আলমগীর হোসেন আবীর

অপেক্ষায়

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

চাঁদ দেখা গেছে আকাশে। চারদিকে সবার মধ্যে খুশির আবহ ছড়িয়ে পড়ছে। ছেলে-মেয়েরা আতশবাজি করে, পটকা ফুটিয়ে উল্লাস করছে। বয়স্কদের মধ্যে যাদের কেনাকাটা এখনও বাকি তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ছে কেনাকাটায়। কাদেরের ঘরে কিছুই কেনা হয়নি। সে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে আর ভাবছে, নিজের জন্য পারবো না, ছেলেমেয়ের জন্য তো কিছু কিনতে হবে। এছাড়া সেমাই, চিনিও অল্প করে না কিনলে চলবে না। গত বছর ছুরাতনকে কিছু কিনে দিতে পারেনি সে। কাদের মনে মনে ভেবে রেখেছিল এবার ঈদে অন্তত একটা কাপড় দিতে হবে ছুরাতনকে। ছেঁড়া কাপড় জোরাতালি দিয়ে পরে ছুরাতন। কাদেরের খুব কষ্ট হয় দেখতে। হঠাৎ একটি বাস ওভারটেক করতে গিয়ে বামে চাপিয়ে দেয় তাঁর রিকশার সাথে। কাদের চেয়ে দেখে ডান পাশের চাকাটা মুঁচড়ে গেছে। চাকাতো গেলই সাথে বাড়তি শুনতে হলো অকথ্য গালি, এই ব্যাটা শুয়োরের বাচ্চা, দেখে চালাতে পারিস না? না মদ খাইয়া নামছস? বাপের নাম ধরে গালি শুনে গায়ে আগুন জ্বলে ওঠে তার। ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিবাদ করল সে, তুই শুয়োর, তোর বাপ শুয়োর, শালা।

শোঁ-শোঁ শব্দ করে চলে যায় বাসটা। কাদের সেদিকে চেয়ে শালা কুত্তার বাচ্চা বলে কয়েকবার হাঁক দেয় শুধু।

রিকশা মেরামত করতে অনেক রাত হয়ে যায়। যে টাকা উপার্জন করেছিল তা দিয়ে চাল ডাল কিনে ঘরে ফিরে কাদের। বাবার ডাক শুনে রনি ও মনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে দৌড়ে আসে। দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ায়। এক মুহূর্ত পরেই তাদের হাসিমাখা মুখ মলিন হয়ে যায়। দু’জনে চোখ কচলাতে কচলাতে কান্না শুরু করে। কাদের বিষণ্ণ মনে ঘরের মেঝেতে বিছানো হোগলার ওপর শুয়ে পড়ে। কারো সাথে বলার কিছু ভেবে পায় না। ছুরাতন ভাত বাড়তে গিয়ে হাঁড়ি পাতিলের উপর রাগ ঝারে– বক বক করে কত কিছু বলতে থাকে। কাদের আর ধৈর্য্য রাখতে পারে না। শোয়া থেকে উঠে গিয়ে ছুরাতনের চুলের মুঠি ধরে কাদের। গায়ে পিঠে ধপাস ধপাস কিল মারতে মারতে বলে, হারামজাদী ঘরে বইয়া খালি খাওনডা বুঝস, কাম করতে গেলে গায় ব্যথা লাগে। আবার মুখে এত বড় বড় কথা আয় ক্যম্মে? কত কষ্ট কইরা এক সাইবের বাসায় কাম যোগাড় কইরা দিলাম। একমাস না কইরাই চইল্লা আইলি। মাইনসের বাসায় কাম করতে পারমু না! ইস! কি জমিদারের ঝি!

খাওয়াইতে পরাইতে পারবি না তো বিয়া করছস কেন? ছুরাতন ফোঁস করে ওঠে, পোলাপান বানানোর সোময় মনে থাহে না?

উপজেলা অফিসের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বাসায় ছুরাতনের জন্য কাজ ঠিক করে দিয়েছিল কাদের। তার রিকশায় চড়ে নিজেই আলাপ করেন ভদ্রলোক। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাদেরের সব কিছু জিজ্ঞাসা করেন, তার বাড়ি কোথায়, ছেলে-মেয়ে কত জন, মা-বাবা আছে কিনা ইত্যাদি। শেষে বলেন, বাসায় কাজ করার জন্য একজন লোক ঠিক করে দিতে পার? বেশি কাজ নেই। শুধু ঘর ধোঁয়া-মোছার কাজ।

পারব স্যার। কাদের চট করে জবাব দেয়, বেতন কত দেবেন?

প্রথমে মাসে পনেরশ দেব। কাজ ভালো করলে পরে বাড়িয়ে দেব।

তাইলে কাইলই নিয়া আসমু স্যার। আমার ঘরের-জন। দুইশ টাকা বাড়াইয়া দিয়েন স্যার। কাজ ভালো না করলে আমারে কইবেন শুধু।

বাসার সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে কাদেরকে একশ টাকা বকশিস দিয়ে বলেন, কালকে সকাল সকাল নিয়ে এসো।

ছুরাতুনও খুব আগ্রহ নিয়ে কাজ করতে গিয়েছিল। কিন্তু ভদ্রলোকের স্ত্রীর ব্যবহার ভালো না। তার মুখে কিছু বাজে না। কাজের একটু ঊনিশ বিশ হলেই বকাঝকা করেন। প্রত্যেকদিন ধোয়ার জন্য গাট্টি গাট্টি কাপড়ের স্তুপ করে রাখেন। ছুরাতনের একটু বসে থাকা সহ্য করতে পারেন না । মহিলার সাথে একদিন ঝগড়া করে ছুরাতুন চলে আসে।

কাদেরের ছুরতনের উপর প্রচণ্ড রাগ হয় তখন।

ফজরের আজান শুনেই বের হয় কাদের– ঢাকা থেকে আসা যাত্রীদের বড় ক্ষেপ ধরবে সে। দুজন মোটা ভারী দেহের ভদ্রলোক নিয়ে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে সে। আজকে এটা তার তিন নম্বর ক্ষ্যাপ। একজন বিশ টাকা বকশিসও দেয় তাকে। আর দুইটা বড় ক্ষেপ মারতে পারলেই হয়ে যাবে। তারপর রনি মনির জন্য জামা কাপড়, সেমাই-চিনি কিনতে পারবে সে।

গ্রামের সকল ছেলে-মেয়েরা নতুন জামা পরে ছুটোছুটি করছে। মেয়ে-বউরা রান্নার কাজে ব্যস্ত। পুরুষরা গায়ে আতর মেখে ছেলেদের সঙ্গে করে নামাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছুরাতুন রনি ও মনিকে গোসল করিয়ে মাথায় সরিষার তেল দিয়ে চুল আঁচরিয়ে দিয়ে ঘরের দরজায় দু’জনকে নিয়ে বসে থাকে। কাদের আসবে নতুন জামা কাপড় নিয়ে। সেমাই চিনি নিয়ে। তারপর তারা ঈদ করবে।

ঝিক ঝিক করে রিকশা এগিয়ে চলছে। লোক দুটিকে বেশ টাকাওয়ালা মনে হয়। ভালো বকশিস দিতে পারে। এই আশায় যখনই কাদেরের মন খুশিতে ভরে ওঠে, ঠিক তখনি একজন তীব্র কন্ঠে বলে ওঠে, ধুরও মিয়া। ভাত খাওনি কতদিনে। আমাদের নামাজ পড়তে দিবা না তুমি?

কথা ঠিকই। সকালে কিছু খায়নি সে। রাতেও ভালো করে খেতে পারেনি। কাঁধের গামছা পেটে বেঁধে নেয় কাদের। তারপর সজোরে প্যাডেল মারতে থাকে। কোথা থেকে যেন গায়ে জোর চলে আসে তার। শোঁ-শোঁ করে বাতাসের বেগে রিকশা চলতে থাকে। রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে সবার কথা ভুলে যায় সে। বেপরোয়া গতিতে পা চালাতে থাকে সে।

সামনের মোড়টা তার খেয়ালের বাইরে চলে যায়। তারঁ দু’কান যেন কে চেপে ধরে রাখে। চোখের সামনে রনি, মনি ও ছুরাতনের মন মরা মুখ ভাসতে থাকে । আরও দেখতে পায় সে, গ্রামের সবাই ঈদের আনন্দে মেতে উঠেছে। তখন বিপরীত দিক থেকে আসা বাসটির বাজানো হুইসেলের শব্দ তার কানে যায় না। যাত্রী দুজন বুঝে উঠেছে ঠিক তখনি বাসটির তলে চাপা পড়ে যায়।

সকল দুঃখ কষ্ট বেদনা ত্যাগ করে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে কাদের। তার এ ঘুম আর ভাঙবে না কখনো। কিছুক্ষণের মধ্যেই কৌতূহলী জনতার ঢেউ বয়ে যায় রাস্তায়।

ছুরাতন রনি-মনিকে নিয়ে এখনও পথ চেয়ে বসে আছে। কাদের আসবে। তারা ঈদ করবে। বেড়াতে যাবে।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu