মানিকরতন শর্মা
জন্ম : ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ, পিতা: মনোরঞ্জন শর্মা, মাতা: শ্রীমতি পুষ্প শর্মা। পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার জগৎপুর গ্রামে।গল্পগ্রন্থ : কালোমেঘের আছর (২০১৭), জলঘর (২০২১) প্রবন্ধ: অদ্বৈত অন্বেষণ (২০১৯) উপন্যাস : অদ্বৈত (২০২১) সম্পাদনা : স্বরূপ-অরূপ প্রাণতোষ চৌধুরী (২০২১)
মানিকরতন শর্মা

কষ্টডাঙার মেঘ

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

মানিকরতন শর্মার গল্প: কষ্টডাঙার মেঘ


কলিং বেল বাজাতেই একজন মাঝবয়সী মহিলা বের হলেন।

কাকে চাই? জানতে চাইল ভদ্রমহিলা।

মাসুদ আছে?

না, ওনি কি এখানে থাকতেন?

এটা ৫০২ নম্বর বাড়ি না!

হ্যাঁ।

এই বাসায়ই তো! নিচু স্বরে বলে অদ্রিকা।

এমন সময় ভদ্র মহিলার পেছন থেকে কাজের মহিলা বলে ওঠে, আপা, মাসুদ স্যার দু’মাস আগেই এ বাসা ছেড়ে চলে গেছেন।

কোথায় গেছে বলতে পারেন?

সেটা তো জানি না।

অদ্রিকার কপালজুড়ে চিন্তার রেখা আরো ঘনিভূত হলো। বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলে এসেছে সে।

কোথায় খুঁজবে এখন! ভাবনাগুলোর সাথে সেই মুখ কেবল ক্ষণে ক্ষণে স্পষ্ট হচ্ছে। অপরিপক্কতার কারণেই হোক, কিংবা একটু উষ্ণতার কারণেই হোক ঘটনাটাতো ঠিকই ঘটেছে।

দেখুন পুরোটাই রিক্স। একই সাথে উভয়ের বিপদ হতে পারে। একটা পর্যায়ে ডাক্তারের কথাই মাসুদ মেনে নিয়েছে। হাসপাতালের মুহূর্ত। শিশুর কান্নার ধ্বনি। অবাঞ্চিত বোধ। কিছুতেই ভুলতে পারছে না। আবার কাউকে বলাও যায় না।

সকালটা কৈশোর হতেই কড়ারোদ মুখের উপর চেপে বসে। ফুটতোলা রিক্সায় ওঠে সে। রাস্তার পাশের নতজানু গাছগুলো শূন্য বাতাসে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কাটাছেড়া চিন্তাগুলো জোড়া দিতেই অদ্রিকার রিক্সা কমলাপুর এসে পৌঁছে। রেল ছুটে চলল আবার সেই নতুন গন্তব্যে। জানালার ওপাড়ে ছুটে চলা আকাশ, দূরের শাদা মেঘ দেখতে দেখতে কখন যে গাল ছুঁয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে বুঝতে পারেনি সে। নিজেকে জিজ্ঞাসা করে, এবার শক্ত কর মন। মেনে নে সকল নিয়তির দৃশ্যপট।

বিকেল গড়িয়ে যায়। বাড়িতে ঢুকতেই ননদ শিউলী দৌঁড়ে এসে ভাবীকে ঘরে তুলে। তোমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ শেষ হয়েছে, জানতে চেয়েছে সে। মৃদু হেসে উত্তর দিয়েছে অদ্রিকা।

মাত্র মাসখানেক হল বিয়ে হয়েছে ওর। বাবা একরকম জোরজবরদস্তি করেই বিয়ে দিয়েছে ওকে। ফিরতে পারেনি আর। বর ফুড অফিসার। বেচারা বেশ শান্ত প্রকৃতির। সহমর্মশীল মন। ভরসা করা যায় ওকে। কিন্তু জীবনের যে ঘটনা, না অঘটনই বলা যায়, সেইকথা একমাত্র আল্লাকেই বলা যায়। আর কাউকে নয়। বুকের মধ্যে সেই কষ্ট জীবন্তশীলা দিয়ে চেপে দিয়েছে সে। কখনো কখনো মনে উঁকিঝুঁকি দিলেও পরক্ষণে গহীন জলে আবার ভাসিয়েও দিয়েছে সে।

শাশুড়ি ননদ প্রায়ই বলে যেমন স্বামী তেমন স্ত্রী। দুজনই এক রকম হয়েছে। কথা না বললেই বোধ হয় ওদের শান্তি। ঘরে যে এতোগুলো মানুষ আছে কেউ বুঝতেই পারবে না।

 

০২.

 

স্যার ঘরে কিন্তু দুধ নাই। এ বেলা কোনো রকম চলবে। রাতেই লাগবে।

আসার সময় নিয়ে আসব।

সবে তিন বছর হল। ঠিক যেন মায়ের মত মেঘকে দেখাশোনা করে যাচ্ছে খালেদা। ঢিবির দুধ ছাড়া চলেই না। একটু দুধ হলেই মেঘের আর কিচ্ছু লাগে না।

খালা অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু কিছুতেই বিয়েতে রাজি হয়নি মাসুদ। ছোটকাল থেকেই এক গো ধরা ছেলে সে। একবার যেটা বলেছে যে বলেছেই। খালা এখন আর বলে না। তেক্ত-বিরক্ত হয়ে একরকম হাল ছেড়ে দিয়েছে।

শিশু মেঘকে নিয়েই মাসুদের পৃথিবী। একমাত্র সুখের আকর। ভাবনা, পরিকল্পনা স্বপ্ন সবকিছুতেই ছেলে মেঘ।

অনেক কিছু ছাড় দিয়ে মেঘের খেয়াল যত্ন করে যাচ্ছে খালেদা। বাচ্চার মা নেই। কোথায় যেন একটা মায়া পড়ে গেছে। বিশ্বস্ত খালেদাকে পেয়ে নিশ্চিন্তেও কাজকর্ম করতে পারছে মাসুদও।

মেঘের শিশুমুখে দুএকবার মায়ের কথা ওঠলেও উত্তর ঘুরিয়ে অন্য ডালে চলে গেছে সে। বলতে চায়নি। স্কুলে যাওয়ার পর বিভিন্ন কাগজে দেখেছে মায়ের নাম। শামসুন্নাহার। যাষ্ট এটুকুই।

একটু বড় হয়ে মায়ের কি হয়েছে, জিজ্ঞাসা করলে, মেঘ কোনো উত্তর পায়নি। বরং মায়ের কথা শুনলেই বাবা যেন কেমন হয়ে যান। পরক্ষণেই একটা হাসি দিয়ে বলে– বাবা আমিই তোর মা এবং বাবা, একই অঙ্গে দুজন, বুঝলি। সেই থেকে মেঘ আর কখ্খনো বাবাকে মায়ের কথা বলেনি।

স্কুলের দেয়াল পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে কবিতা-গল্প লিখে যাচ্ছে মেঘ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করে নিয়মিত। ছাত্ররা মেঘকে এক নামেই চিনে। স্যাররাও ওকে বেশ স্নেহ করে। সাইন্সের ছাত্র হলে কী হবে, বাংলা সাহিত্য তাকে বেশ টানে। তাই প্রতিবছর ছেলেকে খ্যাতিমান লেখকের বই কিনে দেয় মাসুদ। ইদানিং খ্যাতিমানরা কে কোথায় কি লিখছে তার খোঁজখবরের পাশাপাশি তাদের বইও জোগাড় করছে মেঘ।

একাডেমিক্যাল পড়া ঠিক রেখে সাহিত্যচর্চা করছে দেখে খুব খুশি মাসুদ। কলেজে ওঠতেই তার বেশ কিছু লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বের হয়েছে।

অফিসের ট্যুরে যেখানেই যাক, মনে মনে খোঁজে ফিরে তাকে। যদি দেখা হয়ে যায়! তাকে পেলে যাস্ট দুটো কথা বলবে। তার বেশি নয়। পরক্ষণে ভাবে নিয়তির খেলা কে বুঝিতে পারে!

 

০৩.

 

অফিস থেকে ফেরার সময় মেয়ের জন্য ছোট্ট কম্বল কিনতে শো-রুমে ঢোকে রাজিব। বিভিন্ন কম্বল দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে হঠাৎ তার সারা শরীর ঘাম দিয়ে ওঠে। দোকানদার কিছু বুঝার আগেই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। হাসপাতালে নেবার পর ডাক্তার বলেছে হি ইজ নো মোর। খবরটা শোনেই পাগলের মত ছুটে আসে অদ্রিকা। দেখে মেঝের ওপর পড়ে রয়েছে তার স্বামী। জলজান্ত মানুষটা ঠিক যেন ঘুমিয়ে আছে। কিচ্ছু হয়নি। বিশ্বাস করতে পারছে না সে। সুগার শূন্যতার কারণেই মারা গেছে, বলেছে ডাক্তার।

আবার অদ্রিকার নীল আকাশ রাহু গ্রাস করেছে। গাঢ় অন্ধকার ছেয়ে যায় পুরো পৃথিবী। ভাবনাগুলো ধীরে-ধীরে সংকুচিত হতে থাকে তার। দিনঘুরতেই একটা স্কুলে চাকরি নেয় সে। ননদের বিয়ে আর শাশুড়ির মৃত্যুর পর একদম একা অদ্রিকা। সাত বছরের মেয়ে অনন্দিতাই তার এখন নতুন পরিমণ্ডল। ইস্কুল আর মেয়ে, মেয়ে আর ইস্কুল এই গণ্ডিতেই সাঁতার কাটে সে।

একদিন দৈনিক আলো পত্রিকাতে একটা গল্প পড়ে হঠাৎ লিখতে বসে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে দু’একটা গল্প লিখেছে। কিন্তু ঐ দুর্ঘটনা ঘটার পড়ে তার জীবনটাই পাল্টে যায়। রাত জেগে লিখে ফেলে গল্প। সপ্তাহ পর একটি সাময়িকীতে ‘শূন্যঘরে চড়ইর আত্মকথন’ শিরোনামে গল্পটি প্রকাশিত হয়। মনে মনে উৎসাহবোধ করে অদ্রিকা। জীবন-সংসারের শূন্যতা কাটানোর জন্য লেখালেখি চমৎকার মাধ্যম। মেয়েটা সাহিত্য একদমই পছন্দ করে না। সারাক্ষণ মোবাইল নিয়েই আছে।

বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকীতে কে কি লিখছে এগুলোর খোঁজখবর রাখছে অদ্রিকা। এরই মধ্যে মেঘের লেখার প্রতি তার একটা আকর্ষণ তৈরি হয়। ছেলেটাতো বেশ ভালোই লেখে, ভাবে অদ্রিকা। তাঁর লেখার স্বরের সাথে কোথায় যেন একটা মিল খোঁজে পায় সে।

একদিন শুক্রবারের সাময়িকীতে একটি গল্প বের হয় অদ্রিকার। পুরো গল্পটা পড়ে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যায় মেঘ। খুব ভালো গল্প। বাবার সাথে এই নিয়ে শেয়ার করে সে। সুযোগ থাকলে কখনো কখনো গল্প পড়ে মাসুদও। কিন্তু আজ বিকালে বাবাকে গল্পটা পড়তে দিয়ে বন্ধুদের সাথে বের হয় মেঘ।

নিউজ দেখতে দেখতে হঠাৎ ডিস চলে যায়। হাতের নাগালে টি-টেবিলে পড়ে থাকা গল্পটা পড়তে শুরু করে মাসুদ। দু প্যারা পড়েই মনযোগ দেয় গল্পের ভেতরে। ক্রমেই চমকে যায় মাসুদ। শব্দগুলো, বাক্যগুলো এবং ঘটনাক্রমধারা একটু একটু করে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে তার সত্তাকে। অতৃপ্ত কৌতূহল বাড়তে থাকে। এই লেখিকা কে? ভাবতে পারে না সে। এত্ত দিনের পোষা গল্পটা এখানে এলো কি করে! পড়ার পর রাতে ঘুমোতে পারে না। আঠারো বছরের পুরনো সেই অদৃশ্যের ছায়ামুখ আবার সম্মুখে! দেখি মেঘকে দিয়েই ওনাকে খুঁজতে হবে, ভাবে মাসুদ।

আর পনেরো দিন পর গ্রন্থমেলা। রাতে মেঘ বাসায় আসার পর ডাইনিং-এ খেতে খেতে বলে– বাবা অদ্রিকা লেখিকাকে তুই চিনিস!

খুব বেশি না বাবা। তবে প্রায় নিয়মিতই ওনার লেখা পড়ি আমি। কি জান, ওনার লেখাতে না একটা গাঢ়বিষণ্ণতা, বিরহ, অপূর্ণতার ছাপ দেখা যায়। তুমি কি তার আজকের লেখাটা পড়েছ?

পড়েছি। এই কথা বলতে বলতে বুকের ভিতর এক ঝড় বইতে থাকে। ভেঙে যাচ্ছে কুলাকুল। খাবার যেন সব বিস্বাদ লাগছে। মেঘকে কিছুই বুঝতে দিচ্ছে না সে। চাপা কষ্টনানুভূতি ভেঙে দিচ্ছে আজ। মেঘের জন্মরহস্য এই গল্পেই পুরোটা উন্মোচিত হয়েছে।

আচ্ছা বাবা, তার কোনো নম্বর আমাকে দিতে পারবি।

হঠাৎ ওনার নম্বর!

আরে তা না, এতো চমৎকার একটি গল্প লেখার জন্য, ওনাকে ধন্যবাদ জানাতাম, এতোটুকুই। তোদের তো আবার লেখকে লেখকে যোগাযোগ আছে তাই।

ওর নাম তো শামসুন্নাহার। তা হলে অদ্রিকাটা কে! ভাবে মাসুদ। এটা কি তার ছদ্মনাম। নাকি অন্য কেউ। না….। এমন গল্প শামসুন্নাহার ছাড়া আর কেউ লিখতে পারবে না। পটভূমি তো জানারই কথা নয়।

মেলায় যাবে যাবে করে বিশদিন চলে গেল। মেঘ লেখক বন্ধুদের নিয়ে মেলায় প্রায়ই আড্ডা দেয়। সপ্তাহের শেষে একদিন মেঘকে নিয়ে মেলায় আসে মাসুদ। ঘুরে ঘুরে বই দেখা, কিছু কেনা, আর হেঁটে হেঁটে বাপ-বেটা বাদাম খেয়ে যাচ্ছে।

বাবা তুই এখানটায় বস। আমি দুটো আইসক্রিম নিয়ে আসি। এই বলে দোকানে যায় মাসুদ।

দাঁড়ানো অবস্থায় হঠাৎ দেখা হয়ে যায় লেখিকা অদ্রিকার সঙ্গে। মেঘ চিনে ফেলে। কিন্তু মেঘকে চিনতে পারে না অদ্রিকা।

এক্সকিউজ মি আপনি কি অদ্রিকা মেম?

হ্যাঁ।

খুব খুশি হয় মেঘ। পরনে সুতির বড় পাইরের শাড়ি। কপাল জুড়ে বড় করে টিপ পরা। হাতে বইয়ের ব্যাগ। মেঘের পরিচয় পেয়েও অদ্রিকা বেশ খুশি। কথা বলতে বলতে জমে ওঠে দু-গল্পকারের কথা। এক পর্যায়ে মেঘ বলে– মেম আপনার গল্পের নতুন একজন অনুরাগি যুক্ত হয়েছে।

ভালো বলেছ তো, অনুরাগি। কে সে!

আমার বাবা।

ও তাই!

এমনি দুটো আইসক্রিম হাতে নিয়ে মেঘের সম্মুখে দাঁড়ায় মাসুদ। আধাপাকা চুল ও কালো চশমাপরা মহিলার দিকে না দেখার মতই তাকিয়ে ছিল সে। মেঘ বাবার সাথে অদ্রিকার পরিচয় করিয়ে দিতেই–

শামসু, তুমি এখানে!

স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় অদ্রিকাও।

তুমি!

বাবা তুমি মেমকে চিন!

হ্যাঁ রে বাবা, পুরোটাই চিনি।

সরাসরি প্রশ্ন মাসুদের, ‘কষ্টডাঙার মেঘ’ গল্পটা কি তোমার লেখা? সবটা কি সত্যি!

হ্যাঁ, একটি শব্দও মিথ্যা লিখিনি।

এখন বল, আমার ছেলেটা কোথায়? কোন এতিম খানায় রেখে দিয়েছ, বল, প্লিজ ঠিকানাটা দাও।

ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না মেঘ। কথা বলতে বলতে ওরা একটু দূরে সরে যায়। হঠাৎ করে চোখ ইশারায় মেঘকে দেখিয়ে বলে ঐ যে তোমার ছেলে– কষ্টডাঙার মেঘ।

———-সমাপ্ত———-

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu