পিন্টু রহমান
১৩ অক্টোবর ১৯৭৫ খ্রি: চুয়াডাঙ্গার কুমারী গ্রামে জন্ম, পৈত্রিক ঘরবসতি কুষ্টিয়া জেলার বাজিতপুর গ্রামে। মাতা: জিন্নাতুন নেছা ও পিতা: বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিবর রহমান। তিনি একজন কথাসাহিত্যিক। গল্পের ছলে ভাষার আঞ্চলিকতায় চিত্রায়ণ করেন বাঙাল-জনপদের বহুমাত্রিক জীবনাচার। উল্লেখযোগ্য প্রকাশিত গ্রন্থ: পাললিক ঘ্রাণ (গল্পগ্রন্থ), পূরাণভূমি (উপন্যাস), কমরেড (উপন্যাস), পরাণ পাখি (গল্পগ্রন্থ)
পিন্টু রহমান

যে মন্দিরে পতিতারা রানি

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

নিরুত্তাপ চোখে অঙ্গের বসন খুলতে শুরু করে মেয়েটি। খোঁপার কাঁটা খোলে, গলার মালা খোলে, ওড়না খোলে, কামিজ খোলে কিন্ত অর্ন্তবাসে আটকে যায়। রায়হান তাকে থামিয়ে দেয়। থেমে যায় মেয়েটি। অন্য সময় হলে ভাবতো, আগুনে জল পড়লো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ভিন্ন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে কামনা। শরীর বিনিময় করা তাদের নেশা ও পেশা। ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায় অচেনা শরীর ও মনের সাথে সুখ-অসুখ বিনিময় করতে হয়। মাসি বলে, মা-রে অতিথি নারায়ণ; তাদের ফেরাতে নেই। গেরস্থের অমঙ্গল হয়।

প্রথম প্রথম অসুবিধা হতো। ইদানিং অভ্যাস হয়ে গেছে। মানুষ অভ্যাসের দাস। অতিথি না এলে বরং খারাপ লাগে। রাত্রে ঠিকঠাক ঘুম হয় না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করে। মাঝ রাতে শরীর জেগে উঠলে ভয়ানক বিপদ। কামনার আগুনে দগ্ধ হয়। একজন স্থায়ী সঙ্গীর কথা ভাবে। তবে সঙ্গী হিসেবে রায়হান লোকটিকে তার পছন্দ নয়। দাদার বয়সী মানুষটাকে দিয়ে কি হবে, নাহ কিচ্ছু হবে না। ফিরিয়ে দিয়েছিল। লোকটি ঘরের পথ ধরেছিল। কিন্তু মাসি তাকে বাধ্য করেছে– নারায়ণ ফেরাতে নেই মা। উনাকে ফিরিয়ে আনো।

ফিরে এসেছে রায়হান। ম্লান হেসে নেশার পেয়ালায় চুমুক দেয়। কেরু অ্যান্ড কোম্পানীর খাঁটি মাল। বিশেষ অতিথি না হলে মাসি দামি মদ দেয় না। সাধারণ হলে তো বিপদ– চড় থাপ্পড় মারে। রায়হান চৌধুরি ভাগ্যবান। মাসি তাকে দামি মদ পাঠিয়েছে। কুতকুতে চোখে সে ঢকাঢক মদ পান করে। কামনার পানে তাচ্ছিল্যময় চোখে তাকায়। ইস ডশ দেমাগরে! পাত্তা দিতে চায় না। কামনা ভাবে, কিসের এতো দেমাগ তার! অন্য কেউ হলে এতক্ষণে জড়িয়ে ধরতো। দু’বাহুর মধ্যে নিয়ে আদর সোহাগ করতো! চুমোয় চুমোয় গালে চিহ্ন এঁকে দিত!

আয়নার সম্মুখে দাঁড়ায় সে। নিজের রুপে মুগ্ধ হয়। মুগ্ধতার চোখে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সাধারণ একটা ব্রা-তেও অসাধারণ দেখাচ্ছে! গহনাগুলো থাকলে ভালো হতো। নিজেকে তার সত্যি সত্যি রানি মনে হয়– রূপকথার রাজরানি। বুড়োর ভাগ্য যে, এমন একজন সঙ্গী পেয়েছে! অথচ ভাগ্যকে দু’পায়ে ঠেলে। বেচারা নেশার ঘোরে মত্ত। অস্পষ্ট স্বরে কী সব বলাবলি করছে। কামনা বিরক্ত হয়। পেশার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা কমে যায়। কিছু কিছু নেশাখোর উচ্চস্বরে চেঁচামেচি করে। গালমন্দ করে। অশ্লীল কথা বলে। মারতে উদ্যত হয়। কামনার তখন কাঁদতে ইচ্ছে করে। নারায়ণ ভেবে নীরবে অপমান হজম করতে ভালো লাগে না। কামনা একা না, প্রত্যেকের জন্য অভিন্ন বিধান। মাসি বলে, মন খারাপ করতে নেই। সব পেশাতেই কিছু না কিছু খারাপ দিক রয়েছে।

মেয়েটি খারাপ পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করে। দমকে দমকে কাঁশি ওঠে। সিঁদুরের মতো রাঙা চোখ। কামনা জলের কথা বলে, কী গো নাগর, জল নেবে?

রায়হান চৌধুরি হাত নাড়ে। না, তার জলের প্রয়োজন নেই। সে এসেছে আগুন নিয়ে খেলতে। মাত্রই তো খেলা শুরু! লোকটার চোখের আগুন ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়। সজ্জার ওপর বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে। কামনার চোখে অপেক্ষা। অর্ন্তবাসে আর কতক্ষণ; একজন পুরুষের জন্য অপেক্ষা করে। তবু ভালো শরীর জেগে ওঠেনি। বুড়োকে তাহলে খুবলে খুবলে খেত। বুঝতো, এ পথে পা দেওয়ার জ্বালা কী!


দুই.


সে’ই প্রথম মন্দিরে আগমন। তারপর থেকে রায়হান চৌধুরি নিয়মিত। রাত নামলে ক্লান্ত পায়ে হাজির হয়। মেড়ো মন্দির। চাকচিক্যের অভাব। অপ্রশস্ত রাস্তা। যেসব মাড়োয়াড়িরা নির্মাণ করেছিল, তারা নেই। পতিতারা সংসার পেতেছে। মানুষের পূজো-অর্চণা করে। শহর ঘুমিয়ে পড়লেও মন্দিরের বাসিন্দারা জেগে থাকে। নতুন নতুন মেহমানের জন্য অপেক্ষা করে। যশোর শহরের বিশেষ ওই মন্দিরের টানে রায়হান চৌধুরি নিয়ত ছুঁটে আসে। কামনাও বুঝে গেছে বৃদ্ধ লোকটি তার নাগর। নাগরকে নিয়ে আগে ক্ষোভ-আক্ষেপ ছিল। কিন্তু মাসি পাত্তা দেয় না। অসম বয়সের সম্ভোগ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলে। বুড়োর জ্বালাতন তার গা-সওয়া হয়ে গেছে। রাগের পরিবর্তে এখন কেবল অভিমান। আসতে দেরি হলে কামনার অভিমান হয়। খাটের সাথে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। এ নিয়ে মাসি মশকরা করে, তলে তলে এতদূর! তাইতো বলি কার জন্য সাজুগুজু!

সাজলে বেচারা খুশি হয়। সারা মুখে খুশি খুশি ভাব। শরীরে হাত বুলিয়ে প্রশংসা করে, বুঝলে মেয়ে, তোমার এই রূপ দেখে মরে যেতে ইচ্ছে করে। মরবে আমার সাথে?

মরতে দ্বিধা মেয়েটির। মৃত্যু বিষয়ক প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলে। অসম বয়সী মানুষটার প্রেমে পড়েছে সে। বিকেলের আলো হারাতে বসলে কামনা সাজতে বসে। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল– বুড়োর যা যা পছন্দ সে তাই করে। মাসি চতুর। আড়ালে থেকেও কোনোকিছু আড়াল করার উপায় নেই। প্রথম দেখাতেই বুঝে ফেলেছিল লোকটি মালদার পার্টি! তা না হলে মন্দিরের গেট থেকে ফিরিয়ে আনবে কেনো! অথচ সত্যটা অনুধাবন করতে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বুড়ো ঘুমিয়ে গেলে কামনা রাগে-ক্ষোভে চুল ছিড়েছিল। নাক ডাকার কী যে বিশ্রী আওয়াজ! পতিতালয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা; তবে ঘুমিয়ে পড়ার ঘটনা ওটাই প্রথম। শেষ রাতের দিকে কামনার চোখে ঘুমের আভাস। ভেবেছিল, বুড়োর পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমাবে। কিন্তু রুচিতে বেধেছিল। শেষমেশ চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছিল। বুড়ো বলে অন্য কথা– না গো মেয়ে, আমি সেদিন ঘুমাইনি।

তাহলে?

ঘুমের ভ্যান করে শুয়েছিলাম।

বিস্ময়ের ভাব দেখিয়ে কামনা জিজ্ঞেস করে, তাই! কিন্তু কেনো গো নাগর?

তোমার রূপ দেখার জন্য।

না ঘুমালে বুঝি রূপ দেখা যায় না?

না। মুখের সৌন্দর্য দেখতে ঘুম জরুরি।

গভীর তন্ময়তায় রায়হান সেদিন মেয়েটির মুখের পানে চেয়েছিল। আহা, কী মায়াবী মুখ! কতই বা বয়স, একুশ কিংবা বাইশ! চোখের কোণে খানিকটা কালি। ওই কালি দেখে রায়হানের ভুল হয়েছিল। মুহূর্তের জন্য দিলারার মুখটা ভেসে উঠেছিল। কামনার ঘুম ভাঙতে ভাঙতে অনেক বেলা। মাসি না ডাকলে বোধহয় আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকতো। শূন্য বিছানায় চোখ পড়তেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল– মানুষটা গেলো কোথায়? পালিয়েছে নাকি?

রায়হান সেদিন পালিয়েছিল। বালিশের পাশে টাকা রেখে সে বেরিয়ে এসেছিল। অনেক টাকা। মাসি ও কামনা যা আন্দাজ করেছিল তার চাইতে অনেক বেশি। টাকা নিয়ে রায়হানের মাথাব্যথা নেই। এক জীবনে অনেক কামিয়েছে সে। টাকার জন্যই তো দিলারা পর হয়েছে।

দিলারার বিষয়টি জেনেছে আরো পরে।

কামনার সাথে ঘুরতে প্রথম প্রথম লজ্জা হতো। দুরন্ত মেয়ের পাশে বড্ড বেমানান। পুলিশের সামনে পড়লে সংকোচ। হেঁয়ালি করে কামনা জিজ্ঞেস করে, কী হলো নাগর, থামলে যে!

ওই যে পুলিশ দাঁড়িয়ে।

তো কি হয়েছে?

হাতে দড়ি পরাবে।

কামনা হাসে, আরে ধ্যাৎ, ওরা আমাদের লোক।

শুধু পুলিশ নয়, চোর-ডাকাত, সাধু-সন্ন্যাসী, মুচি-মেথর, ধনী-গরিবদের সাথে পতিতাদের বসবাস। শহরের অলিতে-গলিতে তাদের লোক। ছেলে-ছোকরারাও জানে, কে কার নাগর। রায়হানের সাথে দুষ্টুমি করে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, খাসা মালা, দাদুভাই। ক্যামনে জোটালে? তোমার তো রাজকপাল!

কামনার রাজকপাল। কদিনেই বুঝে গেছে, এ আঙিনায় সে নতুন রানি। যখন যা ইচ্ছে তাই করে। রায়হানের টাকা দু’হাতে টাকা খরচ করে। কাছের বান্ধবীরা আক্ষেপ করে, কপাল রে মাগি কপাল! তা না হলে আমাদের এমন দুর্দশা হবে ক্যান?

বস্তুত সব পেশাতেই উত্থান-পতন আছে। কামনার এখন উত্থানকাল। খদ্দের ধরার জন্য দালাল লাগে না। গেটের সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। রায়হানের কোলের মধ্যে পরম নির্ভরতায় ঘুমায়। সুখী জীবনের স্বপ্নে বিভোর হয়। দিলারা বিষয়ক ভাবনায় পতিত হলে লোকটি র্নিঘুম রাত কাটায়। শরীর নিয়ে খেলতে খেলতে থেমে যায়। মনে হয় দিলারা ফিরে এসেছে। কামনা তখন দিলারায় পরিণত হয়। মেয়েটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে– সেই নাক, সেই মুখ, সেই ঠোঁট সেই উরু! অবিকল দিলারা। দিলারার দুরন্ত যৌবন তাকে হাতছানি দেয়। ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ে। নিবিড়ভাবে মেয়েটিকে আলিঙ্গন করে। ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। বুকে মুখ ঘষে। চুলের ঘ্রাণ নেয়। কামনা অস্থির। শরীরে জোয়ার এসেছে। সবকিছু ভাসিয়ে নেবে। রায়হানের বুকে মাথা কুটে মরবে। কিন্তু বিধি বাম। রায়হান নির্বিকার। সে কেবল আগুন জ্বালাতে পারে, নেভাতে অক্ষম। কামনা একদিন তার মুখের ওপর টাকা ছুঁড়ে মেরেছিল– যাও এক্ষুণি বেরিয়ে যাও। আর এক মুহূর্ত নয়। কোনোদিন আমার সামনে আসবে না।

কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বলেছিল, কী ভেবেছো, টাকাই জীবনের সব। না, এমন টাকার মুখে লাত্থি মারি।

পতিতার মুখে এমন কথা বেমানান। রাগ হওয়ার কথা। কিন্তু রায়হান রাগতে পারে না। চরম সত্যের মুখোমুখি সে– মাত্রই বিয়ে হয়েছে। শরীরের চাইতে ব্যবসা রায়হানের কাছে অধিক গুরুত্বের। ব্যবসা নিয়ে সীমাহীন ব্যস্ততা। বাসায় ফিরতে ফিরতে অনেক রাত। দিলারার পানে তাকানোর সময় নেই, ঘুমে চোখ বুজে আসে। দিলারা নির্ঘুম। অঝোরে কাঁদে। নাস্তার টেবিলে স্বামীকে বলে, এই টাকায় একদিন তোমার জীবনের কাল হবে।

দিলারার কথার সত্য হাড়ে হাড়ে টের পায়। টাকা তার জীবনের এলার্জি। অসুখ। নিজেকে মাঝে মাঝে টাকা রোজগারের মেশিন মনে হয়। মুখে টাকা ছুড়ে মেরে দিলারা সেদিন তাহলে ভুল করেনি। অথচ রায়হান অকারণ ক্ষেপেছিল। বউয়ের গায়ে হাত তুলেছিল। চুলের মুঠি ধরে কিল ঘুষি মেরেছিল। রায়হানের অনুশোচনা হয়। কামনার মুখে অন্ধকার। ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য লজ্জিত সে। কাঁধে হাত রেখে বলে, স্যরি। ভুল হয়েছে। ভুলে গিয়েছিলাম আমি পতিতা।

রায়হান কটাক্ষ করে, এ পথে না এলেই পারতে!

হুম, পারতাম।

তাহলে?

কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে কামনা বলে, আমার জন্য দুটো পথ খোলা– হয় মৃত্য না-হয় পতিতালয়।

রায়হান মেয়েটির মুখের পানে তাকায়। আত্মপ্রত্যয়ী। দৃঢ়চেতা। ভাঙবে তবু মচকাবে না। এ পথে কেউ কেউ শখ করে আসে বটে, কামনা নিরুপায় হয়ে এসেছে। প্রেমিকের হাত ধরে পথে নেমেছিল। সুখের কথা ভেবেছিল। ভেবেছিল ছোট্ট একটা সংসার হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। নিয়তি তাকে মন্দিরে টেনে এনেছে। পথিকের অর্চণায় ক্লান্ত সে। সুস্থ জীবনের অনুভূতি ভুলে গেছে। রায়হানকে প্রেমিক ভেবে ভুল করে। অতীত জীবনের মুখরতা নতুন করে অনুভব করে। রায়হান ফিরে যাওয়ার কথা বলে। কামনা তখন উৎভ্রান্তের মতো হাসে, লোভ দেখিও না নাগর। ফিরে যাওয়ার পথ ভুলে গেছি। এখানেই মরবো।

রায়হানও মরার কথা ভাবে। মৃত্যু ছাড়া আর সবকিছু তুচ্ছ। কতিপয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লোকটি পতিতালয়ের পথ ধরেছে। এ পথে না এলে কিছু বিষয় অমিমাংসিত থেকে যেত। কামনার সমান্তরালে দিলারাকে বহুকৌণিক আঙ্গিকে মাপ-পরিমাপ করেছে। যোগফল অভিন্ন– যুদ্ধ ও যৌবন বিষয়ক উপমা জীবনের সারাৎসার। দিলারা যখন অচেনা যুবকের হাত ধরে পালিয়ে যায় আত্মীয়-স্বজন বলেছিল– হাত গুটিয়ে বসে থেকো না রায়হান। সংসারে অনেক কিছু হয়। মেয়েটিকে ফিরিয়ে আনো।

কারো যুক্তি রায়হান সেদিন পাত্তা দেয়নি। মনে হয়েছিল দিলারাকে ছাড়াই তার চলবে। মাস ঘুরতে না ঘুরতে বিয়ে করেছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতে সন্তানের বাবা। রায়হানের এখন সোনার সংসার! অসংখ্য মানুষের পদচারনায় মুখরিত। ধুমধাম করে অনুষ্ঠান হয়। নতুন নতুন মেহমান আসে। রায়হান এসবের মধ্যে নেই। তার জন্য একটা রুম নিদৃষ্ট আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ছেলেদের বুঝিয়ে দিয়েছে। অফুরন্ত অবসর। নিঃসঙ্গতা কুরে কুরে খায়। দিলারার কথা মনে পড়ে। মনে হয়, সে ভুল করেছিল।


তিন.


ঘরের কথা বললে রায়হানের অভিমান হয়। অভিমানে চোখ ফেঁটে পানি বেরিয়ে আসে। কান্নাটা নতুন। আগে কাঁদতে পারতো না। এ মন্দির ছেড়ে কোথায় যাবে! কামনা চুপচাপ বসে আছে। নিরুপায়। চোখের সামনে মানুষটা ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বললেও রাজি হয় না। প্রসঙ্গ বদলায়– আমি কি বোঝা হয়ে যাচ্ছি রানি?

বোঝার কথা কেনো নাগর? যার টাকা আছে সে কখনো বোঝা হয় না। আমিই বরং বোঝা; অসুখ বাঁধালে দূর করে দেবে।

কোথায় যাবে তখন?

জাহান্নামে। যাবে আমার সাথে?

হাসে রায়হান। জাহান্নামের পথ তার মুখস্থ। দৃঢ় পদক্ষেপে দিলারা ওই পথে হেঁটে গেছে। তার নিজেরও যাওয়া উচিত। যাওয়ার কথা ভেবে ভেবে অস্থির। কামনার প্রতি নতুন করে মায়া জন্মিয়েছে। অসুখের যন্ত্রণায় যখন প্রলাপ বকে; কপালে হাত দিয়ে মেয়েটি যখন কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে তখন মনে হয়– দিলারা ফিরে এসেছে। পরম নির্ভরতায় সেবাযত্ন করছে।

সেবাযত্নে কামনার ক্রুটি নেই। কিন্তু আলামত ভালো না। মাসি তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। সম্ভবত চলে যাওয়ার নির্দেশ দেবে। অসুস্থ মানুষ রাখলে তার ব্যবসার ক্ষতি। লক্ষ্মী হাতছাড়া হবে। রায়হান গড়িমসি করে। মাসির সম্মুখে যেতে দ্বিধা– সে নিজে এলেই তো পারে!

মাসি অপরিচিত মানুষের সামনে আসে না।

তাইতো। জানতাম না। এতদিনে দেখা করা উচিত ছিল।

মন্দিরে মাসির ভূমিকা ব্যাপক। তারাই ব্যাবসা নিয়ন্ত্রণ করে।

রায়হান বুঝতে পারে, মাসিকে ম্যানেজ করা ছাড়া এখানে অসম্ভব। প্রয়োজনে তাই করবে। অনুনয় বিনয় করবে। মন্দির ছেড়ে কোথায় যাবে সে। তাছাড়া সে নিজের তো পতিত! কামনা শোনায় রাজার গল্প– না গো নাগর না; পতিত হবে কেনো, তুমি আমার রাজা।

রাজানুভূতি নিয়ে লোকটি মাসির দরজায় হাজির হয়। আলগোছে কড়া নাড়ে। একবার। দুইবার। তিনবার। মাসির মর্জির উপর তার ভবিষ্যত নির্ধারিত। রায়হান বুকে সাহস বাঁধে। যেভাবেই হোক ম্যানেজ করবে। টাকা থাকলে দুনিয়ায় নাকি সব হয়, মাসিও ম্যানেজ হবে! কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে যায় মাসি আসে না। তেমন সাড়াশব্দ নেই। বিশ্রামে আছে নাকি? নাকি পরে আসবে? আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। দরজা খোলার শব্দে চকিত দৃষ্টিতে তাকায়। তার দু’চোখ হোঁচট খায়। কে দাঁড়িয়ে! ঘোমটা মুখে যে বেরিয়ে এসেছে সে দিলারা নয়তো!


This is an original content which is written by a DORPON author. Copying and publishing any part of the content is strictly prohibited.

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu