বউ মরা কুত্তাটার স্বভাব তো পুরা মিনমিনে মিনসি শয়তানের মুতন রে! হারামিডারে ধরি বাইন্ধি রাখ! সুমুন্দির পো আমার থিক মজা নিবি! ওক আমি ছাইড়ি দিবোনানিরে রফিক!
নিজ হাতে জবাই করা মুরগি কিংবা গরু-ছাগলের হাত পা যদি ভালো করে ধরা না থাকে, তড়পানি কিংবা লম্ফঝম্ফের ব্যাপারটা একটু না, বেশ ভালো করে জেনে যায় আশপাশে থাকা মানুষ। কিংবা অন্যমনস্ক কোনো অস্বাভাবিক ব্যক্তিও এদিক তাকিয়ে বলবে, আরে আরে মুরগিটারে ধরো! অথবা ঐ ব্যাটা গরুর পা দুইটা শক্ত কইরা ধর, কী চায়া চায়া মজা দেহস!
বিবি হাওয়ার চিল্লানির গতি বা ধরণ এখন কিছুটা জবাইকৃত পশুর আকার নিয়ে নিয়েছে। সার্কাস কিংবা সাপ খেলা দেখানোতে যেমন মানুষের ভীড় হয়, এখানেও তেমনই হয়েছে। বিবি হাওয়ার চিল্লানির গতি এখন ঐ আগের মতন নেই, তারচে আরেকটু বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে!
একটু ভিতু ভিতু চোখ, ফোলা ফোলা গাল, ফোঁপাতে ফোঁপাতে ধরে আসা গলা আর পানিশূন্য চোখ; এতকিছুর এক চরম কম্বিনেশন নিয়ে বাড়ি ফেরত কাউকে দেখলে যে কেউ দুঃখের জয়গান উঠাতে পারে। গ্রাম কেন, শহর বন্দর সবকিছুকে ডেকে ডেকে বলে দিতে চায় সবাই যে এর মতো একটা ভালো মেয়েও হ্যারেজমেন্ট থেকে বাঁচতে পারল না যখন, তোমরাও তো পারবে না, রাষ্ট্রকে গালি দিয়ে নিচু নিচু করেও ক্ষান্ত হতে পারে না সদ্য স্বামী চলে যাওয়া মেয়ের মা!
বিবি হাওয়া কথাবার্তার বাড়তি চাল এখনো চেলেই চলেছেন!
কেউ কেউ থানা পুলিশ থানা পুলিশ করলে ‘চুপ কর শুয়োরের বাচ্চা’ বলে চুপ করিয়ে দিচ্ছেন বিবি হাওয়া। অপরিচিত কেউ যখন এসে ‘কী হয়েছে’ বলে জিজ্ঞাসা করছে তখন কেউ কেউ বলছে এই তেমন কিছু না বিবির মেয়েরে কে যেন রেইপ করার চেষ্টা করেছে তাই একটু সমস্যা! প্রশ্নের এমন উত্তরে সব অপরিচিতজন অবাক আর বিস্ময় নিয়ে বাড়ি ফিরছে।
নামটা যদি শুধু ‘হাওয়া’ হতো কিংবা শুধু ‘বিবি’ তাহলে তো কোনো না কোনো একটা মানে থাকতই। সবাই ডেকেও আরাম পেত। কিন্তু এই প্রথম মহিলার মতো নাম কেন রেখেছিল বিবি হাওয়া? একদিন নিজে নিজেই রাস্তার সাথে নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়ে বড় হওয়া বটগাছটার ছায়ায় বসে বসে বলেছিলো যে, তাদের বংশ হলো পীর জাতের। মানে মানুষের আত্মশুদ্ধি কিংবা চরিত্র গঠনে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম থাকে। তার কোনো এক পূর্বপুরুষ নাকি একবার আসমানেও ভ্রমণ করেছিলেন। দেখেছিলেন বায়ুমণ্ডলে খোদার কারুকার্য, পানির তর্জনী কিংবা আসমানি মানুষদের সাক্ষাৎ! সেখানেই দেখা হয়েছিলো আদমের আকৃষ্ট কিংবা চাহনির মহা মানবী হাওয়া’র সাথে!
তিনি পৃথিবীতে ফিরে এসে ওসিয়ত করে গিয়েছিলেন যেন তার বংশে কোনো মেয়ের নাম বিবি হাওয়া রাখা হয়। অতি আগ্রহী মানুষজন ধীরে ধীরে প্রলাপ বকছে বলে উঠে যায়। কিংবা হাসতে হাসতে ভেতরের আগ্রহশূন্য অন্তরকে উজাড় করে দিতে দিতে খোয়া ভাঙা রাস্তা মাড়াই। বয়সে ছোট বাচ্চাগুলোও কখন যে ছুটাছুটি শুরু করেছে, সে খেয়াল করার আগেই আবার মেয়ের ডাক পড়ে!
রূপকথার গল্প বলতে বলতে বিভোর হয়ে থাকা হাওয়ার কর্মের বালাই নেই বললেও ভুল হবে। একটু আকটু নিজেকে সামলে নেওয়ার মতো সুস্থ অবস্থায় এখনো তিনি বহাল।
ঝুমুর। বিবি হাওয়ার একমাত্র আদুরে মেয়ে। গোলগাল মুখ, ডাগর চোখ কিংবা কাজল পরা চোখ; এগুলোর কোনোটায় নেই ঝুমুর ভেতর। চুপচাপ বোবা কোনো মানুষের মতো রান্নাবান্না করা, ঘরদোর ঝাড়ু দেওয়া, আর কাপড় কাচতে বাড়ির অদূরে পুকুর পাড়ে যাওয়া ছাড়া অন্যসময়ে দেখাই মিলে না। অথচ এগুলোও একেবারে ছোটখাটো কিংবা অল্প সময়ের কোনো কাজ একেবারেই নয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এসব কাজ করেও সেরে উঠতে না পেরে মাঝেমাঝে নিজের উপরই খুব বিরক্ত হয় ঝুমুর। তখন বিবি হাওয়ার থেকে পাওয়া শ্যামলা মুখাবয়বে একটু লালচে কিংবা ঝাঁঝালো রাগের আভা স্পষ্ট হতে দেখা যেত।
বিবি হাওয়ার রাস্তায় পড়ে পড়ে চিল্লানির যে দায়িত্বটা ছিল সেটা বেলুনের মতো চুপসে যেত। ছোট নাতনিটাকে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বের হবে হবে করেও হয় না। মেয়ে বাড়িতে একা একা থাকবে এই ভেবে আরো একটু ঘরের দেয়াল ঘেঁষে বসতে বসতে জুবু বলে ডাক দেয়। পিচ্চিটা বিড়ালের বাচ্চা ডাকার মতো আওয়াজ করে জানান দেয় যে ‘আমি এখনো জেগেই আছি, ঘুমাইনি নানি’।
সারাদিন বিবি হাওয়ার এসব ভুলভাল চিল্লানি, মাঝে মাঝে নাতনিকে ডাকা আর মেয়েকে পাহারা দেওয়াতেই দিন পার হয়ে যেত।
দোকানের মন্ডল চা’ ওয়ালা খুব রসিক। যাকে তাকে অল্পতেই বসে নিয়ে তার কথামতো কাজ করিয়ে নিতে পারে। স্কুলে যাওয়া পিচ্চি কোনো ছেলেকে দেখলেই কিছু একটা করিয়ে নিতে মন চায়। এইযে এখন সামনে দিয়ে একটা ক্লাস টু’য়ের যে ছেলেটা যাচ্ছে ওকে দিয়ে পাঁচ লিটারের একটা পানির বোতল ভরে আনতে বললে পিচ্চিটা খেঁকিয়ে উঠে ‘আমি পারব না যাও’ বলে সামনে এগোতে এগোতেই পেছন থেকে দোকানির ‘শুন দাদা একটা টোস বিস্কুট পাবিনি কিন্তু তুই’ শুনে ছেলেটা আবার পিছিয়ে আসে। কোঁকাতে কোঁকাতে বয়স কিংবা শরীরের তুলনায় অধিক ভার জিনিস বইতে হচ্ছে বলে বেশ হাঁপাচ্ছে যে ছেলেটা, তাকে আধাখাওয়া একটা বিস্কুট দিয়েই মুখ ফিরিয়ে চলে যাওয়ার জন্য তাড়া দিলো। পিচ্চিটা এঁটো বিস্কুটের টুকরোটুকু পেয়েই খুশি মনে দৌড়াতে দৌড়াতে স্কুলের পিটি ধরতে গেল।
মন্ডল দোকানদার এমনই।
ঝুমুর স্বামী যে ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে সেটা মন্ডলও জানে। জানে মহল্লার সবাই। এক বাচ্চা জন্ম দিয়েই ‘আমার দায়িত্ব শেষ’ এমন ভাব করে উধাও হয়ে যাওয়া পুরুষের স্ত্রী হলো ঝুমু। বেড়ে ওঠা আঠারোর গন্ডি পেরোয়নি বলে এখনো উচ্ছ্বাস কিংবা উদ্দীপনার ব্যপারটা ধুলোর পুরুটে আটকায়নি। থেকে আছে সব। সব।
ঝুমু থ্রি পিচ কিংবা শাড়ি ব্লাউজ যাই পরুক, বেড়ে ওঠা শরীরের সময় তো চলে যায়নি একেবারে। মন্ডল তাকিয়ে থাকে। অপেক্ষায়ও থাকে। ঝুমু পুকুরপাড়ে যাওয়ার সময় টুপি কিংবা গামছাটা দিয়ে বলে ঝুমুর এইটা একটু ধুয়ে দিয়ে যাস তো মা! খানিক ঝুঁকে হাত থেকে ময়লাভরা টুপি অথবা গন্ধযুক্ত গামছা নেওয়ার সময় মন্ডলের গরম শ্বাস-প্রশ্বাসের আভা নিজ হাতেও লাগে!
কখন যে কী দরকার হয় নিজেও না বুঝে হাসফাস করতে থাকা বিবি হাওয়ার প্রেশার উঠতেও সময় লাগে না। আবার একেবারে কমে মাথা ব্যথা কিংবা অস্থির হয়ে যেতেও কোনো নির্ধারিত ক্ষণ লাগে না। কান ঝাঁঝালো মার্কা গালিগালাজ করতে করতে রাস্তায় রাস্তায় যখন হাঁটে তখন দেখে ঝুমু হয়ত দোকান থেকে সয়াবিন কিংবা সরিষার তেল নিয়ে বাড়ির দিকেই আসছে। হাওয়ার চিল্লানি বাজ পড়ে সেকেন্ডে মরে গিয়ে স্থির হওয়ার লোকেদের মতো হয়। এতোটাই চুপচাপ হয়ে যায় যে আগুনে দেওয়া লোহার কড়ায়টা পুড়ে ছাইপোড়া গন্ধ আসার পরেই তার স্মরণ হয় যে, আরে আরে কড়ায়টা তো পুড়ে কালো হয়ে গেল!
তিন বেলা রান্নার দরকার হলেও খিস্তি নিতে না পারায় সকালেই দু’বেলার রান্নার কাজ করে অন্যকাজে মন দেয় ঝুমু। একবেলা বিবি হাওয়া চুলোর পাড়ে যায়। আর ওতেই বাধে যত বিপত্তি।
মন্ডলের দোকানে হালখাতা আজ। শহুরে দোকানিদের মতো সাজসজ্জা না করতে পারলেও সামনে একটা ওয়েট পেপার দিয়ে ‘শুভ হালখাতা’ লেখা কার্ড ঝুলিয়েছে। লাল নীল পাতলা রঙিন কাগজের একপাশে এ্যারারোটের আঠা লাগিয়ে ঝুলানো হয়েছে দরজায়। জানালায়। বসার টুলে দোকানের হুডে আর রাত্রি ফর্সা করা লাইটগুলোকেও আর নিজস্ব অস্তিত্বে রাখা হয়নি।
দোকানের পাশে আতা গাছের নিচে কসাই ছাগল জবাই করে কেটেকুটে মাপার কাজ শুরু করে দিয়েছে। রাজু ডেকেরেটর থেকে আনা হয়েছে বড়বড় পাতিল আর ছোটছোট প্যাকেট আনা হয়েছে সবাইকে ভূনা খিচুড়ি বেড়ে দেওয়ার জন্য। মন্ডলের কাজ খুব!
সরকারি কোনো অধিদপ্তরে গেলে যেমন লম্বা সিরিয়াল দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হয়, মন্ডলের দোকানও তার থেকে কোনো দিক থেকে একেবারেই কম নয়। হাসিখুশি পুরো বছরের পাওনা আদায় করে খিচুড়ির পোটলা হাতে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে সবাই। কেউ কেউ সাথে ছেলে কিংবা বুড়োরা তাদের নাতনিকেও এনেছে বাড়তি প্যাকেট আদায় করবার অভিলাষে। বুড়ো মন্ডলও কম নয়, পিচ্চিপাচ্চাদের জন্য একটা মিষ্টি দিয়ে ছোট্ট ভিন্ন পলিথিনে আলাদা করে রেখে দিয়েছে। এই যেমন ‘ঐ নাসির কাকার নাতনিটারে একটা খাবার দেতো’ বলার সাথে সাথে কর্মচারীরা অজান্তেই তটস্থ হয়ে একটা মিষ্টির দলা ধরিয়ে বিদায় করছে।
শেষ রাতের তারা মিশে গেল কোন আসমানে, লাল কুসুম সূর্য হারালো কোন দিগন্তে। শেষ হলো হালখাতার দিন কিংবা রাত।
ঝুমুর টেনশনে মাথার রগ সেকেন্ডে কতবার উঠানামা করছে সেদিকে খেয়াল নেই। চোখের সাদা অংশ গুড়ো মরিচের মতো টকটকে লাল। গরমে ঝাঁঝ বের হচ্ছে মনে হয়। চুল বেয়ে কপোল তারপর ঠোটের স্পর্শ পাওয়ার আশায় খুব দ্রুত ঘাম চুইয়ে চুইয়ে আসছে। ওষ্ঠদ্বয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কী প্রবল আকাঙ্ক্ষা ফোটা ফোটা নোনা জ্বলের? হিংস্র ভাব নিয়ে ওড়নার একপাশ দিয়ে মুছে ফেলে সব আকাঙ্ক্ষিত বস্তুদের।
সময়ে সময়ে মানুষের ক্রোধ কিংবা রাগের মাত্রা কমতে বাড়তে থাকে। শ্বাস প্রশ্বাসের মতো ঠান্ডা বায়ু ভেতরে ঢুকলেও বেরিয়ে আসে গরম অসহনীয় কিছু তাপমাত্রা নিয়ে। মন মস্তিষ্কের প্রতিটা ব্যাপার এমন না হলেও এর থেকে কোনোদিক থেকে একেবারে কমও নয়।
রাতের গভীরতা এখন মধ্যভাগ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় নেড়ি কুত্তাগুলোর আওয়াজও প্রায় থেমে গিয়ে দুর্বিষহ একটা অকাল পরিবেশ সৃষ্টি করতে কৃপণতা করছে না। ঝুমু হাঁটছে এসবের ভেতর দিয়ে। কিন্তু গা ছমছম কিংবা ভয়ের হাতুড়ি তো বুকের ভেতর জোরেও পিটাচ্ছে না! এমন আহবানে পা উঠতে গিয়েও উঠে না, চলতে চলতে পড়ে যাবে যাবে এমন ভাব নিয়ে চলার ভঙ্গিমা আসলেও মানুষের দুর্বলতা প্রকাশ পেতে কতক্ষণ?
খুব দ্রুত ফিরতে হবে। মন্ডলের দোকানের হালখাতার কার্ড ঝুমুরের হাতেও এসেছিল। বাকির অংকে লেখা ছিল বেশ মোটা অংকের টাকা। “চাচা আমি তো এতো টাকা কত থিক দিবোনি, আমার তো নাই কিচ্ছু। আমারে ছাড়ি দেও না” তখনই প্রস্তাবটা এসেছিল মন্ডল দোকানদারের কাছ থেকে। কিছু সময় নিজেকে সপে দিলেই নাকি সব দেনা পাওনা মিটে যাবে!
কত সহজ ভাবে প্রস্তাবটা পেয়েছিলো ঝুমুর! অথচ জীবনের আত্মসম্মান অথবা বোধের যে এক অস্থির টান এসে যায়। ঝুমুর তার চলে যাওয়া একমাত্র ভরসা স্বামীর কথা ভাবে। ভাবে নিজের সবচে প্রিয় সন্তান কিংবা তাদের ভবিষ্যৎ পরিচয়ের কথা! আচ্ছা, মানুষ কি ওকে বেশ্যার বাচ্চা বলে গালি দিবে?
ঝুমুর দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সন্তর্পণে এদিকওদিক তাকিয়ে ভেতরে ঢুকবে ঢুকবে বলেও ফিরে আসছে বারবার। হঠাৎ দোকানের দরজায় শরীরের পূর্ণ শক্তি দিয়ে দুই তিনটা লাত্থি দিয়ে গালাগাল শুরু করে ঝুমু। টকটকে লাল চোখ থেকে আগুনের ফুলকি বের হয়। জমা হয় এলাকাবাসী।
মন্ডল দূর থেকে বসে বসে এসব দেখে। মানুষের জড়ো হওয়াতে লোলুপতা উপরে ভর করে ভয়।