সাপের মতো কালো কুচকুচে শরীরটা ফিরোজার শরীর জুড়ে ওঠানামা করতে থাকে। ফিরোজার এ সময় দম প্রায় বন্ধ করে থাকে। সময়টা দীর্ঘ মনে হয় ফিরোজার কাছে। দম বন্ধ করার সুবিধা হলো শয়তানটার শরীরের গন্ধ ওর নাকে যায় না। সিগারেটের তামার পোড়া আর ঘামের গন্ধে ওর বমি হতে চায়। ফিরোজার শরীরটা দলাই মাড়াই করতে করতে এক সময় শান্ত হয় সরীসৃপটা। ফিরোজার মনে হয় একটা কালো কুচকুচে সাপ ওকে পেঁচিয়ে রেখেছে। সব শান্ত হলে সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে দম ফেলে লোকটা। ফিরোজাও পাশ ফিরে শোয়। জোরে জোরে শ্বাস নেয়। শরীর দিয়ে ঘাম ছাড়ে। নিজের শরীরের ওপর প্রচন্ড ঘৃণা হয় ফিরোজার। ভাগাড়ের নোংরা মনে হয় শরীরটাকে। মুহূর্তে মনে হয় শরীরটা পঁচে গিয়ে গন্ধ ছড়াচ্ছে। অথচ শরীরটা ইচ্ছে করে নোংরা হয়নি। এখানে ফিরোজার দোষ নেই। তবু তাকেই সব সহ্য করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এখনি সবকিছু শেষ করে দেয়। কিন্তু পারে না। ফিরোজা সাহসী মেয়ে না। অনেকবার আত্নহত্যা করতে গিয়েও ফিরে এসেছে। এখন তা আরও সম্ভব না। গত কয়েকদিনে শরীরে আরেকজনের অস্তিত্ত্ব টের পেয়েছে। নিশ্চিতও হয়েছে।
ফিরোজা এবার গায়ে কাপড় জড়িয়ে উঠে বসে। সরীসৃপটাকে সব খুলে বলতে হবে। অবশ্য বলে লাভ কি! লোকটা তো তাকে বিয়ে করবে না। ওর তো কেবল শরীরের লোভ। সাপের মতো কালো এই লোকটার নাম মজিদ। মজিদ তখনও হাঁপাচ্ছে। কাঁপা হাতেই সিগারেট ধরিয়েছে। সেই ধোঁয়ায় পুরো ঘর ঢেকে গেছে। গন্ধে ফিরোজার বমি আসছে। সিগারেটের ধোঁয়ায় লোকটাকে আর সরীসৃপের মতো লাগছে না। তার বদলে তাকে একটা জানোয়ারের মতো মনে হচ্ছে। দুই হাতকে কোনো চতুষ্পদী জন্তুর মতো মনে হচ্ছে। মজিদের ঘরে বউ আছে। ফিরোজার পাশের বাড়িতেই থাকে। মজিদ অনেকদিন ধরেই ফিরোজাকে বাগে আনার চেষ্টা করছিল। আকারে ইঙ্গিতে নানাভাবে ফিরোজাকে কু-প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ফিরোজা তাতে কান দেয়নি। ফিরোজার মা নেই। মা জন্মের সময়ই মারা গেছে। ওর বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আর বিয়ে-থা করেনি। ফিরোজার লেখাপড়াটা হয়নি। বাবা হাটে দোকান করে। সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ফেরে সন্ধ্যার পর। সারাদিন ফিরোজা একাই থাকে। কাজকর্ম করে। দুপুরে দরজা বন্ধ করে ঘুম দেয়। এটাই ফিরোজার প্রতিদিনের কাজ। ফিরোজার চোখে রাজপুত্তুরের স্বপ্ন। মজিদ একটা কালো বুনো মোষ। ফিরোজার শরীর দেখে মজিদের সহ্য হয় না! নিজের বউটা তো একটা বুড়ি! তিনটা বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বউয়ের কাছ থেকে তেমন কিছুই আর পাওয়া যায় না। শরীরে কোনো উৎসাহ নেই। অথচ মজিদ! এখনও সেই টসবগে যৌবন তার। তারপর আবার বাজারের এক চেনা দোকান থেকে কি যেন ওষুধ খায়। শরীরটা আর সহ্য করতে পারে না। ফিরোজাকে তার চাই। কিন্তু কিভাবে সম্ভব? নেকড়ের মতো ওৎ পেতে থাকে। সময় পেলেই ফিরোজার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে মজিদ। সেদিন দুপুরে দরজা বন্ধ না করেই ঘুমিয়ে পরে ফিরোজা। ভাদ্র মাসের গরম ছিল। ফলে শরীরের কাপড়েরও ঠিক ছিল না। সেই ঘুমই তার কাল হলো। এক ফাঁকে ঘরে ঢুকে ফিরোজার কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। ফিরোজা টের পেয়ে যায়। চিৎকার করতে সবাইকে ডাকতে চায়। মজিদ তখন তাকে মোবাইলে তোলা ফিরোজার ছবিগুলো দেখায়। সেসব ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। ফিরোজা ভয় পেয়ে যায়। তারপর সেই সুযোগে মজিদ ফিরোজার শরীরের ওপর অত্যাচার করে। সেই শুরু। গত কয়েকমাস ধরে ফিরোজা এটা সহ্য করছে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ নেমেছে ওর। ইদানিং সাপটা রাতেও আসতে চায়। কিন্তু ফিরোজার তীব্র আপত্তিতে আসতে পারেনি। মজিদও জোর করেনি। দিনেই যখন ফিরোজা আপত্তি করছে না তখন আর জোরাজুরি করে লাভ কি! ফিরোজার বাবা মেয়ের এসব কিছু বুঝতে পারেনি। তবে মেয়ের মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন সে বুঝতে পেরেছে সে। আগে যেমন ফিরোজা হাসিখুশি ছিল এখন তা নেই। বাড়িতে আসার পর যেন বাধ্য হয়েই কাজকর্ম করে। একদিন অসুখ বিসুখ করেছে কিনা জানতে চেয়েছিল। জবাবে ফিরোজা এড়িয়ে গিয়েছিল। খুব ছোটো বেলায় ফিরোজার মা মারা যাওয়ার পর থেকে অনেক কষ্টে ফিরোজাকে বড় করেছে। মেয়েটার বয়স হয়েছে। বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সেরকম কোনো ছেলে পাওয়া যাচ্ছে না। ফিরোজার কোনো পছন্দ আছে কি না সেটাও জানতে চাওয়া হয়নি।
বিছানায় গা ছেড়ে সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে মজিদ জিজ্ঞ্যেস করে, ‘তোমার খারাপ লাগে?’
‘ঘেন্না করে।’
‘ক্যা, ঘেন্না করে ক্যা? আমি কি মানুষ না?’
‘না।’
‘তয় আমি কি?’
‘তুই একটা সাপ?’
ফিরোজার কথায় মজিদ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হো হো করে হেসে ওঠে।’
‘সাপ’ কথাটা শুনে মজিদ রাগ করে না। তৃপ্তিতে সিগারেট টানতে থাকে।
‘একটা কথা ছিল?’
‘কও।’
‘আমার পেটে বাচ্চা।’
কথাটা শুনে প্রথমে মজিদ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে। তারপর আবার সিগারেটে টান দেয়।
‘কার বাচ্চা?’ সাপের?
ফিরোজা কোনো কথা বলে না।
‘অন্যের বাচ্চা আমার বইল্যা চালাইয়া দিবি?’
‘অন্য কারো বাচ্চা না। তোর মতো কালো সাপের বাচ্চা।’
‘অত প্যাচাল পারনের টাইম নাই। কাইল আমার সাথে শহরে যাবি। একটা পরিচিত ক্লিনিক আছে। সব ফিনিশ কইরা আসবি।’
‘আমি বাচ্চা নষ্ট করবো না।’
‘কার পরিচয় দিবি?’
‘কারও না। আমার পেট থেইকা ওর জন্ম হইবো। আমার পরিচয় দেব।’
‘আর বাবা?’
‘কোনো সাপ কি আর কারও বাবা হয়?’
মজিদ অবাক হয়ে ফিরোজার দিকে তাকিয়ে থাকে। ফিরোজার পর মজিদের নিজের কাছেও নিজেকে সত্যি সত্যি সাপ মনে হতে থাকে।