শেষ শ্রাবণের মেঘলা আকাশ। রাতের প্রথম প্রহরে একটানা ঘন্টা দুয়েক বৃষ্টি ঝরিয়েও মন ভরেনি আকাশের, অভিমানে মুখ গোমরা করে আছে সেই কখন থেকে। উঠোনে থিকথিকে কাদা, আয়াত আলী তবু বারবার ঘর ছেড়ে সেই উঠোনে নেমে আসে, ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকায় এবং আতিপাতি করে কী যেন খুঁজে ফেরে। কী খোঁজে ঘোমটা টানা আকাশের গায়ে? উদ্দিষ্ট সেই বস্তু দেখতে না পেয়ে আবার রোয়াক পেরিয়ে ঘরে ঢোকে। অকারণেই ঘুমন্ত দুই কন্যার মুখে হাত বুলায়। টিয়া ঘুমের ঘোরে একটু নড়েচড়ে ওঠে। পরি চুপচাপ শুয়ে শুয়ে ঘুমের মধ্যেই বাবার আদর গ্রহণ করে। অন্যান্য দিনে ওরা দু’বোনই দাদির কাছে ঘুমায়। আজ দাদির অনেক কাজ। দুই নাতনিকে ঘুম পাড়াবার পর রোয়াকের খুঁটিতে শাড়ি পেঁচিয়ে আঁচিঘর তৈরি করে ওদের আসন্নপ্রসবা মাকে ঢুকিয়েছে সেইখানে। তেল-পানি-আগুনের মালশা নিয়ে সে নিজে পাহারায় আছে– কখন কী হয়, বলা তো যায় না কিছুই! এদিকে গীর্জা-বাড়ির ঘন্টাধ্বনি নিরাকপড়া রাতের নিস্তব্ধ প্রহরকে ঠেলে নিয়ে চলে নির্ভয়ে। মসজিদের মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের আজান ইথার কাঁপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ঘর-উঠোন করতে করতে হয়রান আয়াত আলী, তবু আঁধারলিপ্ত আকাশের গায়ে পোয়াতি-তারার উদ্ভাস খুঁজে পায় না। তখন বিষন্ন চোখে সে তাকায় শাড়ি-ঘেরা আঁচিঘরের দিকে। সেখান থেকে ভেসে আসে নারীকন্ঠের যন্ত্রণাক্লিষ্ট গোঙানি। নতুন এক পৃথিবী সামনে নিয়ে সে আছে প্রতীক্ষায়, কখন আসবে সে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে কখন আসে, কখন… কখন…।
এমনিতে আয়াত আলী খুবই সহজ সরল সাদাসিধে মানুষ। সোজা কথাটুকু খুব সহজে বোঝে। ঘোরানো প্যাঁচানো জটিল কোনো বিষয় তার মাথায় ঢুকতেই চায় না। রাজনীতির জটিলতা মোটেই বোঝে না। তবুও কী যে তার কাপালের ফের, ঘুরে ফিরে রাজনীতির প্যাঁচে তাকে পড়তেই হয়। এই যেমন তার মুক্তিযোদ্ধা হবার ব্যাপারটাই ধরা যাক, এ কি তার রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত ছিল? ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা এই ভবেরপাড়া বল্লভপুর কেদারগঞ্জ থেকেও কত মানুষ মিছিল নিয়ে মেহেরপুরে গেছে, কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে কিংবা শামসুজ্জোহা পার্কে নেতাদের বক্তৃতা শুনে রক্ত গরম করে আবার গ্রামে ফিরেছে; আয়াত আলীকে কেউ কখনো দেখেছে এসব মিছিলে? না, সে অতি সাধারণ জীবন যাপন করে, প্রচুর খাটাখাটুনির পর মুখের আহার জুটাতে হয় তাকে; মিটিং মিছিল দিয়ে কী করবে সে! তবু তাকে সময়ের প্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের মতো বিশাল এক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ঠিকই জড়িয়ে পড়তে হয়। আবার এ নিয়ে সে ভেতরে ভেতরে প্রবল অহংকারও অনুভব করে। অহংকার তো সব মুক্তিযোদ্ধারই থাকার কথা। কিন্তু আয়াত আলীর অহংকারের জায়গাটা অনেক বেশি উজ্জ্বল এবং আলাদা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবারও আগে আনসার বাহিনীর এগারজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সে কুষ্টিয়ার প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, তারাই আবার মুজিবনগরে দাঁড়িয়ে দেশের প্রথম সরকার-প্রধানকে গার্ড অব অনার দিয়েছে; তার অহংকারের শেকড়বাকড় এই ভিন্ন প্রেক্ষিতে প্রোথিত। এ নিয়ে নানাজনের নানা কথা শুনতে হয়; সে শোনে; কিন্তু গায়ে মাখে না। অন্তর্গত অহংকারে সে উদ্ধত রাখে মাথা। বাইরে নয়, আয়াত আলী একাকী নিভৃতে পরাজিত হয় ভেতরের অদৃশ্য এক দুর্বলতার কাছে। ব্যাপারটা যতই হাস্যকর মনে হোক, তিন কন্যার প্রতি আয়াত আলীর স্নেহ মমতার একটুও ঘাটতি নেই, তবু পুত্রতৃষ্ণায় খাক হয়ে পুড়ে যায় তার বুকের জমিন। যুদ্ধে যাবার আগেই সে পেয়েছে ময়নাকে, যুদ্ধের শেষপ্রান্তে এলো টিয়া, মেয়ে তো নয় যেন বা সে লাল সবুজের পতাকা হয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধা আয়াত আলীর ঘরে। আবার বছর দুয়েকের মাথায় আকাশ থেকে উড়তে উড়তে নেমে আসে পরী। পুত্র প্রত্যাশায় অধীর হয়েছিল বটে, পরীবানুর ঘর আলো করা রূপ দেখে আয়াত আলী সেবারও অপ্রাপ্তির বেদনা ঢেকে রাখে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন। পুত্র আকাঙ্ক্ষায় আকুল হয়ে সে পীর-ফকিরের কাছে ধর্ণা দিয়েছে। এবার একটি পুত্র সন্তান চাই-ই-চাই। ময়নার মার পেটের আকৃতি দেখে অভিজ্ঞ মহিলারা আশ্বস্ত করেছে, তবু মনের ধুকপুকি যায় না তার।
দেখতে দেখতে অন্ধকারের অবগুন্ঠন গুটিয়ে নেয় রাত্রি। ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে ভোরের আলো। তবু যেন আয়াত আলীর চোখের ঘোর কাটে না। নইলে ঘরের রোয়াক থেকে নামতে গিয়ে হঠাৎ পা পিছলে যাবে কেন! সে তো এই কর্দমাক্ত উঠোনে নামা-ওঠা করছে সারারাত ধরেই। কই, আগে তো এমন পা পিছলানোর ঘটনা ঘটেনি! অবশ্য ওই মুহূর্তেই আঁচিঘর থেকে শিশুকন্ঠের দুনিয়া-কাঁপানো ‘ট্যাঁ’ ধ্বনি আছড়ে পড়ে তার কর্ণকুহরে। তবে সে কি নবজাতকের কান্নাধ্বনির ধাক্কায় নিজের অজান্তে খানিকটা বেসামাল হয়ে পড়েছিল! উঠোনের কাদাপাঁক থেকে কৌশলে উঠে দাঁড়াতেই আয়াত আলীর মা আঁচিঘরের পর্দা তুলে তারস্বরে ডেকে ওঠে,
ও খোকা, তুই গেলি কুথায়?
আয়াত আলীর পিতৃপ্রদত্ত নাম খোকা নয়। যাকে বলে ডাকনাম, তাও নয় এটা। এতদঞ্চলে মা-বাবার সম্মোধনের ধারাই হচ্ছে এ রকম-খোকা কিংবা খুকি। বয়স বাড়লেও তাদের ডাকহাঁকের বিশেষ হেরফের হয় না। বড় খোকা, মেজো খোকা, ছোট খোকা– এ রকম চলতেই থাকে। আয়াত আলীর মায়ের মুখের এ সম্মোধনও মোটেও নতুন কিছু নয়। তবু সে চমকে ওঠে মায়ের কন্ঠ শুনে। লুঙ্গির গিট ঠিক করে করতে করতে কোনোক্রমে জবাব দেয়– এই যে মা, আমি…
দাঁড়িয়ি আছিস ক্যানে বাপ, আজান দে।
মায়ের কন্ঠে উচ্ছ্বসিত আহ্বান শুনে আয়াত আলী শিউরে ওঠে– আজান দিতে হবে! নিজের কানকেই যেন অবিশ্বাস হয়। গতবার, মানে টিয়ার জন্মের সময় তো সে ওজু-টজু করে একেবারে রেডি হয়েই ছিল। মনে তার অনেক আশা। গ্রামের অভিজ্ঞ দাই রহিমা খালা গভীর আস্থার সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে মেওয়াফল। ফলে সেবার আজান দেবার দরকার হয়নি। এবার মায়ের আহ্বানকে তো উপেক্ষা করতে পারে না আয়াত আলী! আঁচিঘরের দিকে তাকিয়ে আবেগ থরোথরো কন্ঠে সে মাকে আবার শুধায়– আজান দেব মা!
নবজাতক শিশুটি কী যেন বলতে চায়। তীব্র কান্নার আড়াল থেকে তার সে বক্তব্য উদ্ধারে তৎপর দাদি আঁচিঘর থেকে সামান্য মুখ বাড়িয়ে বলে,
আজান দ্যাও বাপ! ইবার তুমার খোকা হয়িছে যে!
আজান দেবে কী, আয়াত আলীর তো ইচ্ছা করে আকাশের গায়ে ডিগবাজি দিতে। ইচ্ছে করে ভোরের আকাশ থেকে ডিমের কুসুমের মতো গোলাকার সূর্যটা নিয়ে এসে তার বৃদ্ধ মায়ের হাতে তুলে দিতে। আহা, দিঘল রাত্রিশেষে এ কোন আনন্দবার্তা শোনালো তার মা-জননী! নিয়ম মেনে নামাজ-কালাম পড়া হয়ে ওঠেনি কোনোদিনই, তবু এই আজানটুকুর জন্য সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছে আয়াত আলী! তাই আর বিলম্ব না করে কাদা-থিকথিকে উঠোনে দাঁড়িয়ে সে দুই কানে আঙ্গুল গুঁজে হেঁকে ওঠে– আল্লাহু আকবার…। উত্তেজনায় তার কন্ঠ ভেঙ্গেচুরে যায়। তবু সেই মধুর ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে ভোরের বাতাস। বাড়ির পেছনের বাঁশবাগান থেকে এক ঝাঁক পাখি ডানা মেলে উড়ে যায় আকাশপারে। আজান শেষ করে আয়াত আলী রোয়াক পেরিয়ে ঘরে ঢুকে দুই মেয়ের গায়ে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলে-টিয়া পাখি ওঠো, পরীবানুও ওঠো। কখন সকাল হয়িচে, ওঠো।
দুই মেয়েকে জাগিয়ে তুলতে গিয়ে বড় মেয়ে ময়নার কথাও মনে পড়ে যায়। সে আছে ফুপু-বাড়ি। নিজের ছেলেমেয়ে নেই, ভাইয়ের মেয়েদের উপর খুব দরদ একমাত্র ফুপুর। বাড়ি তার দূরে নয়। এ-পাড়া ও-পাড়া। ভাইয়ের বাড়ি এলেই যাবার সময় সে ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ময়না অথবা টিয়াকে। এবার পালা পড়েছে ময়নার। গতকাল সন্ধ্যায় সে গেছে ফুপুর সঙ্গে। কাজেই নতুন এই আনন্দ সংবাদটি তাকে বাদ রেখে অন্য দু’জনকেই জানায় আয়াত আলী।
তুমাদের যে একটা ভাই হয়িচে! তুমাদের দ্যাখ্যার জন্যি সে কাঁদছে। তাকে দ্যাখ্পা না তুমরা?
টিয়া এবং পরি দুজনেই লাফিয়ে ওঠে। এক নিমিষে চোখ থেকে ঘুমের জড়তা কেটে যায়। বাইরে থেকে ভেসে আসা শিশুকন্ঠের ধ্বনি তাদের নিঃসংশয় করে দেয়। তখন আর তাদের ঠেকায় কে! দু’জনেই পা বাড়ায় ঘরের বাইরে। কী ভেবে টিয়া পাখি ঘুরে দাঁড়ায়, বাপের কাছে-এগিয়ে এস দাবি জানায়-আমাদের মিষ্টি খাওয়াবা না আব্বা?
মিষ্টি খাওয়াবে না মানে! আয়াত আলী তো ঘোষণা দিয়েই রেখেছে, পুত্র সন্তান হলে এই ভবেরপাড়া গ্রামের সবাইকে সে মিষ্টি খাওয়াবে। খ্রিস্টানপাড়ার লোকজনকেও বাদ দেবে না। তারা পড়শি, তাদেরও হক আছে বই কি! টিয়া পাখির মাথায় হাত রেখে মিষ্টি হেসে আশ্বস্ত করে সে,
হ্যাঁ, মিষ্টি তো খাওয়াবই। সারা গ্রামের লোককে খাওয়াব।
অবুঝ হয়ে আবদার করে টিয়া পাখি,
না, আমরা এখনই খাব।
আজ আর কোনো কিছুতেই না করে না আয়াত আলী। সোজা জানিয়ে দেয়, আচ্ছা আমি মিষ্টি আনতে যাচ্ছি। তুমরা যাও, ভাইকে দ্যাখো গা।
আর দেরি করে না আয়াত আলী। ঘর থেকে উঠোনে নেমে একচালা ছাপড়ার তলা থেকে সাইকেলটা বের করে আনে। যাবে সে কেদারগঞ্জের মোড়ে। স্বাধীনতার পর এ ক’বছরে দেখতে দেখতে জায়গাটা বেশ বাজার মতো হয়ে উঠেছে। ভবেরপাড়া থেকে এইটুকু পথ বেশ পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়। তবু সে তার মাডগার্ড খোলা হিরো সাইকেলটা সঙ্গে নিয়েই বেরোয়। যত তাড়াতাড়ি এনে মেয়ে দুটোর সামনে ধরা যায় ততোই তারা খুশি হবে। ভাবনাটা একটু পরিবর্তন করে আয়াত আলী। মিষ্টি এনে প্রথমে সে তার মায়ের হাতেই তুলে দেবে। তারও একটা নাতির শখ অনেক দিনের। আজ প্রথমে তার মাকেই মিষ্টিমুখ করাবে, তারপর অন্যদের কথা। পাড়া-পড়শি যারা আজ ছেলে দেখতে আসবে সবাইকে আজ মিষ্টিমুখ করাবে। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে সাইকেলের প্যাডেলের পা রাখতে গিয়ে হঠাৎ তার কাদামাখা পা হড়কে যায়। তখনই নবজাতক শিশুটি আবার কেঁদে ওঠে। আয়াত আলীর কান খাড়া করে। পথের পাশে ভেজা দুর্বাঘাসের ডগায় পায়ের কাদা মুছতে মুছতে মনে হয়– ছেলেটার মুখ দেখার জন্য তাকে যদি একবার ডাকতো! নিদেনপক্ষে টিয়া পাখিও যদি পিছন থেকে ডেকে বলতো– তুমি একবার ভায়ের মুখ দ্যাখবা না আব্বা? কিংবা টিয়ার দাদি যদি বলতো– অ বাপ, তুমার সুনার চাঁদ ছেইলিডার মুখটা দেইখি যাও দিনি!
নাহ, কেই ডাকেনি। মা বলেছে আজান দিতে, সে আজান দিয়েছে। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। সে নিজে মুখে কেমন করে পুত্র দর্শনের আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করে মায়ের সামনে! সাইকেলে উঠতে উঠতে সে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, আচ্ছা থাক, মাকে মিষ্টিমুখ করানোর পরই না হয় দেখবে ছেলের মুখ। বিশু ময়রার দোকানের সবচেয়ে ভালো পদের মিষ্টি নিয়ে তবেই সে বাড়ি ফিরবে। পুনর্বার সাইকেলে উঠে বসার পর এতক্ষণে তার হঠাৎ মনে পড়ে, সাতসকালে দোকান খুলেছে তো বিশু ময়রা! আবার নিজেকে বুঝায়, দোকান না খুললেই সে ছেড়ে দেবে! বল্লভপুরে গিয়ে বাড়ি থেকে ধরে আনবে না তাকে! সে না থাকে তার ছেলে নিত্যকে সাইকেলে তুলে এনে দোকান খুলিয়ে নেবে। নিত্যর উপরে জোর খাটাবার মতো অধিকার তার আছে। আজ তার মিষ্টি না হলে চলবেই না।
ভবেরপাড়ার পরের গ্রাম মানিকনগর। কেদারগঞ্জ তারও পরে। তা সেই মানিকনগরে ঢোকার মুখেই নিমাই পালের সঙ্গে দেখা। বাপের বয়সী এই মানুষটিকে সে খুবই শ্রদ্ধাভক্তি করে, আশ্চর্য হয়ে তার হাতের নিপুণ কাজ দেখে, মাটির প্রতিমা তার হাতে যেনবা বাক্সময় হয়ে ওঠে; মুখের উপরে প্রসংশা করলে লাজনম্র ভঙ্গিতে সে বলে– মুসলমানের ছেলে হয়ে তুমি এসবের কী বুঝ্বা বাপ! এভাবে বললেও মনে মনে সে আয়াত আলীকে যথেষ্ট ভালোবাসে। কাজের ফাঁকে ঠোঁটের কোনে বিড়ি ঝুলিয়ে নিজে থেকেই সে বুঝতে চেষ্টা করে– বোধন কাকে বলে, দেবীর চক্ষুদান কখন ঘটে এইসব ধর্মীয় উপাখ্যান। সাতসকালে সেই মানুষের হঠাৎ এমন কী হলো কে জানে! আয়াত আলী পুত্রজন্মের সুসংবাদ জানাবার জন্যে সাইকেলে ব্রেক করে দাঁড়িয়ে পড়ে, একবার উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ডেকেও ওঠে– অ নিমাই কাকা! কাকা! কী আশ্চর্য, লোকটি যেন তাকে চিনতেই পারে না। একবার শুধু আয়াত আলীর মুখের দিকে তাকায়, তারপরই বামদিকের রাস্তায় হনহন করে হেঁটে চলে যায়।
বিস্ময়ের অবধি থাকে না আয়াত আলীর। হঠাৎ নিমাই কাকার এমন আচারণের কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না সে। মনে মনে খুব দুঃখ পায়। এত বড় সুসংবাদটা তাকে জানানোই গেল না! পাশাপাশি গ্রামের মানুষ বলে তো শুধু নয়, আয়াত আলীর বাবা বিলাত আলীর সঙ্গে গলায় গলায় ভাব ছিল নিমাই পালের। নিজের ভাই নিতাই পাল আর সতীশ পাল বর্ডার টপকে চলে গেলে বন্ধু বিলাত আলীকেই আঁকড়ে ধরে সে, সুখ দুঃখের কত কথা যে গুনগুন করে শোনায় তার কি ইয়াত্তা আছে! শৈশব কৈশোরে এসব দৃশ্য তো খুব কাছে থেকে দেখেছে আয়াত আলী! বাপের মৃত্যুর পরও নিমাই কাকার সঙ্গে সম্পর্কের সুতোটা তো শুকিয়ে যেতে দেয়নি আয়াত আলী! হঠাৎ কোথায় কী যে ঘটে গেল তার আগা মাথা কিছুই খুঁজে পায় না সে।
এমন একটা শুভদিনে ভারি মন খারাপ হয়ে যায় আয়াত আলীর। অথচ এটা তো ঠিক, তার পুত্রলাভের আনন্দ-সংবাদ জানতে পারলে নিমাই কাকারও মন ভাল হয়ে যাবে। তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরবে। সব কাজ ফেলে রেখে নাতি-দর্শনের জন্যে ছুটে যাবে ভবেরপাড়ায় তাদের বাড়ি। মানুষটাকে তো সে ভালোই চেনে। মাটির কাজ করতে করতে মনটা হয়ে গেছে মাটির মতো নরম। কী জানি কোথাও বড় কোনো ধাক্কা খেয়েছে কি না! আয়াত আলী মনে মনে স্থির করে বাজার থেকে মিষ্টি নিয়ে ফেরার পথে নিমাইকাকাকে ঠিক ধরে নিয়ে যাবে। তখন নিশ্চয় জানা যাবে কেন তার মন খারাপ, কিসের জন্যে তাকে এভাবে মুখ ফেরাতে হলো।
মানিকনগর থেকে কেদারগঞ্জ কতটুকুই বা দূরত্ব! সাইকেলের প্যাডেল কয়েকপাক ঘুরতে না ঘুরতেই সে পৌঁছে যায় কেদারগঞ্জ মোড়ে। বিশু ময়রার দোকানের চাটাইয়ের সাথে হেলান দিয়ে সাইকেলটা রাখার পর তার নজরে পড়ে মিষ্টির দোকান শুধু নয়, বাজারের সব দোকানই প্রায় বন্ধ। শ্রাবণ আকাশ নুয়ে আছে, তবু বেলা যতটুকু ওঠার তা তো ঠিকই উঠেছে। কিন্তু শিলকড়ুইয়ের ছায়ায় ঢাকা এই গ্রাম্য বাজারে প্রাণের স্পন্দন বলতে যেন কিছুই টের পাবার উপায় নেই। আয়াত আলী তখন কী করে! মিষ্টি না হলে যে তার চলবেই না। তবে কি সাইকেল মেরে বিশু ময়রার বাড়ি পর্যন্ত যাবে সে? নিত্যকে সাইকেলে তুলে নিয়ে আসবে বাজারে? বিশু ময়রার আগমন পথের দিকে চোখ সরু করে তাকাতে গিয়ে এতক্ষণে তার নজরে পড়ে পূর্বদিকে নদীপাড়ে এক চায়ের দোকানে চুলো জ্বলছে গনগন করে। বেশ কিছু লোকজন গোল হয়ে ঘিরে আছে দোকানটা। সেই দোকানে সন্তোষ রেডিও বাজছে গমগম করে। আয়াত আলী পায়ে পায়ে এগিয়ে যায়। গোলাকার বৃত্ত ভেঙে একটা লোক রেগে মেগে বেরিয়ে আসে এবং হাতের আঙ্গুলে ধরা চায়ের কাপটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে– অসম্ভব! এ হতেই পারে না।
অসম্ভবটা কী?
সে উত্তর কর্কশ কন্ঠে ঘোষিত হচ্ছে রেডিও থেকে। কে একজন মেজর জনগণকে শান্ত থাকার এবং ঘর থেকে বাইরে না বেরোবার আদেশ জারি করছে। কেন, স্বাধীন দেশের মানুষ ঘরের বাইরে আসবে না কেন? কারণ রাতের অন্ধকারে তারা দেশের রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার মতো অসম্ভব ঘটনা ঘটানোর পর জরুরি অবস্থা জারি করেছে। আকাশ ফাটানো বিদ্যুৎ চমকের মতো এসব খবর শুনে আয়াত আলীর সারা শরীর কেঁপে ওঠে, হাতে পায়ে বল পায় না। রেডিও থেকে এই ঘোষণা বারবার প্রচারিত হচ্ছে। আয়াত আলীর কানও যেনবা বধির হয়ে যায়। এ অবস্থায় কী করবে সে? বিশু ময়রার দোকানের মিষ্টি কেনার কথা আর মাথায় আসে না তার। নবজাতক পুত্রের চেহারা এখনো সে দেখেনি। তবু তার আকর্ষণেই সে বাড়িমুখো রওনা দেয়। কিন্তু সাইকেলের প্যাডেল থেকে বারবার পা হড়কে যাওয়ায় ভয়ানক বিরক্ত হয়। সেই বিরক্তি প্রকাশের জায়গা না পেয়ে ক্ষোভে দুঃখে এতদিনের সাইকেলটা রাস্তার পাশে ফেলে রেখে সে দৌড়ুতে শুরু করে। কেন যেন তার মনে হয় ঘাতকের কালো হাত বহুদূর বিস্তৃত, তার শিশুপুত্রটিকে হত্যা করাও তাদের পক্ষে অসম্ভব নয়। সেই কালো থাবা থেকে নবজাতককে রক্ষার জন্যেই সে দৌড়োয়।
দৌড়ুতে দৌড়ুতে মানিকনগরে এসে নিমাই কাকার মুখ মনে পড়ে যায়। স্মরণ করতে চেষ্টা করে, কী ছিল সেই মুখের মানচিত্রে? আতঙ্কের অগ্নিছায়া? হতাশার বিষন্ন মেঘ, নাকি অন্য কিছু? এত বড় জাতীয় বিপর্যয়ের খবর সে কি তবে আগেই জেনেছিল? আয়াত আলীর ভাবনা হয়, তার পুত্রসন্তান লাভের সুসংবাদ এখন এই বিপর্যস্ত অবস্থায় কেমন ভাবে গ্রহণ করবে নিমাই কাকা?
মুজিবনগর যাবার প্রধান রাস্তা থেকে সামান্য একটু দূরে নিমাই পালের বাড়ি। মানিকনগরের সেই মোড়ে এসে দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আয়াত আলী। কী করবে সে, যাবে নিমাই কাকার বাড়ি? কাকা যদি এখন সেই মূর্তিটার কথা জিগ্যেস করে, তাহলে কী বলবে সে? যদি জানতে চায়– শেখ মুজিবের মূর্তিটা এখন কোথায় বসাই বলো তো বাপু! একটা মূর্তি বানাবার জন্যে তো কম জ্বালাতন করেনি!
ঢাকা থেকে বহুদূরের প্রত্যন্ত সীমান্ত মুজিবনগরে কখনো শেখ মুজিব আসেন নি বলে তাঁর মূর্তি বানাবার কথা উঠেছে। অতিচেনা বৈদ্যনাথতলা যেদিন মুজিবনগর হয়ে যায় সেই ঐতিহাসিক দিনে নতুন সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান করেছে যে সব আনসার সদস্য, আয়াত আলী তাদের একজন। যুদ্ধের পর কেউ কেউ পরিহাস করে শুধায়– কাকে স্যালুট দিয়িছো তুমরা?
রাগে শরীর জ্বলে যায় আয়াত আলীর, এ কী একটা প্রশ্ন হলো! মুজিবকোট পরে মঞ্চে দাঁড়ানো নেতাদের সবাইকে তার শেখ মুজিব বলে মনে হয়েছে। চোখ বুজলে এখনো সে দিব্যি দেখতে পায়– সেদিন এই আমবাগানের দাঁড়িয়ে মনে মনে স্যালুট করেছে শেখ মুজিবকেই। মুজিব নেই, এ কথা মনেই হয়নি। অথচ সবাই বলে, তিনি এখানে আসেননি। বছরের এই একটি দিনে তারা আশা করে, তিনি আসবেন। আয়াত আলী খুব জোর দিয়ে বলে, অবশ্যই আসবেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই, এখানে এই নিভৃত পাড়া-গাঁয়ে আসার সময় হয়ে ওঠেনি তাঁর। মনের দুঃখে আয়াত আলী আবদার জানিয়ে রেখেছে নিমাই পালের কাছে– এবার একটা মূর্তি গড়ে দিয়ো তো কাকা! আমরা ক’জন ইবার না হয় শেখ মুজিবের মূর্তিকেই স্যালুট করব। প্রস্তাব শুনে হেসেছে নিমাই পাল।
নাহ্, আজ আর নিমাই কাকার সামনে গিয়ে কাজ নেই। আয়াত আলী দ্রুত পা চালায় বাড়ির পথে। ভবেরপাড়া এখনো খানিকটা দূরে। কিন্তু পথে মানুষজন নেই কেন! বেলা তো কম হয়নি! সবাই কি তাহলে রেডিওর ঘোষণা শুনে বাইরে বেরুনো বন্ধ করেছে! এভাবে বালিতে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করার মানে হয়!
আয়াত আলী বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াতেই দুই মেয়ে তাকে জাপটে ধরে। সারা শরীর তার শিউরে উঠে। টিয়াপাখি ঘাড় তুলে বাবাকে প্রশ্ন করে, আমাদের ভাইডাকে তুমি দ্যাখবা না আব্বা?
শুরুতেই মিষ্টির কথা না তোলায় খুব স্বস্তি বোধ করে আয়াত আলী। মনে মনে ভাবে, কী যে ভুলো হয়েছে মেয়ে দুটো! বেশ হয়েছে। টিয়াপাখির মাথায় হাত রেখে সে বলে,
তুমাদের ভাই দেখতি কেমন হয়িচে মা?
ও আব্বা, একেবারে রাজা-বাদশার মতোন। সুনার চন্দের মতোন। চলো দ্যাখবা।
বাপের হাত ধরে হিড় হিড় টেনে আঁচিঘরের সামনে নিয়ে আসে টিয়া। দাদিকে ডেকে বলে, এই যি দাদি, তুমার খোকা এসিছে।
কোলের পোটলা আরো একটু জড়িয়ে ধরে এক গাল হেসে ছেলের সঙ্গে তামাশা করে টিয়ার দাদি– মিষ্টি কই বাপ! মিষ্টি না হলি তো তুমার খোকার মুখ দেখা হবে না।
মুখে যা-ই বলুক, নবজাতককে ঠিকই আয়াত আলীর হাতে তুলে দেয় তার মা। এতক্ষণে টিয়ারও যেন মনে পড়ে যায় মিষ্টির কথা। সেও দাবি করে, মিষ্টি কই আব্বা? মা এবং মেয়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আয়াত আলী দু’হাতের আঁজলায় ধরে রাখা শিশুপুত্রের মুখের দিকে অপলকে চেয়ে থাকে। এরই জন্যে এতদিনের অপেক্ষা? চারিদিকে এত অন্ধকার, তবু এত আলো! ভেতরে ভেতরে কী যে ওলোট পালোট হয়, তার দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অশ্রুদানা। একটুখানি ফুঁপিয়ে ওঠে যেনবা। তার মা চমকে উঠে প্রশ্ন করে,
কী হয়িচে বাপ তুমার?
সর্বনাশ হয়িচে মা।
সবার চোখেমুখে গভীরে উৎকন্ঠা। মা-মেয়ে স্ত্রী সবাই তাকিয়ে আছে আয়াত আলীর মুখের দিকে। কেবল নবজাতক আছে দু’চোখ মুঁদে, নিরুদ্বেগে। এরই মধ্যে শক্তিশালী বোমার বিস্ফারণ ঘটায় আয়াত আলী।
শেখ মুজিব বেঁচে নেই মা। তাকে হত্যা করা হয়েছে।
এইটুকু বলার পর আয়াত আলী চমকে ওঠে। নিজের কন্ঠ নিজের কাছে অচেনা মনে হয়। সকালে রেডিওতে শোনা কর্কশ কন্ঠেরই প্রতিধ্বনি যেনবা আছড়ে পড়ে তার বাগযন্ত্র দিয়ে। তখন প্রবল বিবমিষার উদ্রেক হয় তার ভেতরে। কিন্তু এ কী! তার মা যে চোখ বন্ধ করে সংজ্ঞা হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে! তখন কী করে আয়াত আলী? নবজাতক পুত্রকে অতিদ্রুত তুলে দেয় স্ত্রীর কোলে। তারপর বৃদ্ধা মায়ের চোখে পানির ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফেরাতে তৎপর হয়। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফেরামাত্র দু’হাতে বুক চাপড়ে বৃদ্ধা হাহাকার করে ওঠে– শেখ মুজিব নেই! শেখ মুজিব নেই!
‘নেই’- এই সত্যটুকু মানতে পারে না গ্রাম্য বৃদ্ধা, আয়াত আলীর মা। এমনিতে গতরাতে তার উপরে অনেক ধকল গেছে, সেই সঙ্গে বিরামহীন বিলাপ তাকে যথেষ্ট দুর্বল করে ফ্যালে। তবু নবজাতক নাতিটিকে তার কোলে চাই। স্নেহময়ী দুই হাত বাড়িয়ে বউমার কোল থেকে সে তুলে নেয় আদরের নাতিকে। রক্তিম দুই গালে এঁকে দেয় মমতার চুম্বন। তারপর কী যে উদয় হয় তার মাথায়, সহসা তার ছেলের চোখে চোখ রেখে গভীর প্রত্যয়ে ঘোষণা করে, মুজিবুর মরবে কেন হা বাপ! এই যে আমি তুমার খোকার নাম রাখছি মুজিবুর।
আকস্মিক এই ঘোষণা আয়াত আলীকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। ঘরের রোয়াকে থেকে সে নেমে আসে উঠোনে। তার খুব ইচ্ছা করে আনসার বাহিনির অবশিষ্ট এগার জনকে ডেকে এনে এই উঠোনে দাঁড়িয়ে আবারও একটা গার্ড অব অনার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। না হোক ১৭ এপ্রিল, আজকের এই দিনে মহান নেতার প্রয়াণে শেষ স্যালুট জানালেই বা ক্ষতি কী!
কিন্তু আয়াত আলী সেই একাত্তরের সাথিদের ডেকে হেঁকে যে একত্রিত করবে, তার প্রিয় বাহন মাডগার্ড খোলা সাইকেলটি এখন পাবে কোথায়!