হঠাৎ করে এমন একটি কাণ্ড ঘটে যাবে বিমলার কল্পনায় আসেনি। বেড়ার সঙ্গে টানানো ফ্রেমহীন আয়নার কাচটি টনটনে শক্ত মাটিতে পড়ে ভেঙে গেছে।
মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাচের টুকরোর দিকে উঁকি দিয়ে বিমলা বলে উঠল, ‘ইস ভগবান। আমাগো আবার কোন বিপদের মইধ্যে ঠেইলা দিতেছ। বিপদ তো এমনিতেই আমাগো ছাইড়া যাইতে চায় না। জম্মের মতো জড়াইয়া রইছে।’
বুকের মধ্যে হঠাৎ করে বিমলার মনে একটি কামড় দিয়ে ওঠে। অনেকক্ষণ ধরেই দুই ছেলের কোনো সাড়া-শব্দ পাচ্ছে না। কোথাও গিয়ে কোনো বিপদে-আপদে পড়ল না তো? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে বলে উঠল, ‘হায় হায় রে আমার পোলা দুইডা গেল কই?’
দরজার সামনে মাটিতে পড়ে থাকা আয়নার ভাঙা কাচগুলো পরিষ্কার করে ছেলেদের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।
এ-বাড়ি ও-বাড়ি, এখানে-সেখানে ছেলে দুটোর নাম ধরে চিৎকার করে ডেকে খুঁজতে লাগল।
বিধান আর বাঁধন পিঠাপিঠি দুই ভাই। বিধানের চেয়ে এক বছরের ছোট বাঁধন। হৃদয়নন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে বিধান ও তৃতীয় শ্রেণিতে বাঁধন পড়ে। দুই ছেলেই বিমলার যক্ষের ধন। ছেলেদের ঘিরেই তার স্বপ্নভাঙা জীবনে নতুন করে স্বপ্ন বুনছে।
হৃদয়নন্দী গ্রাম। রাজৈর উপজেলার বুকের ওপরে বয়েচলা কুমার নদের পাশেই ছবির মতো একটি গ্রাম। নদটির পাশেই গ্রামের একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। যেখানে গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়ে পড়ে।
বিমলার স্বামী যতীন ঋষি হৃদয়নন্দী বাজারের মধ্যে বড় যে শিরিষ গাছটা আছে, ওই গাছটার নিচে দশ বছর ধরে জুতা সেলাই ও কালির কাজ করছে। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে কোনো দিন শরীরের প্রতি যত্নও নিতে পারেনি। চুপি চুপি যতীনের শরীরে নানা রকমের অসুখ বাসা বেঁধেছে। কিন্তু যতীন তাকে কোনো দিন পাত্তাই দেয়নি। ভাগ্য ফেরাতে নয়, শুধু খেয়েপরে বেঁচে থাকার জন্যই কাজ করে গেছেন।
শিরিষ গাছটার নিচে বসে কাজ করতে করতে একদিন সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বাজারের সবাই ধরাধরি করে যতীনকে রাজৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে ভর্তি করায়। সেদিন স্বামীর অসুস্থতার খবর শুনে বিমলা প্রায় অজ্ঞান হয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালে দৌড়ে এসেছিল।
এক দিন নয়, দুই দিন নয়। একটানা বিশ দিন চিকিৎসার পর হাসপাতালের বড় ডাক্তার আনোয়ার হোসেন বিমলাকে ডেকে বলল, ‘আপনার স্বামীর চিকিৎসা এখানে সম্ভব নয়। ঢাকায় নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করলে ভালো হয়ে যেতে পারে। আমাদের এখানে তার তেমন কোনো সুচিকিৎসা নেই।’
ডাক্তারের মুখ থেকে এ কথাটি যখন বিমলা শুনল তখন এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে গেল। স্বামী হারানোর মতো শোকাহত কান্না ও চিৎকার করতে লাগল। হাসপাতালের দু-একজন রোগীর আত্মীয়স্বজন এসে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলে আস্তে আস্তে একসময় বিমলার চিৎকারের আওয়াজ থেমে যায়।
স্বামীর ক্যান্সার ভালো হয়ে যাবে শুধু এই স্বপ্নটুকু বুকের ভেতরে লালন করে ওঝা, কবিরাজ, পির-হুজুর, সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে এক আকাশ বিশ্বাস ও ভক্তি নিয়ে জলপড়া, তেলপড়া, পানিপড়া তাবিজ-কবজপড়া সবই করেছে। কিছুই বাদ দেয়নি।
যখনই বিমলা কারও মুখে শুনেছে অমুকখানে এক কবিরাজ অথবা এক হুজুর কিংবা এক ব্রাহ্মণ ক্যান্সারের চিকিৎসা দেয়। পাগলের মতো সেখানে ছুটে গেছে। স্বামীকে সুস্থ করে তুলতে বিমলার সে কী আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু কোনো কিছুতেই যতীন সুস্থ হয়ে ওঠে না। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর ঘরের ছোট চৌকিটাই হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গী।
এভাবে দিনের পর দিন। রাতের পর রাত। মাসের পর মাস। প্রায় এক বছর বিছানায় থেকে কোনো এক গভীর রাতে নিঃশব্দে যতীন চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ে। সেই থেকে দুই ছেলেকে নিয়েই বিমলা তার লতানো লাউয়ের ডগার মতো শরীর নিয়ে যতীনের রেখে যাওয়া ভিটেমাটিতে জীবনসংগ্রাম করেই বেঁচে আছে।
এখানে, ওখানে খুঁজতে খুঁজতে হৃদয়নন্দী স্কুল মাঠে গিয়ে বিমলা দেখতে পায়, তার দুই ছেলে গ্রামের অন্য ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলছে। ছেলেদের মুখ দেখেই যেন বিমলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এতক্ষণ ধরে তার শুকিয়ে যাওয়া গলায় স্বস্তির জলের ধারা বইতে শুরু করে।
মাকে দূর থেকে দেখেই দুই ভাই এক দৌড়ে মায়ের কাছে ছুটে আসে। কিছুটা রাগের স্বরে বিমলা বলে, ‘তোরা এইহানে খ্যালতে আইসোস হেইডা আমারে কইয়া আবি না। আর এইহানে বল খ্যালার কাম কী?’
‘ক্যান, মা। কী অইছে খ্যাললে?’
‘এইহানের পোলাপান ভালো না। তোগো ল্যাং মাইরা হাত-পাও ভাইঙা দিলে ক্যামনে তোগো লইয়া ডাক্তারের ধারে যামু। ল ল বাড়ি ল। এইহানে তোগো খ্যালার কাম নাই।’ মায়ের সঙ্গে সঙ্গেই দুই ছেলে বাড়িতে চলে আসে।
বিমলা গ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ির গৃহস্থালি কাজ করে তিনমুখে তিনবেলা ভাতের জোগাড় করে। কোনো কোনো দিন কাজ করতে না পারলে সারা দিন দুই ছেলের মুখে কোনো খাবার তুলে দিতে পারে না। যেদিন বিমলা খাবার জোগাড় করতে পারে না সেদিনই ছেলেদের সবচেয়ে বেশি ক্ষুধা পায়। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করে মাঝেমাঝে ছোট ছেলে জোর গলায় বলে ওঠে, ‘মা, আমাগো জম্মের খিদা লাগছে। খিদায় প্যাট পুইড়া যাইতেছে। তুমি আমাগো কিছু খাইতে দেও, এহন খাইতে না দিলে মোনায় মইরা যামু।’
বিমলা বলে ওঠে, ‘মরবি ক্যান। এ্যা-তোরা মরবি ক্যান। কষ্ট কর। কষ্ট করতে হেক তোরা। তোদের এ্যামুন কইরা বানামু যেন পিথিবীর কোনো কষ্টই তোগো কাবু না করতারে। কষ্টরা জানি তোগো চেহারাডা দ্যাখলেই পালাইয়া যায়।’
বাঁধন বলে ওঠে, ‘মা, এহন আমাগো খাওয়ন লাগবে না। তুমি যহন খাইতে দিবা তহনই খামু। আমাগো কোনো খিদা নাই মা।’
ছেলেদের কথা শুনে বিমলা কাঁদতে কাঁদতে ছেঁড়া কাপড়ের আঁচল দিয়ে দুচোখের জলটুকু মুছে ফেলছে। মাকে জড়িয়ে ধরে ওরাও আরও কিছুক্ষণ কাঁদে। কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে একসময় দুই ভাই ঘুমিয়ে পড়ে।
এভাবেই অভাব আর দুঃখের সঙ্গে যুদ্ধ করেই কেটে যাচ্ছিল ওদের জীবন। কিন্তু কষ্টের ভেতরেও নাকি জীবনের কিছু ছন্দ থাকে। বিমলার জীবনে সেই ছন্দটুকুও নেই। নেই কোনো শান্তিও। পৃথিবীর সব অশান্তি বিমলার এই ছোট্ট ভাঙা ঘরে এসে যেন ভর করেছে।
যতীন মারা যাওয়ার পর থেকে প্রায় রাতেই মেম্বার বিমলার ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। কখনো কখনো মোটা মোটা শব্দের কাশি দিয়ে বিমলাকে ডাক দেয় মেম্বার, ‘ওওও যতীনের বউ। যতীনের বউ। এই রাত্তিরেই কি ঘুমাইয়া গ্যাছনি?’
প্রথম দুইবার বিমলা শুনেও কোনো উত্তর দেয় না। বিমলা বিশ্বাস করে প্রথম দুইবারের ডাকে সাড়া দিতে হয় না। কোনো ভূত-পেত্নী ডাক দিতে পারে। যখন হায়দার মেম্বার তিনবার ডাক দেয় ঠিক তখন বিমলা বলে ওঠে, ‘কেডা মেম্বার কাকা নাকি, কিছু কবেন নাকি, কাকা?’
‘হ বিডি। তোমার লগে এহন তো এট্টাই কতা। যতীন আমার কাছের থোন বিশ হাজার টাহা নিছিল। তয় যতীন তো আর বাঁচল না। টাহা না দিয়াই সে বেডা মরছে। এহন আমার টাহা তো আর বছরের পর বছর তোমাগো ধারে হালাইয়া রাখতারি না।’
বিমলা বলে ওঠে, ‘ওগো বাপে যে আপনার কাছের থোন টাহা নিছিল সে কতা তো একবারও কয় নাই।’
‘আরে বিডি। যতীন কী ভাবছিল যে, সে সত্যি সত্যিই মইরা যাইবে। যদি জানতই তাইলে সে তোমার ধারে কইয়াই মরত।’
‘টাহা যদি ওগো বাপে নিয়াও থাহে। তয় কাকা এহন তো আপনারে কোনো টাহা দিতারমু না। পোলা দুইডা নিয়া এহন তিনবেলা ভাত জোগাড় কইরাই খাইতারি না। টাহা দিমু কোনহান থোন।’
‘হোনো যতীনের বউ। তুমি যদি আমারে টাহা না দিতারো তাইলে কিন্তু তোমার ভিডামাডির এই ঘরডা গ্রামের বেবাকরে ডাইকা ভাইঙা দিমু। বিশ হাজার টাহার বদলে তোমার ঘরের ভিডির জাগাটুক নিমু। এইহানে আমাগো গরুঘরডা বানামু ভাবতেছি।’
বিমলা খুব ক্ষেপে ঘরের ভেতর থেকেই মেম্বারকে বলে ওঠে, ‘ক্যান এইহানে আপনে গরুঘর বানাইবেন ক্যান? আপনার কি ভিডামাডির কোনো অভাব আছে? এইহানে গরুঘর বানাইলে পোলা দুইডারে লইয়া যামু কই?’
‘হোনো বিডি। তোমারে একখান ভালো ব্যবস্থা কইরা দিমুনে। তুমি খালি এট্টা স্ট্যাম্পে সই দিবা। আমি তোমারে ঢাহার এট্টা গার্মেন্টসে চাকরি লওয়াইয়া দিমু। পোলা দুইডারে লইয়া ঢাহায় ভালোই থাকবা।’
‘ঢাহায় যাইয়া আমার গার্মেন্টসে কাম করন লাগবে না। আমাগো এই ভিডায় আপনারে গরুঘর বানাইতে দিমু না। এই ভিডার ওপরে ওগো বাপে মরছে। এই ভিডার সঙ্গে আমাগো আত্মা জড়াইয়ে আছে। এই ভিডা কিছুতেই ছাড়মু না।’
‘ঠিক আছে। তয় কথাডা তুমি মনে রাইখো যতীনের বউ। আমি কিন্তু এই ভিডায় গরুঘর উঠামু। পারলে তুমি ঠ্যাকাইয়ো।’
‘ক্যান? আমাগো ভিডার ওপরে আপনার এত লোভ হইল ক্যান? কৈলাস বাড়ৈ ও শ্যামল ভাদুরীগো কোডে মিত্যা মামলা দিয়া দ্যাশ ছাড়া করছেন। এহন আমাগোও দ্যাশ ছাড়া কইরা মোগো ভিডাটুক দহল নিতে চান? আমি বাঁইচা থাকতে হেইডা আপনারে করতে দিমু না।’ কথাগুলো বিমলা গলগল করে মেম্বারকে বলতে থাকে।
‘হ বিডি। তুমি হাসা কতাই কইছ। আমি চাইলে তোমারেও দ্যাশ ছাড়া করতারি।’
‘ওগো বাপে বাঁইচা থাকতে তো দুই খণ্ড ফসলি ভূই লেইখা নিছেন, হেইয়াতে আপনার মন ভরে নাই। হেই সুযোগ আপনেরে আর দিমু না।’
বিমলা ও তার সন্তানদের উৎখাত করার জন্য সারা বছরই হায়দার মেম্বার নানা ধরনের ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। এখন আষাঢ় মাস। সারা দিনই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ে। গতকাল রাতেও বৃষ্টির মধ্যে মেম্বার বিমলার কাছে এসেছিল। এবার মেম্বারের কথায় ছিল অন্য চাহিদার সুর। মেম্বার বিমলাকে শান্ত স্বরে বলে, ‘কী খবর যতীনের বউ, পোলা দুইডারে কী রাইতে ভাত খাওয়াইছ?’
‘ক্যান হেইয়া আপনে হুইন্না কী করবেন?’
‘আমি বুজি বিডি, পোলা দুইডা লইয়া তোমার বাঁচতে ম্যালা কষ্ট অয়। তুমি চাইলে এই ভিডামাডিতে আরও ম্যালা দিন থাকতারো। তুমি খালি এট্টু আমার দিকে ভালো কইরা তাকাইতা, তাইলেই তো চুপচাপ থাহি।’
‘ক্যান। আমি আপনার দিকে তাকাইতে যামু ক্যান। আপনার ঘরের বউ কী আপনার দিকে ভালো কইরা তাকায় না?’
মেম্বার বলে ওঠে, ‘ঘরের বউয়ের লগে লগে তুমিও যদি আমার দিকে এট্টু ভালো কইরা তাকাইতা, তাইলে দিলের মইধ্যে মেলা শান্তি পাইতাম?’
‘মেম্বার কাকা আপনে এহন এইহান থোন যান। নইলে কিন্তু জোরে বৃষ্টি নামার আগেই গ্রামের বেবাক লোক ডাইকা এইহানে আনমু।’
মেম্বার বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে, ‘ঠিক আছে। আমি এহন যাইতেছি মাগি। কিন্তু দুই-এক দিনের মইধ্যে তুই যদি এই ভিডামাডি ছাইড়া চইলা না যাস, তাইলে কিন্তু তোর এই ঘরদুয়ার বেবাক কিছু ভাইঙা দিমু।’
মেম্বারের এমন নানা ধরনের চক্রান্তে একসময় ভেঙে পড়ে বিমলার মন। বিমলা ভাবতে থাকে, মেম্বারের সঙ্গে আর কয়দিন এমুন কইরা মুখ চালাইয়া এই ভিডামাডির ওপরে টিইকা থাহন যাইবে।
বিমলা দিন দিন সাহস হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। বিমলা মনস্থির করে এই আষাঢ় মাসেই দুই ছেলেকে নিয়ে সে ঢাকায় চলে যাবে। কোনো দিন আর ফিরে আসবে না। হৃদয়নন্দী গ্রামের আলো-বাতাস আর মাটি কোনো দিন গায়ে মাখাবে না।
সপ্তাহ দুই ধরে শুরু হয়েছে আষাঢ় মাস। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রচণ্ড রোদে শুকিয়ে যাওয়া খাল-বিলে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে দিনভর আষাঢ়ের বৃষ্টি। হৃদয়নন্দী গ্রামের চারদিকের ডোবানালা খাল-বিলগুলোয় নতুন পানি পেয়ে বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ নানা রকমের জলজ প্রাণী খলবল খলবল শুরু করেছে।
বৃষ্টির পানিতে ডোবা-নালার কচুরিপানাগুলোও বসে নেই। আড়মোড়া দিয়ে যেন তারাও জেগে উঠেছে। দিনভর মেঘলা আকাশ থেকে থেমে থেমে ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। বৃষ্টির জল কচুরিপাতাগুলোর ওপরে পুরু আস্তর পড়া ধুলোবালিগুলো সব ধুয়েমুছে ফেলেছে। চারদিকের কচুরিপাতাগুলোয় একদৃষ্টিতে তাকালে চোখে পড়ে, শুধুই ঝকঝকে চকচকে প্রাণবন্ত সবুজের সমারোহ।
গত দুই সপ্তাহের বৃষ্টির জলে চারদিক থইথই করছে। বৃষ্টির জল ডোবা-নালা ভরে উঠোন পেরিয়ে বিমলার ঘরের সামনে চলে এসেছে। একদিন বিকেলে বিমলা ঘরের মেঝেতে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটেমাটি ছেড়ে কোথায় যাবে? যদি ঢাকায় চলে যায়, তবে বিধান আর বাঁধনকে নিয়ে কীভাবে ঢাকায় উঠবে। কার কাছে যাবে। কেউ তো তার পাশে দাঁড়াবে না। জীবনের সব বাধা-বিপত্তি নিজেকেই মোকাবিলা করতে হবে।
এ রকম নানা ধরনের চিন্তাভাবনা করতে করতে হঠাৎ করে উঠোনের দক্ষিণ কোণের ডোবার জলের দিকে বিমলার চোখ পড়ে যায়। সেখানে ডোবার স্বচ্ছ জলে এক মা টাকি মাছ তার একঝাঁক সন্তান-সন্ততি নিয়ে নতুন পানিতে মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে।
মা টাকি তার বাচ্চাদের লাফালাফি দেখে বিমলার চোখ সরছে না। নিজের সন্তানগুলোকে চোখের নজরে রাখার জন্য মা টাকিও বসে নেই। খেলার আনন্দের মাঝে তার বাচ্চাগুলো যেন কোনো বিপদের মুখে পড়ে না যায় সে জন্য মা টাকি বাচ্চাগুলোর পাশে থেকে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করে বিমলার চোখে পড়ল মা টাকির বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলার জন্য হলুদ রঙের ভেতরে কালো ডোরাকাটা দাগের সংমিশ্রণের একটি তরুণ ঢোঁড়া সাপ তেড়ে যাচ্ছে।
বিমলার চোখ আটকে আছে মা টাকির বাচ্চাগুলোর দিকে। মুহূর্তের মধ্যেই ঢোঁড়া সাপটি মুখ হা করে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ার জন্য ছোবল মারতে উদ্যত হয়। ঠিক তখন মা টাকি বাচ্চাদের জীবন বাঁচাতে ঢোঁড়া সাপটিকে প্রতিরোধ করার জন্য লেজে একটি কামড় বসিয়ে দেয়। ঢোঁড়াটি যতবারই বাচ্চাগুলোকে খাওয়ার জন্য ছোবল মারতে উদ্যত হয়। ততবারই মা টাকি ঢোঁড়াটির লেজে কামড় বসিয়ে হেঁচকা টান মারে। সন্তানদের মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচাতে এক মায়ের সে কী আপ্রাণ চেষ্টা!
মা টাকির বাচ্চাগুলো যে কোনো মুহূর্তে ঢোঁড়া সাপের খাবার হয়ে যাওয়ার ভয়ে জড়সড়ো হয়ে ডোবা পুকুরের এক কোণে বসে কাঁপতে থাকে। কিন্তু মা টাকি কিছুতেই তার বাচ্চাগুলোকে ঢোঁড়া সাপের মুখে মরতে দিতে চায় না।
যতবারই ঢোঁড়াটি বাচ্চাগুলোকে খেতে যায় ততবারই মা টাকি ঢোঁড়াটির শরীরের যে কোনো স্থানে কামড় বসিয়ে দিয়েই এক দৌড় দিয়ে কিছুটা দূরে সরে যায়।
বিমলার চোখ কিছুতেই সরছে না, ঢোঁড়া সাপটিকে কয়েকবার কামড় দেয়ার পরে সাপটি খুব রেগে মা টাকিকে খাওয়ার জন্য মুখ হা করে ছোবল মারে।
কিন্তু মা টাকি নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মুহূর্তের মধ্যেই ঢোঁড়া সাপের মুখে পাল্টা কামড় বসিয়ে দিতে লাফ দেয়।
কিন্তু বিধিবাম। বিমলা দেখছে, ঢোঁড়াটি যখন মা টাকিকে মুখ হা করে লাফ দিয়ে কামড় দিতে যায় তখন মা টাকিও পাল্টা কামড় দিতে গেলে ঢোঁড়াটির মাথা মা টাকির মুখের ভেতরে ঢুকে যায়।
মা টাকিও সুযোগ পেয়ে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে ঢোঁড়াটিকে কামড়ে ধরে। শুরু হয় মা টাকি ও ঢোঁড়া সাপের লড়াই।
মা টাকি একটানা প্রায় চল্লিশ মিনিট ঢোঁড়া সাপটিকে কামড়ে ধরে লড়াই করতে থাকে। অবশেষে ঢোঁড়া সাপটি মা টাকির কামড় ও মুখের ভেতরে মাথা থাকায় দম আটকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
মৃত্যুর মুখে নিজের জীবনকে বাজি রেখে সন্তানদের এভাবে বাঁচাতে পেরে মা টাকিও যেন সব ক্লান্তি ভুলে গেছে। ডোবায় আসা আষাঢ়ের নতুন পানিতে মা টাকি তার বাচ্চাদের নিয়ে মনের আনন্দে খলবল খলবল করে জলকেলি শুরু করে।
মা টাকি ও ঢোঁড়া সাপের এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে হঠাৎ হায়দার মেম্বারের কথা মনে এলে বিমলার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে প্রতিবাদের চিহ্ন।