নয়ন মাহমুদ
কবি ও কথাসাহিত্যিক
নয়ন মাহমুদ

চিরায়ত প্রথার বাইরে কোভিড নাইন্টিন

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে বুদ্ধদেব বসুর আত্মজীবনী পাঠের কৃপায়। আর যেদিন সৈয়দ শামসুল হক লোকান্তরিত হন, সেদিন ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়া আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত ঘটে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আমার বরাতে জোটে নাই, তবু এ নিয়া আমার ভিতর কোনো খেদ নাই, বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নাই। কেননা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সবসময়ের জন্যই প্রশ্নবিদ্ধ, আর আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী, ইত্যাকার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে আস্থা রাখি। কে জানতো, পুনরায় চোখাচোখি হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে? শাহবাগ আমার ফুফার কর্মক্ষেত্র এবং সেখানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ফুফার পুরা শরীর ঝলসে যাওয়ায় ফুফুকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসার বদৌলতে এবং পুনরায় দ্বিতীয়বার দেখা মেলে পাক্কা ভার্সিটি পরীক্ষা দেয়ার তিন, সাড়ে তিন, কিংবা পৌনে তিন, অথবা চার বছর পর, যে প্রাঙ্গনে হুমায়ুন আজাদ, আহমদ শরীফ, শামসুর রাহমান, আহমদ ছফা, শহীদুল জহির, মুনীর চৌধুরী এবং আরও আরও অসংখ্য প্রিয় মানুষদের আখড়া, সেই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সশ্রদ্ধভাবে হাঁটি এবং ফুফুকে ঢাকায় রেখে বগুড়ায় ফিরে আসার ব্যপারে বদ্ধপরিকর, কেননা কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অধীন ছয় মাস মেয়াদি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আমি একজন শিক্ষার্থী। শিক্ষার বাণিজ্যিকরণে কি বালছাল শেখায় সেসব ব্যাপারে সচেতন অনেক মানুষই অবগত। কাজেই কথা না বাড়িয়ে বলাই যাক, ফুফার এই ক্রান্তিলগ্নে সেখানে অবস্থান না করে কেন ফিরে আসা? কারণ প্রধানত দুইটি। এক. হাসপাতালের পরিবেশ অন্য সকলের মতো আমার কাছেও খুবই বিঁদঘুটে ঠেকে। দুই. আমি তাবেয়াকে ভালোবাসি।

কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমি নামমাত্র শিক্ষার্থী। মূলত প্রশিক্ষকের কাজটাই আমায় করতে হয়, কেননা অনেকের কম্পিউটারের প্রাথমিক ধারণাটাই হয়তো নাই। সেখানকার প্রশিক্ষকরা ১৫ মিনিটের লেকচার দিয়ে ফুরুৎ। প্রবলেম হলে প্রশ্ন করবার সুযোগ যদিও থাকে কিন্তু কেউ সে সুযোগ লুফে নেয়ার সাহস দ্যাখায় না। কাজেই চারপাশের অধিকাংশ জনতা আমাকেই তালাশ কিংবা তলব করে। অনেকেই তুই সম্বোধনও করে। ও দানিয়েল ভাই, বাংলা টাইপটা একটু বুঝায় দ্যান। কম্পিউটার অন হচ্ছে না ক্যান রে। এক্সেলে সমষ্টি নির্ণয়ের ফর্মুলাটা জানি কি, ইত্যাকার বহুবিধ সমস্যার সমাধান করে দিতে দিতে একদিন হঠাৎ তাবেয়া বলে, ভাইয়া যুক্তবর্ণটা একটু বুঝায় দ্যানতো। আমি যেন সেদিন পুণ্ণিমা চাঁন হাতে পেলাম। এতদিন অমাবস্যায় ঢাকা ছিল সেই চাঁদ। প্রথম দর্শনেই প্রেমের মহত্তর উপলব্ধিতে স্ব-মহিমায় নিমজ্জিত হয়ে নারী শরীরের সুবাসিত ঘ্রাণে হলাম আত্মহারা, কিন্তু সংযত। এরপর থেকে স্বেচ্ছায় অযাচিতভাবে তাবেয়ার সান্নিধ্যে থাকার চেষ্টা করি। তাবেয়ার হৃষ্টপুষ্ট শরীর। ওর অমায়িক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ। তাবেয়া জানায় সে বাংলা বিষয়ে পড়ছে এবং সে আমার থেকে এক বছরের জুনিয়র। এমনিতেই সাহিত্যের প্রতি আমার আলাদা মোহ, ভালোবাসা। তার ওপর এত চমৎকার একটা মেয়ে। উফফ। কি এক প্রগাঢ় অনুভূতি আমায় ছেয়ে রাখে, সেটি কেবল ভুক্তভোগী-ই জানে এবং সেই অনুভূতি হয়তো গানে, কবিতায় প্রকাশ করা সম্ভব।


২.


ঢাকা থেকে বগুড়া আসার পথে কাকতালীয়ভাবে বাসে পাওয়া অচেনা সহযাত্রী আমার সঙ্গে দেদারসে গপ্প জুড়ে দ্যায়, প্রসঙ্গ বলাবাহুল্য ঐ লোকের বহুগামিতার বয়ান, মূলত দশম শ্রেণিতে পড়া ঘরে বৌ, আর বাইরে বিভিন্ন বয়সী প্রেমিকা, পতিতা : ইত্যাকার অতীতের বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত নারী সংসর্গের অভিজ্ঞতার বরাতে, সে নিজেকে এমনভাবে জাহির করে যেন সে মেয়েদের গাইনি চিকিৎসক অর্থাৎ কিনা মেয়েদের যোনি, পাছা কিংবা স্তন বিশেষজ্ঞ, যদিও সে মার্কেটিং সেক্টরে কর্মরত। হঠাৎ কথার খেই হারায় ফেলে ঐ লোক, অথবা কথা সমাচারে আমাদের ব্যাঘাত ঘটায়, যখন পার্শ্ববর্তী এক সিটে বসা যাত্রী হাগামোতার চাপ সামলাতে না পেরে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে অবগত করানোর ব্যপারে নিজের ভেতর সমস্ত দ্বিধা, সংকোচ জলাঞ্জলি দ্যায় এবং হেল্পার বলে, চাপ সামলায় রাখেন মিয়া, হাতে পায়ে শুধু লাম্বায় হইছেন, কমন সেন্স তো জন্মায় নাই। থতমত খেয়ে প্রত্যুত্তরে সে বলে, এগুলা প্রকৃতির ডাক কি বলে কয়ে আসে। তখন হেল্পার হাঁক দ্যায়, আরে ও ড্রাইভার সামনের কোনো তেলের পাম্পে বাস থামা, শালার এক মফিজ যাত্রী হাগামোতার কবলে পড়ছে। বাসের অনেকেই ঘুমে ঢুলুঢুলু, ক্লান্ত। কেউ বা কেউ কখনো সখনো বমিতে পুরা কাহেল দশায় উপনীত। সবিশেষ ছয়, সাত অথবা আট ঘন্টার জার্নি শেষে ফকফকা ভোরে অতিক্রান্ত ফজরের আজানে বগুড়া শহরে এসে নেমে পড়ি। ওঁ শান্তি।

লোকমুখে প্রচলিত বুলি যেমন, বাংলা সাহিত্যে কাকের চেয়েও কবি বেশি, ঠিক তেমন ঢাকা শহরে যে লোকের সঙ্গে ধাক্কা খেলেন সেই ব্যক্তিও নাকি বি.বি.এ এবং এম.বি.এ পাস। চিন্তা করেন কি পরিমাণ সস্তা ম্যানেজমেন্ট সাবজেক্টে অনার্স পড়ছি বগুড়ার লোকাল এক সরকারী কলেজে। সে প্রসঙ্গ থাক। যদি কেউ আহমদ ছফার ‘অলাতচক্র’ পড়ে থাকেন তবে দানিয়েল চরিত্রের সঙ্গে আপনাদের হয়তো পরিচয় গড়ে ওঠার কথা। সেই দানিয়েলের সঙ্গে আমার অধিকাংশ মিল, যেমন- একরোখা, অপরিচ্ছন্ন, অপরিপাটি, গোঁয়ার স্বভাব। তবু মাঝে মাঝে নিয়ম ভাঙতে হয়। ঢাকা থেকে ফিরে নিয়ম বিরুদ্ধ ক্লিন শেভ আর চুল ছেঁটে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করি, যেখানে আমি অন্যান্যদের মতো বয়সের ভারে নুব্জ নই, বরং বয়সের তুলনায় শারীরিকভাবে একেবারেই কমবয়সী, সুস্থ, স্লিম চেহারার অধিকারী। নাকি দাড়ি গোফ কাটলে প্রত্যেককেই এমন লাগে? মনের মধ্যে প্রাণবন্ত সতেজ নির্মল আনন্দ, কেননা পাক্কা সপ্তাহ খানেক পর তাবেয়ার দেখা পাওয়া যাবে, কিন্তু চারপাশে বৃষ্টি যেন রবীন্দ্র বন্দনায় মগ্ন, তবু যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে উপস্থিত হই। বহু আকাঙঙ্খিত তাবেয়াকে পুনরায় যখন দরজা খুলে ক্লাসে অনুঃপ্রবেশ করতে দেখি, তখন মহাবিশ্বে পরিভ্রমণকারী আমি যেন পাই এক নতুন নক্ষত্রের সন্ধান, অতঃপর ক্লাস শেষে কুশলাদি জিজ্ঞেস করে পরস্পর মানসিক ভাব বিনিময় করি এবং সে জানায়, জীবনানন্দের ‘কবিতার কথা’ বইটা নিয়ে আসছিলাম দুই দিন, কিন্তু আপনি লাপাত্তা, যাক আজ বইটা নিয়া আসছি, বইটা কি নেবেন?

আমি বলি, আলবাত।


৩.


তাবেয়া আমার পাহাড়সম পরিমাণ হৃদয়ে নীরবে ঘুমায়, জেগে ওঠে চন্দ্রিমায় স্বপ্নহীন মেঘমালা এবং স্বয়ং ঈশ্বর যেন দুজনার আঙুলে আঙুল ঠেকে দ্যায়। ক্ষণিক স্পর্শের অনাবিল সুখে হার্দিক নৃত্যে কেটে যায় গ্রীষ্ম, বর্ষা। ফুটে ওঠে পারস্পরিক ভালোবাসা, একই ছাতার নিচে দুজনের হেঁটে বেড়াবার স্মৃতি বগুড়ার রাস্তায়, পাশাপাশি, গা ঘেসে। এক সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে উপলব্ধি করি তাবেয়ার হৃদয় ঝুলে আছে আমার শার্টের তলায় বুকের গহীনে, চিরায়ত প্রথার বাইরে COVID-19 তাকে আমার থেকে আলাদা করে দ্যায়, কী এক পাথরের মতো কঠিন, নিষ্ঠুর, নিয়তি। শেষবার সে আমায় অতিক্রম করে যাওয়ামাত্র এক পার্থিব অন্ধকার আমার সমগ্র শরীর ছেয়ে নেয়। আঙুলের স্পর্শের ঠুনকো মুহূর্ত আমায় গভীর বিষাদে ফেলে দ্যায়। ফলশ্রুতিতে আমি এক গভীর সত্যে উপনীত হই যেখানে, একমাত্র ভালোবাসাই সব। অপ্রতিহত, অপ্রতিরোধ্য। সমগ্র শরীর এবং আত্মায় যা ধারণ করা যায় না।

নির্জনতায় ঈশ্বর চেপে বসে চিন্তায়। বিশেষত গোধূলি অতিক্রান্ত রাতের অন্ধকারে আমার শরীর হয়ে ওঠে গীর্জা। রাস্তায় ধর্মযাজকের সঙ্গে কথাসমাচার। মেয়েদের স্তন বালকের বুকের আকার নেবে, কারণ কলঙ্কিত খোঁয়াড়ে আমার বন্ধুরা গিয়েছিল। কিংবা আত্মীয় স্বজনরা অতীব ভাগ্যবান, কারণ শরীরের ভাষা শিখে তারা হৃদয় নিয়ে গর্বিত ছিল। অথচ মেয়েরাও গর্বিত হতে পারতো, যদি কোনো কিছুর বিনিময়ে বিকিয়ে না দিতো নিজেদের সতীত্ব। শরীরের চত্ত্বরে মায়ের সমাধির কথা মনে আসে। কিন্তু আমি চেষ্টা করি শূন্য বিছানায় নিজের একাকীত্ব ভুলে যেতে। তবু অনস্তিত্ব ভাবনা অন্ধকার করোটিতে হাঁটে, একা। তখন হঠাৎ মৃত নগরীর মতো ঘুমের অতল গহ্বরে ডুবে গিয়ে বেঁচে যাই। কিংকর্তব্যবিমুঢ় চিন্তার করালগ্রাসী ছোবল ফণা তোলে। মধ্যরাতের স্বপ্নে মৃত মানুষ জীবিত রূপে আসে। জীবিত মানুষ শোকাবহ অবস্থায় ফেলে চলে যায়। নীলিমায় মায়ের মৃত্যুর শোকের ব্যানার। মানুষ কফিন ফেলে ছুটে পালায়। ঘুপচি গলির ভেতর আসে যুদ্ধের ঘোড়া COVID-19। যেন কোথাও কোনো ভবিষ্যত নেই, কেবল বর্তমানের আগে বিগত শৈশব বারান্দায় স্থবির। COVID-19 যেন এক বন্য শুয়োর যে কিনা মানব ইতিহাসের রাস্তা পেরিয়ে আসে। তখন ঘুমের গহ্বরে অনাগত আত্মা গায়, সবকিছুর ভেতর ঈশ্বরের মহিমা।


চাঁদকুটি সরকার পাড়া
১৭ মে, ২০২০


 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu