধু এই-ই নেই বা থাকবে না।’ অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা বেশি বিশেষায়িত হতে হবে। যে বিশেষ্যের কোনো পদ নেই। কর্তাই পদ এবং পদকর্তা।
এই অব্যক্ত বেদনা মগজে নিয়ে মগজাবার বাটার গলিতে থাকে আপন শাহেদ। ছোট একটা চিলেকোঠা। নিজের ফেইজবুক ইনফোতে লিখেছে: চিলেকোঠার সেপাই। কবিতা লেখে, সঙ্গে দু’চারটা গল্প এবং সিনেমা স্ক্রিপ্টের চেষ্টা-চরিত্তির আছে। মূলত গল্প আর কবিতাই তার ধ্যান জ্ঞান।
খুব অল্পতে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে। বর্তমানে একটা প্রাইভেট কম্পানিতে কেরানির চাকরিতে বহাল। পারিবারিক পিছুটান বলতে বাড়িতে আছেন বাবা, সৎ মা, সৎ ভাই দুজন আর সৎ বোন চারটা। আপন বাড়িতে না গেলে যারা খুশি।
তার এ সাহিত্যিক বাসনা আর তা চরিতার্থ করতে যেন প্রায় প্রতিদিন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে, মাঝে মাঝে কাটাবন কনকর্ড, আজিজ, কচিৎ টিএসসিতে গিয়ে বসে থাকে আর স্বস্তায় ডার্বি ফুকে। ডার্বি ফুকে আর ভাবে, এই গিসারেটের মতো শেষ হয়ে যাচ্ছে জীবন।
যেমন আজকে। শুক্রবার। কেরানিগিরি আজকের জন্য স্থগিত। ফলে সে একটা বই নিয়ে বসবে। ক পাতা পড়বে। কলম-খাতা নিয়ে বসে ঝুলতে থাকবে। ক লাইন লিখবেও বা। কিন্তু যুতসই শব্দের দেখা না পেয়ে লেখায় ইস্তফা দিবে।
‘তার চেয়ে বরং অন্য একটা লেখা নিয়ে বসি।’ এই বলে বছর দুই আগের একটা লেখা সম্পাদনা করতে বসল আপন।
মাথার উপর ফ্যান ‘পিনপিন’ ঘুরছে। সময় কেটে ফালাফালা করে চলেছে কালের ঘড়ি। ঘরের কাপড় ও তার ছায়া ফ্যানের বাতাসে নড়ছে। হাতের নিচে খাতার পাতাও বাতাসে পতপত করছে। এই চিলেকোঠার ক্লান্তি এবং বন্দিত্ব থেকে যেন মুক্তি চাচ্ছে কবুতর।
যে লেখাটা নিয়ে বসেছে আপন সেটা একটা গল্প। পড়তে গিয়ে বারবার পড়া ব্যহত হচ্ছে। দু’চার পেরার পর আর এগুনোই যাচ্ছে না। এহেন সময় এমন এক সাংঘাতিক হাতাশা তাকে পেয়ে বসল যে সে খাতাটা ছুড়ে মারতে বাধ্য হল। সেই সঙ্গে কাজের সবকটা উদ্যোম হারিয়ে জীবনের ব্যাপারে ভয়ানক বিতশ্রদ্ধ হয়ে উঠল। ‘এ জীবন দিয়া কি করিব?’– এমন এক মনোভাবে তেপায়ার তলা দিয়ে হাত-পা কেলিয়ে শুয়ে পড়ল। বিছানাতে তেপায়ায় পড়া-লেখায় অভ্যস্ত সে।
ঘুরন্ত ফ্যান আপনের দৃষ্টি সীমা কুচিকুচি করে কেটে নিচ্ছে। নিতান্ত চক্ষুপীড়ায় চোখ ফিরিয়ে নিল সে। দরজার পাশে জুতার কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে খাতাটা। সেদিক থেকেও চোখ ফিরিয়ে নিল। চোখ বন্ধ করে মরার মতো পড়ে থাকল কতক্ষণ। মুখ তার সাদা কাগজের মতো ফ্যাকাসে, চোখের নিচে কালসিটে দাগ।
এ আপনের নৈমিত্তিক সংঘাত। আমরা দেখেছি, আগের লেখা নিয়ে বসলে এমন নানা কাণ্ড তার দিয়ে হয়ে থাকে। গল্পের অসংগতি, কলকব্জার দুর্বলতা, সমায়েতের অকেজো অবস্থা– মূল কথা গল্পটা তার পায়ের উপর দাঁড়াতে পারেনি। বলা ভালো, কিছুই হয়নি। এতে লেখকের কোথায় কী গেলো, তা বুঝি কেবল মায়েরাই বুঝতে পারবেন; যথার্থ বুঝবেন যে মার সন্তান বিকলাঙ্গ। তা বলে আমি এ বুঝাতে চাচ্ছি না, লেখক মার সমান, মায়ের মতো দরদি। কারণ কোন মা-ই তার সন্তানকে এভাবে ছুড়ে মারতে পারে না। সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। অন্য কেন তা বলছি, লেখাটা এভাবে ছুড়ে দিলে যদি তখনই সেটা মরে যেতো বা উড়ে যেতো, খাতা থেকে মুছে যেতো, তখন লেখক কী করত বা করতে পারত–সে না হয় তখন দেখা যেতো। এখন ধারণার আশ্রয় না নেই।
এমন আস্পর্ধার কথাও তো হতে পারে লেখক তার লেখার ব্যাপারে মায়ের চেয়েও বেশি দরদি! এতো বাড়িয়েও বলছি না, তবে লেখকের কাছে তার লেখা মার কাছে সন্তান যেকথা, তার কোন অংশে কম না।
তাহলে লেখা আর সন্তান, মা আর লেখক কে বেশি দরদি? সে অবান্তর প্রশ্ন। স্পর্শকাতরও বটে। ফলে প্রসঙ্গটা বরং আমরা চলুন এড়িয়েই যাই। কারণ পরিস্থিতি তেমন উদ্ভুত হয়নি যে আমাদের অগ্নিপরীক্ষায় যেতে হবে। তাছাড়া যখন জানি, সন্তানের মা যেমন লেখক হন, তেমনই প্রসবের আগ মুহূর্তে তিনি হয়তো দুয়েক ছত্র লিখেনও–পরিস্থিতিটা অনেকটা এই।
এতো কথা বলার অর্থ হলো, এতে আমরা হয়তো আপনের দুঃখটা একটু অনুধাবনের কষ্ট স্বীকার করলে করতেও পারি। বিশ্বাস করুন, একজন লেখক তার লেখার চেয়ে বেশি কিছুকে ভালোবাসতে পারে না। তাই আপনের চিন্তাজুড়ে লেখার এ সব চিন্তা নিয়ে আমরা বিরক্ত হবো না।
যেমন ‘কেন কিছুই হয় না?’ নাকি ‘এই পরিস্থিতিই হয়ে থাকে লেখার ক্ষেত্রে?’ তখন ‘এ সময় তাহলে কী করতে হয় একজন লিখিয়ের?’–এইসব অসংখ্য প্রশ্ন মাথায় পাক খেতে থাকে আপনের।
প্রশ্নগুলো মাথায় করে সে তেপায়ার তলা থেকে বেরিয়ে এলো। হাটুর ঝটকা লেগে বিছানায় উল্টে পড়ল বেটিল। ছড়িয়ে পড়র টেবিলের উপরের বই, খাতা, কলম, মোবাইল। মোবাইলটা হাতে নিয়ে আপন ব্যর্থমনরথে বেরিয়ে পড়ল বিকেলটা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে কাটিয়ে দেবে বলে। বহু বছর যাতায়াতের ফলে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে তার একটি বন্ধুবলয় তৈরি হয়েছে। শিল্প-সাহিত্যের তাবড় তাবড় মানুষ, যারা আপনের মতোই মনে একটি শিল্পীর বেদনা নিয়ে বেঁচে আছে।
এই বন্ধু মহলে এলে আপনের হীনমন্যতা কেটে যায়। প্রতিভাময় বড় বড় চুল, তীক্ষ্ণ চক্ষুর একদল বন্ধুর মেলে এসে, তাদের কথা শুনে, নিজেকে, নিজের অক্ষমতাকে ভুলে যায় আপন। এ এমন জায়গা যেখানে আত্মপ্রসাদের লাল-নীল বেলুন উড়িয়ে ভুলে যাওয়া যায় নিকট অতীত। আপন শাহেদের মতো পেটভরা গু আর বুকভরা কামুকদের জন্য এখন যা অত্যন্ত জরুরি।
বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্রে ঢুকতে প্রথমেই দেখা হয়ে গেল বছর চল্লিশেকের টাকমাথা গোলপেট ইসরাফিল ইসলাম ভাইয়ের সঙ্গে। নারী ঘেষা বলে বিশেষ খ্যাতি লোকটার। অবিবাহিত টাকমাথা গোলপেট মাঝারি উচ্চতার লোকটা। হাতে স্মার্টফোন। মেসেঞ্জারে কারো সঙ্গে বোধ হয় চ্যাট করছিলেন। ইসরাফিল ভাই যে কী করেন, কী তার পেশা, কোথায়ই বা থাকেন–তা বুঝি কেউ জানে না। তবে তার নারী লোলপতার কথা জানে না এমন লোক নেই। অবশ্য ইসরাফিল ভাইও সেসব জানাজানির থোরাই কেয়ার করে, যেমন তাকে নিয়ে কে কি বলল তা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। অনেকে বলে ইসরাফিল ভাই লোচ্চামিকে শিল্পের পর্যায়ে নিতে পেরেছেন।
তার ধর্ম আর দর্শন যাই বলি না কেন, সে হলো–প্রথম দিন দেখা, দ্বিতীয় দিন কেকা (অর্থাৎ রেস্টুরেন্ট, খাওয়া-দাওয়া), তৃতীয় দিন লেখা (অর্থাৎ প্রাকৃতিক কলমে সাইনিং করে দেয়া)।
‘লেজকাটা চৈতা এসব কুকুরদের আমি মোটেও দেখতে পারি না’-এ হলো ইসরাফিল ইসলামের ব্যাপারে আপনের ঢালাও মন্তব্য। ফলে আপন হাই-হ্যালোর মধ্যেই ইসরাফিলের কবল থেকে মুক্ত হয়ে সোজা ছাদে চলে এলো।
পাঠক কী ভাবছেন তা আমি জানি, আহা, কী সাধুপুরুষটি এলেন এতোক্ষণে! আমিও ঠিক তাই ভাবছি। ইসরাফিল ইসলামরা হলেন সেই শ্রেণীর মানুষ, যারা নিজের জন্য নিজের কথা বলতে কোন সংকোচ করেন না। আপনরা হলো সেই শ্রেণীর মানুষ, যারা ক্ষুধায়-পিপাসায় মরে শুটকি হয়ে যাবে, তবু মুখ ফুটে এক ফোটা পানির কথা বলতে প্রাণ বেরিয়ে যাবে। প্রাণটাও না হয় গেল, তবু সে তার তিয়াষের কথা বলতে পারবে না। তবে মুখচোরা, ঈর্ষাকাতর এইসব যুবক-যুবতিরা আমাদের সমাজেরই অংশ, হ্যা, তার চেয়ে বরং নিজের উপর দোষ চাপিয়ে বলি, আমরাই, আমিই।
আপনকে বলা যায় না ইসরাফিল ভাই যদি-বা হন মুদ্রার এ-পিঠ, সে মুদ্রার ও-পিঠ। তারচেয়ে তাকে বলা যায় ইসরাফিল ভাইয়ের মুদ্রাপিঠের সে একটা অংশ বিশেষ। কারণ মুদ্রার এ-পিঠ বা ও-পিঠ যাই বলুন না কেন– সেটা একটা কৃতিত্বের কথা। কিন্তু কোনো পিঠ না হয়ে, পিঠের অংশবিশেষ হওয়া কতটা লজ্জার এবং গ্লানির তা বলতে পারছি না, তবে নিশ্চয়ই পূর্ণাঙ্গরূপ কিছু না। একে বলা যায় অপরিণত, বিকলাঙ্গরূপ।
আপন লোকটা যে কেমন আমি মুখে বলতে চাই না। সেটা আপনের মুখ থেকেই আমি শুনতে চাই। তাই একটু ধৈর্য্য ধরুন। শুধু বলি, এই গল্প শুনার পর একজনের মন্তব্য– আপন লোকটা যে একটা মিষ্টি শুয়োরের বাচ্চা, যাকে আবার ভালোও বাসা যায়! কারণ একজন পাড় মাতালের যেমন থাকে বোধ, তা কেবল নেশায় ঢাকা পড়ে যায় এই যা। তেমনই একনজ নিষ্ঠুরেরও থাকে হৃদয়, তাতে ময়লা জমে হয়তো পাথর হয়ে যায়–সেই পাথরের স্তরটুকু কাটলেই সেই সাবানের ফেনার মতো মনটি কিন্তু আপনি পেতে পারেন। আবার একই সঙ্গে সাবানের ফেনা ঘেটে আপনি পেতে পারেন পাথরের টুকরো। আমরা সে চেষ্টাও করব।
একজনের আঁতের খবর জানতে হলে, অবশ্যই আপনাকে ঘা দিতে হবে তার সবচেয়ে অনুভূতিপ্রবণ বা স্পর্শকাতর জায়গাটিতে। অবশ্য ইতোমধ্যে আপনের যে সবচেয়ে অনুভূতিময় জায়গাটা লেখা, সেটা আমরা জেনে গেছি। তো আসুন একটু আধটু ঘা দিয়ে দেখি আপন লোকটা কেমন। তবে মনে রাখতে হবে, আমরা যেহেতু শিল্পপড়া, শিল্পমনা মানুষ, অবশ্যই সে ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা মানবিক হওয়ার প্রয়োজন আছে বৈকি। অন্তত লোক দেখানোর জন্য হলেও। কারণ আমরা তো সবাই মানুষ। নিজের সম্পর্ক সম্যুক জ্ঞান রাখি। এবার আসুন গল্পে ফেরা যাক–
ছাদের উত্তর দিকের বটগাছের বনসাইটার পাশঘেঁষে জমেছে আড্ডা। গোল টেবিলটা ঘিরে রেখেছে আপনের সমমনা সব মানুষ। এই তার আড্ডাস্থল। এখানেই আপন বসে। এছাড়াও ছাদময় আরো অনেক টেবিল। সেসব টেবিল ঘিরেও চলছে আড্ডা। রাজনৈতিক, নৈতিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক সংলাপে গমগম করছে কেন্দ্রের ছাদ। সাথে চা, শিঙাড়া, সমচা, ছোলা চলছে দেদারসে আর কথার ফুলঝুরি। এদের দেখলে যে কেউ সন্দেহ করতে পারে জীবনে আড্ডা দেয়াটাই সম্ভবত এদের একমাত্র কাজ। কিন্তু এর বাইরেও এদের কাজ আছে। আপন যেমন কেরানির কাজ করে।
আপন অনেক কষ্টেসৃষ্টে একটা খালি চেয়ার জোগাড় করতে পারল। আড্ডার একদম উল্টো দিকে, দক্ষিণ দিক থেকে সবার মাথার উপর দিয়ে, ভিড় ঠেলে প্লাসটিকের নীল চেয়ারটা সে উড়িয়ে নিয়ে এলো। এ ক্ষেত্রে তার ছ ফুট উচ্চতা তাকে খুব সাহায্য করল। অদ্রির বন্ধুদের আড্ডার টেবিলটা অতিক্রম করার সময় সে লক্ষ করল আড্ডায় বাবড়ি চুলের তুলতুলে মেয়েটা নেই।
আপন আড্ডার একদিকে চেয়ার পেতে বসল। বটগাছটার দিকে পেছন ফিরে বসা বিশিষ্ট কথাশিল্পী আলাওল হাসান। জুলিয়াস সিজারের মতো চুলের কাট। নাকটা রবীন্দ্রনাথের মতো টিকোনো-বাঁকানো। কথা বলে তর্জনি উচিয়ে এটা-ওটা নির্দেশ করার মতো। যিনি তার উপন্যাসের মাঝপথে আছে প্রায় বছর তিনেক হবে। তার ধারণা এটি বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসে একটি সংযোজন। তার ব্যতিক্রমি ভাষা, স্লেং, বর্ণন কৌশল ও চিন্তা-ভাবনার জন্য। যা নাকি ভড়ংবাজদের কপলে এক মারাত্মক চপেটাঘাতের মতো। যে আঘাতে চোয়াল ঘুরে যাবে আত্মবিস্মৃত বাংলার পাঠক কুলের। এ সময় যেটা নাকি আবার খুব প্রয়োজনও।
আপন এ প্রতিভাবান কথাশিল্পীর ঠিক উল্টো দিকে বসেছে। আপনের পাশে যিনি লম্বা লম্বা চুল আর দীর্ঘ ঝুলফি নিয়ে বসে নখ খুটছে তিনি প্রখ্যাত ফিল্মম্যাকার ঝিলিক কুমার। এরপর যুগের অন্যতম দার্শনিক ফ্রয়েডের উত্তরসূরি এস. এল. কবির সিংহ। যিনি দুটি পাথরের ঘর্ষণকেও যৌনতা মিলিয়ে বিচার করেন। এছাড়া কবি হৃদয় মাহতসহ আরও কত প্রতিভাবান, অপ্সরা-অপ্সরিতে খুব আল্পসময় এ আড্ডা! আপন তাতে আধহাত পরিমাণ ফাঁকে হাটু মুড়ে বসল।
ঝিলিক তার লম্বা লম্বা চুল নাচিয়ে, দাঁতে কাটা নখের অংশটা থুক্ করে সামনে ছিটিয়ে দিয়ে বলছিল জাপানী এক দীর্ঘতম ছবির কথা, ‘চার ঘন্টা শুধু ক্যারটারটা সমুদ্র উপকূলের একটা বারে বসে থাকে। চেয়ার চেবিল সামনে নিয়ে সে বসে আছে তো বসেই আছে। অদ্ভুত! কী নিরীক্ষা। ফলে দর্শক সিনেমায় ইনভল্ব হয় কীভাবে দেখো- কেউ হয়তো ভাবছে এবার বুঝি কিছু একটা ঘটবে, কেউ ভাবছে এই বুঝি কিছু ঘটল বলে; কেউ কেউ আবার উঠে যাচ্ছে ছবি রেখে, কেউ এসে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু ক্যারেকটারটা তার জায়গা থেকে একচুল নড়ছে না। জাস্ট ভাবা যায়! একেই বলে সাহস। এমন ডিরেক্টরকে আমার সালাম।’
আলোচনায় সবার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা উপচে পড়ছিল। কিন্তু কি বুঝে মুগ্ধ বক্তা ঐ জাপানি সিনেমা পরিচালককে (কী নাম কে জানে) অমন ষাষ্ঠাঙ্গে প্রমাণ ঠুকছেন আর কি বুঝে শ্রোতারা অত মুগ্ধ নয়ন– তা কেবল এই আড্ডার শিল্পীরাই বলতে পারবে। আরও ভালো পারত বোধ হয় সাকি সৌলভ, সেও ফিল্মম্যাকার। আজকে অনুপস্থিত।
সকলের মুগ্ধ দৃষ্টির মাঝখানে হৃদয় মাহাত, যিনি একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করছেন, প্রস্তুতি প্রায় শেষ, অবশ্য শেষ হয়েও হচ্ছে না তা আজ দু বছর। বইটির প্রচ্ছদ হবে কিউবিক ফর্মে, তা নাকি হয়ে উঠছে না শিল্পীর অভাবে। হৃদয় তার লিকলিকে ঘাড়ের উপর শালগমের মতো মাথাটা নেড়ে নেড়ে বলল, ‘সেই জন্যই বলি নতুন। ঐ নতুনের কেতন উড়ে। নতুনকে জানতে হবে, নিতে হবে। পুরনোকে জাস্ট আস্তাকুড়ে…। পুরনোর কঙ্কালে নতুন মাস লাগাতে হবে। আধুনিকতাকে ছাড়িয়ে উত্তরাধুনিক…। চাঁদের আলো দেখলে হবে না ভায়া, চাঁদের জামা… গায়ে দিয়ে বাংলামটর মোট দিয়ে হেটে যেতে হবে।’ কাব্যিক ছোয়াচে লাগা এই কথাগুলো বলে সে তার নীলচে ঢোলা শার্টের গোটানো হাতা থেকে কার্টুনের মতো বেরিয়ে আসা লিকলিকে হাত নাড়িয়ে মাংলামোটর মোড়ের দিকে ইঙ্গিত করল।
‘হ্যা, যা বলেছ’, কথাশিল্পী আলাওল বলল, ‘যেমন ধরো আমার উপন্যাসটা, আমি একটা ছাগলের ক্যারেকটার রাখছি। নাম মতি। বাড়িতে যখন কেউ থাকে না, বাড়ির গৃহিনী মতির সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলে সময় পাড় করে। গৃহনী মতির সঙ্গে এতো কথা বলে যে, ছাগলটা এখন মানুষের কথা বুঝতে পারে। শুধু কি তাই, সে বলতেও পারে– একে দিয়েই কাজটা আবার শুরু করব বলে ভাবছি।’
আলাওলের কথা শেষ হলে সকলের মধ্যে একটা নিরবতা নেমে এলো। এটা সৃষ্টিশীলদের নিজেদের প্রতি এক ধরণের সম্মান প্রদর্শন।
আপনকে দেখে এই নিরবতা ভাঙল পাশের চেয়ারে বসা বিশিষ্ট সাহিত্য সম্পদক পিটার গোমেজ। দেখলে মনে হতে পারে, মাংসের বস্তা থেকে মাথাটা কেটে বের করা, কেউ সেখান থেকে উঁকি দিচ্ছে। আদপে পিটারের মাথাটা ডান কাধের দিকে কাৎ করতে চেষ্টা চলছে। পিটার মাথা যেটুকু পারল কাৎ করে বলল, ‘আপন! কী অবস্থা। লেখা কোথায়? গল্পটা তো লাগবে। কাজে হাত দিবো আগামী মাসে। নতুন সংখ্যাটা দ্রুতই বাজারে আনব বলে ভাবছি। দেখ, নতুনরা এতো উন্নাসিক হতে নেই, বুঝলে স্লা। এমন উন্নাসিক! তার কাছে লেখা চেয়ে চেয়ে মারা যেতে হবে, তাও তার লেখ মিলবে না। এমন হলে আর শিল্প-সাহিত্য চোদাতে হবে না ভায়া।’
কথার মধ্যে পিটারের এভাবে স্লেং মেরে দেয়া তার পুরনো অভ্যাস। সে সবাই দুটো একটা বলেই থাকে। এ ক্ষেত্রে পিটার অগ্রগামী যে কারণে, সে স্থান-কালের বিচার করে না, মুখে এলো তো বলে দিল। পিটার বলে চলল, ‘আসলে হয়েছে কী, এই অর্থ-লোলোপ সমাজটা আসলে কোন কাজের না। কোন দিকে যাচ্ছে এ শুয়োরের গোৎ গোৎ? সবকিছুর জন্য অর্থ আছে, শিল্প-সাহিত্যের জন্য নেই। মাই পত্রিকা করবে, ময়লা পড়া আষটে গন্ধ পুরনো পঁচাডিমদের জ্বালায় নতুনেরা জায়গাই পাবে না। করপোরেট অফিসগুলোও এমন, শুধু নাম দেখে বিজ্ঞাপন দিবে। তাহলে নতুনের কেতন কী করে উড়বে বল দিকিনি বাছা-ধুনরা?’
পিটার গোমেজের একটা সাহিত্য পত্রিকার স্বপ্ন। যেখানে সে দেশের তরুণ প্রতিভাদেরকে জায়গা দিবে। পত্রিকার নামে একটা সাহিত্য পুরস্কারেরও আয়োজন করার ইচ্ছে তার। যা বিশ্বের যে কোন সাহিত্য পুরস্কারের অর্থমূলের সমানানুপাত। এই পরিকল্পনা তার পাঁচ বছরে গড়াবে বোধ হয় কিছু দিনের মধ্যে আর পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যাটা বেরুবে বেরুবে করছে তাও বছর দুই ধরে। ফলে পিটারের লেখা চাওয়ার উত্তরও আপনের তৈরি করা। কারণ লেখাটা যেহেতু সে এই পাঁচ বছর ধরেই চেয়ে যাচ্ছে এবং প্রথম সংখ্যায় লেখার জন্য আরও বেশি চেপেছিল। কিন্তু লেখাটা বড় বড় বাজার কাটতি লেখকদের লেখার ভিড়ে জায়গা করতে পারেনি। আপন তার বন্ধুর স্বভাবের ব্যাপারে অবগত হওয়ায় সে বলল–
: লেখাটা তো রেডি। আসতে সময় আনতে শুধু ভুলে গেছি। আগামী সপ্তায় পাবা।
আপন মুখে আমুদে একটা হাসি টেনে পিটার কথার উত্তর দিল। কিন্তু পিটার তো ছাড়বার পাত্র নয়। সে আপনকে আরেক চোট নিল–
: এতো দেরি করলে হবে? আগমী সপ্তায় গল্পটা চাই, দিতে হবে। স্লা।
মরুব্বিচালে কথাটা শেষ করে পিটার কচ্ছপের মতো মাথাটা তার ধলধলে ধরের মাংসের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়ার প্রয়াস পেল। তার আগেই পাশ থেকে বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানালো বিশিষ্ট সার্ক্সবাদি বুদ্ধিজীবী আমহেদ রুদ্র। পিটারকে নিয়ে তাও সম্ভবত কোনো তিক্ত স্মৃতি থেকে থাকবে।
রুদ্র ‘বাংলাদেশে মার্ক্সবাদের চর্চা ও পরচর্চা’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে শেষ করেছে সম্প্রতি। তাও মাস দুই হলো। সেখানে আলোচনার উপজীব্য হচ্ছে, দেশে কতটুকু মার্ক্সবাদের চর্চয হয়েছে আর কতটা এই নিয়ে হৈ চৈ, ব্যাবসায়, ফাজলামো, পরচর্চা হয়েছে তার একটি খতিয়ান। সেখানে সে দেখিয়েছে, বাংলাদেশের মাক্সবাদি আদর্শ যে পরিমাণ বিকিকিনি হয়েছে, তার একশতমাংশও ধারণ করেনি কেউ। ওদিকে রাশিয়ায় সোভিয়েত রাষ্ট্র কায়েম হতে পারলে, সেটা এখানে কেন কায়েম হতে পারবে না? যদিও দুটোই কৃষিভিত্তিক সমাজ? এই প্রশ্ন রেখে ঐ প্রবন্ধ সে শেষ করে পরবর্তী প্রবন্ধের বিষয় হিসেবে সে নির্ধারণ করেছে, দেশে কেন সামাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হচ্ছে না– তার পিণ্ডি চটকানো।
এদেশের তরুণ সমাজের আচরণে সে এতোটাই উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ যে, সেটা এক রকম হতাশায় পর্যবসিত। তার বক্তব্য থেকে তাই বুঝা গেল। রুদ্র দ্রুত পিটারের কথার প্রতিবাদ করে উঠল, ‘না ভাই, তুমি এভাবে ফোর্স করতে পার না। সে হয়তো মাটি কাটত। সেখানে শব্দ লিখছে। হতে পারত দিনমজুর, হয়েছে কলমশ্রমিক। তাই বলে তুমি তাকে ফোর্স করতে পার না। কারণ ফোর্স করা হচ্ছে পূজিবাদি সমাজের শোষণের ছড়ি, সেটা বন্ধুত্বের ছলে হলেও। তাকে লিখতে তুমি অনুরোধ করতে পারো, বাধ্য করতে পার না বা এভাবে বলতেও পার না।’
আহমেদ রুদ্র একটু সিরিয়াস ঘরনার মানুষ। সব সময় সে তার কথার মাথাটা মার্ক্সবাদের দিকে এমনভাবে ঘুরিয়ে দিবে, তা কারো চোখ এড়াবে না। সে তার সেই বোলচাল সম্পূর্ণ বজায় রেখে বলে চলল, ‘যেদিন থেকে পূজির উদ্ভব হয়েছে, সেদিন থেকেই শ্রমের ভয়ানক অবমূল্যায়ন হয়ে আসছে। অথচ উচিৎ ছিল, শ্রমের যথোচিত মূল্য দেয়া। তুমি যে তাকে এভাবে বললা, তুমি তাকে লেখার বিনিময়ে কী দেবে? আমি তো জানি, কিছুই দেবে না। এ দেশে এমন কোন সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি যে, লেখার বিনিময়ে অর্থ। এর ভয়ানক পরিণতিতে কী হয়েছে জানো, এ দেশে বুদ্ধিজীবী সমাজ তৈরি হয় নাই। জন্ম হয়েছে কতগুলো কল্পলেখকের। যারা সামাজের নাকে খত দিয়ে ঘুরায় আর বলে, বল, আমার কথা শুনবি কিনা? কারণ বুদ্ধিজীবীরা সব মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, অধ্যাপক- যারা প্রথম শ্রেণীর একটা ক্লাস মেইনটেইন করে চলে। লেখা লিখে তাদের অর্থের প্রয়োজন হয় না। এখানেই যত গলদ। গোলমালের শুরু এখানেই। লেখাটা শখের বসে লেখে, জীবনের তাগিদে না। তারা প্রবন্ধের নামে ফিকশন লেখে। তারা না জানে কৃষকের ঘরের কথা, না জানে শ্রমিকের হাড়ির খরব– তাদের জানার প্রয়োজনও নেই। বছরের অর্ধেক সময় বিদেশে ছেলে-মেয়েদের কাছে কাটায় আর ছ মাস এদেশে ইউরোপীয় রুচির চর্চা করে বুদ্ধিবৃত্তি ফলায়। জাস্ট ফেলাসি! বুদ্ধিজীবীনামী এ সব মনগড়া ফিকশন রাইটারদের আমি ঘৃণা করি।’
রুদ্রের কথায় পিটার এতোটা ক্ষেপে গেল যে, তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল। সে মাংসের বস্তা থেকে ষাড়ের মতো সিং বাগিয়ে রুদ্রের উপর ঝাপিয়ে পড়ার উপক্রম হলো। ভাবখান এমন যে, এর সবই তাকে উদ্দেশ্য করে বলা, যেহেতু তার কথা প্রসঙ্গে এসেছে। কিন্তু পিটারকে সে সুযোগ দিল না সাহানা সাথী। সময় মতো পাশ থেকে পিটারের ঠাণ্ডা আগুনে জল ঢেলে দিল সে।
পূব দিকে পিটারের পাশে, ঝিলিকের মুখোমুখি বসেছে শাহানা সাথি। শিল্পপতির বৌ। ছোটবেলা থেকে স্কুল, কলেজ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ। শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে নিজের একটি আত্মিক টান বোধ করে। তাই চলে আসে এখানে। বাহারি শাড়ি, লাল লিপস্টি দেয়া ঠোটে মিচকি হাসি ফুটিয়ে একদিকে চুপ করে বসে থাকে। ফাকেফুকে সবাইকে চায়ের, ছোলার ওফার করে। পরিস্থিতি উৎতপ্ত বুঝে সে তার চায়ের ওফারটা করে ফেলল।
‘কে কী খাবেন?’
‘আমি কিছু খাব না।’ আপন সাথীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল।
‘সবাইকে ছোলা দাও মিন্টু, তারপর চা। আপন ভাই খাবে না, একটা কম দিও ছোলা।’ সাথী বেয়ারাকে ডেকে বলে দিল।
যদিও সবার মতো আপনেরও মন চাচ্ছিল ছোলাটা খায়। কিন্তু নিজের বিশিষ্টতা জাহির করতে এ আপনের পুরনো পদ্ধতি। এ তার গোপন মনবৃত্তি। এমন মনবৃত্তি, যা পরিতৃপ্তির পথ না পেয়ে, এমন সব পথে বেরিয়ে পড়ে, যা তার নিজের জন্য খুব স্বস্তিদায়ক নয়।
সবাই ছোলা চিবোচ্ছে। আপন তার ভেতর বসে সন্তর্পনে মুখের জমা লালা গিলতে লাগল। সেটাতে সে এতো দক্ষ যে, মাঝে মাঝে ঢুক গেলার সময় নড়েচড়ে বসল। ফাকে গিলে ফেলল ঢুক। এমন নির্লোভ ভাব মুখে ফুটিয়ে সে ঢুক গেলে যে বিশ্বাসই হবে না, সে এমন এক সাংঘাতিক সংকটের সঙ্গে যুদ্ধরত।
এবার চা-পর্ব। আপন আর না করল না এ পর্বে। বরং স্বোৎসাহে সায় দিল। তবে ব্যাতিক্রম হিসেবে সে মিন্টুকে বলল, ‘আমারটা লাল চা, চিনি কম।’ এটাও তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। কারণ কে না জানে, খালি লিকারের চা আপনের কাছে জঘন্য লাগে। তবু তাই সে বলবে এবং বললও তাই।
চায়ের কাপে ধোয়া তুলে চলল রাষ্ট্র, রাজনীতি উদ্ধারের কাজ। এক্ষেত্রে কাউকে সৎ ভাবার কোন কারণ নেই। সকলেই নিজের মনের উল্টো পথে চলল, উল্টো কথা পাড়ল। কারণ কারো ধরে যেহেতু দুটো মাথা নেই। ধর্ষণ, বাক-স্বাধীনতা, খুন, হামলা, মাললার প্রসঙ্গ ধরে যখন আলোচনার প্রবাহ বিপদ-সীমার উপর প্রবাহিত হতে চলল, লাল বাতি জ্বলে উঠল সকলের মস্তিস্কে আর বাজতে লাগল সাইরেন। কী এক অদ্ভুত অটোসেন্সরে সবাই নীরব হয়ে গেল। কিন্তু নীরবতা যেহেতু আরো ভয়ানক। তাই প্রসঙ্গ ঘুরে গেলো আন্তর্জাতিক রাজনীতির দিকে। সবচেয়ে নিরাপদ প্রসঙ্গ। ইতোমধ্যে আপন তার চায়ের কাপে বেশি করে ঠোঁট ডুবিয়ে মুখে নিচ্ছে তার অল্পই। পিটার তার যুদ্ধংদেহিভাব ছোলার সঙ্গে সম্ভবত গলাধঃকরণ করে ফেলেছে।
ফলে রুদ্রকে সর্বোচ্চ নীরাপদে তার ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিয়ে কথা বলে যেতে কোন বাঁধার মুখোমুখি হতে হল না। যথাবিহিত তার সিরিয়াসনেস বজায় রেখে (ছোলা খাওয়ার সময় যা কিছুক্ষণের জন্য জেনারেল হয়ে গিয়েছিল ছিল) পিটারের প্রসঙ্গ টেনে রুদ্র বলল, ‘পিটার রাগ করো না। ও আমি তোমাকে বলিনি। বলেছি সমাগ্রিক অর্থে।’
‘হয়েছে, হয়েছে। আর বুঝাতে হবে না। ওতটুকু বুঝার ক্ষমতা এ ঘটে আছে, স্লা।’ পিটার এই বলে চুপ করে গেল।
কেউ কোনো কথা বলছে না বলে, রুদ্র আবার তার কথায় ফিরে এলো। সে তার হাতের ছাইরঙের রোলেক্সের ঘড়িটায় শব্দ তুলে বলল, ‘ঠিক না। এসব একদম ঠিক না। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমি বুক ফেটে মরে যাই। শুধু একটি উদাহরণ দিয়ে আমি বলতে চাই’, কথা বলতে বলতে রুদ্র এতো উত্তেজিত হয়ে পড়ল তাকে একটু থামতে হল শ্বাস নেয়ার জন্য–
‘আমি শুধু একটা উদাহরণ দিব। ক্রিমিয়া এই সেদিন স্বাধীন হল ইউক্রেন থেকে। বয়স হিসেবে আমাদের দেশের নাতির বয়সী। সেখানকার প্রাইমমিনিস্টার এই কিছুদিন হল পদত্যাগ করেছেন। কেন? রাষ্ট্রপতি নিয়ে তার একটি ফোনালাপ প্রকাশ পেয়েছে। প্রাইমিনিস্টারকে সেখানে বলতে শোনা যায়, তিনি কাউকে বলছেন, আমারদের প্রেসিডেন্ট দেশের অর্থনীতি ভালো বুঝেন না। আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে তাই না? এইটুকু কথার জেরে কেউ প্রাধনমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিতে পারে? এ তো কাল্পনিক গল্প! কিন্তু সত্যি হচ্ছে এটিই। একে বলে মর্যাদাবোধ, আত্মসম্মান। আমাদের শাসক হলে, তা আর না বলি। শাসকের মনভাব কার অজানা–আমাকে প্রাণে মারো অথবা গোটা জাতি রসতলে যাক তবু ভাই গদি ছাড়ব না।’
‘আহা, কী প্রেম! মরেঙ্গে হাম চেয়ারো পর, ক্ষমতা হোগা কাফন আপনার। আবার কবিও তো তিনি! কেয়া বাত, কেয়া বাত।’ পাশ থেকে ফোড়ন কাটল আলাওল।
‘শাসক না বলে, বলো তোষক।’ পিটার তার হাতের নিশপিশ করা পিনটা না ফুটিয়ে থাকবে কেন? সে ফোড়ল কাটল, ‘জাতিকে করে করে মুর্দফরাসে শুইয়ে দিছে।’
এই যে আড্ডা চলছে। কেউ অফিসের কেরানি, কেউ দ্বিতীয় শ্রেণী অথবা প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। কেউ হয়তো এখনও বাবার হোটেলে খায়, ঢাকায় বাড়ি আছে। কেউ বেকার, চাকরির জন্য জুতার শুকতলা উজাড় করে দিয়েও কিছু করতে পারছে না। কেউ নারীর প্রত্যঙ্গ পরিমাপক যন্ত্রমাত্র। কিন্তু বিকেল হলে সবাই চলে আসবে এখানে। রাতদুপুর পর্যন্ত চলবে আড্ডা। নানা ধরণের গাল-গল্পসহ চলবে জাতি উদ্ধারের কাজ। তারপর সব পাখি ঘরে ফেরে। যার যার ঘরে ফিরে যাবে সবাই।
আড্ডা শেষে আপনের বাড়ি ফিরতে মন চাইল না। কেন যেন মনে হল ঘরটায় কেউ তুখোড় জাপানি ওয়ালতার পিপি বাগিয়ে উত পেতে বসে আছে আর সে খবর আপনের কানে উঠেছে। এবার ঘরে গেলেই শেষ করে দেয়া হবে। বাসায় ফেলে আসা লেখার কথা মনে হতে এমন আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসল তাকে। বাসার দিকে না গিয়ে শাহবাগের দিকে পা বাড়াল। কোনদিকে যাচ্ছে, প্রথমে সেটা তার খেয়াল হয়নি। কিন্তু মোল্লার দৌড় মসজিদ আর কবির দৌড় শাহবাগ–এতো প্রবাদে দাঁড়িয়ে গেছে। অগত্যা বাসায় না গিয়ে শাহবাগের দিকে যে আপনের পা চলতে থাকবে তা আর বিচিত্র কি!
রাস্তার ফুটপাথের উপর মানুষ, ফেরিওয়ালা, কখনো-সখনো মোটর সাইকেলের ঝক্কি-ঝামেলা, ঠেলাগুতো খেয়ে আপন হাটছে। রাস্তার জ্যাম, ধুলো, হর্ন, চিৎকার, ঝগড়া–সব কিছুর ভেতর দিয়ে পূর্ণ একজন নিঃসঙ্গ মানুষ হেটে যাচ্ছে। এ সবের কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। তার মন-মস্তিস্ক জুড়ে একটি জট– লেখা শুরু করে কেন শেষ করা যায় না?
এই যেমন কয়দিন আগে একটা দীর্ঘ গল্প লিখতে বসেছে। কিছু দূর কলম চলল। চলল বললে ভুল হবে, সানন্দে চলল। বরং গল্পের বয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কলম চলতে হিমশিম খাচ্ছিল। চিন্তার গতি এতো বেগবান যে, কলম তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না। এক সময় অবশ হয়ে এলো হাত। চোখ মুদে এলো ক্লান্তিতে। নাছোড় চিন্তার গতি যেন ততধিন বেগবান হতে লাগল। নীল জিপগাড়ির মতো ওড়ে চলছে। যেন টানা লিখে শেষ করে ফেলা যেত। ক্লান্তি তাকে কখন গ্রাস করল সে নিজেও বলতে পারবে না। ঘুমের অতলে হারিয়ে মেঘের উপর ভাসতে লাগল আপন। এভাবে লেখার বাকিটুকু আগামীকালের জন্য রয়ে গেল।
সচরাচর সবাই তো এভাবেই লেখে। নয় তো হাজার হাজার পৃষ্ঠার বই তো আর এক বসায় লেখা সম্ভব না। এইসব ক্ষেত্রে আপনের দেখা দেয় যত বিড়ম্বনা। শেষ নেই তার। সেদিন যেমন হলো, গতকালের ছাড়া লেখাটা আজ কিছুতেই উঠছে না। আগাতে চাচ্ছে না। এমনভাবে শেকড়-বাকড় গজিয়ে বসেছে যে, আগের দিনের জায়গা থেকে তাকে বল্ডুজার দিয়েও টেনে তুলার জো নেই। অথচ গতকাল লেখাটা সে ছেড়েছিল শুধুমাত্র ক্লান্তিবসত। সেই গতিময় লেখাটা গতকালের জায়গায় এমনই শেকড়-বাকড় গাজিয়ে বসেছে যে, তাকে চলানো আর মৃত গাধাকে হাটানো প্রায় সমান কথা। এমন হয় কেন?
পরিবাগের ওভার ব্রিজ ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল আপন। সাকুরার নামনে দেখল দুটো কুত্তা-কুত্তি ঠোঁট চাটাচাটি করছে। নিয়নের হাল্কা আলো-আধাঁরিতে কুকুর দুটোকে দেখে নিমেষে তার মনের খেয়ালে চলে এলো– ‘এই জন্য।’
‘কোন জন্য?’ নিজের অন্যমনস্কতায় সে নিজেই অবাক হয়ে গেলো। এতে সে এতোই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ল যে, একটু এগিয়ে ডানের গালিতে ঢুকতেই দেখা গেল একজন শাড়ি পরা ভদ্রমহিলা রাস্তায় পড়ে আছে। অচেতন। কতগুলো লোক তার চারপাশে দাঁড়িয়ে কী সব বলাবলি করছে। আপন এ দৃশ্য অতিক্রম করে চলে এলো। থামল না।
শাহবাগ ছাড়িয়ে চারুকলার সামনে এসে কী মনে হতে আপন ফিরতি পথে বাসার পথ ধরল। রিক্সার চাক্কা পাংচারের শব্দে তার টনক নড়ল। এতক্ষণ সে কিসে ডুবে ছিল নিজেও বলতে পারবে না।
হয়তো কোন চিন্তা-ই সে করেনি কিংবা লেখা যে একটা জীবন্ত জিনিস তাই নিয়ে ভাবছিল আর বিস্মিত হচ্ছিল। চাক্কা পাংচার হওয়ার বিকট শব্দে আপন লক্ষ করল, একশ বিশ কেজি ওজনের এক ভদ্রমহিলা ধপ করে রিক্সা থেকে মাটিতে পা ফেলল। আপনের মনে হলো, তার পায়ের গুতোতে মাটি দুলে উঠল। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া না চুকিয়ে হাটতে লেগে গেল ভদ্রমহিলা। মধ্য বয়স্ক রিক্সাওয়ালা পেছন থেকে মার খাওয়া কুকুরের মতো ‘কেউকেউ’ করতে লাগল। তার কথায় কান না দিয়ে মহিলা সোজা টিএসসির দিকে হাটছে। এ যেন চিরায়ত এমন এক দৃশ্য, মানুষের হৃদয়ে যা পাথর বেঁধে দিয়েছিল। রিক্সাওয়ালার আর্তনাদ আপনের কাছে পাখিদের কলতানের মতোই দুর্বোদ্ধ মনে হয়। পানিতে পড়া সূর্যালোকের প্রতিবিম্বের মতো অধরা। সে ঘরে ফেরার তাড়না বোধ করল। টিএসসিতে না গিয়ে আপন ফিরে এলো আপনালয়ে, নিজের নরকে।
ফিরতি পথে আপন হাটছে কিন্তু, করোটিতে তার কোন চিন্তা খেলছে না। এমনকি লেখার চিন্তাও না। ফাগুনের আগুনরাঙা নিরর্থ আকাশের মতো ফাঁকা করোটি। তবে এমন মনোযোগের সঙ্গে হাটছে যে, মনে হবে সে কোন চিন্তার গভীরে বৈঠা মারছে আর ছলাৎ করে তার ছিটে মানুষের চোখে-মুখে এসে লাগছে। এ এমন এক অবস্থা কেউ দেখলে জিজ্ঞেস করবে: কী অতো ভাবছ?’ অথচ মাথাটা তখন বোরধান কাটা ধু-ধু মাঠ ছাড়া আর কিছু না।
সাকুরার সামনে এসে সে-সময় যে অবস্থায় ভদ্রমহিলাকে গলির মুখে পড়ে থাকতে দেখেছিল আপন, সেখানে তাকে সেভাবে পড়ে থাকতে দেখা গেল। কিন্তু তাকে ঘিরে যে লোকগুলো ছিল তাদের কউকে দেখা গেল না। পিজি হাসপাতালের উন্নয়নের কাজ চলছে। কর্ম বিরতির রাতে বড় বড় ক্রেনের মাথায় জ্বলছে লাইট। সেই আলোয় ভদ্রমহিলার মুখটা বুঝি দেখতে পেল আপন। কপালে একটা লাল টিপ।
চলতে চলতে আপনের কেমন যেন অস্বস্তি হল। রাস্তায় পড়ে থাকা ভদ্রমহিলার কপালের লাল টিপটা হঠাৎ করে মনে হয় গুলিবিদ্ধ ফুটো।
পরদিন সংবাদপত্রের পাতায় খবরে এলো, পরিবাগ এলাকায় একজন নারী গণধর্ষণের শিকার। ভদ্রমহিলা ঢামেকে ভর্তি। তার চেতনা নেই। আশঙ্কাজনক অবস্থা বলে জানিয়েছে দায়িত্বরত চিকিৎসক। তার কাছে পরিচয়পত্র অথবা পরিচয়ের কোন সূত্র পাওয়া যায়নি। বেনামা দশ জনের নামে মামলা হয়েছে শাহবাগ থানায়। পুলিশ বলেছে, আসামিদের ধরতে চেষ্টা চলছে। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হবে। তার পরিচিত কেউ থাকলে যোগযোগ করুন।
আপন চুপ করে কিছু সময় বসে থাকল। স্তব্ধ, বজ্রাহত এসব বাগাড়ম্বর শব্দ দিয়ে আসলে আপনকে এখন বুঝা যাবে না। সম্ভবত সে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল, বোবা-কালা কেমন একটা অবুভূতি তার হলো, যা আসলে যে কেমন পুরোপুরি ব্যাখ্যা করে বলা যায় না। শীতের দিনের শুষ্ক চেটচেটে হাত-পার মতোন, নাকে একটু ব্যথা হবার মতোন। এ সময়, ঠিক এই সময়ই আপনের মাথায় হঠাৎ খেলে গেলো, এ নিয়ে গল্প লেখা যেতে পারে। গল্পটা কেমন হতে পারে? তাও চট করে তার মাথায় খেলে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে লেখাটা নিয়ে সে ভাবনা-চিন্তায় লেগে গেলো।
গল্পটা এমন হতে পারে– এক লোক বাসা থেকে বেরিয়ে দেখবে একজন ভদ্রমহিলা রাস্তার পাশে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। সময় আনুমানিক রাত বারোটা। ভদ্রমহিলার পায়ের কাছে একটা কুকুর বসে আছে। (কুকুটা দিয়ে গল্পটার মোড় অন্যদিকে ঘোরানো যায়। যেমন কুকুটা ভদ্রমহিলাটাকে রক্ষা করবে। ধর্ষকদের কামড়ে বিচি কেটে নিবে। কিন্তু গল্পটি যে তেমন হচ্ছে না তা তো দেখা যাচ্ছে।) তাহলে কেমন হবে?
ভদ্রমহিলা রাস্তায় পড়ে আছে। পায়ের কাছে কোনো কুকুর নেই। জায়গাটার কিছুটা দূরত্বে একটা বাসার পুরনো বন্ধ গেইট। বাগাল বিলাশে ছাওয়া। অন্ধকার। তাতে তিন-চারটা কালো ব্লেজার পড়া গুয়ার টাইপ ছায়া সিগারেট ফুকছে।
ভদ্রমহিলাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে লোকটা একবার ভাবে তার কি করার থাকতে পারে? কিছু করার আছে কি-না পড়ে থাকা ভদ্রমহিলার জন্য? কিন্তু ঠিক কী করার থাকতে পারে তা সে সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় ঠাহর করে উঠতে পারে না। না হয় কথাটা ভাবতে ভাবতে লোকটা না দাঁড়িয়ে হাঁটতে থাকবে কেন?
ইতোমধ্যে সে অচেতন মানুষটির কাছ থেকে অনেকটা দূরত্বে চলে গিয়েছে। বলা যায় নিরাপদ দূরত্বে। হাটার গতি না থামানোর ফলে ইতোমধ্যে সে আরও দূরে চলে গেলো। এখানে অচেতন পড়ে আছেন অজ্ঞাতপরিচয়ের এক নারী। লোকটা সেখান থেকে এখন অনেক অনেক দূরে, নাগালের বাইরে।
যে দূরত্বে সে ইতোমধ্যে চলে এসেছে, সে দুরত্ব ঘুচিয়ে অচেতন মহিলার কাছে ফেরা তার পক্ষে কোনদিনই সম্ভব হবে না। কেন সম্ভব না? সে অনেক কারণ হতে পারে। লোকটা ভীতু, স্বার্থপর, বদমাশ, জানুয়ার অথবা লোকটা আসলে এসবের কিছুই না। সে একটা সাধারণ লোক, যে একটা অন্ধকারের মধ্যে এমন একটা ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চায় নি, যাতে হয়তো তার কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারত! হতে পারে লোকটার মা হাসপাতালে মারা গিয়ে থাকবে, সেখানে সে যাচ্ছে। পতিতালয়ে যে যাচ্ছে না তাই-বা বলছি কি করে! কথাটা হচ্ছে লোকটা চলে গেছে আর অচেতন মানুষটি এখানে পড়ে আছে।
পরদিন পত্রিকা পড়তে গিয়ে এক জায়গায় তার চোখ আটকে যায়। লক্ষ করে, তার এলাকায় এক লোমহর্ষক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ভদ্রমহিলা দুই সন্তানের মা। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। ধর্ষিতার স্বামী একজন ব্যাংকার। তিনি নিজে একটা সঙ্গীত স্কুলের মাস্টার। কিংবা হতে পারে ভদ্র মহিলা অজ্ঞাতনামা। তাকে আইডেন্টিফাই করার মতো কোন সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। কিংবা সে ছিল খুব দুখী একজন মানুষ, যিনি পেইন্টিং করেতেন। যা কিছু হতে পারে। অর্থাৎ ভদ্রমহিলা খুব দরদি চেহারার আর সুন্দরী। বয়স চল্লিশ ছুঁইছুঁই। এখনও তার বিয়ে হয়নি। সে এমন একটা রোগে আক্রান্ত, ধীরে ধীরে সে অন্ধ হয়ে যাবে। এই তার নিয়তি। মোটা লেন্সের চশমা পরত। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ফুটপাত আর রাস্তা আলাদা না করতে পেরে পড়ে গিয়েছে রাস্তার পাশে। পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে থাকবে।
সংবাদটা পড়ার পর লোকটার মধ্যে হঠাৎ একটা পরিপর্তন লক্ষ করা যায়। কেমন যেন খটকা লাগতে থাকে তার চিন্তায়। এক ধরণের খটমট আরকি। পথ, মানুষ, বাড়ি, গাড়ি, ফুটপাত– সব কেমন অপ্রকৃতিস্থ, অপ্রতিস্থাপিত বলে বোধ হয়। প্রথমে তার মনে হয়, বড় মগবাজরের মতো জায়গা, (যে এলাকায় সে প্রায় তিন বছর হল আছে। কিন্তু কোনদিন এমন প্রশ্ন মনে জাগেনি।) সেখানে কেন একটা ওভার ব্রিজ নেই? কিন্তু যেভাবে ফ্লাইওয়ার করা, যেন এদেশের মানুষের প্রত্যেকের একটা করে গাড়ি আছে, তাতে তো ফুটওভার ব্রিজ থাকার প্রশ্নই আসে না। তবে এই যানবাহন চলতি পথে এভাবে যে শত শত মানুষ পাড় হচ্ছে, সেখানে তো এক্সিডেন্টটা একটা স্বস্তা, সাভাবিক ব্যাপার। স্বাভাবিক? সে কি! নয়? তাহলে তো ওভার ব্রিজ থাকত। ফ্লাইওভারের কারণে তা না হয় না– হলো আন্ডারপাস হত।
রাস্তায় চলা মানুষদের দেখে মনে হয়, সবাই যেন উর্ধ্বশ্বাস ছুটছে বাসের তলে। কে আগে যাবে তা নিয়ে এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা! মগবাজারটায় এক সময় থাকত মগরা। অদ্ভুত লাগে লোকটার। মগের মুলুক!
কিন্তু অচেতন ভদ্রমহিলার চিন্তা লোকটা কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারে না। এ চিন্তা থেকে রেহাই পেতে, সে নানা ধরণের উদ্ভট চিন্তায় আত্মমগ্ন হতে চেষ্টা করে। ঐ যেমন মগবাজার মোড়ে কেন পারাপারের ব্যাবস্থা নেই? বেছে বেছে যখন দেশে কৃষকরা পেঁয়াজ তুলছে, তখনই কেন বাইরে থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে? কিংবা অনেক অনেক আগে একবার ইউরোপে যখন পেঁয়াজ নিয়ে সংকট দেখা দিল, তখন জার্মানরা কী করল? গুন্টার গ্রাস বোধহয় কেবল এর সংকটটা বলেছিলেন? ইত্যাদি।
কিন্তু ঘুরে ফিরে অচেতন পড়ে থাকা মহিলাটির কথা-ই তার মনে আসে। তার হাত, নাক, জুতোসুদ্ধ পা, সরে যাওয়া কাপড়ের ফাকে পেট, নাভি– স্যাললয়েডের ফিতার মতো সেসব ঘুরে ঘুরে লোকটার চোখে ভাসে।
এমন অদ্ভুত সময়ের মধ্য দিয়ে সে দিন পাড় করতে থাকে। ক্রমেই লোকটা সেই চিন্তার কাছে পরাজয় মানতে থাকে, যা গত সাতদিন আগে ঘটেছিল আর তার পর দিন সংবাদপত্রে খবর হিসেবে ছেপেছিল। সেই অচেতন হাত, হাতের অনামিকায় একটা আংটি। কোথাকার আলোয় যা লোকটার চোখে একবার চমকে উঠেছিল। নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে। বিভ্রান্তবোধ করে লোকটা।
এ সময় হঠাৎ সে খেয়াল করে অবাক হয়ে যায়, কে যেন তাকে অনুসরণ করছে। লোকটার মনে হয়, পায়ে পায়ে যে তাকে বাংলামোটর থেকে অনুসরণ করে মাগবাজারের কাছাকাছি চলে এসেছে। এ খেয়াল হতে পেছন ফিরতে প্রথম প্রথম লোকটার একটু ইতস্তত লাগে। তারপর পিছন ফিরে। কিন্তু কউকে দেখতে পায় না। কেউ নেই পেছনে। দূর পেছনে ফেলে আসা ডাস্টবিনটার ছায়ায় কুকুন না ভালুকের একটা কায়া নড়াচড়া করেছে। বাকি সব নিয়নের আলোর মরু। কোন জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। পেছনের সব ভালো করে দেখে নিয়ে নিঃসংশয় হয়ে আবার হাটতে শুরু করে।
‘কেউ নেই তাহলে কে অনুসরণ করছে?’ চিন্তাটা মাথায় একবার বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে যায়। কিন্তু কিছু দূর গেলে আবার তার মনে হতে থাকে কেউ তাকে অনুসরণ করছে। এই যে পা ঘষ্টানোর শব্দ! কি মনে করে লোকটা পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। মনে হয়, শব্দ আরো কাছে চলে এসেছে। এবার তার জুতায় পাড়া দিবার জন্য গায়ের খুব কাছাকাছি। এই দিল বলে! হঠাৎ আবার লোকটা পেছন ফেরে, না কেউ না; আবার, হঠাৎ ফেরে: কেউ না।
‘এই কে তুমি, অশরীরিরী, সাহস থাকে তো সামনে আসো?’ কথাটা কেমন করে লোকটার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল। যেন কেউ বলিয়ে নিল। বাচ্চার হাত ফসকা মারবেলের মতো গড়িয়ে পড়ে চারদিকে ছরিয়ে গেল। নিজের কথায় নিজেই অবাক হয়ে গেল লোকটা। বিপরীত দিক থেকে আসা একটা খালি রিক্সার টুংটাং শব্দে লোকটার সম্ভিৎ ফিরল। ‘কী নিয়ে ভাবছি এ সব!’–বিরক্তিতে তার মুখ বেঁকে গেলো।
লোকটার হঠাৎ খেয়া হলো, এ সব আসলে আর কিছু না। নিজের মনেরই কষ্টকল্পিত ব্যাপার, ‘আমিই যেন অবচেতনে কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে কান পাতছি। আসলে পাও নেই, আওয়াজও নেই। সত্য হলো, আমিই যেন কারো জন্য, কারো পায়ের আওয়াজ পাওয়ার জন্য অমন মুখিয়ে ওঠেছি যে, এতো প্রবল সে প্রত্যাশার শক্তি, সেই শক্তিই ঐ লোকটাকে সৃষ্টি করেছে। শুধু সৃষ্টিই করে থামেনি, এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে যা আমার পায়ের খুব কাছাকাছি। যার স্পর্শের আশঙ্কায় আমি অমন গুটিয়ে যাচ্ছি।’
মগবাজার মোড়টায় এলে ক্ষুধার্ত পেটের কুকুরটার কেউকেউ-এ তার মনে পড়ল, সারাদিন না খাওয়া সে। খেতে হবে হোটেলে। বাসায় দিন পরেন হল বুয়া আসে না।
মগবাজার মোড়ের একটা ভুতোড়ে রেস্টুরেন্টে লোকটা গিয়ে ঢুকল। ভূতুড়ে এই অর্থে, ভেতরে আলো কম আর সাইনবোর্ডের এককোনে একটা লাইট টিপটপ নিবছে-জ্বলছে। নামটা ধুলা-ময়লায় অদৃশ্য।
হোটেলে গেলে যা হয়, বেয়ারা এসে খুব আপ্যায়ন করতে থাকে। হাত ধুয়ার পর টিস্যু বাড়িয়ে দেবে। দ্রুত পানি দেবে। পরিষ্কার থাকার পরও টেবিলটা বারবার মুছতে থাকবে আর বিনয়ে ভেঙে পড়েবে। বলবে, ‘বস, কী দিব?’ এরপর সে তার পুরনো রেকর্ডার চালিয়ে দিবে, জানিয়ে যাবে পচিশ-ত্রিশটা মেনু। আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না। তবে বিল দিতে গিয়ে দেখা গেলো মানিব্যাগে যে টাকা আছে বিল তার থেকে দু’টাকা বেশি। বেয়ারাকে বকশিস তো দূরে থাক, হোটেল বিল তাকে দু টাকা কম দিয়ে বেরুতে হল।
হোটেল থেকে বেরিয়ে আসার সময় সে শুনল, বেয়ারাটা তার সহযোগীকে বলছে, ততটুকু আওয়াজে যাতে লোকটা শুনতে পায়, ‘ছেচড়া আর কারে কইছে! মানিব্যাগে টাকা থাকতেও মিথ্যা কতাছে। তাও দুইটাকা কম দেওনের লাইগ্যা। মোজা-ছেচড়া!’
কথাটা কানে যেতেই বাইরে এসে তড়িৎ হাতে মানিব্যাগ খুলল লোকটা। খুলে সত্যি সে অবাক হয়ে গেলো। সত্যি সত্যি মানিব্যাগে টাকা! এই যে তিনটা একশ টাকার নোট। দুদিন চলার মতো। ওমা, এ দেখি আরও, একটা পাঁচশ টাকার নোট– আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এলো লোকটার মুখ থেকে। সে এই ঘটনায় এতোটাই অভিভূত যে, এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না। কোন ব্যাখ্যা দাঁড় করাবার চেষ্টাও করল না।
কিন্তু পথে বেরুতে সেই পূর্বচিন্তা ধেয়ে আসার আগেই সে টাকা কোথা থেকে এলো সে চিন্তায় ডুব দিতে চাইল। ভুলে থাকতে চাইল সেই ভয়াবহ চিন্তা, যা এই ক’দিন ধরে তাকে অক্টোপাসের পাশের মতো চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। অবশ্য এখনও টাকাটা যে কোথা থেকে এলো বা হোটেলে থাকতে ছিলই-বা কোথায় তার কোনো ব্যাখ্যাই দাঁড় করাতে পারল না সে। হয়তো মানিব্যাগে টাকাগুলো জন্মেছে– লোকটা ভাবল। এ উত্তরে তবু সে সন্তুষ্ট হতে পারল না চাইল না।
তার কথা হলো, টাকাটা যেহেতু ছিলই, তাহলে হোটেলে থাকতে তার চোখে পড় না কেন? হোটেলে কেন সে দেখতে পেল না। তখন কি সে মানিব্যাগ আতিপাতি করে খুঁজে দেখেনি? কিন্তু তাও মনে করতে পারল না সে। তাছাড়া ধরলাম তিনশ টাকা না হয় ছিল, কিন্তু পাঁচশ টাকাটা কোথা থেকে এলো! কিছুতেই কিছু মিলছে না যেন। নিশ্চিত ঐ তিনশ টাকা থেকে জন্মেছে! এসব অদ্ভুতুড়ে ভাবনা-চিন্তায় তালগোল পাকিয়ে লোকটা তার বাসার সামনে এসে হাজির হল।
আপাতত এখন যে সমস্যায় পড়া গেলো তা যেন উত্থান রহিত। কিছুতেই বাসার তালা খুলছে না। তালায় চাবি ঢুকছে না। কিছুতেই তালা খুলতে না পেরে রেগেমেগে আগুন হয়ে গেলো লোকটা। গায়ের সব শক্তি দিয়ে দরজায় এক লাথি ঝেড়ে দিল। স্টিলের দরজায় তাতে বোমা ফাটার মতো শব্দ হল। ঘেমেনেয়ে একাকার শরীরটা নিয়ে এমনিতেই ত্যক্তবিরক্ত, তার মধ্যে এই সমস্যা। কপাল থেকে চোয়াল বেয়ে থুতনিতে এসে ঘাম ঝুলছে, কোনো ফোটা নিচে পড়ছে, কোনটা গেঞ্জির ফাক গলে ছার পোকার মতো একটা অনুভূতি জাগিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। ফলে মেজাজ আরো খিচড়ে গেলো। দিল আরেক লাথি কষিয়ে। এ লাথি আগের দুটোর সমানানুপাত শব্দ করল।
নিচেই থাকেন বাড়িওয়ালা। সে এই ভয়ানক শব্দের উৎসের কাছে নিচ থেকে প্রায় উড়ে উড়ে চলে এলেন।
‘কী কী? বলি কী হয়েছে?’ তাকে দেখে মনে হবে, হঠাৎ করে কেউ বুঝি বাড়িওয়ালা কলিজার গোড়ায় পেরেট ঠুকে দিয়েছে। সেইভাবে সে ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলেন।
: তালা খুলছে না।
লোকটা যত পারা যায় মুখ গম্ভীর করে বাড়িওয়ালার কথার উত্তর দিল।
: তালা খুলছে না বলে আমার দরজার উপর রাগ ঝাড়া! দুই টাকার তালা….আর, আর তারা খুলবে কেন শুনি। বলি চোখের মাথা খেয়েছো। পয়সা দিয়ে কোনদিন তালা খোলে। শুনেছ বাপের জন্মে!
বৃদ্ধ বাড়িওয়ালা রাগে কাঁপতে লাগলেন।
বাড়িওয়ালার কথায় লোকটা যেন এবার চন্দ্রনাথের চূড়া থেকে আচমকা পা হড়কে পড়ে গেলো। এতোটাই হতবাক হয়ে গেল নিজর কাজে, কিছুক্ষণ কোন কথা সরল না মুখে। শুনতেও পেল না কিছু। বলে কী! অবাক হওয়ারও শক্তি লোপ পেল বোধ হয়, যখন সত্যি দেখল হাতে তার চাবি না, দুই টাকার কয়েন। তবে বাড়িওয়ালার সামনে সে চমকটা সহসাই কাটিয়ে উঠার প্রয়াস পেল।
নিজের ভুল বুঝে লোকটা নিজেকে সামলে নিল। কারণ শত হলেও সে বাড়িওয়ালা। তার সামনে এমন পরাজয় মানে হলো, বাড়িওয়ালার সামনে সব সময় নাকে ক্ষত দিয়ে থাকা।
বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটিয়া সম্পর্ক হলো রশির ওমাথা-ওমাথার মতো। দু দিক থেকেই দুজন টানছে, যে পড়েছে ওমনি পাছায় লাথি। অদ্ভুত এ সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যা প্রয়োজন তা হলো– ভাড়া। সময় মতো ভাড়া দিয়েছো, পৃথিবী সুন্দর। দিতে পারোনি, নরকে যাও। কিন্তু যতদিন আছো, ততদিন বাড়িওয়ালার কাছে যদি কোন কারণে নত হয়েছো তো ভোগান্তির এক শেষ, পেয়ে বসবে তোমাকে। এটা-ওটা উপদেশ আদেশ খেতে হবে। ব্যাচেলর হলে তো কথাই নাই। চাই কি অভিভাবক হয়ে বসবে। এমনকি ফাই-ফরমায়েশ করার ধান্দায় থাকবে : তুমি তো আমার ছেলের মতো, কারেন্টের বিলটা একটু দিয়ে এসো তো বা অমন কিছু করাবার মতলব ভাজবে। তাই বলে ভাড়া দেরি করে দিলে চলবে না কিন্তু।
শহরের প্রতিটি ভাড়াটিয়ার কপালে বাসা আর ভাড়া– এ যেন নিয়তির পাল্লার মতো ঝুলে। পাল্লার কোন একটা এদিক থেকে ওদিক হয়েছে তো গাড্ডায় পড়া শেষ। সে পাঁকে পড়ে এমন পঙ্কিলতায় জড়িয়ে যাবেন যে হয়রানির একশেষ করে ছাড়বে। তাই এ দাঁড়িপল্লাটা ঠিক রাখা খুব জরুরি। ভাড়া ঠিক তো পেরেকে দেয়াল আহত করেও পার পাওয়া যেতে পারে। এ পাল্লা ঠিক না থাকলে তাহলে আর দেখতে হচ্ছে না। আমাদের গল্পের এই লোকটার মতো অবস্থা হবে। নানা ছলা-কলার আশ্রয়ে মধুর সম্পর্কটি টিকিয়ে রাখা আরকি। লোকটা যখন দেখল, ভালো রকম গাড্ডায় পড়া গেছে। সে প্যান্টের পকেট থেকে, এতক্ষণ যা ভরা ছিল, বা-হাতটা বের করে বলল–
: আজ দু’দিন হল গোছল না। কার মাথা ঠিক থাকে। মটর নষ্ট হয়ে আছে। ঠিক করেন না! ভাড়ার বেলায় তো দশ তারিখ, এহ! মামাবাড়ির আবদার।
: হ্যা হ্যা, গল্প করো না। দেখা আছে। ভালো না লাগে তো চলে যাও না কেন?
: বাড়ি আপনার বলে তাই সব সময় বড়কথা শুনতে হবে নাকি আপার!
: আমি না, অত বড় বড় কথা শুনালে তো তুমিই। একরুম নিয়া থাক, তার উপর অত বড় একটা ছাদ ব্যবহার করছ– কয়টাকা দ্যাও বলো শুনি?
: ভাড়া যা তাই দেই। কেন কম দেই নাকি?
: তা দ্যাও না সেইটা স্বীকার করলেও, দ্যাও কবে শুনি? তোমার মুখে তারিখের কথা মানায় না। তুমি দশ তারিখে ভাড়া দিয়েছো সে কবে কও দেখি? তখন তো আঙ্কেল, আঙ্কেল, একটু সমস্যা! দুইদিন পরে দেই। স্যালারি হচ্ছে না তো, আরে বেটা তোর স্যালারি হবে, না-হবে না-তার সাফরার আমি হব কেন?
: হোক না। না দিয়ে আর তো থাকি না। নাকি একমাসের ভাড়া মকুফ করছেন গত তিন বছরে।
: এহ! মকুফ। মকুফ তো মুখের মোয়া। প্রতিমাসে ব্যাংক সুধাতে হয় এতোগুলো, হিসাব আছে। বাসা তো এমনি এমনি হয় না। অত কথা দরকার নাই, আজকা কত তারিখ, চৌদ্দ, ভাড়া দিছ। দ্যাও নাই। না পার যাও না চইলা। অমন ভাড়াটিয়া আমার দরকা নাই।
বাড়িওয়ালা রেগে আগুন হয়ে গেল।
লোকটা অবস্থা সামল দিতে এবার একটু মোলায়েম হল। না হয় দেখল, সমস্যা ক্রমেই পাহাড়প্রমাণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শেষে না বাসাই ছাড়তে হয়! এই সময় সে কোথায় যাবে। তাই সে সহজ হয়ে এলো, মোলায়েম করে দাসানুদাসের সুরে কথা বলল। কারণ এ এমন এক ভাজ, যার ভেতর আস্ত একটা মহাযুদ্ধ গাব করে দেয়া যায়। সদাশয় ভাষায় লোকটা বলল–
: তা ঠিক। বাড়িওয়ালাদেরও কম কষ্ট না। বরং বলতেই হবে, তাদের একজনের চিন্তা, একশ ভাড়াটিয়ার সমান।
লোকাটার এমন কথায় বাড়িওয়ালা প্রথম বুঝি একটু বিভ্রান্ত বোধ করল। লোকটার মুখ ভালো করে দেখে নিয়ে কি যেন বুঝতে চেষ্টা করলেন। পর মুহূর্তে বাড়িওয়ালার মুখে কিছুটা সন্তুষ্টির ছায়া লক্ষ করা গেল। বিজ্ঞজনোচিৎ উপদেশের সুরে তিনি বললেন–
: বলি বাড়ি, বুজলে, আর কিছু না। বাড়ির মালিক হওয়ার যে হ্যাপা সেটা তো তোমরা জানবে না। জায়গা হলেই তো হয় না। বাড়ি করতে গিয়ে ব্যাংকের স্মরণ নিতে হয়। সেটা কি আর যে সে স্মরণ। ফলে বাড়ি হয়ে যায় ব্যাংকের। আমি হয়েছি বাড়ির ক্যায়ারটেকার আরকি, বুঝলে। দেখোশুনো, ভাড়া তুল। তারপর সে টাকা নিয়ে ব্যাংকে গিয়ে জমা দিয়ে আসো। যদি বলো তাহলে আমার কী? ঐ যে আশা, একদিন লোন শেষ হবে আর বাড়ি আমার হবে। বুঝলে, বাড়ি! করে দেখো গে, ধান-চালের হিসেবটা তখন টের পাবে।
বাড়িওয়ালার টানা কথা বলার অভ্যাস। একবার শুরু হলে তা থামানো বড় মুশকিল বা থামানোর চেষ্টা করাটাও বৃথাশ্রম। ছাদময় ঘুরে ঘুরে, এটা এখানে তো, ওটা এখানে সরিয়ে রাখছে আর বকে যাচ্ছেন। নিজের মনে বকে যাচ্ছেন আর নিজেই মাথা নাড়াচ্ছেন। সাতরাজ্যের কাহিনী বয়ান। নোয়াখালী থেকে এলেন ঢাকায়, নিয়ে এসেছিলেন চারটা হাত-পা, তারপর কি করে বাড়ি-গাড়ি করলেন, বিয়ে করলেন, শালাকে বিয়ে করালেন– কোন কথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। অথচ তার কথা কেউ শুনছে কি না, তা সে খেয়াল করারও প্রয়োজনবোধ করছেন না।
তার অনন্ত কথামালা শুরু হয়েছে তো শেষ হওয়ার কোনো নাম নেই। কথা বলতে বলতে বলেই যাচ্ছেন। বাড়িওয়ালা যখন ট্যাংকির ওদিক গেলেন, লোকটা এই ফাকতালে রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিল। একেতো ঘেমেনেয়ে একার, তাতে যোগ হয়েছে রাজ্যের ক্লান্তি, তার উপর বাড়িওয়ার বকবকানি– বিরক্তির এক শেষ!
লোকটা ঘরে ঢুকেই বুকের মধ্যে ঘরের নির্জনতায় একটা প্রশ্রয় প্রত্যাশা করল। কিন্তু উল্টো চমকে উঠতে হল। কাপড় পাল্টাতে গিয়ে মনে হল, রান্নাঘরে কী যেন পুড়ছে। দৌড়ে গেল কিচেনরুমে। নাহ, সব তো ঠিকই আছে। চুলা খালি। ভাতের, তরকারির পাতিল ধুয়ে উল্টে রাখা। পোড়ার সে গন্ধটাও তো আর পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে এমন মনে হল কেন? সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, কেন মনে হল রান্নাঘরে কিছু পুড়ছে। এ সময় রান্নাঘর থেকে মনে হল, বেইডরুম থেকে পুড়ার গন্ধ আসছে। মনে হলো, কে যেন হাটছেও শুয়বার ঘরে। স্পষ্ট সে চটি ঘষটানোর শব্দ শুনল।
: ঘরে কে?
লোকটা ডেকে চিল্লে ওঠল। তরিৎ ফিরে এলো বেডরুমে। না তো, সব তো ঠিকই আছে। মশারি সরিয়ে দেখল। এ ছাড়া তো ঘরে আড়াল বলতে কিছু নেই। ফ্লোরিং করা তোশক। বাথরুম খালি। তাহলে কে হাটল?
লোকটা এই অদ্ভুতুড়ে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। হাত-পা জোরেসরে নেড়েচেড়ে সে গায়ের পোশক খুলে লুঙ্গি পরে সোজা বিছায় গেল। বাতিটা আর নিভালো না। ঘুমের সাথে কতক্ষণ ধস্তাধস্তি করে বিধস্ত বিরক্ত হয়ে রুমের বাইরে চলে এলো। ওদিকে বাড়িওয়ালা বাইরে কথা বলেই যাচ্ছে। অথচ রাতও কম হয়নি।
: শালা বাচাল কোথাকার!
সেদিন সারারাত বাড়িওয়ালার বকবক চলল। শেষে অতিষ্ট হয়ে লোকটা যখন বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। বাড়িওয়ালাকে একহাত নেবে এই ভেবে। চাইকি ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবে। তারপর জেলফাঁজ যা হয় তাই সাই, ‘হোক বাসা ছাড়তে, ছাড়ব। যা হোক এর একটা হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার।’
লোকটা শক্তমুখ করে ধা করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বেরিয়েই আগুন জ্বালিয়ে দিবে এই তার সিদ্ধান্ত। কোথায় সে? এদিক খালি, ওদিকেও নেই। পুরো ছাদ ফাঁকা। চারদিকে অরক্ষিত ছাদের কার্ণিশ। ঠিক অন্ধকার নয়, অন্ধকারের আলখাল্লা পরে দাঁড়িয়ে আছে শহর ঢাকা। জর্জেটের কালো কাপড়ে মোড়ানো নির্মেদ তলপেটের মতো রাতের মোহময় ঢাকা যে এখন কার উত্থানের আর কার পতনের স্বাক্ষী তা কেবল ঐ পরজীবী মেঘই জানে।
পুরো ছাদ তন্নতন্ন করে করে খুঁজে কোনো লাভ হলো না। বাড়িওয়ালা কেন, কোথাও ভূতপ্রেতের টিকিটিরও অস্তিত্ব নেই এখানে। তন্নতন্ন বলতে পুরো ছাটাই তো নেড়া, শুধু পানির ট্যাংকিটার পেছনে যা একটু কার্ণিশ। বাড়িওয়ালা ওখানে যেতে যাবে কেন?
ইতোমধ্যে লোকটার খাটো করে ছাটা চুলের গোড়াগুলো ঘামে ভিজে উঠেছে। কপাল নাক ঘামিয়ে ওঠেছে। কালচে আকাশ। কোন তারা নেই সেখানে। বৃষ্টি পূর্ববর্তী সময়ের ভ্যাপসা গরেমে চারপাশ হাশপাশ করছে। এর ভেতর রেশমের সুতোর ছোয়ার মতো একটা মৃদু বাতাস বয়ে গেলো লোকটার ত্যক্ত চামড়ার উপর দিয়ে। বাতাসের চেয়ে একটা চিন্তা–
‘যেতেও তো পারে। সে হয়তো মজা করেই গিয়েছে।’ এমন অদ্ভুত ধারণার বশবর্তি হয়ে লোকটা ছাদের ঐ কার্নিশ-ঘেষা পানির ট্যাংকিটার পেছনে একবার উঁকি দিল। আবার, আবার, আবার–এভাবে বেশ কয়বার উঁকি দিয়ে কি ভেবে সে নিজেই ওখানে গিয়ে দাঁড়াল।
হ্যা, লোকটা এবার পানির ট্যাংকিটার পেছনের বিপদজনক কার্নিশে গিয়ে দাঁড়াবে। পুরো শহরটাকে মনে হবে, কতগুলো ছায়ার উচু-নিচু সিঁড়ি। দূরতম এক বাসার ছাদ থেকে হল্লা ভেসে আসছে। মিউজিকের বিস্ফোরক শব্দে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারী। ছেলেপেলেরা হয়তো বারবিকিউ করছে। দুটো আতশ ছোড়া হলো ছাদ থেকে। একটা অলোক রশ্মির মতো সাই করে আকাশে ওঠে গিয়ে ক্রিসমাস ট্রির মতো ছড়িয়ে গেলো চারদিকে। অন্যটা মনে হল কতগুলো নক্ষত্র– যা আকাশ খড়ে পড়ছে।
চরিত্রটা খাড়িয়ে গেছে– হ্যা প্রভাবশালী এক চরিত্র– আপন শাহেদ মনে মনে বলল। কিন্তু তার হঠাৎ সন্দেহ হয়, ‘লোকটা আসলে কে? আমিই না তো?’ আপনের মনে এমন প্রশ্ন জাগে। ‘ঐ যে লোকটা, যে কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আছে, সে কী আপন শাহেদ?’ আপনের মুখে একটা অনিশ্চিত হাসি খেলে যায়। গল্পের এ পর্যায় এসে আপন বড় বেকায়দায় পড়ে যায়। বিপন্নবোধ করে সে।
লোকটা রয়েছে ছাদের কার্ণিশে, একদম কার্ণিশে– এটা তার বারবার মনে হতে লাগল। সে কে? যেই হোক– আপন ভেবেই পায় না লোকটা কেন কার্ণিশে গেল? সে কেন কার্ণিশে গিয়ে দাঁড়াবে? কেন? হঠাৎ খুব বিরক্তিকর মনে হয় পরিস্থিতিটা।
‘লোকটা দেখি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠার মতলবে আছে। সে কী চায় আমার চেয়ে বড় হতে চায় নাকি?’ আপনের ঠোঁটের কোনের মৃদু হাসিটায় যেন আরও কয়টা রেখা ফুটে উঠল। এ যেন স্রষ্টার মুখে সৃষ্টির আনুকুল্যের হাসি, বস্যতার হাসি।
‘লোকটা! এই লোকটা তুমি কে? কি চাও আমার কাছে? ছাদের কার্ণিশে কেন তুমি? জেনো রাখো তোমাকে আমি লিখছি না। তুমি সটকে পড়ো তো। তোমাকে আর পৃথিবীর মুখ দেখতে হচ্ছে না।’ আপন লোকটার উদ্দেশে বলল, তার ব্রহ্মতালু তখন ফুটছে। প্রচণ্ড মাথাব্যাথা। কেউ বুঝি মাথার দুপাশে লোহার দাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। মাথাটা যন্ত্রণায় ছিড়ে যাচ্ছে।
‘লোকটা আসলে কে তুমি?’ আপনের মনে ভূতুড়ে জাহাজের অপচ্ছায়ার মতো প্রশ্নটা পাল খাটাল। আগাতে লাগল। এগিয়ে আসছে, কিন্তু আগাচ্ছে না। যেখানে ছিল, সেখানেই যেন কুয়াশাচ্ছন্ন ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে।
‘লোকটা তুমি নিজেই।’ আপনে মনের কানে কেউ যেন বলল। মনে হলো কেউ পাশে থেকে কথা বলে উঠল।
‘আমি? আমি কেন হব?’ আপন স্বশব্দে চেঁচিয়ে উঠল। চারদিকে ঘাড় ফেরাল। কিন্তু কেউ কোন উত্তর দিল না। আপনের হঠাৎ মনে হল, ‘এ কিসের প্রত্যাশা করছি আমি। কে উত্তর দেবে আমার কথার?’ এবার তার ঠোঁটের হাসিটায় মাকড়শার জালের মতো সূক্ষ্ণ বিষাদের ছায়া পড়ল।
‘হ্যা তাই তো! আমি কেন হতে যাব লোকটা। আমি না। কখনোই আমি হতে পারি না।’ আপন প্রায় ঝগড়া করার মতো চিল্লে উঠল। সে লক্ষ্য করল, তার মুখোমুখি যে দাঁড়িয়ে আছে, সে আর কেউ না, আপনই বটে। আপনের প্রতিবিম্ব। সে বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আয়নার আপনটা যদিও একটু ঝাপসা। সেটা হয়তো দীর্ঘকাল না পরিষ্কারের কারণে।
আপন ঝট করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। গায়ে গেঞ্জিটা চাপিয়ে, চটি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। ছাদের মাঝামাঝি কার্নিশ-ঘেষা পানির ট্যাংকিটার দিকে এক পলক তাকিয়েই সে সোজা নেমে এলো বাসা থেকে।
‘অনেক দিন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে যাওয়া হচ্ছে না।’ এই বলে আপন বাংলামটরের দিকে হাটতে লাগল। ভাবল ‘তাও সপ্তাহ হয়ে এলো।’ সেই ঘটনার পর আর কেন্দ্রে যাওয়া হয়নি আপনের।
এ শহরে রাস্তায় হাঁটলে কিছু না কিছু অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হতেই হয়। হয়তো ভালো, না হলে মন খারাপ করে দেবার মতো। এই যেমন রাস্তার পাশের ময়লার স্তুপে দেখা যাচ্ছে একটা ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর থেকে একটা মানুষের বাচ্চার পা বেরিয়ে আছে। সেটা ধরে টানাটানি করছে একটা কুকুর।
‘লোকটা ভয়ানক সংকটে পড়তে যাচ্ছে।’ আপনের ভেতরের কণ্ঠস্বরটা বলল। যা হঠাৎ হঠাৎ তার মনের কানে কথা বলে ওঠে। যে কণ্ঠস্বর আপনের নিয়ন্ত্রণে নেই। কারণ আপন ইচ্ছে করেও তাকে দিয়ে কিছু বলাতে পারে না, আবার কখন বলবে তাও বলতে পারে না। এভাবে কতদিন যায় ভেতরের ঐ লোকটার একটা কথা শোনার অপেক্ষায়। কিন্তু সে টু শব্দটি করে না। আবার যখন বলার নিজে থেকেই বলে উঠে। এটা আপনের জন্য যেমন আনন্দের কিছু না। আবার খুব ফেলে দেবারও কিছু, তাও না। বরং কখনো কখনো খুব প্রত্যাশিতও বটে, কিন্তু কাজের না। কারণ এখন যেমন সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বরের একটা পরামর্শ দরকার। গল্পটা লিখবে কি-না? কিন্তু কোন উত্তর নেই।
‘হ্যা, আমি আমার গল্পের চরিত্র নির্মাণ করব পৃথিবীর সমস্ত সংকট দিয়ে। কার্নিশে দাড়ানো লোকটাও এর বাইরে না।’ আপন সচেতনভাবে ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কারো সঙ্গে কথা বলার মতো করে মৃদু উচ্চারণে বলল। তার চোয়াল শক্ত হয়ে নাচতে লাগল। ইতোমধ্যে আপনের পায়ের উপর দিয়ে একটা রিক্সা চলে গেলো। মন চাইল চিৎকার করে থামিয়ে কষিয়ে চড় বসায় রিক্সাওয়ালাকে।
‘ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় হাটলে এমন তো হবেই।’ রিক্সার যাত্রী বকের মতো পেছনে গলা ফিরিয়ে বলল।
যাত্রীলোকটা পেছন ফিরার ফলে তার শুকনো মুখের উপর কুচকুচে কালো গোফ দেখে আপনের অদ্ভুত খেয়াল হলো, ‘ঐ গোফ জোড়া কার্নিশে দাঁড়ানো লোকটাকে দিলে কেমন হয়?’
গোফ সে নিজে না রাখলেও, গোফের ব্যাপারে তার নিজস্ব বক্তব্য আছে। এই যেমন বড়ে গোলাম আলী অথবা সালভাদর ঢালির মতো চোখে পড়ার মতো গোঁফ! গোফ নিয়ে হুমায়ুন আহমেদ নাকি বলেছিলেন, মানুষ গোফ রাখে, তার কাছে মনে হয়, নাকের নিচে একটা মাকড়াশা বসে আছে। তবে গোর্কির গোফটা কিন্তু তুখোড়। অবশ্য হিটরের গোফ আর চ্যাপলিনের গোফ সেইম হলেও ব্যক্তিত্বে আকাশ আর পাতাল। অবশ্য প্রশ্ন হচ্ছে, চরিত্রটার কি দাবি? সে কি গোফ দাবি করে? আপন স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো এসব ভাবে। ভেবে যায়। যদিও কিছুক্ষণ আগেও সে গল্পটি লিখবে না বলে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিল। অবশ্য আমরা এও জানি, জ্বরাক্রান্ত ছিটগ্রস্থ মানুষ কত কথাই না বলে!
চিন্তাছন্নতার মধ্যে হঠাৎ আপন খেয়াল করল, দূর থেকে দেখা যাচ্ছে মুখময় মিষ্টি হাসির সেই মেয়েটাকে। ‘ওর বিয়ে হয়ে গেছে।’ আপনের ভেতরের কণ্ঠস্বরটা বলল। যে কণ্ঠস্বরটা হঠাৎ হঠাৎ কথা বলে উঠে, সে যে কেমন কার্যকর কথা বলতে পারে এ হলো তার একটা নমুনামাত্র। কথাটাকে কোন আমলে না নিয়ে আপন মেয়েটাকে না দেখার ভান করে তাকে অক্রিম করে চলে এলো।
দু’ পা যেতে না যেতে পেছন থেকে মিষ্ঠি মেয়েলি কণ্ঠের ডাক তাকে ফেরাল–
: ভাইয়া।
: আরে, অদ্রি না?
: হ্যা, আমিই…
যার সঙ্গে দেখা হলো, সে বিকেলে কেন্দ্রের ছাদের সেই তুলতুলে মেয়েটা। নাম অদ্রি। মাথার একদিকে সিথি। ডান-হাতে একটা ব্রেসলেট, আর বা-পায়ে একটা পায়েল। সে পায়েল খুব নিভৃতে বাতাসের সঙ্গে তক্ক করে– যা খুব আলত করে বাজে। সেটা কানে বাজে না বলে বলা যায়, মনে বাজে। গালের দু দিকে দুটো ঝুলফি সে বের করে রাখে আর হাসে খুব পাতলা করে। সেটা যেন পায়েলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে। আপনের মতে কমনীয়তা আর মোলায়েমতায় সব সময় পায়েলের থেকে অনেক এগিয়েই সে হাসি।
‘আপনি আমার নাম জানলেন?’ যোগপদ আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে অদ্রি বলে চলল, ‘আচ্ছা যাক যাক, কেমন আছেন আপনি?’ হঠাৎ আপন কেমন আছে সেটা জানার জন্য অদ্রি যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আসলে আগের প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যেতেই তার এ তাড়া।
: ভালো তো। আপনি?
আপন ছোট্ট করে উত্তর দিল। ইতোমধ্যে তার নাকের আগায় ঘাম জমতে শুরু করেছে।
আপনের অস্বস্তি হল অদ্রির নাম জানা নিয়ে। কারণ সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেলো, ছাদের সব কীর্তিগুলো। সে যে বেহায়ার মতো কান পেতে অদ্রির নাম উদ্ধার করেছে, শুধু তাই না, তাদের যে কত কথায় সে কান পেতেছে– তা একটা বৈদুত্যিক চাকুকের মতো ঝলসে উঠল তার মনে।
‘এ এখন আর লোকাবার কোন কায়দাই নেই।’ আপন ভাবল। শুধু কি তাই, আপন যে এভাবে কান পাতত, সেটাও যেন অদ্রির লক্ষের বাইরে না। এভাবে যে আপনের কুশল জিজ্ঞাসা করল, ব্যস্ততার তো এই কারণ।
তবে নামের কথা বললে, বলতে হবে, আপন নিরানব্বই ভাগ নিশ্চিত ছিল, ওর নাম অদ্রিই আর সেটা উদ্ধার পদ্ধতি তো ইতোমধ্যে সবার জানা হয়ে গেছে। তবে ঐ যে এক ভাগ অনিশ্চিয়তা, সেটা কিন্তু নিশ্চিত। কারণ এর আগে তাদের মধ্যে কথাই হয়নি। সেক্ষেত্রে এই অন্ধকারে ঢিল ছুড়া যে কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল তার পক্ষে তা কেবল আপনই বলতে পারবে। যদিও এই এক পার্সেন্ট অনিশ্চয়তাকে একার্থে সৌজন্যও বলা যায়।
তবে আপনের নড়াচড়ার মধ্যে তার ভেতরের অস্বস্তিভাবটা আর ঢাকা থাকল না। উত্তরোত্তর তা বেড়ে চলল। সে ঘামিয়ে উঠল। চোখ বারবার মাটিতে নামিয়ে নিল। অস্বস্তিটাকে তো ঢাকতে পারলই না, বরং আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল তার এসব আচরণ। একে তো এই প্রথম কথা, তাই আবার অদ্রির নামটা যে অদ্রিই, সেটা মিলে যাওয়ায় আপনের আরও বেশি অস্বস্তি হল। মনে হলো, ধরা পড়ে গেছি।
সে যে ওদের আড্ডার দিকে বেহায়ার মতো মনোযোগ দিয়ে তার নাম উদ্ধার করেছে– কথাটা আবার তার মনে উপর যেন দৌড়াতে লাগল। তার মনে হলো, এর চেয়ে জলের মতো মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়াই আরামপদ–
: খুব ভালো।
অদ্রি আপনের কথার উত্তর দিল, ‘অনেক দিন দেখা না তো, দেখলাম যাচ্ছেন, তাই ভাবলাম কথা বলি। আবার কবে কথা হয়, না হয়। তা ডিস্টার্ব কললাম বুঝি?’
‘আরে না, না।’ সে এভাবে হা-হা করে উঠল যে, মনে হলো এই বুঝি চাদরের কোণে আগুন লেগে গেছে। ‘কী বলছেন, ডিস্টার্ব হব কেব?’
আপন খেয়াল করল, তার মানে আপন যে কয়েক দিন কেন্দ্রের ছাদে যায় না, সেটাও অদ্রির অলক্ষ্যে নেই। কথা শুনে আপনেরও আনন্দ হলো, তদুপরি তার লজ্জার ভাব গেল না। বরং অস্বস্তিটার পরিমাণের মাত্রাটা আরও এক স্তর বেড়ে গেলো। অবশ্য এর যে কী করণ হতে পারে, সেটা তখন সে উদ্ধার করতে পারল না। অদ্রি আবার বলল–
: আমরা চলে যাচ্ছি ভাইয়া।
: শ্বশুর বাড়ি?
আপনের ভেতরের ঐ বেহায়াটা আপনের কণ্ঠে বলে উঠল। এবার তার মন চাইল মাটির সঙ্গে না, হাওয়ার সঙ্গে মিশে যায়, তার চেয়ে রোদের সঙ্গে– এমন লজ্জাবোধ হল তার। এমন প্রশ্ন কেউ করে?!
: না ভাইয়া। কানাডা।
কথাটা বলে অদ্রি একচোট হাসল, ‘ভাইয়া-ভাবী ওখানে থাকে তো। আমাদের শুধু যেতে বলত। বাবা কিছুতেই যাবে না। বাবা মারা গেলেন তাও ছ’ মাস হয়ে গেলো। ভাইয়া মাকে কিছুতেই দেশে এভাবে থাকতে দিবে না। অগত্যা মা রাজি হল, তাই….’
: ও আচ্ছা।
নিজের কথায় নিজেই কেমন বিরক্ত হল আপন। এসময় কোথায় একটু সান্ত্বনা দিবে, তা রেখে কেমন হাস্য-পরিহাসের মতো কথা বলছে। ‘বাজে!’ আপন মনে মনে আওড়াল। সে বলল–
: শুভ কামনা। তা একবারে যাচ্ছেন? আবার আসবেন তো?
আপনের কথা শুনে অদ্রি আবার হাসল। তার সেই বিখ্যাত পাতলা ঠোঁটের রিনরিনে হাসি। তাতে কেমন বোকা বোকা ঠেকল নিজেকে আপনের। অস্বস্তির পরিমাণ তাতে তো কমল না আরও চড়ে গেল। মনে হল একটা জালে সে ধরা পড়ে গেছে, যাতে সে আজীবন ধরা পড়ে থাকতে চায় না। কিন্তু যেকোন বড়মাছের স্বভাবমতো সে তো দুটো একটা ঘাইঘুই দিবেই। কিন্তু জালটা হলো ততধিক গা-ছাড়া। তাই ফসকে এলো আপন। কোনো বাঁধার মুখোমুখি তাকে হতে হল না। এমন বাঁধার মুখে পড়ে আটকে যাওয়া কতই না সৌভাগ্যের– আপন ভাবল। মেয়েটা হেসেই জানাল–
: না না। আসব না কেন। আপনারা আছেন। আর দেশ কি কেউ একবারে ত্যাগ করে যায় নাকি?’
: না, সেতো বটেই। আস্তে আস্তে করতে হয়।
আবার আরেকটা বেখাপ্পা কথার পেরেক ঠুক্ করে এসে বিঁধল। ভেতরের সেই বদমাশটা নিশ্চয়ই তৃপ্ত! –আপন ভেতর ভেতর গর্জন করে উঠল। এ কথা কী করে মুখ ফসকে বেরুতে পারল? অথচ তার মনে হল, কথাটা সে নিজেই বলেছে। আপনের মনে হলো সে সত্যি মারা গেছে–
‘আচ্ছা যাই।’ বলে আপন চলে এলো। আসার সময় মেয়েটার সেই হাসিহাসি মুখে দুর্লভ মসলিনের বিষণ্ণ পর্দা নেমে এলো। আপন সেই সূক্ষ্ণতম বিষণ্ণমুখের মেয়েকে নিয়ে একটা কিছু লেখার পরিকল্পনা করে রাখল।
বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রর ছাদ। ছাদের উপর আকাশের নীল চাদোয়া। ঠাণ্ডা আমেজের হাওয়া বইছে চারদিকে। যে হাওয়া যে কারো অনুচ্ছ্ল মনকে উচ্ছ্ল করে দেয়ার পক্ষে অদ্ভুত ক্ষমতাশালী। আড্ডায় আড্ডায় ছাদ সরগরম। ফলে সন্ধ্যায় ঘুমাতে অভ্যস্ত হলেও ছাদের চারদিকের ফুলের গাছগুলো হয়তো ঝিমুচ্ছে, ঘুমোতে পারছে না।
যথারীতি বটবনসাইটার কাছে অন্যান্য দিনের কোন ব্যতিক্রম না ঘটিয়ে বসেছে আপনের চিরচেনা আড্ডা। সবাই আড্ডায় মজে আছে। তবে সন্ধ্যার পর ছাদময় আড্ডা গমগম করতে থাকে, এখনও সে পরিস্থিতি হয়নি। লোকজন আছে, কথাও হচ্ছে, তবে গমগম করছে না। আজকে একটু আগে চলে এসেছে সে। তাই চেয়ার পেতে বসতে সমস্যা হল না।
‘কী অবস্থা? অনেক দিন দেখাশুনা না, কই ডুব দিছিলেন?’ জিন্স-ফতুয়া পরা সিজার ছাটের কথাশিল্পী আলাওল হাসান বটগাছটা পেছনে রেখে আপনকে জিজ্ঞেস করল। আলাওলের পাশে একটা নীলাম্বর শাড়ির নতুন মুখ। প্রতিমার মতো মুখে একটা হাসি লেগে আছে। কপালে সূক্ষ্ণ টিপ। ভ্রু-প্লাগ করার ফলে ভ্রুতে একটা কটাক্ষভাব লেগেই আছে। মেয়েটার দুধসাদা চোখের কালো তারা আপনকে এক অনির্দেশ্য সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। মুহূর্তটাক মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল আপন। অদ্রি হয়তো তখন ভিনদেশের পথে পা বাড়িয়েছে। সেই বিষণ্ণ মুখটা আপনের স্মৃতির পর্দায় তখনও ঝিরঝির করছে।
চেয়ারে বসতে বসতে আপন ডুবন্ত ব্যক্তির মতো বলল– ‘চাকরী চলে গেছে।’
হাতে দু’কাপ চা নিয়ে এসে চেয়ারে বসল বিখ্যাত ফিল্মম্যাকার, সাংবাদিক সাকি সৌলভ (যে একটি ব্যতিক্রমী স্ক্রিপ্ট নিয়ে ঘুরছে। প্রোডিউসার পাচ্ছে না বলে কাজে হাত দিতে পারছে। বিগ-বাজেটের ছবি তো। তায় আবার ব্যতিক্রমী ছবি। সে একজন বিজ্ঞানীর চরিত্র দাঁড় করাবে। যে আত্মা অবিষ্কার করবে। অর্থাৎ জীবন কি কি মৌলিক পর্দার্থের যৌগিক তা সে আবিষ্কার করবে এবং তারপর সে প্রথম প্রাণ দেবে একটা সৈনিকের মৃত ঘোড়াকে।) সৌলভ বলল–
‘আরে কী খবর আপন? চাকরী গেল! নট বেড, আবার হয়ে যাবে। চা খাবে? তা শুন, একটা কমার্শিয়াল সিনেমার চিন্তা করছি আপাদত কাস্ট হল ও।’ সে প্রতিমাসদৃশাকে দেখিয়ে বলল। মেয়েটার সাথে মিষ্টি একটা হাসি বিনিময় করে সৌলভ বলল–
‘আপন! একটা স্ক্রিপ্ট লিখে দাও। খুব দ্রুত।’ সৌলভ তার দ্রুতজাত জিহ্বা চালনা শেষ করে চায়ের কাপে নাক ডুবাল। অপর চায়ের কাপ ঐ প্রতিমার হাতে। সেও যেন জীবনটা কীভাবে চেখে দেখতে হয়, সেভাবে চেখে দেখছে চা। স্বাদটা নিবে কি-না এই নিয়ে যার ঘোর সংশয়। সৌলভের কথা শুনে মাথা নেড়ে আড় করে চেয়েছিল মেয়েটার দিকে। আপন এবার সৌলভের দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল–
‘ঘোর সংকটটা আসলে নায়কের। একটা গল্প লিখেছি, নায়ক ছাদের কার্ণিশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না, লোকটা ওখানে কেন গেল? সে আসলে কি আত্মহত্যা করতে চায়? কিন্তু আমি তো কোনদিন আমার নায়ককে আত্মহত্যা করাতে চাইনি! অবশ্য চাকরিটা গল্পের নায়কের না, আমারই গেছে।’ বলে আপন হাসার চেষ্টা করল।
‘আমার মনে হয় সে বাঁচতে চায়।’ অপ্রত্যাশিতভাবে বলে উঠল প্রতিমাসদৃশা। প্রথমে এমন একটা বিভ্রান্তির ছায়া সবার চোখে দেখা দেবার যোগাড় হলো যে, কে কথা বলল প্রথমে যেন আনতাজ করাতে পারল না কেউ। অদ্ভুত মিষ্টি কণ্ঠের ভেতর, ততধিক সুন্দরী মেয়েটার কথার টংকারে সবাই মনে হল হকচকিয়ে গেছে। শুধু সৌলভকে দেখা গেলো সে তার অবস্থানে ঠিক আছে, একটু বা নাড়াচাড়া করছে। অবশ্য তাকে দেখেও মনে হয়, সেও কিসের একটা ঘোরের মধ্যে আছে। সবাই থ-মেরে থেমে আছে বলতে গেলে। পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক হলো বলতে গেলে পর মুহূর্তের মেয়েটারই মিষ্টি কথার টংকারে। সবার চোখে-মুখে একটা মুগ্ধতার হাওয়া খেলে গেলো। প্রতিমাসদৃশা তার অঙ্কিত ঠোঁটের চুমুতে কথাগুলোকে ভেজে ভেজে আবার বলল–
‘আমার মনে হয় সে বাঁচতে চায়। কারণ সে কার্ণিশে গিয়ে থাকতে পারে হাওয়া খেতে।’
‘কিন্তু কেন আপনার তাই মনে হল?’ আপন প্রশ্ন করল।
‘কারণ, হয়তো তাকে খুনিরা খুঁজছিল। কারণ ঘটনার পূর্বাপর আমি জানি না। তবে আপনাকে দেখে মনে হল, লোকটা সত্যি আত্মঘাতী হতে পারে না। কেন তাই মনে হল, তা প্লিজ জিজ্ঞেস করবেন না। কারণ এটা আমার জাস্ট মনে হওয়া, আর কিছু না।’
‘লোকটা একজন নারীকে ধর্ষিতা হতে দেখে। কিন্তু তার তখনকার করণীয় সে করে না। পরে সে পাগল হয়ে যায় বা যাচ্ছে। লোকটার চাকরি চলে যাবে হয়তো।’ মেয়েটরার স্ব-প্রতিভূ কথার স্টাইল সবারই বোধ হয় ভালো লাগে। এতোটা যে তাকে কথার স্পেস দিতে এবারও কেউ রা কাটল না। অথবা দেখতে চাইল এর প্রতিক্রিয়ায় সে কি বলে। সে বব-কাটা চুলের গুচ্ছ ব্যস্ত হাতে গালের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে কানের পেছনে গুজে বলল–
‘কেন সে এমন করল? একটা কাপুরুষ ক্যারেকটার কেন আপনি সৃষ্টি করছেন? আমি হলে তা করতাম না।’
‘মানুষ আলটিমেটলি কাপুরুষই কিংবা বলতে গেলে পুরুষ হওয়ার কোন মানে হয় না।’ দার্শনিক কবির তার কালো শার্টের হাতা গোটতে গোটতে বলল।
‘আমার মনে হয় আমি একটা মানুষকে আঁকতে চেয়েছি– যে জন্মের পর শুধু সংকট দেখেছে। মা মারা গেছে অল্প বয়সে। মা নিয়ে তাই তার কোনো স্মৃতি নেই, তাকে নিয়ে কোনো ফিলিংসও কাজ করে না লোকটার। বাবা দ্বিতীয় আর বিয়ে করেনি। অবশ্য ছেলের খোঁজও নেননি কোনদিন। কাজের মহিলার তত্ত্বাবধায়নে সে বেড়ে উঠেছে। পড়াশুনো ভালো লাগে না তাই তেমন একটা পড়াশুনোও করেনি। অল্প বয়সেই শহরে পালিয়েছে বাড়ি ছেড়ে। শহরে এসে বহু ঘুরেছে কোন রকম একটা চাকরি জোটাতে। কিন্তু চাকরি তার মেলেনি। পেট মহাশয় তো আর তা বুঝবে না। ফলে কিছুদিন টয়লেটের ট্যাংকি-সাফাইয়ের কাজ করে। তাও সে কাকতালিয়ভাবে কাজটা জোটাতে পেরেছিল। তখন ঐ বাসার সামনেই বা সে কেন যাবে আর তারই বা কেন একজন সহযোগী সেদিনই আসবে না। কিন্তু একদিন টেংকিতে নামার পর জলজ্যান্ত মানুষকে লাশ হয়ে যেতে দেখে, যে তাকে এই কাজে নিয়েছিল, মধ্যবয়স্ক নিঃসন্তান লোকটার নিঃষ্প্রাণ দেহটা তাকে এতো আতঙ্কিত করল যে, সেদিনই কাজে ইস্তফা দিয়ে লোকটা চলে গেলো।
এই শহর, এ হলো যোগযোগের শহর। যোগাযোগের মাধ্যমে এখানে জিরো থেকে হিরো হওয়া যায়। এমনকি এ শহরে রাজার সাথে দেখা হয়ে যাওয়া কোন ঘটনাই না, যদি যোগাযোগ থাকে। সেই যোগাযোগের গুরুত্বটা এর মধ্যে গল্পের নায়কটা বুঝতে পেরেছে। এ শহরে যাকে মামা বলে, এই যোগাযোগ মামার সূত্র ধরেই সে একটা বায়িং হাউজে চাকরি জুটিয়ে নিল। উন্মুক্তে ভর্তি হল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পরীক্ষাটা দিয়ে দিল। শেষে সে এখন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানির চাকরি পেয়ে গেলো। সে চাকরিটাও নেই নেই করছে। যায় নি কিন্তু। যায় যায় আরকি।
সেই লোকটা একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসার সামনের রাস্তায় একজন নারীকে পড়ে থাকতে দেখে এবং ঘটনায় নিজেকে কোন রকম না জড়িয়ে চলে আসে। পরের দিন সংবাদপত্রে গণধর্ষণের খবরটি সে পড়ে। যার ফলে লোকটা মানসিকভাবে প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়। যা ক্রমেই তাকে গ্রাস করে ফেলে। যা থেকে সহসা সে বেরুতে পারছে না। সে ছাদের কার্ণিশে এসে দাঁড়িয়েছে, এবার বলুন এখন সে কী করবে?’
ধর্ষিতা নারীর ঘটনায় এমন নির্বিকার চরিত্রের কথা শুনে যার গলায় একটু আগেই এক ধরণের যুদ্ধংদেহি ভাবের সঞ্চার হয়েছিল, সেই মেয়েটিরই গলার সুরে কেমন যেন একটা পরিবর্তন সে লক্ষ করল। যা হয়তো আপনকে সহযোগীতা করবে পুনঃজীবনযুদ্ধে উৎসাহিত হতে। মেয়েটা বলল–
‘আমার মনে হয় ঐ ভাগ্যাহত লোকটা ওখানে বাতাস খেতেই গিয়েছে। তার শরীর খুব ঘামিয়ে গেছে। বাতাসে তার মন ও শরীর দুটোই ঠান্ডা হয়ে থাকবে। সে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে, জীবনের পথে হাঁটতে চাবে। যে পথে প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি মানুষের আত্মীয়। একটা জালের মতো যে সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক জালে সে নিজেকে জড়িয়ে নেবে।’
এসময় আপনের কেবল মনে পড়ছিল সেই ছাদটা, যা আসলে তারই ছাদ। পানির ট্যাংকিটা, যা আসলে তার বাসার ছাদেরই পানির ট্যাংকি আর কার্নিশে দাড়ানো ঐ লোকটার কথা, যে আসলে সে নিজেই। হ্যা, সে নিজেই। আপন বলে–
‘হ্যা, লোকটা খুব সম্ভব ওখানে হাওয়া খেতেই গিয়েছে। সে আসলে সেখান থেকে ফিরতে চাইবে। ফিরবে। তার ফেরা উচিৎ।’
আপন আর কোন কথা না বলে আড্ডা থেকে উঠে গেলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়, আটতলা থেকে সিড়ির ফাঁকে তাকাল। অনেক দূরে নিচটা ধুয়াটে মনে হল তার। সে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নামতে লাগল। তার মনে হল, সে যেন হাল্কা পালকের মতো নরম হয়ে গেছে। তার মনে হল মার কথা– যিনি একটি প্রাণকে পৃথিবীতে এনে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে নিজের প্রাণটা বিসর্জন দিয়েছিল। তাকে আপন দেখলো, এই প্রথম, কপালে লাল একটি ফুটো, চোখ বন্ধ– মা। যিনি রাতের আধারে দূর থেকে গন্ধ বিলানো হাস্নাহেনার মতো।