গৌতম বিশ্বাস

অরাজনৈতিক

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

গৌতম বিশ্বাসের গল্প

অরাজনৈতিক


ছেলেকে নিয়ে বড়োই আতান্তরে পড়েছে বিন্তিবালা। এমন হাবাগোবা ছেলের জন্ম দিয়ে কেই বা আর ভালো থাকে। ভালো নেই বিন্তিবালাও। সারাক্ষণ মাথার ভেতর একটা দুশ্চিন্তা ঘুর ঘুর করে। তার যদি কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে ছেলেটাকে দেখবে কে? খাওয়াবে কে?

অথচ এ ছেলে কিন্তু জন্ম থেকে এমনটি ছিল না। বছর পাঁচেক বয়স পর্যন্ত দিব্যি হেসে খেলে বেড়াতো। সারা বাড়ি জুড়ে কত ছোটাছুটি। কত হৈ হল্লা। বিন্তিবালা প্রায়ই বলতো, “ওরে, ওই দস্যি ছেল্যে, থাম, থাম। ”

কে শোনে কার কথা। নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত রতন।

হ্যাঁ, সখ করে এই নামটাই রেখেছিল বিন্তিবালা। বলেছিল, “আমার সুনার চান্দ। আমার মানিক রতন। ”

রতন বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। বিয়ের তিনবছরের মাথায় পেটে আসে সে। এত দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আসে বলেই বোধকরি ছেলেকে একটু বেশিই ভালোবাসতো বিন্তিবালা। আর তাইতো ছেলে যতই দুষ্টুমি করুক, যতই এটা ওটা নষ্ট করুক, কখনোই তার গায়ে হাত তোলেনি বিন্তিবালা। আর না বকাঝকাও করেছে কখনও। তাতেই যেন ছেলে আরও বেশি করে দুরন্ত হয়ে উঠেছিল। তবে সেই দুরন্তপনা বেশ লাগতো বিন্তিবালার। কেবল রাতেরবেলা বিছানায় শুয়ে ছেলেটাকে কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে বলতো, “সুনা আমার, মানিক আমার এমনডি করে না বাপ। মানষে মন্দ কয়।”
ছেলের তখন দুইচোখে ঘুমের ঘোর। মা তাকে কী করতে বারন করছে সেটা বুঝে ওঠার আগেই একরাশ ঘুম এসে তাকে কোথায় তলিয়ে নিয়ে যেত। রাজা-রাণী, দত্যিদানো, লালপরী-নীলপরীদের কোনও জগতেই হয়তো বা। সুতরাং ভোর হতেই ছেলে যে কে সেই।

সেই ছেলেই বাপের মৃত্যু চোখের সামনে দেখে হঠাৎ করেই কেমন যেন হয়ে গেল।
হ্যাঁ, এক সন্ধেবেলায় বাপ তার মাঠ থেকে ফিরে ঝপ করে বসে পড়লো ঘরের দাওয়ায়। সারা শরীরে ঘাম। হাত পা কাঁপছে। ঠিকরে বুঝি বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখ দু’টো। শ্বাসে হাঁপের টান। উঠোন ঝাটানো শেষ না করেই দৌড়ে এসেছিল বিন্তিবালা, ” ওগো তুমি এমুন করছো ক্যান? কী হইচে তুমার? ”

কিছু না বলেই আচমকাই যেন আছাড় খেয়ে পড়েছিল মানুষটা। তারপর কাটা মুরগির মতো বারকয়েক আছাড়ি পাছাড়ি খেয়ে একেবারেই শান্ত হয়ে গিয়েছিল।

বেশ খানিকক্ষণ পরে বিন্তিবালার যখন খেয়াল হয়েছিল, দেখেছিল ছেলে তখনও বাঁশের খুঁটিতে হাত রেখে একভাবে বাপের দিকে চেয়ে আছে। মুখে কথা নেই। চোখে জল নেই।

বিন্তিবালা ছুটে এসে জাপটে ধরেছিল ছেলেকে, “ও বাপ, কী হইচে তোর? কান্দিস নে ক্যান? কান্দ বাপ, কান্দ। কান্দলি কষ্ট ডা হালকা হইয়ে যায়।”

তখন বাড়ি ভর্তি লোক। উঠোনে পাড়া প্রতিবেশীর ভীড়। সন্ধে নামতে শুরু করে দিয়েছে। ঝোপঝাড়ে, গাছের পাতায় আসন্ন রাত্রির হামাগুড়ি। আকাশে চোখ মেলতে শুরু করেছে গোটাকয় তারা। চারপাশে ঝিঁঝিঁর ডাক।

না, ছেলে এতটুকু কাঁদেনি। তার চোখ বাপের শরীরের দিকে হলেও মন ছিল অন্য কোথাও। হয়তো কোনও অতীত, কিংবা অনাগত কোনও ভবিষ্যতে।

সেই থেকেই কেমন হয়ে গেল ছেলেটা। হাসে না। কাঁদে না। মন খুলে দু’টো কথাও বলে না পর্যন্ত। সে কেবল একা থাকে। গাছপালা দ্যাখে। আকাশ দ্যাখে। ফুল, পাখি, মাঠ দ্যাখে। আর হয়তো একা একাই কিছু বলে। কে শোনে তার কথা? হয়তো ওই ফুল, পাখি, মাঠ, গাছপালা, আকাশ–

অথচ কত বয়স হয়ে গেল ছেলেটার। দিনে দিনে সময় গেল। শরীরে যৌবন এলো। অথচ মন তার রয়ে গেল সেই পাঁচ বছরেই।

আজকাল তাই ছেলেকে নিয়ে বড়ো ভাবনা হয় বিন্তিবালার। নিজেকে মনে হয় হয়তো বুঝি আজ আছে কাল নেই। সত্যিই যদি তেমন কিছু একটা হয়ে যায় তখন কী হবে এ ছেলের? কে দেখবে? কার কাছে থাকবে? এখন না হয় লোকের বাড়ি চেয়ে চিন্তে, এর ওর হাতের কাজটা করে দিয়ে যা হোক দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জোগাড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তখন? তাছাড়া বয়স তো বাড়ছে বিন্তিবালার। শরীরেই বা আর সইবে কতদিন?

ভাবনাটা কেবল কুরে কুরে খায় বিন্তিবালাকে। বিশেষ করে যখনই একটু একলা থাকে। ভাবনাগুলো কোত্থেকে এসে যেন আচমকাই ঝাঁপিয়ে পড়ে বিন্তিবালার ওপর। ভেতরটাকে বড়ো অস্থির করে তোলে। কখন যে চোখের কোনায় বিন্দু জল এসে জমা হয় তা টেরও পায় না সে। সেই জল ভরা চোখ নিয়ে সে বসেই থাকে কেবল।

এই তো এখনও ঠিক তেমনি করেই বসে আছে বিন্তিবালা। সন্ধেটা নামি নামি ভাব। দিনান্তের শেষ আলোটুকু দ্রুত মুছে আসতে শুরু করেছে। গাছের পাতায়, ঝোপঝাড়ের গায়ে কেমন এক অস্পষ্টতার হামাগুড়ি। গলা ছেড়ে ডাকতে শুরু করেছে ঝিঁঝিঁ পোকা।

এমন সময়, ” কই গো কাকি বাড়ি আছো নাকি? “বলে হাঁক ছেড়ে কারা যেন দল বেঁধে ঢুকে পড়লো বাড়িতে। ঘাড় ঘুরিয়ে বিন্তিবালা দেখলো ওরা ওপাড়ার হাবুল, পল্টু, বাবলা, ঝড়ু, নাদুরাম, আরও কে কে। এতগুলো মানুষ এভাবে বাড়িতে ঢুকে পড়া দেখে অন্য সময় হলে চমকেই উঠতো বিন্তিবালা। কিন্তু আজ আর চমকালো না। তার কারন ক’দিন ধরে এমন কতজনাই তো আসছে। আসলে ভোট এসে গেছে কিনা। যারা সারাবছর বিন্তিবালাকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে রাস্তা পেরোয়, তারাও বাড়ি বয়ে এসে দাওয়ায় বসছে। এক গেলাস জল চেয়ে খাচ্ছে। আর বলছে, “কাকি, ভোটটা কিন্তু আমাদেরই দিও।”

বিন্তিবালা সবাইকেই আশ্বস্ত করছে, “দেবো বাপ দেবো। তোমাগের ছাড়া আর কাগের দেবো কও। সারাডি জেবন তোমাগেরই তো দে আলাম।”

শুনে যেন খানিক খুশিই হচ্ছে ভোট চাইতে আসা মানুষগুলো। বলছে, “সে তো আমরা জানিই। তোমাকে নিয়ে আমাদের ভাবনা নেই।”
“কিন্তুক বাপ–”

“কী হল?”

“আমার ঘরখান তো দ্যাকছো–”

“ঘর তো এবার তুমি পাবেই। পঞ্চায়েতে তো আমরাই আসছি ক্ষমতায়। এসে প্রথম লটেই–”

“সত্যি কচ্ছো বাপ?”

“মিথ্যে বলবো তুমি ভাবলে কী করে? তোমার ঘরের যা অবস্থা তাতে তো তুমিই প্রথমে পাওয়ার উপযুক্ত।”

“হ বাপ, ঝড় বিষ্টিতি থাকতি পারি নে। চালের ফুটো দে জল পড়ে। খাট বিছনে ভিজ্যে যায়। পঞ্চাৎ থ্যিকে সেই কবে একখান তাবু পালাম তাই দে ঢেক্যে ঢুক্যে আছি বাপ। যদি একখান ঘর পাতাম–”

“বললাম তো পাবে। একবার খালি জিতে আসতে দাও। প্রথম নামটা তোমারই থাকবে এই বলে গেলাম।”

এই জীবনে এমন প্রতিশ্রুতি কত যে পেয়েছে বিন্তিবালা তার আর হিসেব নেই। তবু কেন যেন প্রত্যেকবারই এসব কথা তার বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে করে। বিশ্বাস করেও সে। তার কেবলই মনে হয় এই জগৎ সংসারে বিশ্বাসের থেকে বড়ো কিছু নেই।

হাবুল, পল্টু, ঝড়ু-রা ঝপ ঝপ করে এসে বসে পড়লো দাওয়ায়। মাটির দাওয়া। কতদিন হয়ে গেল একটু গোবর জলের লেপা পড়ে না। তাতে কী? অন্য সময় হলে হয়তো একখানি খেঁজুর পাতার মাদুর পেতে দিলেও কেউ বসতো না। কিন্তু ভোট বড়ো বালাই। কেবল একটা ‘ফু’ দিয়ে বসার জায়গার আলগা ধুলো টা সরিয়ে বসে পড়লো ওরা।

হাবুল জিজ্ঞেস করলো, “তারপর বলো কেমন আছো?”

আলগা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো বিন্তিবালা, “ক্যামুন আর থাকপো বাপ। আছি তুমাগের আশীব্বাদে–”

“কী যে বলো না কাকি। আরে আমরা তোমায় আশীর্বাদ করবো কী? বরং তোমার আশীর্বাদ নিয়েই তো আমরা আছি।”

বিন্তিবালা কিছু না বলে ঘাড় কাত করে একবার তাকালো আকাশের দিকে। সন্ধে নামি নামি আকাশটা রঙ পাল্টে এখন পুরোটাই অন্যরকম। কেমন এক ঘোলাটে অস্পষ্টতায় ঘিরে নিয়েছে তার সারা গা। এতটুকু রোদ নেই কোথাও। আর না একফালি মেঘ। কেবল গোটাকয় শালিক দল বেঁধে উড়ে গেল সেখান দিয়ে।

হাবুল জিজ্ঞেস করলো, “কী ভাবছো কাকি?”

কি একটা ভাবনা যেন আসতে গিয়েও এলো না বিন্তিবালার। আকাশের দিক থেকে মুখ নামিয়ে ফের তাকালো হাবুলের দিকে। বলল, “না বাপ, কিছু না।”

হাবুল জিজ্ঞেস করলো, “রতন, রতন কই? তাকে তো দেখছি নে।”

রতন ঘরেই ছিল। নিজের নাম শুনে এতক্ষণে সে বেরিয়ে এলো দাওয়ায়।

পল্টু বলল, “ওই, ওই তো রতন।”

হাবুল জিজ্ঞেস করলো, “কী রে রতন, কেমন আছিস?”

হাসি হাসি মুখ করে ঘুরে তাকালো রতন, “ভালা।”

“বাঃ। ভালো তো থাকতেই হবে। তা হ্যাঁ রে রতন, কাল যে ভোট তা জানিস তো?”

“হুঁ।”

“ভোটটা কোথায় দিবি মনে আছে?”

“হুঁ।”

“কাল কিন্তু সারাদিন আমাদের সঙ্গে তোকে থাকতে হবে রতন।”

এ কথায় বেশ খানিক অবাকই হল বিন্তিবালা। তার অমন হাবাগোবা ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে ওরা করবে কী? জোড়া ভ্রু ঈষৎ ভাঁজ করে বিন্তিবালা জিজ্ঞেস করলো, “তুমাগের সঙে থাকপে মানে?”

“মানে আমাদের সঙ্গে থাকবে। আরে ওই যে ভোটের দিন দ্যাখো না তাবু খাটিয়ে আমরা টেন্ট বানাই। মানুষজন গিয়ে বসে। খাওয়া দাওয়া হয়। ওই ওখানের কথা বলছি। কেবল বসে থাকবে। আর কিছু নয়।”

“বুঝিছি।”

“শোন রতন, কাল সকাল সকাল চলে যাবি। সারাদিন থাকবি। খাওয়া দাওয়া নিয়ে ভাবনা নেই। মাংস ভাতের ব্যবস্থা করেছি। শুধু ফ্রী তে খাওয়া দাওয়াই নয়, ফেরার সময় দু’শো টা করে টাকাও পাবি।”

একে মাংস ভাত, সঙ্গে দু’শো টা টাকা– শুনেই যেন জিবে জল চলে এলো রতনের। কতদিন যে মাংস দিয়ে একমুঠো ভাত খায় না। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে যখন কোনও বাড়ির ভেতর থেকে রান্না করা মাংসের ঘ্রাণ বাতাসের পিঠে ভেসে এসে রতনের নাক ছুঁয়ে যায় তখন মাথার ভেতরটা কেমন করে ওঠে তার। বুক ভরে শ্বাস টানে বার বার। তাতে মন ভরলেও পেট টা ভরে না। এতদিনে পেটটা ভরবে শুনেই কেমন একটা মাতাল মাতাল দশা হয়ে গেল তার। সে কিছু বলতে পারলো না। কেবল একরাশ হাসি হাসি মুখ করে তাকালো মায়ের দিকে। বিন্তিবালার চোখে তখন কড়কড়ে দু’শো টাকার নোট। সে হাবুলের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমরা যহন কচ্ছো তহন অবশ্যি যাবে বাপ।”

হাবুল বলল, “ভোট দিয়ে ফেরার পথে তুমিও চাট্টি খেয়ে এসো কাকি।” বলে আর দাঁড়ালো না ওরা। কাল ভোট। আজ তাই চুড়ান্ত ব্যস্ততা সবার। দু’দণ্ড বসার সময় নেই।

ওরা বেরিয়ে গেলে ছেলেকে কাছে ডাকলো বিন্তিবালা। ততক্ষণে সন্ধে নেমে গেছে। চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে আঁধারের অস্পষ্টতা। ঝিঁঝিঁর ডাকে কান পাতা দায়। আকাশে এরই মধ্যে একটা দু’টো তারাদের উঁকিঝুঁকি। আধখানা চাঁদও উঠে এসেছে একপাশে।

রতন এসে পাশে বসলে মাথায় হাত রাখলো বিন্তিবালা। বলল, “শুনিছিস তো বাপ পরা কী কইয়ে গেল? কাল যদি ওগের সঙে থাকিস তাহলি ভালো খাতি পাবি। দুই শো ট্যাকা পাবি। আবার পঞ্চাৎ থ্যিকে একখান ঘরও–”

এতসব কথার কিছুই কানে ঢুকছে না রতনের। সে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে আছে অস্পষ্টতায় ঘিরে আসা বাইরের ঝোপঝাড়ের দিকে। তার চোখে ভেসে উঠছে একথালা গরম ভাত। ধোঁয়া ওঠা মাংস।

তাবু টাঙানো রং বে রংয়ের ঘেরা দেওয়া জায়গাটায় এসে রতন যখন পৌঁছেছিল রাতের আঁধার ফেটে দিনের আলোটা তখনও পুরোপুরি বেরোয়নি। পূবের আকাশে হালকা রঙ ধরলেও পশ্চিমের আকাশটা তখনও একরাশ কালো আঁধারে ছেয়ে আছে। আর বেশ জ্বলজ্বলে দু’একটি তারাও সেখানে উপস্থিত। ঝোপঝাড়ে আঁধারের অস্পষ্টতা।

সেখানে তখন অল্পই দু’চারজন এসে পৌঁছেছে মাত্র। রতন কে দেখে খানিক যেন অবাকই হয়েছিল হাবুল। সত্যি সত্যি রতন যে আসতে পারে তা যেন ধারনাতেই ছিল না তার। অবাক চোখে রতনের দিকে তাকিয়ে তাই বলেছিল, “আরে, রতন দেখি যে? এসে গেছিস?”

হলদেটে ছোপ ধরা দাঁতগুলো বের করে হেসেছিল রতন। মুখে কিছু না বলে তাকিয়ে ছিল হাবুলের দিকেই।

হাবুল বলেছিল, “বেশ করেছিস। তা দাঁড়িয়ে না থেকে আয় দেখি, একটু হাত লাগা আমাদের সাথে।”

এমন ভালোবেসে যেন কেউ কোনওদিন বলেনি রতনকে। বেজায় খুশি হয়ে কাজে হাত লাগিয়েছিল রতন। কাজ মানে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার দিয়ে বসার জায়গা আর সামনের রাস্তাটাকে সাজানো। যাতে দেখেই ভোটারদের মনে একটা প্রভাব পড়ে।

সে অবশ্য সেই কোন ভোর সকালের কথা। আর এখন বলতে গেলে দুপুর। গাছতলার ছায়াটুকু বাদ দিলে চারপাশে ঝাঁ-ঝাঁ রোদ। ভোট দিতে আসা মানুষগুলো পর্যন্ত ঘেমে নেয়ে একসা। মাথার ওপর খোলা আকাশটার থেকে মুঠো মুঠো আগুন যেন ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।

এখানে অবশ্য মাথার ওপর ফ্যান চলছে। ফ্যানের নিচে সারি সারি চেয়ার। তেমনই একখানি চেয়ারে বসে আছে রতন। আশেপাশের কোনও চেয়ারই ফাঁকা নেই। কেউ না কেউ ঠিক বসে আছে। চারপাশে আরও কত মানুষ। বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে যার মত। চোখের সামনে কত মানুষের ভীড়। কত কোলাহল।

এসবের দিকে অবশ্য মন নেই রতনের। সেই কাল রাতে চাট্টি খেয়েছিল। তারপর থেকে বার কয়েক কেবল একটু চা ছাড়া আর কিছুই পড়েনি পেটে। একটা রাক্ষুসি খিদে পেটের মধ্যে আঁচড়াতে কামড়াতে শুরু করে দিয়েছে। চিনচিনে একটা ব্যাথাও বুঝি অনুভূত হচ্ছে কোথাও। কখন খেতে দেবে কে জানে। তবে রান্না যে হচ্ছে কাছেপিঠে কোথাও তা বেশ টের পাচ্ছে রতন। শিরশিরে একটা দোখনে হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় থেকে থেকেই ভেসে আসছে কড়াইতে চড়ানো মাংসের ঘ্রাণ। কতদিন পরে যে গরম গরম মাংস দিয়ে চাট্টি ভাত খাবে রতন।

ভাবতে গিয়ে জিভে জল চলে এলো রতনের। ‘সুড়ুৎ’ করে সেই জল ভেতরে টেনে নিয়ে বুক ভরে একবার শ্বাস টানলো সে। মাংসের গন্ধটা অমনি সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল তার। বেশ একটা ভালোলাগা হঠাৎ করেই এসে ছুঁয়ে গেল তাকে। মুহূর্তে দু’টো চোখ বন্ধ হয়ে এলো রতনের।

আর ঠিক তখনই কোথায় যেন একটা হৈ চৈ। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রতন। মুহূর্তে চারদিকে ছোটাছুটি। চিৎকার। একদল কারা যেন লাঠি সোটা হাতে ছুটে আসছে এদিকেই। ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই রতন দেখলো বসার জায়গাটা পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেছে। একা রতনই রয়ে গেছে কেবল। সকলেই পালিয়ে গেছে। রতনও কী পালাবে? কিন্তু গরম গরম মাংস ভাত, নগদ দু’শো টাকা– কী হবে তার?

না, আর বেশি ভাবার সময় পেল না রতন। তার আগেই দুইচোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে গেল তীব্র একটা আলোর ঝলকানি। সেইসঙ্গে কানে এলো প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ। মুহূর্তে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কী সব ঢুকে যাওয়ার অসহ্য একটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল রতন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ-ই যেন খুব ঘুম পেয়ে গেল রতনের।

পরদিন বিকেল। কাঁদতে কাঁদতে চোখের সবটুকু জল নিঃশেষ করে দাওয়ার খুঁটিতে পিঠটাকে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বিন্তিবালা। চোখের সামনে ভাসছে একথালা মাংস মাখা গরম ভাত। তার পাশে পড়ে থাকা রক্ত মাখা একটা শরীর। যা দেখে আরও একবার শব্দ করে কেঁদে উঠতে গেল বিন্তিবালা। আর ঠিক তখনই কানে এলো দূরের রাস্তায় মিছিলে ওঠা স্লোগান, “রতন মালোর রক্ত/হবে নাকো ব্যর্থ”।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu