মনজুরুল ইসলামের গল্প
ঢাকা থেকে ফিরেছেন শফিক। সিলেকশন গ্রেড পাননি বলে মন খারাপ। কোনো এক মনীষীর বাণীতে পড়েছেন, মন খারাপ থাকলে ব্যস্ত থাকতে হয়, ব্যস্ততা বাড়লে দুঃখ হারিয়ে যায়। এমন ভাবনায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন আপাতত। তবে সত্যিই কি দুঃখ হারিয়ে যায়? নিমগ্ন চিত্তে ভাবছেন সফিক। না, হারায় না। একটু হলেও কষ্ট দেয় ও। এটিই ওর সাফল্য। নইলে তো ওর অস্তিত্ব থাকে না। তাছাড়া দুঃখও তো জীবনের একটি অংশ। একে ত্যাগ করতে চাইলে ও অভিমান করে। ফিরে আসে বারবার। অভিজ্ঞতা দিয়ে উপলব্ধি করেছেন সফিক। দুঃখের সাথে বাস করা শিখলেই না কেবল জীবন মহৎ হয়। একই সাথে সুখকেও উপভোগ করা যায়। দুঃখের কারণগুলি বারবার বিশ্লেষণ করেছেন সফিক। আর কাজ করেছেন দুরন্ত গতিতে। এই মুহূর্তে অনেকটাই স্বাভাবিক। সহকর্মীদের নিমন্ত্রণ গ্রহণই তার জ¦লজ্যান্ত উদাহরণ। একই দিনে তিনজনের বাসায় নিমন্ত্রণ। যদিও যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপারে ভেবেছেন অনেক। শেষ মুহূর্তে এসে সিদ্ধান্তে নিয়েছেন যাবার। আজ নিমন্ত্রণের দিন। আলমিরা থেকে বের করলেন কমলা রঙের কলারওয়ালা টি-শার্ট ও নীল রঙের জিন্সের প্যান্টটি। নিলেন কালো ক্যাপটিও। ইন করলেন। কেডস জোড়া পায়ে দিয়ে দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিলেন। অতঃপর মাকে বলে বাড়ী থেকে বেরুলেন।
গন্তব্য তেঁতুলিয়া। পঞ্চগড় থেকে তেত্রিশ কিলোমিটারের পথ। নিজ গ্রাম বিলাসপুর থেকে ত্রিশ। বাসে যেতে সময় লাগে পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিনিট। মোটর সাইকেল নিলেন না সফিক। মহাসড়কে মোটর সাইকেল চালাতে নিরপাদ বোধ করেন না তিনি। বাসের মধ্যে পায়ের উপর পা দিয়ে আয়েশ করে যাত্রা করা তার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। বাড়ী থেকে অটোতে করে আসলেন বিলাসপুর স্ট্যান্ডে। এখন বর্ষাকাল। তবুও নেই বৃষ্টির ছিঁটেফোটা। রোদের প্রখর উত্তাপ এসে যেন শরীরে আঘাত করছে সূচের মতো। প্রকৃতির এমন বিরুদ্ধাচরণ মানুষেরই সৃষ্টি। সেটি নিয়ে চিন্তার পরিধিকে আর বিস্তৃত করলেন না তিনি। অফিসব্যাগ থেকে বের করলেন গোলাপী-সাদা রঙের ছোট্ট ছাতাটি। উফ বাবা, বাঁচা গেল! ভাগ্যিস ছাতাটি এনেছিলাম। ছাতা মাথায় দিয়ে অনুভব করলেন এমন একটি বোধ। তার পাশেই দাঁড়িয়ে বেশ কিছু যাত্রী। এই মুহূর্তে বাসের দিকে না তাকিয়ে সবাই তাকালেন তার ছাতাটির দিকে। ক্ষুদ্রাকৃতির ছাতা। ইস! ছাতাটি আর একটু বড় হলে অন্তত একজনকে নেয়া যেত। অবলীলায় ভাবলেন সফিক। লোকগুলির কপাল থেকে দরদর করে ঝরছে ঘাম। দেখলেন সফিক। ঘাড়ের গামছা ও লুঙ্গি দিয়ে ঘাম মুছবার দৃশ্যটিও তার দৃষ্টির আড়ালে রইলো না। কি করবেন তিনি? জিনিসপত্রের যে দাম তাতে এমন ছোট ছাতা না কিনে উপায় আছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবতে থাকলেন সফিক।
এই ভাবনার মাঝেই চলে এলো বাস। এবার আর কেউ কারো দিকে তাকালো না। ছুটতো থাকলো বাসের দিকে। বাসে বেশ কিছু সিট ফাঁকা। মূল বাস স্ট্যান্ডে সবসময়ই যাত্রী পূরণ হয় না। দৃশ্যটি দেখেই কপালের ভাজগুলি স্ফীত হলো সফিকের। অন্তত ত্রিশ মিনিট না হলে বাস পূর্ণ হবে না। আর পূর্ণ না হওয়া অবধি ছাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। অতীত অভিজ্ঞতা হাতড়ে নিশ্চিত হলেন সফিক। উপায় না দেখে পছন্দের সিটের জন্য বাসের ভেতর প্রবেশ করলেন। এ, বি, সি, ডি, ই গুনে গুনে ই নম্বর সিটটিতে বসলেন। যদিও বাসের সিটে লেখা নেই নম্বর। ই নম্বর সিটই তার পছন্দের। এবং অবশ্যই জানালার পাশে। কোনো কারণে এ্যাকসিডেন্ট হলে হাড়গোড় ভাঙলেও অন্তত বেঁচে থাকার একটা সম্ভাবনা থাকবে বলে তার বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই ই সিট নির্বাচনের কারণ। এ মুহূর্তে বাসের দুর্দশার কথা না ভেবে বসে পড়লেন সিটটিতে।
বাসের সিটে বসেছে সবাই। সিটে বসেই তাকিয়ে আছে লিকলিকে শুকনো শরীর, গায়ে বিবর্ণ হয়ে আসা টি-শার্ট ও প্যান্ট পরিহিত হেলপার কাম সুপারভাইজারের দিকে। পোশাকগুলি যে কতদিনের পুরোনো তা অনুমান করা যাচ্ছে না। তেঁতুলিয়া, তেঁতুলিয়া বলে যতটা সম্ভব উচ্চ স্বরে চেচিয়ে যাচ্ছে অনবরত। ড্রাইভারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে যাত্রীদের মাঝে লক্ষ করা যাচ্ছে বিরক্তির ভাব। বিশেষত এই রুটে যারা নতুন তাদের মাঝে। কেউ যে কিছু বলবে তাও বলছে না। উত্তরাঞ্চলে মফস্বলে অন্ত্যজ শ্রেণীর যাত্রীদের এই এক দূরবস্থা। বাসে, ট্রেনে নৌকাসহ সবখানেই। টাকা দিয়ে টিকেট কেটেও চুপচাপ থাকে এরা। প্রতিবাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করে না। হেলপারের মতোই শীর্ণদেহী মধ্যবয়সী ড্রাইভার অবশেষে উঠলো গাড়ীতে। পেছনের বেশ কিছু সিট খালি রয়েছে এখনো। তাকিয়ে দেখলেন সফিক। অতঃপর তাকালেন সামন ও পেছনের যাত্রীদের দিকে। কয়েকজনের মুখে দেখতে পেলেন কিছুটা স্বস্তির প্রলেপ। কোনো লাভ নেই। আরো কমপক্ষে পনের মিনিট। সিট ভর্তি না হওয়া পর্যন্ত বাস ছাড়বে না। বিড় বিড় করে উচ্চারণ করলেন সফিক।
বন্তুত সেটিই ঘটলো। বিষণ্নতায় ভরা মুখগুলি দেখে হাসি পেলেও প্রকৃত অর্থে হতাশা অনুভব করলেন তিনি। মফস্বলের সাধারণ মানুষের সাথে আর কতদিন ধরে চলবে এই প্রবঞ্চনা! একটা শাটল ট্রেনই এর সমাধান। সেটি হলে বাংলাবান্দা রুটে ভারতের সাথে ট্রেন চলাচলের সম্ভাবনাটিও সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি সোনাহাট, বুড়িমারি, হিলি রুটে ভারতের সাথে ট্রেন যোগাযোগ চালু হলে উত্তরের উন্নয়ন যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে হিসেব কষতে শুরু করলেন সফিক। আপনাআপনিই চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো শিলিগুড়ি, দিল্লী, আসাম, মেঘালয় এবং কলকতা মহানগরের চিত্র। মনে পড়তে থাকলো কলেজে পড়বার সময় এসব রুটে ট্রেনের দাবীতে আন্দোলনের কথা। দুর্ভাগ্য! এখনো সে সম্ভাবনাই সৃষ্টি হয় নি। আক্ষেপে অনুশোচিত হলেন সফিক। কিন্তু বেশী সময় ধরে অনুশোচিত হতে হলো না তাকে। পেছন থেকে একটি বাস এসে অনবরত হর্ণ বাজিয়ে তাড়া করলো। এবার পাইলটের মতো মনোভঙ্গি লক্ষিত হলো ্ড্রাইভারের মাঝে, যেন সে অপেক্ষা করছিল পরবর্তী বাসের তাড়া খাবার অপেক্ষায়। তাড়া না খেলে ড্রাইভারের স্পিড যে বাড়ে না এই প্রথম দেখলো নতুন যাত্রীরা। দ্রুত স্টার্ট হলো বাস। বিমানের গতিতে যেন এগিয়ে চললো মহাসড়ক ধরে। প্রতিটি জানালা দিয়ে হু হু করে আসতে থাকলো বাতাস। যাত্রীরাও অনুভব করলো প্রশান্তি।
প্রশান্তি প্রাপ্তির অভিপ্রায়ে পায়ের জুতো খুললেন সফিক। মুজোজোড়া ভাজ করে রাখলেন জুতোর ভেতরেই। ডান পাটি বাঁ পায়ের ওপর দিয়ে বসলেন আরাম করে। বিরক্তি নিয়ে খুললেন ময়লাযুক্ত জানালাটি। বাম হাতের কনুইটি জানালার ফ্রেমে রেখে হাতটি বাম গালে চেপে দেখতে থাকলেন সারিবদ্ধভাবে সাজানো চায়ের বাগানগুলি। নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর অন্তর আকাশের মতো উচ্চতা বিশিষ্ট নারকেল বৃক্ষগুলিও তার চোখের পাতায় এনে দিলো প্রফুল্ল ভাব। শুরুতে দ্রুত গতিতে গাড়ীর চাকা ঘুরলেও এই মুহূর্তে ধীরে চলেছে বাস। চকচকে মসৃণ মহাসড়ক দ্রুত গাড়ী চালাবার আহ্বান জানালেও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না ড্রাইভার। বরাবরই তাই করে। যত ধীরে গাড়ী চলবে ততই যাত্রী জড়ো হতে থাকবো সামনের স্টপেজে। আর পকেট ভরবে ওদের। এই সূত্র কঠোরভাবে মেনে চলে ড্রাইভার, হেলপার এবং সুপারভাইজার। শেষে সময় কভার করতে দ্রুত চালায় গাড়ী। অথচ এই বাসে এত নিয়ন্ত্রণহীন গতিতে গাড়ী চালালে যে নিজের মরণ হতে পারে সেটিও ভাবে না বিন্দুমাত্র। কম বেশী সব ড্রাইভারেরই একই দর্শন। বউ-বাচ্চার কথাও চিন্তা করে না এরাা। জীবনের অর্থ যেন এদের কাছে চায়ের পাতায় স্থিত বৃষ্টির ফোঁটার মতো ক্ষণস্থায়ী।
প্রকৃতি দেখতে দেখতে বিষয়টি ভাবলেন এবং প্রকৃতির দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকলেন সফিক। চাবাগান আর নারকেল গাছগুলি না থাকলে গরমে যে বিধ্বস্ত হতো যাত্রীরা সেটি ভেবেই প্রকৃতিকে ধন্যবাদ জানাবার আগেই চোখ দুটি বুজে এলো তার। বাম হাতটি আপনাআপনি জানালা ছেড়ে উরুর উপর এসে পড়লো। গোটানো পাদুটিও হয়ে গেল পৃথক। ছড়িয়ে পড়লো সামনের সিটের নিচে। চোখমুখের ভাব এখনও শাণিত হয়নি সফিকের। আবেগের বাহুল্য রয়েছে সামান্য। তবে সততা ও সরলতা আবৃত করেছে সেই বাহুল্যগত দুবর্লতাটিকে। মাত্র চার বছরে অর্জন করেছেন সাধারণ মানুষের আবেগবহুল ভালোবাসা। তাছাড়া সহজ সরল মানুষগুলির আবেগ একটু বেশীই থাকে। ফলতঃ ওদের পেটের বৃত্তেও বিরাজ করে না কোনো কূটবুদ্ধি। কাবলী পরিহিত পাশের যাত্রীরও চোখ বুজে এসেছে। স্থুল ফর্সা শরীর, চাঁপা ঘন দাঁড়ি আর কথার ভঙ্গি দেখে সহজেই বোঝা যাচ্ছে বিহারী। হয়ত পাথরের ব্যবসার জন্য তেঁতুলিয়া যাচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিহারীরও নাক ডাকতে শুরু করলো। বাসের পরিবেশে বিরাজ করা গুমোট ভাবটিও ইতোমধ্যে কেটে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে একটি প্রশান্ত আবহের। আর এ সুযোগেই আপাদমস্তক আবৃত ঝলমলে পোশাকের এক আগন্তুক এসে বসলেন সফিকের সিটের পাশে থাকা জানালায়। তাকিয়ে থাকলেন সফিকের মুখের দিকে।
‘কি সফিক সাহেব, নিমন্ত্রণ গ্রহণ কি ঠিক হচ্ছে?’ভরাট মুখে হাসির নাচন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আগন্তুক।
‘সিদ্ধান্ত নিলেও মনের মধ্যে একটি দ্বিধাই রয়ে গেছে। কিন্তু, না গেলে তো—।’ বলতে গিয়েই আটকে গেলেন সফিক।
‘কোনো কিন্তু নয়, আপনি যাবেন না, গেলে ভীষণ ক্ষতি হবে।’ গম্ভীর ভাবটি ফুটে উঠলো এবার আগন্তুকের মুখাবয়বে।
‘কিন্তু কেন বলুন তো? আর আপনার পরিচয়।’ অনুসন্ধিৎসু মনোভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সফিক।
‘স্বার্থ, বুঝলেন স্বার্থ। আর ধরুন, আমি আপনার পুরোনো বন্ধু। এক সময় আমাদের নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। সে যাই হোক, আজ তো আপনার তিন জায়গায় নিমন্ত্রণ রয়েছে তাই না?’
‘তাই তো। আমার সহকর্মী, উপজেলা চেয়ারম্যান আর আমার এক কন্ট্রাকটর বন্ধুর বাসায়। কিন্তু আপনি এ কথা জানলেন কীভাবে? আর সেঁধে সেঁধে আমাকে এ কথাগুলি বলছেনই বা কেন!’ আশ্চর্য হয়ে বললেন সফিক।
‘যেভাবেই জানি না কেন আমার কথাগুলো আগে মনোযোগ দিয়ে শুনুন আর যদি প্রশ্ন করি তাহলে উত্তর দিন। তাহলে বুঝতে পারবেন কেন নিমন্ত্রণ গ্রহণ ঠিক হবে না। আর এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকবেন, আমি আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে আসি নি। উপকারই করতে এসেছি।’
‘আচ্ছা, শুনছি বলুন।’ এক নিঃশ^াসে বলেই আগন্তুকের দিকে তাকালেন সফিক।
‘প্রথমত, আপনার সিনিয়র সহকর্মী খুব ভাল করেই জানেন আপনি কী পরিমাণ সৎ, মেধাবী এবং রুচিশীল। তাছাড়া বর্তমানে সৎ মানুষের কি সংকট তা তো আপনি জানেন। হয়ত শুরুতে উনিও সেরকমই ছিলেন তাই আপনার প্রতি দুর্বলতা অনেক বেশি। এখন তো মনে হয় উনি ঠিক বিপরীত?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক বিপরীত। তবে শুনেছি শুরুতে উনি অনেক সৎ ছিলেন। আসলে শুরুতে সবাই সৎ থাকবারই চেষ্টা করে কিন্তু আর্থিক দীনতাসহ নানা মহলের অনৈতিক চাপ আর অনৈতিক ব্যবস্থাপনা কাউকে সৎ থাকতে দেয় না।’
‘তাহলে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট, ওনার ঘরে যে কন্যা সন্তানটি রয়েছে প্রথমত তাকে দিয়ে আপনার মতো একজন সৎ অফিসারের সাথে সম্পর্ক গড়িয়ে তুলবার চেষ্টা করবেন। এতদিনে হয়ত তার ব্যবহারে আপনি কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছেন। দ্বিতীয়ত, ওনার কাজে আপনি যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেন সে রাস্তাটিও খুলে যাবে। আপনি কি পারবেন ওনার মতো একজন অসৎ ব্যক্তির কন্যার চাহিদা পূরণ করতে? বলুন?’ কিছুটা জোরের সাথে সফিক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন আগন্তুক।
‘আমি তো এত গভীরভাবে ভাবিনি।’ কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলতে থাকলেন সফিক। মাথার মধ্যে অনুভব করলেন শূন্যতা।
‘এখন থেকে একটু চিন্তার গভীরেই নামতে হবে সফিক সাহেব। মানুষের সাথে সহজেই ঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে না। পৃথিবী যতটা সরল হওয়া উচিত ছিল প্রকৃত অর্থে তা ততটা সরল নয়। আচ্ছা, এখন আসা যাক, আপনার কন্ট্রাকটর বন্ধুর কথায়। বন্ধুর সংজ্ঞা তো আপনার জানবার কথা। দু’একবছর এক ক্লাসে পড়লেই কি বন্ধু হওয়া যায়? তেতুঁলিয়ায় তো কলেজপড়ুয়া আরো অনেক বন্ধু রয়েছে আপনার, কই তাদের কেউ তো নিমন্ত্রণ করলো না? বুঝতে পারছেন কি? আপনার অফিসে আগমনের পথ চালু করাই তার এই নিমন্ত্রণের উদ্দেশ্য। স্বার্থ উদ্ধারের জন্যই আপনার ওই নেতা মাপের কন্ট্রাকটর বন্ধু মহানন্দার মাছ, দেশী মুরগী আর দই নিয়ে বসে আছেন আপনার অপেক্ষায়। একবার ফাঁদে পা ফেলেন, দেখবেন পরদিন থেকেই আপনার অফিসে এসে বসে থাকা শুরু করবে। আপনার নাম করে বিভিন্ন জায়গায় নিজের কর্তৃত্ব জাহির করবে? শার্লক হোমসের পাঠক হয়েও আপনি বুঝতে পারলেন না আপনার বন্ধুর উদ্দেশ্য। আপনি কি চান, এমনটি ঘটুক।’ প্রশান্ত চোখ দুটি দিয়ে সফিকের চোখ দুটির দিকে গভীরভাবে তাকালেন আগন্তুক। ভালো থাকুক সফিক, ধরে রাখুক তার সততা এটিই যেন প্রতিফলিত হচ্ছে আগন্তুকের দুটি চোখে।
কোনো কথা বলতে পারলেন না সফিক। চোখে মুখে দৃশ্যমান হলো বিনা মেঘে বজ্রপাতের ছায়া। শুধু তৃষ্ণাত্ব গলায় জানতে চাইলেন- ‘তাহলে উপজেলা চেয়ারম্যানের ব্যাপারটি?’
‘যত দূর মনে পড়ে, উপজেলা চেয়ারম্যান আপনাকে শুধু চায়ের দাওয়াতই দিয়েছিলেন?’ আবারো মুখে ভরাট হাসি সৃষ্টি করে প্রশ্ন করলেন আগন্তুক।
‘ঠিক তাই।’
‘কারণ, উনি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন আপনার দ্বারা কোনো অন্যায় সাধন সম্ভব নয়। এবং অসৎ বলেই আপনার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলবার চেষ্টা করছেন। যদি কখনো বিপদে পড়েন তাহলে আপনার পক্ষ থেকে তার উপর যেন এক ধরনের নমনীয়তা কাজ করে সেটিই এই বিশেষ নিমন্ত্রণের মূল উদ্দেশ্য। আপনি হয়ত চিন্তা করছেন, উনার অনেক ক্ষমতা। না গেলে আপনার ক্ষতি করতে পারেন। উদ্বেগের কিছু নেই, উনি আপনার কিছুই করতে পারবেন না। বড়জোর আপনার বদলীর সুপারিশ করতে পারবেন। তবে সে সম্ভাবনাও খুবই কম। মনে রাখবেন, কোনো মানুষ যখন সৎ হয় তখন একজন সর্বোচ্চ অসৎ মানুষও তাকে হৃদয়ের কোনো না প্রান্ত থেকে শ্রদ্ধা করে। কারণ পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের ভেতরেই সততার একটি অনুভূতি রয়ে যায়। যেটি তাকে তাড়িত করে সে কাজটি করতে।’
‘কিন্তু, আমি তো অত বড় অফিসার না।’ আশঙ্কা নিয়ে বললেন সফিক!
‘হতে কতক্ষণ। চাকরি তো কেবল শুরু। আপনার পদোন্নতি হবে, ঢাকায় পোস্টিং পাবেন। আর মনে রাখবেন, ‘এ্যা গুড লেবার নেভার গোজ আনরিএ্যাওয়ার্ড।’ ভালো শ্রমিককে পুরস্কৃত করাই আমাদের কর্তব্য।’এবার আগন্তুকের চোখ ও মুখ থেকে ফুলের মতো হাসি ঝরে পড়লো। মসৃণ সাদা দাতগুলি চিকচিক করতে থাকলো মমতার প্রলেপ। তারা যে ভালো মানুষগুলিকে সত্যিকার অর্থেই পুরস্কৃত করতে চান সেটিরই প্রতিচ্ছবি যেন দেখা গেল তার মুখাবয়বে।
‘না, না, ঢাকায় পোস্টিংয়ের দরকার নেই।’ মুহূর্তেই গত হওয়া ঢাকার দুঃসহ প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠলো সফিকের মনোজগতে। সিলেকশন গ্রেডের জন্য এক সপ্তাহ ধরে সহ্য করা অসহ্য যন্ত্রণাগুলো যেন তার সামনে এসে চিত্রিত হলো।
‘আমি এখানেই বেশ আছি। সবসময়েই মনে হয়, প্রকৃতির পাতার মধ্যভাগে শুয়ে আছি আমি। প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারছি। একটু হলেও তো সহজ সরল বঞ্চিত মানুষগুলির উপকারে আসতে পারছি। আপনি থাকুন না আমার সাথে, খুব ভালো লাগবে, মজা করে গল্প করা যাবে।’ আবারো শিশুর মতো করে বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন সফিক।
‘এজন্যই তো আপনাদের মতো লোকগুলির ঢাকায় পোস্টিং দরকার। সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তারা যখন ঢাকায় কাজ করবেন তখনই তো উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। একই সাথে প্রণীত হবে যুগোপযোগী নীতি। আর অসৎ ও অদক্ষ কর্মকর্তায় ভরে গেলে শুধু পাবলিকের ভোগান্তিই বাড়বে। ’কথাটি এত উচ্চস্বরে বললেন আগন্তুক যেন হাতুড়ি পেটানোর শব্দ এসে কানে প্রবেশ করলো সফিকের।
‘আপনার মাঝে যে সংকীর্ণতাগুলি কাজ করছে সময়ের সাথে সাথে সেগুলি আপনাআপনিই কেটে যাবে। চিন্তা করবেন না। যে নৈতিক সম্পদ আপনার মাঝে রয়েছে সেটিকে যে কোনো মূল্যে ধরে রাখতে হবে। আর মানুষকে না বলা শিখতে হবে। যে বিষয়টি আপনার কাছে অনৈতিক মনে হবে স্রেফ বিনয়ের সাথে দুঃখিত বলে চুপ করে থাকবেন। চেষ্টা করবেন বোঝানোর এবং আপনি কেমন সেটিও বোঝাতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু কোনোভাবেই সৎ বলে অহংকার করবেন না। অহংকারের পাশাপাশি যদি একগুয়েমি ভাব দেখান তাহলে জনতার পিটুনির একটিও মাটিতে পড়বে না।’বোঝাতে পারলাম কি সফিক সাহেব? অনবরত বলে গেলেন আগন্তক।
‘আপনার প্রকৃত পরিচয়টা কিন্তু এখনো জানতে পারলাম না?’
‘ধরুন, সৃষ্টিকতার প্রতিনিধি আমি। আর আপনি কেন? পৃথিবীতে কে কি করেন সবই আমাদের নখদর্পণে। আপনি মানুষকে ভালোবাসেন, দেশকে ভালোবাসেন তাই আমরাও আপনাকে ভালোবাসি। আপনি ভাল থাকুন এটিই আমাদের চাওয়া।’
‘কিন্তু পৃথিবী কিংবা পৃথিবীর মানুষগুলি এত জটিল কেন বলুন দেখি?’ উত্তরের প্রত্যাশায় আগন্তুকের দিকে তাকাতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন সফিক। দেখতে পেলেন সামনের সিটের এক যাত্রী বয়ে দিচ্ছে বমির বন্যা। নিজেকে কোনোরকমে রক্ষা করলেন সফিক বাতাসে মধ্যে দিয়ে ছুটে আসা বমির ছিটেফোঁটা থেকে। এত অল্প দূরত্বেই যদি পেটের এই অবস্থা হয় তাহলে দীর্ঘ দূরত্বে কি হবে রে বাবা। মনে মনে ভাবতেই শিউরে উঠলেন তিনি। অবচেতনে দেখা আগন্তুকের সাথে ভারী কথোপকথনে ঘেমে গেছে তার শরীর। কপালে জমে গেছে মৃদু ঘাম। অত্যধিক গরম বোধ করায় আলগা করলেন টি-শার্টের বোতাম। বাতাস প্রবেশ করতে থাকলো বুকের ভেতর। রাস্তায় দৃষ্টি প্রক্ষেপ করে বুঝতে পারলেন চলে এসেছেন গন্তব্যের কাছাকাছি। সামনেই একটি স্টপেজ আছে। এখানেই নামবেন। আগন্তুকের কথাগুলি গভীর প্রভাব ফেলেছে তার মনোজগতে। যাই হোক না কেন নিমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন না– স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। পকেট থেকে বের করলেন নকিয়া-৩৩০০ মডেলের মুঠোফোনটি। প্রায় সাত বছর ধরেই ব্যবহার করছেন ফোনটি। পুরোনো হলেও যত্ন করেন প্রচুর। বডিতে যাতে ময়লা না লাগে সেজন্য ছ’মাস পরপর পরিবর্তন করেন কভার। এখনো চকচক করছে বাটনগুলি। স্বল্প আয়ের সৎ মানুষদের এভাবে যত্ন না করলে চলেও না। তারা তো আর ইচ্ছে করলেই অন্যদের মতো দামী মোবাইল কিনতে পারেন না। চকচকে সোনালী রঙের বাটনগুলি টিপে অনায়াসেই একটি মেসেজ লিখলেন। তিনজনকে পাঠিয়েই সুইচড অফ রাখলেন। এবার হেল্পারের কণ্ঠে বটতলা, বটতলা বাজার শুনতেই মুঠোফোনটি বন্ধ করে আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
‘স্যার, তোমারা না তেঁতুলিয়া যাইবেন?’ সরল কণ্ঠে বললো হেল্পার।
হেল্পারের কথা শুনেই তার সরল মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন সফিক। মিষ্টি স্বরে ‘না’ বলতেই হাতে থাকা টাকার গোছা থেকে হেল্পার দশ টাকা ফেরত দিলো সফিককে।
‘টাকাটা তুইই রাখ।’ কথাটি বলবার সাথে সাথে হেল্পারের মুখে যে প্রাণখোলা হাসির প্রভা দেখতে পেলেন সফিক তা সত্যিই অভাবনীয়। অপলক তাকিয়ে সেই হাসিটি উপভোগ করলেন সফিক। বুকের ভেতর তৃপ্ততার এক শীতল অনুভূতিকে সঞ্চয় করে বাস থেকে নেমে পড়লেন। একই সাথে নিম্ন্ত্রণ গ্রহণ না করবার সিদ্ধান্তেও পুরো শরীরজুড়ে অনুভব করলেন ঝরঝরে ভাব। রাস্তায় দাঁড়িয়েই দেখতে থাকলেন সামান্য দূরত্বে অবস্থিত বটতলা বাজার। ক্ষুধায় আসমানে উঠেছে তার পেট। আলুভর্তা ডাল হলেও সঠিক সময়ে খাওয়ার অভ্যেস সফিকের। এ কারণেই পেটের অবস্থা অনেক ভালো তার। দীর্ঘ যাত্রা করলেও বমি করেন না। গ্যাস্ট্রিক, আলসার, বুক জ¦ালা এসবের কিছুই নেই। বাজারের হোটেলেই কিছু খেয়ে নিয়েই আবার ফিরবেন বাড়ীতে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই হাঁটতে থাকলেন বাজারের দিকে।
কাঁচা রাস্তার দু’ধার জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষগুলি যেন সৃষ্টি করেছে ছায়ার প্রাচীর। এই ভরা দুপুরেও সূর্যের প্রখর রৌদ্রালোক প্রবেশ করতে ব্যর্থ হচ্ছে রাস্তার মাঝখানে। এমন পরিবেশে ছাতা খুলে হাঁটলে নিশ্চিত পাগল বলবে সাধারণ মানুষ–উপলব্ধি করলেন সফিক। আশপাশ দেখেই গোলাপী-সাদা রঙের ছোট্ট ছাতাটি বন্ধ করে রাখলেন অফিসব্যাগে। হাঁটতে থাকলেন আর দু’চোখ মেলে তাকালেন গ্রামের চারদিক। বৃক্ষের গায়ে গ্রাম্য মহিলাদের কাঁচা গোবর লাগানোর দৃশ্য, মধ্যবয়সী পুরুষের বাসার সামনেই টিউবওয়েলে গোসলের দৃশ্য, ছোট্ট পুকুরে উদোম হয়ে বাচ্চাদের গোসলের দৃশ্য-একটিও তার দৃষ্টির আড়ালে রইলো না। গ্রামের এমন প্রকৃত দৃশ্য উপভোগ করলেও মেজাজ খারাপ হয়ে এলো সফিকের যখন চোখে পড়লো হাটের প্রবেশপথেই ক্যারাম খেলায় ব্যস্ত বলিষ্ঠ তরুণদের। হঠাৎ করেই তাকে দেখে যখন আড়ষ্ঠ হলো তরুণরা তখন জুয়ো খেলার বিষয়ে নিশ্চিত হলেন সফিক। গ্রামের এই তরুণরা নিয়মিত জুয়ো খেলে আর হেরে গিয়ে বউদের পেটায়। অনেক কষ্ট করে নিজ গ্রাম বিলাসপুরে বন্ধ করেছেন সফিক ক্যারাম খেলার প্রথাটি। আহত দৃষ্টিতে তরুণদের দিকে একবার তাকিয়ে ঘুরে দেখতে থাকলেন বটতলা বাজারটি। লবন তেল থেকে শুরু করে শার্ট প্যান্টও যে পাওয়া যাবে এই বাজারে ভাবতে পারেন নি তিনি। প্রবল আগ্রহ নিয়ে এবার এগুতে থাকলেন লাগোয়া তিনটি রেস্টুরেন্টের কাছে। তরকারির উপর ভেসে থাকা তেল আর ভাতের উপর ভনভন করতে থাকা মাছি দেখে একটিতেও প্রবেশের সাহস পেলেন না। বিস্কুট আর কলা খেয়েই বাড়ীতে ফিরবেন। সিদ্ধান্ত নিয়েই আসলেন বাজারের সর্বোন্নত কনফেকশনারীতে। দাঁড়িয়ে থেকে পর্যবেক্ষণ করলেন কনফেকশনারীটি। কিন্তু তাকে দেখেই হঠাৎ খুশিতে স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠলো পঞ্চাশোর্ধ এক মহিলা। আশ্চর্য হয়ে কাছে এসে বললো–
‘তোমরা হামার সফিক স্যার না?’
‘জি¦ বুবু। আপনি কি চেনেন আমাকে?’ মৃদু স্বরে বললেন সফিক। অফিসার হলেও ধনী, গরীব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত সবাইকে শ্রদ্ধা ভরে সম্বোধন করেন সফিক।
বুবু ডাক শুনে অবাক হলো আয়না বিবি। এমন ভদ্র ব্যবহার প্রত্যাশা করে নি সে। করে না আয়না বিবির মতো সাধারণ মানুষরাও। কিঞ্চিৎ ভালো লাগা বোধ করে সফিক সাহেবের দিকে তাকালো আয়না বিবি। মাথা ঝুঁকে ঝুঁকে আবারো বললো সফিককে-
‘মোক চেনেন নাই। মুই আয়না বিবি। গত বছর যে ভিজিডি কার্ড দিলেন মনে নাই। আল্লাহরে, এই কার্ডের জইন্যে মেম্বার চেয়ারম্যানসহ দালালের পিছনোত কত ঘুরছি। উপায় না দেহি উপজেলা অফিসের বারান্দাত সকাল থাকি সন্ধ্যা পর্যন্ত বসিও ছিলুও। ট্যাকা ছাড়া একজনও কথা কয় নাই। তাই আশায় ছাড়ি দিছিলাম। আর তোমরা মোক ট্যাকা ছাড়াই কার্ড নিয়্যা দিছল্যান মনে নাই।’ শেষ বাক্যটি উচ্চারণ করতেই আবেগমথিত হয়ে উঠলো আয়না বিবি। তার কথা বলার স্বর এবং অঙ্গভঙ্গি দেখে মুহূর্তেই জড়ো হলো বটতলা বাজারে থাকা শিশু থেকে বুড়ো। বিষয়টির প্রকৃত কারণ উদঘাটন করতে হবে এমন একটি প্রতিজ্ঞা স্পষ্ট হলো সবার মাঝেই। কারণ হিসেবে সফিককে ভেবে পুলিশের মতো করে তাকিয়ে থাকলো তার দিকে।
‘জি জি, চিনেছি বুবু, চিনেছি।’ ঠিক মনে করতে না পারলেও আয়না বিবির কথার জোরে চিনতে হলো সফিককে। অফিসে অনেকেই আসে সরকারি সহায়তার উদ্দেশ্যে। নিরন্ন অসহায় লোকদের শারীরিক অঙ্গভঙ্গি দেখে সফিক চেষ্টা করেন সহায়তা করবার। কোনো ধরনের অর্থের বিনিময় তো নয়ই বরং কর্মচারীদের সতর্ক করে দেন যাতে কোনো ধরনের ভোগান্তি সহ্য করতে না হয় সহায়তা প্রত্যাশীদের। একই সাথে সুকৌশলে জনপ্রতিনিধিদের অন্যায় আবদারগুলিও প্রত্যাখ্যান করেন।
‘ভিজিডির ট্যাকা দিয়া একনা মুরগীর খামার করছিনু। মেলা মুরগী হইছে। দুইট্যা গরুও কিনছিনু। আজ কয়দিন থাকি খালি তোমারে কথা মনে হয়। চলো স্যার, চলো, মোর বাড়ীত চলো।’ আয়না বিবির দাওয়াত প্রত্যক্ষ করে সন্দেহের অবসান ঘটলো পুলিশী দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা আমজনতার। দু’একজন সরে গেলেও দাঁড়িয়ে রইলো সবাই। নাটকের শেষ দৃশ্য কেমন হতে পারে সেটি উপভোগের অপেক্ষায়। অকস্মাৎ দাওয়াত পেয়ে অপ্রস্তুত হলেন সফিক। কি করবেন বুঝতে পারছেন না এ মুহূর্তে।
‘স্যার, চলো তো, স্যার মোর মনের আশাডা পূরণ করো।’ হঠাৎ সফিকের একদম কাছাকাছি এসে হাত জোড় করলো আয়না বিবি। আয়না বিবির মুখের দিকে তাকালেন সফিক। গোলাকৃতির মুখমণ্ডলটিতে ফুটে উঠেছে শিশিরের মতো সরলতার শুভ্রতা। ঘোলা চোখ দুটিতে দৃশ্যমান হচ্ছে সফিককে একবেলা আপ্যায়নের উতুঙ্গ অভিপ্রায়। লম্বা কানের গহ্বরও তীক্ষèভাবে শুনতে উদগ্রীব হচ্ছে সফিকের ইতিবাচক উত্তর। অনুভব করছেন শফিক। শাড়ীর আঁচলের খুট দিয়ে মুখ মুছলো আয়না বিবি। শফিকের মৌনতায় যেন বোবা হতে থাকলো এ মুহূর্তে আয়না বিবি।
‘যাও তো স্যার, যাও, এত করি কবার লাগছে। যাও।’ দাঁড়িয়ে থাকা জনতার অভিব্যক্তি থেকে প্রতিধ্বনিত হলো শব্দগুলি। শব্দের প্রকম্পনে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো আয়না বিবি। গুনগুন করে ব্যাখা করতে থাকলো গার্মেন্টস দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর পরও কার্ড বঞ্চিত হবার ইতিহাস। একইসাথে ব্যাখ্যা করলো আগুনে পুড়িয়ে যাবার পরও প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবার আখ্যান।
‘খুব ভালো রান্না করেছো বুঝি, বুবু?’ আয়নাবিবিকে স্বাভাবিক করবার উদ্দেশ্যে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন সফিক।
কথাটি শুনেই স্প্রিংয়ের মতো আবারো লাফিয়ে উঠে বললো আয়না বিবি, ‘যদি যান তাইলে মোর কইলজ্যা ছিড়ি তোমাক খাওয়াইম। বিশ্বাস না হইলে বুকের ভেতরটা ফাড়ি দেখেন।’ আর কোনো কথা নয়। আয়না বিবির এ কথায় ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়ে সম্মত হলেন সফিক। আয়না বিবির চোখের জল নিমিষেই তেঁতুলিয়া থেকে গিয়ে পড়লো টেকনাফের সমুদ্র সৈকতে। প্রকৃত ভালোবাসা বোধহয় এমনই হয়। এখানে থাকে না স্বার্থের কোনো লুকোচুরি। মনে মনে ভাবলেন সফিক।
‘মোর যে কি ভালো লাইগতেছে, ঘরে নতুন জামাইও আইসছে। মোর কপাল আইজ খুলি গেইছে। বাজার কইরব্যার না আসলে কি যে ভুল হইতো। ’ বলতে বলতে সফিককে নিয়ে দ্রুত হাঁটছে আয়না বিবি। আয়নাবিবির পেছন পেছন হাঁটছেন সফিক। অতীত হাতড়ে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করছেন আয়না বিবিকে। আয়নাবিবির মতো এমন অনেককেই সাহায্য করেছেন তিনি। কিন্তু স্রেফ সরকারি কর্তব্যের বাইরে কিছু ভাবতে পারেন নি কখনো। তাছাড়া মানুষের জন্য ভালো কিছু করবার বিপরীতে কিছু প্রত্যাশা করাকে ঘৃণা করেন তিনি। মননকেন্দ্রিক প্রসন্নতা অন্বেষণ তার কাছে সকল ভালো কাজের প্রকৃত প্রাপ্তি। কে কীভাবে মূল্যায়ন করলো সেটি বিবেচনায় আনা মোটেও সমীচিন মনে করেন না তিনি। প্রকৃতপক্ষে সেটিই হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। এমন ভাবনায় বিচরণ করেই হাঁটছেন ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা নিয়ে। দেখছেন বটতলা গ্রাম, গ্রামের মানুষ এবং কুমারী প্রকৃতিকে।
‘জামাই, জামাই, আছমা দেহ রে, দেহ কাক ধরি আইনছং। কাই আইচচে হামার বাড়ীত। তাড়াতাড়ি বেইর হন।’বাড়ীর কাছে আসতে না আসতেই প্রায় চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো নতুন মেয়ে জামাই আরমান এবং মেয়ে আছমাকে। মায়ের ডাক শুনে কিছুটা দৌড়ের মতো করে বাড়ী থেকে বের হয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ালো আরমান ও আছমা। অবাক বিস্ময়ে সফিকের দিকে তাকিয়ে রইলো ওরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে ওরা। শহুরে শিক্ষিত মানুষ গ্রামের কোনো বাড়ীতে আসলে বাড়ীগুলি আনন্দে ভরপুর হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে, গ্রামের মানুষগুলি শহরের কোনো বাড়ীতে আসলে বাড়ীগুলি কেমন জানি মলিন হয়ে যায়। আয়না বিবির মতোই অনুভূতির প্রতিচ্ছবি দেখা গেল আরমান ও আছমার মুখাবয়বে। সফিককে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে গেলো ওরা তিনজনই। ভেতরে প্রবেশ করামাত্রই হাঁস ও মুরগীর বিশ্রী গন্ধ নাকে আসলো সফিকের। আয়না বিবিরা কষ্ট পাবে ভেবে নাক টিপে ধরলেন না। নিঃশ্বাস চেপে ধরে চেষ্টা করলেন গন্ধ সহ্য করবার। কিছুক্ষণের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে এলে বিষয়টি। তবে বিকট গন্ধে অসহ্য বোধ করলেও পুলকিত হলেন আয়না বিবির হাস-মুরগীর খামার দেখে। মহিলা যে কার্ডের সদ্ব্যবহার করেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হলেন। বেশিরভাগ মহিলারাই কার্ডের সদ্ব্যবহার না করে অর্থের অপচয় করে। পরিদর্শনে গিয়ে অভিজ্ঞতা হয়েছে সফিকের। এমন অবস্থা চলতে থাকলে যতই সাহায্য কিংবা ঋণ দেয়া হোক দারিদ্র্য কখনোই দূর হবে না। ভাবছেন সফিক। গর্বও বোধ করছেন আয়না বিবির জন্য। গর্বের মাত্রা বৃদ্ধি পেলো যখন ডান দিকে তাকাতেই দুটি গাভীও দেখতে পেলেন। এতো দেখি লঙ্কা কাণ্ড করেছে আয়না বিবি? মনে মনে উচ্চারণ করলেন সফিক। তার সামনে দাঁড়িয়ে আরমান। হাত দেখিয়ে আহ্বান করছে রুমের ভেতর প্রবেশের। আহ্বানে সাড়া দিয়ে আরাম করে বিছানায় বসলেন সফিক। ছিপছিপে শরীর, ছোট ছোট চুল, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের লাজুকতায় ভরা মুখখানি দিয়ে সফিককে দেখতে থাকলো আরমান। কিছু একটা বলতে চাইছে আরমান বুঝতে পারলেন সফিক।
‘স্যার, তোমরা থাকেন, মুই একনা বাইর্যা থাকি আইসও।’ লজ্জায় আনত হয়ে আরমানের বলা কথায় নীরব সমর্থন জানালেন সফিক। ঘরে একাই বসে রইলেন এবার। জানালা খুলে দেখতে থাকলেন বাড়ীর পেছন দিক। লাউ, লালশাক ও বেগুনের চাষ দেখে চোখ জুড়িয়ে এলো তার। হাস মুরগীর বিকট গন্ধের পরিবর্তে এই মুহূর্তে অনুভব করছেন তরকারির সুঘ্রাণ। দেরী হতে পারে ভেবে বাইরে আসলেন। আয়না বিবিকে বলে এগুলেন বাজারের দিকে। মা-মেয়েতে মিলে রান্না করতে থাকলো বিভিন্ন পদ। পাশের বাড়ীর দুজন মহিলাও এসে যোগ দিল ওদের সাথে। দ্রুতই কয়েক ধরনের পদ রান্না করে ফেললো ওরা। আলাদা আলাদা পাত্রে উঠালো ভাত, মাছ, পালিত মুরগীর মাংস ও ডিম ভাজি, ক্ষেতের বেগুন ভাজি, বুটের ডাল এবং খাঁটি দুধের তৈরী পায়েস। পাত্রগুলি নিয়ে রাখলো খাটের উপর বিছানো লালসবুজ রঙের গামছায়। খাবারগুলি সাজিয়ে নির্ভার বোধ করলো আয়না বিবি। অপেক্ষা করতে থাকলো সফিকের। তবে তার এই নির্ভারতায় শংকার সৃষ্টি করলো আরমান। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। আচরণে একটু ব্যতিক্রম হলেইগ্রামের জামাইরা অভিমান করে। অবরোধ করে দিনের পর দিন শ্বশুর বাড়ী আসে না। আর চড়াও হয় স্ত্রীদের ওপর। আবার সবাই যে এমন তাও নয়। তার জামাই এমন নয়। নিবিড় বোঝাপড়া তাদের মাঝে। কোনো বিপদ হলো কিনা ভেবে দিগি¦গিক ছুটতে থাকলো আয়নাবিবি। দেখতে না পেয়ে উদ্বিগ্নতার পরিমাণ বেড়ে গেল। আছমার আশ্বাসও শান্ত করতে পারলো না তাকে। তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করতে থাকলো দুজনেরই জন্য। এরই মাঝে চলে আসলেন সফিক। তাকে দেখতে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো আয়না। মেয়ের পরামর্শে নিয়ে গিয়ে বসালো ঘরে। দেরী করলে খাবার ঠাণ্ডা হতে পারে। এমন ভাবনায় খেতে অনুরোধ করলো সফিককে। অনুরোধের মাঝেই ঘর থেকে শুনতে পেল একমাত্র জামাইয়ের লাজুক কণ্ঠস্বর।
‘জামাই, কোটেও গেছল্যান তোমরা?’
‘আম্মা, হামরা যে মিষ্টিগুলা আইনছিলাম সেইগল্যা তো শ্যাষ হয়আ গেইছে। তাই মিষ্টি আইনব্যার গেইছল্যাম।’ আয়না বিবির প্রশ্নে উত্তর দিলো আরমান।
খুশিতে চোখ মুখে আনন্দের ঝিলিক বয়ে গেল আয়না বিবির। জামাই যে তার সত্যি সত্যিই সুবিবেচক-ভাবতেই গর্বে বুকে ফুলে গেল। সকালে নিয়ে আসা এক প্যাকেট মিষ্টি নিজেরা খেয়ে বাকী সবগুলিই পড়শীদের বিতরণ করেছে আয়না। আর সবাইকে বলেছে, ‘খাও রে, মোর জামাই আইনছে।’ এ মুহূর্তে জামাই সফিক সাহেবের সাথে খেতে বসতে ইতস্তত বোধ করলেও সফিকের অনুরোধে বসলো। মা-মেয়েতে মিলে খাবার পরিবেশন করতে থাকলো দুজনের জন্যে। জোর করেই তরকারির প্রতিটি পদ তুলে দিলো সফিক ও জামাইয়ের প্লেটে। আনন্দের প্লাবন বইতে থাকলো আয়নাবিবির অন্তর্করণে। স্বার্থহীন প্রকৃত ভালোবাসার একটি প্রতিলিপি স্বচক্ষে দেখতে পেয়ে আপ্লুত হলেন সফিক। এত স্বল্প সময়ে এতগুলি খাবারের পদ দেখেও অবাক হলেন। প্রতিটি পদ খেয়ে পূরণ করলেন আয়না বিবির মনের আশা। পেটের কোনো অংশই ফাঁকা রাখলেন না। কয়েকটি মিষ্টি খেয়ে মিষ্টি করে তাকালেন আরমানের দিকে। অত:পর জোর করে দেয়া পান চিবোতে চিবোতে গল্প করতে থাকলেন আরমানের সাথে। তন্ময় হয়ে তার কথাগুলি শুনতে থাকলো আরমান। এরই মাঝে মা ও মেয়ে খাওয়া শেষ করে যোগ দিলো আলোচনায়।
‘এবার যে বিদায় দিতে হবে আয়না বুবু।’ স্বল্প সময় পরেই আয়না বিবির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন সফিক। সফিক সাহেবের এমন আহ্বানে প্রস্তুত হলো সবাই। সফিককে নিয়ে হাঁটতে থাকলো বটতলার দিকে। পাশের বাড়ীর মহিলা ও শিশুরা তাদের পেছন পেছন ছুটতে থাকলে। এবং কিছুদূর যাবার পরই আয়না বিবির ইশারায় আর কেউ এগুলো না। আয়নাদের মুখের ভাষা দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিনের পরিচিত এক আত্মীয়কে বিদায় জানাচ্ছে তারা। এমন অপ্রত্যাশিত একটি অধ্যায় তার জীবনের সাথে যুক্ত হবে কখনো ভাবতে পারেন নি সফিক। অবাক বিস্ময়ে শিথিল হয়ে এসেছে তার শরীর। এটিই তো জীবন, সরলতার মোড়কে আবৃত করেই একে উপভোগ করা সম্ভব- আপনাআপনি ভাবছেন সড়কে দাঁড়িয়ে। তার সাথে রয়েছে আয়নাবিবির পরিবার। ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে একটি বাস। লক্ষ করলো সবাই। প্রায়ই ফাঁকা–কাছে আসতেই দেখতে পারলো। এ বি সি ডি ই গুনতে গুনতে ই সিটের জানালার পাশে এসে বসলেন সফিক। বাস দ্রুত ছাড়বে-বুঝতে পেরে খুললেন মরচে পড়া জানালাটি। সফিকের ইশারায় জানালার কাছে আসলো তিনজনই। অফিস ব্যাগ থেকে তিনটি শপিং ব্যাগ বের করলেন সফিক। ব্যাগ তিনটি দিলেন আয়না বিবির হাতে–তার জীবনে আবিস্কৃত এক পরিশ্রমী মানবিক নারী। এবং জোরের সাথে বললেন– ‘নতুন কাপড় পরে তিনজনই আমার বাড়ীতে আসবেন। দাওয়াত রইলো।’ আর কিছু বলতে পারলেন না সফিক। চোখ ভিজে আসতে চাইছে তার। দমও ভারী হয়ে এসেছে। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করবার চেষ্টা করছেন। একই সাথে মনের মাঝে একটি স্বপ্ন আপনাআপনি দানা বাঁধছে। দুনীর্তির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসবে স্বদেশ। অধিকারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে আয়নাবিবির মতো প্রতিটি পরিবারের। প্রাকৃতিক অরণ্যে ঘেরা মসৃণ ধূসর রাস্তা ভেদ করে কচ্ছপের গতিতে এগিয়ে চলেছে বাস। বাসটি চোখের আড়াল না হওয়া অবধি রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলো আয়না বিবির পরিবার।