আনিফ রুবেদ
জন্ম ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ, চামাগ্রাম, বারঘরিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: জীবগণিত (২০২০), মন ও শরীরের গন্ধ (২০১৪), দৃশ্যবিদ্ধ নরনারীগান (২০১৭), এসো মহাকালের মাদুরে শুয়ে পড়ি (২০১৫)।
আনিফ রুবেদ

ক্ষুধিত খরায় জীবনের খতিয়ান

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

: কহছি, আর ভাত লিব্যা নাকি?

খরখরে কণ্ঠে মতি জিজ্ঞাসা করে। চোখ ভর্তি ধোঁয়াটে বিতৃষ্ণা। ভাত নিবে কি নিবে না, তা মতির জিজ্ঞাসা করার কথা নয়। দায়িত্বটা তার স্ত্রীর, কারণ, সে-ই খাবার বেড়ে দেয়, সে-ই কে কতটুকু খায় তার মাত্রা জানে। কিন্তু রমেলা বুড়োকে মোটেও দেখতে পারে না। বুড়োকে দেখলেই তার সারা শরীরে দাঁত বের হয়। ‘কোথাকার কে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে’ মনোভাব তার পুরো মন জুড়ে। কখনো কিছু যদি সে বলেও তা আর কথা হয়ে থাকে না, কণ্ঠস্বরে কাঁচের গেলাস ভাঙার শব্দ হয়। মতি অবহেলার স্বরে হলেও জিজ্ঞাসা করে।

সূর্যটা পশ্চিমের পাল্লাতে কেবল চড়ছে। কড়া রোদ। বৈশাখি সময়। চচ্চড়ে রোদের তাপে পুড়ছে পৃথিবী। বেশ ক’দিন থেকে বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। হয়ত বৃষ্টির ফেরেস্তা ঘুমিয়ে আছে। ঘুম ভাঙানোর জন্য গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ব্যাঙ কাটল। বয়স্করা মসজিদে আল্লার কাছে আরজি করল– ‘আল্লা তুমি ম্যাঘের নিন্দ্ ভাঙ্গো, পানি দ্যাও, নাই্হলে মইর‌্যা যাব।’ উড়তে উড়তে কাকেরা ধপাধপ পড়ছে। চাতকেরা ফুটুকজল, ফুটুকজল করে হাঁপিয়ে শেষ। বৃষ্টি নাই। পানি নাই পুকুরে। শীকর নাই মাটিতে। ব্যাঙের রক্ত, মানুষের চোখের নোনতা জল, কাকপক্ষীর আবেদনে বৃষ্টির ফেরেস্তার ঘুম ভাঙ্গেনি। নদীর জল পায়ের গোড়ালির কাছে এসে গেছে, এ পানি ব্যবহার বিয়োগ্য। মেয়েরা পুকুরের তলার মাটি এনে চুলা তৈরি করছে।

নামাজ পড়ার সময় পাঞ্জাবি ঘামে ভিজে শরীরের সাথে চেপে লেগে গেছিল। নামাজ শেষ করে সেটা খুলে চালের বাতায় ঝুলিয়ে রেখে খেতে বসেছে ফরজেন। পিঠের বিন্দু বিন্দু ঘাম এক জায়গায় জমে পিঠের দাঁড়ি বেয়ে পাছার নালা ধরে। মাঝে মাঝে কপালের দুএক ফোঁটা নোনতা ঘাম ঝরে পড়ছে ভাতের থালায়। বৃদ্ধ ফরজেন কানে কম শোনে। মতির ডাক শুনতে পায়নি। মতি আবার চিৎকার করে।

: কহছি, আর কিছু লিব্যা নাকি?

: কিছু কহছিস নাকি ব্যাটা মতি?

ফরজেন মুখ তুলে মতির দিকে তাকায়।

: না কহি ন্যা, শালা বহির‌্যা কুণ্ঠেকার!

ঝাল ঝরে মতির কথায়।

: ও ভাতের কথা? না আর লিব না।

রমেলার কণ্ঠে বিষমাখা কাঁচের গেলাস ভাঙে–

: কী আর লিবে দিয়্যাছি কী কম কইর‌্যা!

বৃষ্টির সময় গাছের নিচে গেলে পানি একটু কম লাগে বটে কিন্তু বৃষ্টির পর গাছের তলা মোটেও নিরাপদ নয়। তখন বিনা বৃষ্টিতেই ভিজতে হয়। স্বয়ং গাছের পাতা একটু বাতাসেই বৃষ্টি ঝরায়। তারপরেও ফরজেন মতির বাড়ি ছাড়তে পারে না। খোলা আকাশের নিচে যাবার মতো তার বয়সের সামর্থ্য নেই। দুপুরভাত খেয়ে ধীরে ধীরে ওঠে ফরজেন।


২.


গরমের দিনে বিকেল বলে কিছু থাকে না। সমান তেজে সূর্যটা জ্বলতে জ্বলতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায়। সন্ধ্যা লাগে। ফরজেন মাগরিব পড়ে বারান্দায় জলচৌকিতে বসে থাকে। গাছের ফাঁকফোকর পূর্ণ করার পর গাছপালার বাইরেও রাত লাগতে শুরু করেছে। ফরজেন দূরে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার ধারের গাছটা বিড়ি টানছে। সেই দূর হতে আলোর ছিটেফোটা ছড়িয়ে পড়ছে তার পায়ের কাছে। আলোটা একটু চোখ সওয়া হলে বুঝতে পারে গাছ বিড়ি টানছে না, ও পাড়ার মুন্টু মিয়ার কার্নিশের আলো গাছের একটা ফাঁক দিয়ে আসছে।

ফরজেনের মনে পড়ে, ছোটকালে সে একবার ওর বাপের বিড়ি চুরি করে খেয়েছিল। বাপ জানতে পেরে বেড়ার বাতা ভেঙে খুব মেরেছিল, কান ধরিয়ে বলেছিল– ‘ছুব ফেল্যা, জিভ্যা দিয়্যা চাট আর কহা কুনুদিন বিড়ি খাবো না।’ সে হাতের তালুতে থুথু ফেলে জিভ দিয়ে চেটেছিল। নিজের থুথু যে এত জঘন্য কে জানত। তারপর হতে আর কোনোদিন বিড়ি মুখে করেনি ফরজেন। কিন্তু নিজের থুথু নিজে গিলার ঘটনা মনে যতবার পড়ে ততবার মুখ ভরে ওঠে থুথুতে। থুথু ফেলার জায়গা মেলে না, থুথু ফেললে রমেলা গাল দেয়। সে মুখ ভর্তি থুথু গিলে ফেলে। নিজের থুথু গিলতে হচ্ছে, পরের থুথুৎকার সইতে হচ্ছে অবিরাম। ফরজেন চোখ বুঁজে কান্না গিলে নিল কয়েক ঢোকে। থুথু গেলা, কান্না গেলা জীবন। ঢোক গিলে যেমন কান্না গিলা যাচ্ছে, থুথু গিলা যাচ্ছে তেমনভাবে জীবনটা গিলা গেলে বড্ড ভালো হতো।

কানে কম হলেও চোখে পুরা ফরজেন বুড়া। চোখে সব দেখে, মন দিয়ে বুঝে নেয়। এই যে মতি, মতির বউ তাকে দেখতে পারে না এটাও সে বুঝতে পারে। বেঁচে থাকতে ভালো লাগে না। জীবন চলাটা অর্থহীন মনে হয়। চলতে চলতে পথটাই যদি মুখ্য হয়ে যায়, কোনো উদ্দেশ্য না থাকে তবে ক্লান্তি আসবেই।

ফরজেনের আর কারো দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। কাউকে সজন বলে মনে হয় না, সকলকে পাশবিক চরিত্রের এক একটা প্রচ্ছায়া মনে হয়। এই যে কালু, সে কত নাদানই না ছিল। তাকে কেউ সাথে নিত না, খেলতে নিত না। সঙ্গ দিলে ফরজেনই তাকে দিত। সেই কালুও ফরজেনের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়, বাঁকা কথা বলে। গরুর দালালি করে এখন তার মেলা টাকা। টাকা-পয়সা, ছেলে-মেয়ে-নাতি-পুতি ভরা কালুর সংসার। কালুর আয়-উন্নতিকে হিংসা হয় না কিন্তু তার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কথায় ফরজেনের পাঁজর ভেঙ্গে যায়। বন্ধুর পাঁজরে বন্ধু এভাবে বাড়ি মারে!

যাক সবই কপাল, ট্রেনের মতো দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ছুটে যায় দূর আকাশের দিকে। তার দীর্ঘশ্বাস আকাশের ছোট ছোট তারার সাথে মিশে ফেনিয়ে ওঠে। দুঃখগুলো কর্পুরের মতো উড়ে গিয়ে বাতাস ভারী করে। ফরজেন মনে মনে প্রার্থনা করে– ‘আল্লা হামাকে মুক্তি দ্যাও, হামাকে লিয়্যা ল্যাও…’ সহসাই প্রার্থনায় ছেদ পড়ে। মতির বউ এর গলা, পাকা মেঝেতে টিনের থাল আছড়ে পড়ার মতো ঝন ঝন করে ওঠে– ‘কহছি, ভাত খাইয়্যা ল্যাও।’ ফরজেন ওঠে। রাতভাত খেতে বসে।


৩.


খাওয়া শেষে ফরজেন বুড়া এশা পড়ে আবার বসে থাকে জলচৌকিতে। মুন্টুর কার্নিশের আলোটা নিভে গেছে। তরল আঁধারগুলো গাঢ় লেই এর মতো চারদিকে লেপ্টে আছে। মহিষের গায়ের মতো রাত। মতি শুয়ে গেছে, বউ সবকিছু সাটা-সুটো করে ফরজেনকে শুয়ে যেতে বলে দুয়ার লাগায়। ফরজেনের মনে হয়, তার সামনে আর কিছু নাই, পৃথিবীর সব দরজায় সিলগালা করা। যেদিকে তাকায় অনন্ত রাতের মধ্যে লীন হয়ে গেছে সব পথ। পৃথিবীর সব দরজা বন্ধ। অনন্তের সব দরজা উদারভাবে খোলা।

ফরজেন আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদ উঠেছে, তারা উঠেছে। তারাদের দেখে মনে হচ্ছে গরু ভেড়ার পাল, সারা আকাশে দাপাদাপি করে কালো কালো ঘাসগুলো খেয়ে বেড়াচ্ছে। এত ঘাস খায় তবু ঘাস শেষ হয় না– অন্ধকারঘাস শেষ হয় না। চাঁদটা যেন রাখাল, তারাগুলোকে চরাচ্ছে আকাশমাঠে। ছোট কালের গরু চরানোর স্মৃতি ভেসে ওঠে ফরজেনের মনে, অস্পষ্ট হয়ে। অস্পষ্ট স্মৃতিতে মিষ্টতা বেশি থাকে, নিজের ইচ্ছে মাফিক চিনি-মধু-গুড় মাখিয়ে নেওয়া যায়। খেজুর পাতার মাথাল মাথায় থাকত তার। শরীরে থাকত উথাল পাথাল যৌবন আর জোর। দূর হতে সখিনা নূপুর পায়ে হেঁটে আসত। নূপুরের নিক্কন দূরে থাকত– কাছে আসত– আবার মিলিয়ে যেত খেঁসারির ভুঁইটা পার হয়ে ছোট ছোট ঝোঁপ ঝাড় মাখা ধুলোর পথে।

রাত বেশি জাগে না ফরজেন, এশা পড়েই প্রতিদিন শুয়ে যায়। আজ কেন যেন ঘুম আসছে না। রাত বাড়ছে। চাঁদটা তার অবস্থান থেকে আরো কয়েক হাত উপরে উঠল। ফরজেন বসেই থাকে। হঠাৎ তার খেয়াল হলো তার কান খুলে যাচ্ছে। যত রাত বাড়ছে, তত কান খুলে যাচ্ছে, স্মৃতি খুলে যাচ্ছে। রাতের যে নিজস্ব একটা শোঁ-শোঁ শব্দ আছে তা শুনতে পাচ্ছে। একটা বেভুলো পাখি, বাইরের গাছ হতে করচ-চর, করচ-চর করে ডেকে উঠল। ফরজেন শুনতে পাচ্ছে। ফরজেনের ঘুম যেন তারাদের কাছে চলে গিয়ে ছুটোছুটি করছে। কোথা হতে পুরনো সব দিনগুলো এসে হাজির তার বুকের ভেতর। ভাবনার দুয়ার খুলে যায়, হুড়মুড় করে ভাবনাজল ঢুকে পড়ছে বুকের ভেতর, ভাবনাজলে সে সাঁতার কাটে, সব ভাবনা যেন আজই ভেবে শেষ করতে হবে। ভাবনার জলজালে তার প্রাণ হাঁসফাস করে। ভাবনানদীর কূল কতদূর, কতদূরে!

ফরজেন বুড়া ছোটকালেই মা বাবা হারা হয়েছিল। যে দুচার বিঘা জমি ছিল তা দিয়েই চলে যেত। বিয়ে থা করেনি। পৃথিবীতে তার আপন বলে কেউ নেই, তার নিজের বলতে সে নিজেই। ফরজেন ভাবে– ‘তার কোনোদিন সুখ হলো না। সারাটা জীবনই কষ্টে কষ্টে কাটল।’ নিশ্ছিদ্র রাতের বুকে মিহি একটা ছিদ্র কেটে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে– ‘সুকপাল না থাকলে সুখ হয় না, শু-কপালে জুতার ঘা-ই মানানসই।’

তার মনে হচ্ছে জীবনের সব ভেদ তার জানা হয়ে গেছে। মানুষ মানুষকে নিয়ে কী করে? প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে কী করে? মানুষ কেমন? মানুষ কী? মানুষ কেন? সব তার বোঝা হয়ে গেছে। মানুষের জীবনে দুঃখ ছাড়া আর কিছু নাই। জীবন একটা যন্ত্রণা তৈরির কারখানা মাত্র। বড় বড় ধনিরা যেমন চেকের পাতায় লেখে– ‘এক হাজার কোটি টাকা মাত্র।’ মাত্র কথাটা গিরগিটির মতো, বহুরূপ তার। সে চেকের ভাষায় ভাবে – ‘একটা জীবন মাত্র।’ সবার চেকে টাকার অঙ্কের কমবেশি থাকে কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে সবাই এক। সবাইকে চেকের পাতায় লিখতে হবে– ‘একটা জীবন মাত্র।’ টাকা আর জীবনের মিল হলো দুটোই খরচ হয়। কিন্তু অমিল হলো টাকা ইচ্ছে করলে দ্রুতই খরচ করা যায় বা বিলিয়ে দিতে চাইলে নেবার লোকের অভাব হয় না, কিন্তু জীবনের ক্ষেত্রে তা হয় না। ফরজেন চাইছে তার জীবনটা দ্রুত খরচ করে ফেলতে কিন্তু পারে না, খরচ হয় না। ক্ষয় হয় না। তার জীবন ক্ষয় হচ্ছে কচ্ছপের গতিতে, খরগোশের গতিতে নয়। এখন তার জীবন এসে ঠেঁকেছে খাওয়াতে, বসে থাকাতে আর বসে বসে বারো কিসিমের বারো বিষয় ভাবাতে।


৪.


তার ভাবনাতে রিপন এসে হাজির হয়। রিপন মতির ছেলে। প্রতিদিন ভোরে ফরজেনের কাছে বসে গল্প করে। তার গল্প বলার ধরনটা মনে পড়ে হাসি পেল ফরজেনের। রিপন গল্প শুরু করে এভাবে– ‘একছিল রাজা আর একছিল রাণী। তারা সারা দিন মাঠে কাজ করত…’ এটা মনে পড়াতে, ফরজেনের মুখটা নিঃশব্দ হাসিতে ভরে গেল। ঐ ছোঁড়া কেন যে রাজা রাণীকে তার গল্পে মাঠে কাজ করায় তা কিছুতেই বোধে আসে না। কিন্তু সে নিজে মাঠে কাজ করত বলে শুনতে খারাপও লাগে না।

তার জীবনের কাঁটাময় সময়গুলোর মধ্যে রিপনের সঙ্গলাভের সময়টুকুই ভাল লাগে। সে রিপনকে প্রায়ই বলে– ‘দাদু, মানুষকে মানুষ হতে হয়। তুমি মানুষ হবে। যদিও পথটা খুব কঠিন দাদু।’ আরো কত কথা, কত গল্প দুজনে বসে বসে করে। ধর্মের গল্প, কর্মের গল্প, মর্মের গল্প। যে গল্প রিপন বুঝতে পারবে সে গল্প করে, যে গল্প রিপন বুঝতে পারবে না জানে সে গল্পও করে।

গল্পের ফাঁকে রিপন একদিন প্রশ্ন করেছিল– ‘দাদু, তুমি এত কিছু জানো, মানুষের কাছে প্রকাশ করো না কেন? সারাদিন চুপচাপ শুধু বসে থাকো।’ রিপন আঞ্চলিকতা বর্জন করে পাঠশালার ভাষায় কথা বলে। ওর সাথে কথা বলার সময় ফরজেনও ভালো ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। তার প্রশ্ন শুনে খুব হেসেছিল ফরজেন। হাসির গমকে মাথা দোলাতে দোলাতে ইয়ারকির সুরে উত্তর করেছিল– ‘ভয় হয় রে দাদু, ভয় হয়, যদি পরিচিতি পেয়ে যায়। পরিচিতি থেকেই খ্যাতি সম্মান। আর এই সম্মান করতে করতে মানুষ একদিন পুজা শুরু করে দেয়। পুজা যে পাপ দাদু।’ হাসতে থাকে বুড়া মাথা দুলিয়ে। কিন্তু রিপনের একটা বুজরুকি কথা শুনে হঠাৎ করে ব্রেক কষা বাসের মতো থেমে যায় হাসিটা। রিপন বলেছিল– ‘সম্মানইতো ভাল দাদু। এই যে তোমাকে কেউ দেখতে পারে না– ভাবো আমি বুঝতে পারি না– এতে কি তোমার অপমান হয় না? সম্মানের পুজা যদি পাপ হয় তবে অসম্মান করা কি পাপ নয়?’

কিলবিলে সাপের মত রিপনের প্রশ্নটা বৃদ্ধকে খোঁচায়, সে চুপ করে থাকে। ভাবে– ‘আমার অপমানই যখন ওদের আনন্দ তখন আমার অপমান কী। ওদের আনন্দটাও তো কম বড় কথা নয়।’ বুড়ার চিন্তাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। সবকিছুর মাঝেই একটা আপোষের সূত্র খোঁজার চেষ্টা, স্বস্তি সন্ধানের চেষ্টা, সন্ধি সন্ধানের চেষ্টা। আপোষ করে করে পোষমানা জন্তু হয়ে থাকা। পোষমানা জন্তুও নয়, যন্ত্রের মতো। পোষমানা পশুও তো কখনো কখনো এদিক ওদিক টান মারে ছুটে যাবার জন্য। তার সে ক্ষমতাও নাই। মনও মরা মাঝি। তাহলে সে যন্ত্রও নয়। যন্ত্রও তো বেশি চাপে বিগড়ে যায়। তাহলে সে কী? সে জন্তুও নয়, যন্ত্রও নয়, মানুষও নয়। সে শুধু ফরজেন। এভাবে এ ভাবনা শেষ করে কোনোমতে কিন্তু আরো আরো ভাবনার দঙ্গল তার সামনে এসে হাজির হয়।


৫.


ফরজেনের ভাবনার শেষ হয় না। রাত মেলা হয়েছে। সে বসেই থাকে, চাঁদটা ধীরে ধীরে আরো উপরে ওঠে। জোছনা হয়ে বেহেস্তের মধু ঝরে পড়ছে চাঁদের মুখ হতে। তারাগুলো বেহুঁশের মতো, আরও অশান্ত হয়ে ছুটোছুটি করছে। বাইরের গাছটাকে জমাট বাঁধা ছাইয়ের গাদার মতো মনে হয়। কিছুক্ষণ আগে সেখান হতে একটা পাখি ডেকেছিল। আবার এখন ডেকে উঠল। রাতটা চিড়বিড় করে ফেটে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তারাগুলো থমকে, চমকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। সেই পাখিটাই কি? কী হয়েছে তার? মনটা ছটফট করে ফরজেনের।

লাঠিতে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। বদনাটা নিয়ে তলপেটের চাপটা বাইরে ফেলে এসে আবার বসে। ঠুঁঠা হাতটা পড়ে আছে জোরহীন পাঁজরের একপাশ ছুঁয়ে। ভালো হাতটা দিয়ে তার চলার সঙ্গী লাঠিটাকে আদর করে। লাঠি ঘুমায় তার পায়ে হেলান দিয়ে। কান দুটো আরো খোলাসা হয়ে উঠে। বাইরে যেখানে সে বসে আছে তার পাশেই মতির ঘর, সে ঘর হতে শীৎকার ভেসে আসে। পুবের আকাশ হতে জোছনারূপি যে সুগন্ধী মদের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, সেই চাঁদ মদ খেয়ে পৃথিবীটা এখন মাতাল। বড় সুন্দর রাত।

সে আর বসে থাকে না। সুন্দর রাতটাকে বাইরে রেখে, ঘরে এসে শুয়ে যায় ফরজেন। কিন্তু কানে যে শীৎকারের শব্দটা লেগেছে তা বেজেই চলছে। মনে পড়ে সখিনাকে, যার চুড়ি আর কলসির শব্দ তাকে বাঁশি বাজিয়ে নিত। স্মৃতিবই পড়তে পড়তে নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হয়– ‘যে জীবনকে নিজেই বঞ্চিত করেছে তাকে নিয়ে মিঠে ভাবনা কেন? সে কি ইচ্ছে করলে সখিনাকে নিয়ে ঘর করতে পারত না?’ স্মৃতিপাঠ বন্ধ রেখে অন্ধ আবেগে ল্যাং মেরে সে ভাবনাটাকে সরিয়ে দেয়। আবার আনন্দও পায় সে, বিয়ে করেনি, সন্তান করেনি ভেবে। এ পৃথিবী এমন কিছু নয় যে, এখানে কোনো মানুষকে আসতে হবে। এ পৃথিবী এমন কিছু যে, এখানে কোনো মানুষের না আসাই উচিত।

সৃষ্টি, অনাসৃষ্টি, সুখ, দুঃখ মেলা কিছু ভাবতে ভাবতে চোখ মেলে শুয়ে থাকে ফরজেন। আবছা আঁধারের মধ্যে চালের বাতাগুলো দাঁত মেল করে হাসে, আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে, ঘরটা ছোট হতে থাকে। খুবই ছোট, কবরের মতো। চৌকিটাকে কুরক কুরক করে কুরছে ঘুণে পোকা। ফরজেন ভাবে, এমন করে তারও মাংসমজ্জা কুরে নেবে কিলবিলে পোকা। কত মানুষকে সে পৃথিবীতে আসা যাওয়া করতে দেখল তার হিসাব নাই। এখন, মানুষের মরা ব্যাপারটা খারাপ লাগে না, জন্মা ব্যাপারটা খারাপ লাগে।


৬.


কুড়ানদার কথা মনে পড়ে। অদ্ভুত স্বভাবের লোক ছিল। কুড়ানদার জন্যই তার জীবনটা এ রকম। তার জন্য ফরজেন যেমন এতদিন মরেনি, তেমন ঠিকমত বেঁচেও নাই। কুড়ানদা তার জীবন কেড়ে নিয়েছে শুধু প্রাণটা বাঁচিয়ে রেখেছে। এখন তার প্রাণ আছে, জীবন নাই।

ফরজেন ভালো হাতটা দিয়ে ঠুঁঠা হাতের ডগাটা নাড়ে। তার দুটা হাতই ভালো ছিল। একটা ভালো হাত থেকে কুড়ানদা আধখান কেটে নিয়েছে। ফরজেন কত কাকুতি মিনতি করেছিল– ‘কুড়ানদা এব্যারকার মতন মাপ কর‌্যা দ্যাও, একটা সুযোক দ্যাও আর কুনুদিন করব না।’ কুড়ানদা শুনেনি– ‘না রে ফরজেন এট্যা হয়ন্যাখো, এটা যে ইসলামের বিধ্যান। হাঁকে পালন করতে দে ভাই।’ যার মুখের কথা এত মিষ্টি তার বুকের তলাটা যে এত কঠিন ভাবতে বুকটা বার বার কুঁকড়ে যায়।

সেদিন, গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি নামছে। উপরের ধুলি-বালি ধুয়ে অতিরিক্ত সবুজ হওয়ার জন্য গাছের পাতাগুলোকে কালচে ঠেকছে। বেশ ঠাণ্ডা। বেশির ভাগ মানুষ ঘরের খিল এঁটে চাদরের নিচে শুয়ে বউয়ের গন্ধ শুঁকছে। বাইরের শুনশান অবস্থা দেখে বোধ হয় ‘বাহির’ বলে যে জগতে একটা কিছু আছে তা মানুষেরা ভুলে গেছে। অবশ্য মাঝে মাঝে গন্ধবন্ধহীন দুচারটা মাত্র মানুষ চাদর গায়ে, ছাতা মাথায় বাইরে এসে ‘বাহির’ বলে যে একটা কিছু আছে তার প্রমাণ রাখছে।

কাল থেকে চারদিন হরতাল। এ হরতালের শানে নুযুল কী তা ফরজেন জানে না, শুধু এইটুকু বুঝতে পারে সরকারের সাথে বিরোধী দলের কিছু একটা হয়েছে। তাদের বিরোধ সবসময় লেগেই থাকে। মানুষের জন্য নয়। তাদের জন্যই তাদের বিরোধ। ক্ষমতার জন্য তাদের বিরোধ। মাঝ থেকে মানুষের মরণ, রক্তের ক্ষরণ। গ্রাম্য বাজার বলে এদিকটাতে হরতালের প্রভাব তেমন পড়ে না। দোকানপাট খোলা থাকে। কিন্তু এখান থেকে মাত্র কিলোপাঁচেক দূরে শহর, হরতালের নিস্তব্ধতায় নিমগ্ন থাকে। কুড়ানদা তার সারের দোকানে ফরজেনকে বসিয়ে শহরে গেছে, হরতালের চারদিন যেন সারের মজুদ ঠিক থাকে তাই। ফরজেন কুড়ানের কেউ নয়। বন্ধুত্বের সম্পর্ক, যদিও ফরজেনের চাইতে কুড়ান বছর পাঁচ-সাতেকের বড়ই হবে।

ফরজেন দোকানে বসে আছে। সূর্যের দিক দিয়ে ধরলে সকাল হতেই বিকেল লেগে আছে, কিন্তু ঘড়ির সময়ানুযায়ী বিকেলটা পার হয়ে সন্ধ্যের কাছে ধরা দিয়েছে। ঘড়ি দেখতে আগে সে জানত না, শিখিয়ে দিয়েছে কুড়ানদার বউ, চিনি ভাবি। তার নামটা যেমন সুন্দর তেমন দেখতেও ছিল মিষ্টি। চিনি ভাবির কাছে সে নাম সহি করা শিখেছিল, বানান করে বাংলা পড়া শিখেছিল। শিখেছিল আরো মেলা কিছু যেমন– র‌্যাট মানে ইঁদুর, ক্যাট মানে বিড়াল, ম্যাট মানে মাদুর, এ্যাক্স মানে কুড়াল, শু মানে জুতা, হেড মানে মাথা।

মিহি মিহি সাদা বৃষ্টি সাবানের ফেনার মতো পড়তেই আছে নিঃশব্দে। মনে হচ্ছে কয়েকদিন চলবে। দোকানের সামনের সরু পিচের রাস্তায় ঘোলাটে পানির পাতলা স্তরটা পুরু হচ্ছে ধিরে ধিরে। সেই পানিতে ছ্যাপার ছ্যাপার শব্দ তুলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো কয়েশ–

: ফরজেন ভাই তুমি এখ্যানে, আর হামি তোমাকে ঢুঁড়্যা ঢুঁড়্যা হয়র‌্যান হেগেনু। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে কয়েশ।

: কী ব্যাপার রে কয়েশ কী হেছে, এমন করছিত কেনে?

: ফরজেন ভাই, হামাকে হাজার ড্যাড়েক টাকা দিতেই হৈবে, নাইহ্লে হামার ছাইল্যাটা বাঁচবে না। অর খুব ব্যারাম।

কয়েশের জন্য মনটা কেঁদে উঠল ফরজেনের। টাকার জন্য একটা ছেলে মরে যাবে! তার ছোট ভাই তুফানির কথা মনে পড়েছিল তখন। কী যেন অসুখ হয়েছিল তার, শুধু পেটে ব্যথা। ডাক্তার বলল– ‘রাজশাহী নিয়ে যেতে হবে, অপারেশন করা দরকার।’ বাপ টাকার জন্য কত হন্য হয়ে ঘুরে বেড়ালো, টাকা পায়নি কোথাও। পরে, দু তিনদিন দারুণ পেটের ব্যথায় দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে তুফানি মারা যায়। টাকার জন্য কয়েশের ছেলেটারও এমন হবে! তার ভেতর ব্যথায় মোচড়াতে লাগল। কোনো ভাবনা-চিন্তা না করে, ফরজেন কুড়ানদার ক্যাশ হতে দেড় হাজার টাকা কয়েশকে দিয়ে দিল। সন্ধ্যার পর দোকান লাগিয়ে চিনি ভাবির হাতে চাবি দিয়ে ফরজেন নিজের বাড়ি চলে গেল।

পরদিন, ভোরে ঘুম হতে উঠে তার মনে পড়ে টাকার কথা। টাকার জন্য তার মনটা অস্থির হয়ে উঠল। ফরজেন ঠিক করল কুড়ানদাকে গিয়ে সব খুলে বলবে। জামাটা গায়ে দিয়ে বের হচ্ছে। কুড়ানদা এসে হাজির– ‘ফরজেন তোকে খুব বিশ্বাস করতুনরে …’ ফরজেন কাকুতি মিনতি করে– ‘বিশ্বাস করো কুড়ানদা হামি টাকা লিয়্যাছি ঠিকই কিন্তু চুরি করিনি।’ সে সবকিছু খুলে বলল কিন্তু কুড়ান শুনল না। কয়েকজন মিলে বিচার করে হাতটা কেটে নিল। গ্রামের কেউ কোনো প্রতিবাদ করল না। কুড়ানদা প্রভাবশালী মানুষ। মানুষজনের দিকে তাকিয়ে কুড়ানদা শুধু বলল– ‘হামি খালি ইসলামের বিধ্যান পালন করনু ভাইজনেরা, অর হাতের চিকিৎস্যার খচ্চাপাতি হামিই দিব।’ বিচারের মধ্যে বহুবার কয়েশও বলেছিল তার টাকা নেবার কথা, তার বেটার ব্যারামের কথা। কাজ হয়নি।

ঐ ঘটনার পরদিন কয়েশ পুলিশকে নাকি খবর দিয়েছিল। পুলিশ আসছিল কিন্তু পুলিশকে নৌকা থেকে নামতেই দেয়নি কুড়ানদা বা তার লোক। টাকা দিয়ে ঘাট থেকেই বিদায় দিয়েছিল পুলিশকে–

: এটা গ্রামের ব্যাপার, মোড়ল মাতবররা মিটিয়ে ফেলেছে।

পুলিশেরা ফিরে গেছিল টাকা পেয়ে। টাকার উপর শাসক নাই। টাকার উপর বিচারক নাই। টাকা জগতের চাকা। টাকা ছাড়া বাঁকা জীবন। টাকা ছাড়া মানুষ নুলো। যে হাতে টাকা নাই সে হাত হাতই নয়, শুকনো ডাল। মট্ করে ভেঙে যায়। সে তার নুলো হাতের দিকে তাকিয়ে গভীর শ্বাস ভেতরে টেনে রাখল। সে তার শুকনো ডালের মতো মট্ করে ভেঙে যাওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল।


৭.


তার মনে পড়ে– আদরের ছলে কুড়ানদার বউ– চিনি ভাবি, একা ঘরে একবার ফরজেনের গাল টিপে দিয়েছিল। মাত্র এইটুকুই। তখনই মনে হয়েছিল জানালার ফাঁক দিয়ে কুড়ানদা বুঝি দেখল। কিন্তু পরে কিছু বলেনি বলে মনে হয়েছিল– ‘শ্বশুরের টাকায় ব্যবসা বলে কুড়ানদা কিছু বলল না।’ অবশ্য এমনও মনে হয়েছিল, ‘কুড়ানদা হয়ত দেখে নিয়েছে’ মনে হওয়াটা নিজের মনের ভয়। কিন্তু যখন সামান্য দেড় হাজার টাকার জন্য ধর্মের দোহায় দিয়ে হাতটা কেটে নিল তখন থেকে ফরজেনের মনে হয়– ‘কুড়ানদা সত্যি সত্যি গাল টেপার দৃশ্য দেখেছিল।’ পরে হয়ত কুড়ানদার মনে সত্যি সত্যি অনুশোচনা জেগেছিল তাই মারা যাবার সময় মতিকে ডেকে বলেছিল– ‘তোর ফরজেন চাচাকে দেখিস, বাহালুতা করিস ন্যা। আশ্রায় দিস।’

তখন ফরজেনের অবস্থা খুব খারাপ। পদ্মা জমিগুলোকে গুড়ের মতো ভেঙে ভেঙে শরবত করে খেয়ে নিয়েছে। তবুও ফরজেন মতির বাড়িতে থাকেনি। কয়েক বছর এর ওর জমিতে একহাতেই কামলা খেটেছে, খেয়েছে, ঘুমিয়েছে। সময়কে ফুরিয়ে যেতে দিয়েছে। সময় ফুরিয়ে ফুরিয়ে বেদনা জমিয়েছে। বেদনা সঞ্চিত হয় খালি, খরচ হয় না।

বহু বছর পরে বিছানায় পড়ে শরীর ভেঙ্গে গেলে, কোথাও কাজ পায়নি যখন, তখন চেয়ে-মেঙে খেয়েছে। তবু মতির বাড়িতে থাকেনি। কিন্তু শেষে যখন শীতকালে হাঁপানিটা চাঁড়া দিয়ে উঠল, শ্বাসকষ্টটা তীব্র হয়ে উঠল তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বছর খানেক থেকে মতির বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।


৮.


রাত প্রায় শেষ। শুকতারা মাঝ আকাশ থেকে হাত বিশেক পশ্চিমে। চাঁদ তারার আলোর সুতোয় আঁধারের ছোট ছোট খণ্ড নিয়ে যে জট বেঁধেছিল তা খুলে যাচ্ছে। সে অজু করে আসে। এই শান্ত স্নিগ্ধ নিমভোরেও তার ভেতর ছটফট করে, খাঁ খাঁ করে ভেতর বাহির। কথা শুনতে শুনতে কান ক্লান্ত, বলতে বলতে জিভ ক্লান্ত, দেখতে দেখতে চোখ ক্লান্ত। দেহমনের সমস্ত ক্লান্তি নিয়ে সে ফজরের আল্লার সামনে দাঁড়িয়ে গেল– ‘আল্লাহু আকবার।’

ভোর হয়েছে। সকাল হচ্ছে। ফরজেন ঘর হতে বেরুচ্ছে না। মতিবউয়ের ভোরের ভাত রান্না শেষ হয়েছে। মতি ফরজেনের দরজার সামনে এসে ডাকল– ‘চাছা ও চাছা ওঠো।’ সাড়া নাই। মতি ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখে সিজদাতে আছে ফরজেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মতি বুঝল ফরজেন ফজরের নামাজ পড়তে পড়তে সিজদারত অবস্থায় ঘুমিয়ে গেছে। মতির রাগ চড়ে যায় – ‘ইঁহ্ লবাবের ব্যাটা লবাব, নমাজ পঢ়তে পঢ়তে নিন্দ্ চল্যা গেছে।’ সে রাগ করে কিন্তু রাগ চেপে হাঁটু দিয়ে আলতো একটা ঠেলা দেয়। আলতো ঠেলায় আলতো করে গড়িয়ে যায় ফরজেন। এ ঘুম ভাঙ্গবে না। প্রভাতভাত খাবার তার আর দরকার নেই। তার নতুন সময় শুরু হয়ে গেছে। এখানে খাওয়া নাই, গাওয়া নাই, থুথু গিলা নাই, দুঃখতা নাই, রুক্ষতা নাই। শুধু ‘নাই’ আছে। বিশাল ‘নাই’।

মিকাঈলের ঘুম ভেঙ্গেছে। বেশ কিছুদিনের রিক্ত আকাশ বিজলী দাঁতে হাসছে। ঝম ঝম শব্দ মাখা বৃষ্টি ভাসিয়ে দিচ্ছে সারা পৃথিবী।

রিপন কাঁদছে। মতি অবাক হয়ে খেয়াল করে, তার বউ রমেলাও মিহি সুরে গুনগুন করে কাঁদছে, ফুলে ফুলে উঠছে তার বুক।


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu