এক পূর্ণিমার রাতে সে সমুদ্রে মাছ ধরতে গেল। পূর্ণিমার চাঁদের আলো সমুদ্রের ঢেউয়ে পড়ে এক মোহময় দৃশ্যের অবতারণা করছিল। উরাশিমা মাছ ধরতে ধরতে সেই সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেললো। এমন সময় সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর ভেসে উঠলো এক সাগরকন্যা। সাগরকন্যা উরাশিমাকে জাপটে ধরে সমুদ্রের নীচে নিয়ে চললো। সমুদ্রের গভীরে সমুদ্ররাজ্যে নিয়ে গিয়ে সাগরকন্যা তাকে বালির একটি বিছানায় শুইয়ে দিল। উরাশিমার যাতে শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট না হয় এজন্য সাগরকন্যা তাকে সাগরের জাদুতে বশ করে নিল। তারপর সে নাচতে নাচতে সমুদ্রের গান গাইতে লাগলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় উরাশিমা একরকম হতভম্ব হয়ে পড়লো। সে সাগরকন্যাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কে গো?’
সাগরকন্যা জবাব দিলো, ‘আমার তুমি চেনো না গো, আমি হলেম সাগরকন্যা– রূপজগতে অনন্যা।’
উরাশিমা বলে, ‘তুমি যেই হও না কেন, আমায় তুমি যেতে দাও। আমার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমার জন্য চিন্তা করছে।’
সাগরকন্যা বলে, ‘না, না। তা হবে না। তুমি আমার সাথে থেকে যাও।’
উরাশিমা বলে, ‘যেতে দাও আমায়। আমি এখানে থাকতে চাই না। আমি বাড়ি যেতে চাই।’
সাগরকন্যা সুরে সুরে বলে,
‘উরাশিমা যেও না যেও না।
আমি হলাম সাগরকন্যা।
লক্ষ্মী জেলে উরাশিমা,
আমায় ছেড়ে যেও না।’
উরাশিমা বলে, ‘আমাকে তো যেতেই হবে। তুমি যদি আমাকে ফিরিয়ে না দিয়ে আসো, আমি নিজেই এখান থেকে চলে যাবো।’
উরাশিমার আকুতিতে সাগরকন্যা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘তাহলে শুধু আজকের রাতটুকু থেকে যাও!’
সাগরকন্যার কান্না দেখে উরাশিমার অনেক মায়া হলো। সে ভাবে– একটাই তো রাত, থেকেই যাওয়া যাক। তাই সে বলে, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু মনে রেখো, শুধু আজকের রাতটুকুই থাকবো। কাল সকালে তুমি আমায় আমার দেশে রেখে আসবে।’
রাত পার হলে সাগরকন্যা তাকে জলের উপরে তার বাড়ির কাছের সমুদ্রতীরে রেখে আসে। আর যাবার সময় বলে, ‘এই যে একটা ঝিনুক বাক্স স্মৃতিস্বরূপ তোমায় দিলাম। ও আমার প্রিয়তম, ও আমার উরাশিমা, ও আমার জেলে– এটা কখনো খুলো না।’
উরাশিমা ঝিনুকটা নিয়ে তার বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো, আর সাগরকন্যা আবার সমুদ্রের গভীরে তার রাজ্যে চলে গেল। কিন্তু এদিকে আরেক কাণ্ড। উরাশিমা তার বাড়িতে গিয়ে তার ছেলেমেয়েদের ডাকতে থাকে। কেউ সাড়া দেয় না। সে ভাবে তার ছেলেমেয়েরা হয়তো বাইরে খেলতে গেছে। এবার সে তার বউকে ডাকে। তারও কোনও পাত্তা নেই। সে তন্নতন্ন করে খুঁজেও তার পুরো বাড়িতে কোনও প্রাণীর সন্ধান পায় না।
এবার সে বাজারের দিকে যায়। চারিদিকে তাকিয়ে সে দেখে সবকিছু কেমন জানি পাল্টে গেছে। কিন্তু এই একরাতে সবকিছু এমন পাল্টালো কিভাবে? সে খুব চিন্তায় পড়ে গেল। রাস্তার লোকজন তার দিকে কেমন কেমন করে যেন তাকাতে লাগলো। সে ভাবলো, সে কি তাহলে ভুল জায়গায় চলে এসেছে! তাই যদি হয়, তাহলে তার বাড়িটা একইরকম আছে কিভাবে?
কোনও কিছু ভেবে কুলকিনারা করতে না পেরে উরাশিমা একজন মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আচ্ছা ম্যাডাম, আপনি কী উরাশিমা নামে কাউকে চেনেন?’
মহিলাটি বলে, ‘উরাশিমা আবার কে? এ নাম তো আমি জনমে শুনি নাই বাবা।’
উরাশিমা এবার আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে গ্রামের সবাইকে জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু সবাই বলে, উরাশিমা নামের কাউকে তারা চেনেই না। সবশেষে এক থুরথুরে বৃদ্ধকে উরাশিমা জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা দাদু, তুমি কি কখনো উরাশিমার নাম শুনেছো?’
থুরথুরে বৃদ্ধটি বলে, ‘উরাশিমা…? উহ হ্যা, মনে পড়েছে। আমার দাদার কাছে এমন একটা নাম শুনেছিলাম আমি। আমার দাদাও তার দাদার কাছে শুনেছিল বলে শুনেছি।’
উরাশিমার শরীরের রোম খাড়া হয়ে ওঠে, সে বলে, ‘কী হয়েছিল উরাশিমার?’
বৃদ্ধটি বলে, ‘শুনেছি, উরাশিমা একদিন সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিল। তারপর আর ফিরে আসেনি। সবাই ধারণা করে, উরাশিমা সমুদ্রের জলে ডুবে মারা গেছে।’
উরাশিমা এবার সব বুঝতে পারে। সে সমুদ্রের তীরে যায়, সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে সাগরকন্যার দেওয়া ঝিনুকের বাক্সটি খোলে। সাথে সাথে উরাশিমার শরীরের চামড়া কুঁচকে যায়, তার চুল পাকতে শুরু করে, তার শরীরের শক্তি কমতে থাকে, সে কাঁপতে থাকে। তারপর সে চিরদিনের জন্য ঢলে পড়ে সমুদ্রের বুকে।