শৈশবে কুমু ছিল খুব ডানপিটে। সারাদিন এদিক-ওদিক ছুটোছুটি সে করতেই থাকতো। কুমু তাদের বাড়ির একমাত্র মেয়ে। কুমুর সমবয়সী কোনো খেলার সাথী নেই। সে সারাদিন একা একা মাঠে খেলা করতো, তখন সে প্রায়ই দেখতো পাড়ার ছেলেদের ঘুড়ি উড়াতে। তারও মনে মনে ইচ্ছে হতো তাদের মতো ঘুড়ি উড়ানোর। কিন্তু কুমু কাউকে বলতো না। কারণ তার বাবা থাকে শহরে। বছরে দু’বার গ্রামে আসে। তার মা সংসারের কাজ নিয়ে থাকে। আর বাড়ির সকলে নিজ নিজ কাজ নিয়ে থাকে। তাই সে প্রতিদিন মাঠে এসেই ঘুড়ি উড়ানো দেখতো। কুমুর কোনো খেলার সাথী ছিল না। বাড়িতে পুতুল খেলা, মাঠে একা একা ছুটোছুটিতে দিন পার হতো তার।
হঠাৎ একদিন কুমুর খুব ইচ্ছে হলো ঘুড়ি উড়ানোর। সে যে কোনো উপায়ে ঘুড়ি উড়াবেই। তাই সে বাড়ির পুরোনো কাগজ, সুতো নিয়ে চলল মাঠে। মাঠে রৌদ্রের মধ্যে বসে বসে দেখছিল ঘুড়ি দেখতে কেমন, কিভাবে বানানো যায়! এ নিয়ে সারাদিন মাঠেই কাটলো। ওদিকে কুমুর বাড়িতে হইচই পড়ে গেল। মেয়েটা কোথায়! সূর্য ডোবার পর কুমু বাড়ি ফিরে এলো। বাড়ির সবাই তাকে দেখে খুব অবাক হয়ে গেল। এত ডানপিটে মেয়েটা আজ এত চুপচাপ! কুমুর খুব মন খারাপ ছিল। তার মাকে তাকে বার বার মন খারাপের কারণ জানতে চেয়েছে, কিন্তু কুমু কিছুতেই বলে নি।
পরের দিন সকালে কুমুর ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম থেকে উঠেই বাড়ির কাউকে কিছু না বলে চলে গেল মাঠে। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো প্রতিদিনের মতো ঘুড়ি উড়ানো। কুমু খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো। সে মনে মনে ঠিক করল আজ সে তাদের কাছ থেকে একটি ঘুড়ি আনবে। তারপর কুমু গেল একটি ঘুড়ির জন্য, কিন্তু কেউ তাকে দিল না। সে আবার মন খারাপ করে বাড়ি ফিরল। সেদিনও বাড়ির সবাই খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল।
কিছুদিন পর তার বাবা গ্রামে এলো। তার বাবাও তার মন খারাপের কারণ জানতে চাইলো। কিন্তু কুমু তার বাবাকেও কিছু বলে না। প্রতিদিনের মতো সেদিনও কুমু মাঠে গেলো। মাঠে গিয়ে চুপচাপ গাছের নিচে বসে ছিলো। তার বাবা তখন তাকে দেখছিলো সে ঘুড়ি উড়ানো দেখছে। তারপর বাবা তার পাশে গিয়ে বসলো। তাকে জিজ্ঞেস করলো,”মা,তুমি ঘুড়ি উড়াতে পার?” কুমু বলল,”না,বাবা। আমি উড়াতে পারি না।আমার তো কোনো ঘুড়ি নেই।” তখন তার বাবা বলল,”এজন্য কী আমার মেয়ের মন খারাপ?” কুমু বলল,”হ্যাঁ।”তার বাবা হেসে বলল,”ধুর পাগলি! এজন্য কেউ মন খারাপ করে? আমাকে বললেই তো আমি নিয়ে আসতাম।” তারপর তার বাবা সঙ্গে সঙ্গে কুমুকে বাজারে নিয়ে কুমুর পছন্দের ঘুড়ি ও লাটাই কিনে দিল। কুমু তো ঘুড়ি ও লাটাই পেয়ে খুব খুশি। খুশি মনে বাবার সাথে লক্ষ্মী মেয়ের মতো বাড়ি ফিরে এলো।দুপুরের খাবার খেয়েই বাবাকে নিয়ে কুমু ছুটল মাঠে।কুমু তার বাবার কাছ থেকে ঘুড়ি উড়ানোর কৌশল শিখতে লাগল। অনেক তাড়াতাড়িই কুমু ঘুড়ি উড়ানো শিখে ফেলল।
অন্যদিকে কুমুর দাদীর এসব ঘুড়ি উড়ানো ছেলেদের খেলা পছন্দ না। তার দাদী তাকে বলল, “তুমি মেয়ে, মেয়ে হয়ে এত দস্যিপনা ভালো না। তুমি আজকে এ ঘুড়ি রেখে দিবে। ঘুড়ি উড়ানো ছেলেদের খেলা, তোমার খেলা না।” কুমুর তার দাদীর কথা শুনে খুব মন খারাপ করল। সেদিন কুমু আর মাঠে গেল না। ছাদের এক কোণায় বসে ছিল মন খারাপ করে। কুমু তার বাবাকে ফোন করে বলল,”বাবা, আমি মেয়ে হয়েছি বলে কি আমি ঘুড়ি উড়াতে পারব না?” তার বাবা বলল,”কে বলল মা, পারবে না? পারবে, তুমিও ঘুড়ি উড়াতে পারবে।” কুমু বলল,”বাবা,তাহলে যে দাদী বলল।” তার বাবা বলল,”তোমার দাদী একটু বয়স্ক তো, এসব কথা এমনেই বলেছে। তুমি মন খারাপ করে থেকো না। কাল থেকে তুমিও মাঠে ঘুড়ি উড়াতে যেও। কেউ কিছু বলবে না। আমি সবাইকে বলে দিব।” কুমু তো বাবার কথা শুনে ভীষণ খুশি। আবার সে ঘুড়ি উড়াতে পারবে।
কুমুর বাবার বারণে ঘুড়ি উড়ানো নিয়ে কেউ কুমুকে কিছু বলে নি। কুমুও খুশি মনে প্রতিদিন ঘুড়ি উড়াতো। ঘুড়ি উড়ানোর মাঝে কুমু খুব আনন্দে থাকতো। কুমুর সাথে ঘুড়িটার এক বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠলো। কুমু ঘুড়িটার খুব যত্ন করতো। কুমুর ঘুড়ি উড়ানোর শখ দেখে তার বাবা তাকে প্রতি বছর নিয়ে আসত পুরান ঢাকার ঘুড়ি উৎসবে। কুমুর ঘুড়ি উৎসব খুব পছন্দের ছিলো।
এভাবে কুমু ধীরে ধীরে শৈশব পার করল। তারপরেও ঘুড়ি উড়ানো সে ছাড়তে পারল না। ঘুড়ির সাথে যেন কুমুর এক দৃঢ় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ছোটবেলার খেলার সাথী। ছোটবেলা থেকেই ঘুড়ি উড়ানোর মধ্যে কুমু খুব খুশি থাকতো। এখন পড়াশোনার জন্য কুমু আর কুমুর মা তার বাবার সাথে শহরে থাকে। এখানে ঘুড়ি উড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এজন্য গ্রামে গেলে কুমু ঘুড়ি উড়াবেই। তার বাবা তার এ পাগলামি দেখে বলে,”মেয়েটা আমার আর বড় হবে না।”