মুখ ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করে গফুর। প্রশ্নটা তাকে করেছে। কী বলবে ভেবে পায় না। উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে পাশের যাত্রী আবার বলে, গজবের ভেতর আছি বুঝলেন। গত বছর করোনার জন্য কেউ কেনাকাটাও করতে পারলাম না। এমন করে যে ঈদ করতে হবে তা কেউ কি কোনো দিন ভাবছে!
গফুরের কানে কথাগুলো শব্দ হয়ে বাজে শুধু। গুণবতী স্কুলে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে মাধ্যমিকের নিচের ক্লাসে গণিত পড়াতে শুরু করেছিল সে। বেশি দিন পড়াতে হয়নি, জেলখানার সময়টাতে প্রতিদিন দুবার সে কয়েদির সংখ্যা গুনতে শুনেছে। ১,২…
বাসটা ভাঙা ব্রিজের মাথা বাস স্ট্যান্ডে থামে। হেলপারকে বিশ টাকার নোট দিতেই সে ১০ টাকা ফেরত দেয়। বাস থেকে নেমে গফুর এদিক ওদিক তাকিয়ে মূহুর্তে খুঁজে নেয় গুণবতী যাবার বাস। বাসে উঠে জানালার পাশে একটি সিটে বসে। শহরের পুবের শেষ এ জায়গার নাম তবুও রয়ে গেছে ভাঙা ব্রিজের মাথা। মানুষকে কতো পুরোনোকে নিয়েই না পথ চলতে হয়! স্টেশন থেকে গুণবতীর বাস ঝকঝকে নতুন ব্রীজ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে আসে কিছুক্ষণের মধ্যেই। যাত্রীদের ওঠা নামা, হাক ডাক এসব গফুরের কানে পৌঁছায় না। অনেক বছর পর বাসের জানালা দিয়ে বাতাসের ঝাপটানিতে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। বন্ধ চোখে কালচে রঙ ভেদ করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সেদিনের সেই মূহুর্তটি। খুন করার অপরাধে হাতকড়া পরিয়ে ভোরে তাকে তোলা হয় পুলিশের একটি টেম্পুতে।
গুণবতীর উজানী গ্রামের দক্ষিণে তার বাড়ী। এলাকায় এ পাড়াটি ঠাকুর বাড়ি নামেই পরিচিত। পনেরো-ষোলো পরিবারের বাস এ মাটির ওপর, জড়াজড়ি করে আছে, যেন একটি মাত্র ঘর। এ গ্রামে নিরঞ্জন, সুভাস, মনির, বেলায়েত আরো অনেকের সাথে একসাথে বেড়ে ওঠা তার। সুধারাম কাকার কী অপূর্ব গানের গলা! কাকা নিরঞ্জনকে তালিম দিয়েছে অকৃপণভাবে। বাপ ছেলে যৌথ গান আর কথায় তৈরী হত বাউল সঙ্গ। গফুর কৈশোরে বেড়ে ওঠা আর নিজেকে বুঝতে শেখার মন্ত্র পেয়েছিল সুধারাম কাকার গানে। ফাগুনের সে রাত। রাত প্রায় একটা। তখনো শীত যায় যায় করেও রেশ ছিল খানিকটা। পুরো গ্রাম ঘুমে। হঠাৎ তীব্র চিৎকারে ঘুম ভাঙে গফুরের। বাইরে এসে দেখে পাড়ার পুবের শেষ মাথায় আগুন। ব্যাপারটা বুঝতে আর একমুহূর্তও লাগে না তার। এ মাটির উপর অনেক আগেই চোখ পড়েছিল সিকদার ব্যাপারীর। নিরঞ্জনের পৈত্রিক ভিটে, সুধারাম কাকার জন্মও নাকি এ মাটিতেই। অন্ধকারে সেদিকে দৌড়াতেই গফুরের সাথে ধাক্কা লাগে কারো। চিনতে পারে গফুর। এ গাঁয়ে কী করে জলিল! পেছন থেকে নিরঞ্জন বলে উঠে, গফুর! ধর! ধর! এরা সিকদার ব্যপারীর লোক!আগুন লাগিয়ে পালাচ্ছে! গফুর কী স্বপ্ন দেখছে? ফাগুনের এ রাতে এ কেমন আলোর বন্যা! জোরে এক ধাক্কা লাগায় তার হুঁশ হয় ফের। নিরঞ্জন ততক্ষণে কাছে এসে বলে, এদের এক্ষুনি ধরতে না পারলে আর ধরা যাবে না।
বাড়তে থাকা আগুনের শিখায় অন্ধকার পথে ঝরা আলোয় জলিলকে জাপটে ধরতে এতটুকু দেরি হয় না গফুরের। ধস্তাধস্তিতে জলিলের এক সাথীর লাঠির আঘাত এসে লাগে গফুরের বাম কাঁধে। জলিলের শক্তির কাছে নিরঞ্জন অসহায়। অনেক হয়েছে আর না। জলিলকে জাপটে ধরে তার হাতের লাঠিটা ছাড়িয়ে নিয়ে গফুর তার পিঠে বসিয়ে দেয় এক ঘা। ততক্ষণে জলিল আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে পিছলে পড়ে। লাঠির আঘাত তার পিঠে না লেগে সোজা মাথায় দিয়ে লাগে। জলিল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর ক্রমশ তার শরীর শিথিল হয়ে অাসে। আগুনের শিখা কমে আসে, মাটিতে পড়ে থাকা জলিলের মাথার চারপাশে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ কালচে হয়। খুন, খুন! পালা,গফুর পালা!
গফুর পালায়নি। সেদিন না পালানোর ভাবনাটা গফুরকে আজও তৃপ্ত করে। পালায়নি বলেই ঠাকুর কাকার শিখানো গান জেলের গরাদে বসে গুন গুন করে গাইতে পেরেছে, এত বছর পর মায়ের কাছে ফিরতে পারার সুখটুকু কোন হাটে কি কেনা পাওয়া যায়! গফুরের মস্তিস্কে বাজতে থাকে, বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে… সত্য আর সুন্দরের স্বাদটুকু অনুভব করে জেলের ছয় বছরের জীবন এ মুহূর্তে তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়।
বাসের হঠাৎ থেমে যাওয়া আর যাত্রীদের ব্যস্ততায় গফুরের ধ্যান ভাঙে। মাগরিব-এর আযান দেবে। সবাই ইফতারের জন্য নেমে পড়ে তাড়াহুড়ো করে।
বাসটি ছোট একটি বাজারের পাশে থামে। রোজা ভাঙতে গফুরও অল্প মুড়ি, ছোলা, কলা আর পানি কিনে নেয়। ইফতার শেষে বাস আবার চলতে শুরু করে। জেলে গফুর খবর পায় সুধারাম কাকা মারা গেছেন দুই বছর হলো। সামনের আষাঢ়ের শুরুর দিকে নিরঞ্জন আর অঞ্জলীর বিয়ে। নিরঞ্জন আর অঞ্জলীর নব জীবনের শুরুতে গফুরের ফিরে আসাটা বড় উপহার।
তমালতলা হাটে বাস এসে থামলে গফুর নেমে পড়ে। গাঢ় এ অন্ধকারে তার কাছে নতুন ঠেকে। রিক্সার হাঁক ডাক শুনে কোন জবাব দেয় না সে। এ রিক্সাওয়ালাদের গফুরকে চেনার কথা নয়। সে হেঁটে বাড়ি ফিরবে। অনেক বছর পর গ্রামে ঢুকছে। অনেক কিছুই বদলে গেছে নিশ্চয়। মিজানদের বাড়ির সামনের পথে এসে থমতে দাঁড়ায় গফুর। মিজানের ছোট বোন বকুল। বকুল টের পেত তার প্রতি গফুরের গোপন অনুভব। বকুলকে আর বলা হয়নি সে কথা। জেলে যাবার দু’বছর পরই বকুলের বিয়ে হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে আলতা দিঘির পাড়ে এসে দাঁড়ায় গফুর। দিঘির ওপারে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা নিজের গ্রামটাকে এ অন্ধকারেও দেখা যায়। এত বছর পর তাকে কি চিনতে পারবে এ দিঘির জল, মাটি! বাতাস, খুঁজে কি পাবে সে সব স্পর্শ যেখানে লুকিয়ে রেখেছিল বকুলের জন্য অপ্রকাশিত সোনালী অনুভব। মুহুর্তে দিঘির পাড়ের নীরবতা ভাঙে একদল তরুণের হাস্যজ্জ্বল হেঁটে যাওয়ায়। বুকের ভেতর কেমন করে উঠে গফুরের। এদের কেউ কি গফুরের ফেলে আসা সময়ের গুণবতী স্কুলের ছাত্র! তারা কি গফুরকে খেয়াল করেনি, নাকি তারা এড়িয়ে যেতে চায় এক কয়েদিকে! এমন আরো কতো প্রশ্ন বাতাসের ঝাপটার সাথে পাল্লা দিয়ে গফুরের মনে ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হয়। দিঘির এপার থেকে ওপারে, দিঘির জলে এক টুকরো বাঁকা চাঁদ নাচতে থাকে। আশা নিরাশার দ্বন্দ্বে গফুর বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে আর গেয়ে উঠে, আমায় চিনতে কেন পারছ না মা সবি ভুলে গেলে, আমি তোমার অবুঝ ছেলে ফিরে এলাম মায়ের কোলে…
কাছাকাছি কোথাও বাজির শব্দ গফুরের মনের দ্বন্দ্বে নতুন ছায়া ফেলে। কাল ঈদ।