রাত দশটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকী আছে। সালিশি বৈঠকে লোক সমাগম অন্যান্য বার থেকে বেশি। কারণ এ যাবৎ যত বৈঠক হয়েছে, এটা তার থেকে ভয়ানক। এরকম ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। উৎসুক গ্রামবাসির কৌতুহল। বিচারের রায় কি হবে? গ্রামের বৌ-ঝিদের পুকুর ঘাটের আলোচনা থেকে শুরু হয়ে বাজারের নাপিতের দোকান পর্যন্ত রেশ রয়ে যায়।
গ্রামের একমাত্র স্বজ্ঞান ব্যক্তি মাস্টার সাহেব। বিজ্ঞ অনবিজ্ঞ লোকের উপস্থিত তুলনামূলক। মাস্টার আসাতেই বিচারের মাঝখানে জায়গা করে দিল উৎসুকজনতা। যাতে মাস্টার সাহেব নির্বিঘ্নে সভার মধ্যেখানে চেয়ার নিয়ে বসতে পারেন। হালকা ফিসফিসানির গুঞ্জন শুরু হলো। গ্রামের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইসহাক হাত উচিয়ে বললেন থামেন মিয়ারা।
ইসহাক চেয়ারম্যান– আজকে কি বিষয় নিয়ে বিচার কার্য শুরু হবে নিশ্চয় আপনারা অবগত হয়েছেন।
দেলোয়ার হোসেন– (গ্রামের কুচুটে স্বভাবের লোক ) চেয়ারম্যান হচ্ছে আমাদের সকলের মাথা। উনি যা ভালো মনে করেন, তা ঠিক হবে কিনা বলুন?
বাকী সবাই মাথা নিচু করে কথায় সাই দিয়ে ‘হুঁ!’ বললেন।
দেলোয়ার হোসেন– আসামি কোথায়? তাকে নিয়ে আসো বিচারের মধ্যে খানে।
চেয়ারম্যান– কী মাস্টার সাহেব কিছু বলেন। আপনি বলবেন নাকি আমি শুরু করবো ?
সুলতান মাস্টার– হ্যাঁ। আপনি শুরু করতে পারেন।
আসামি কোন ছেলে নয়। আসামি সাধারণ একটি মেয়ে। মেয়ের বিচার হবে জেনে মানুষের ভীড় বেশি। আসলে আমরা যে সমাজে বসবাস করি। তা মূলত সম্পূর্ণ পুরুষ পরিচালিত। যতই মুখে প্রচার করে ছেলে মেয়ের সমান অধিকার। কিন্তু বাস্তবে বিন্দু পরিমানও মিল নেই! বিশেষ করে গ্রামে। সমাজে মেয়েদের সামান্য দোষ-ত্রুটি থাকলে তা বড় পর্যায়ে নিয়ে যায়। গলা উচিয়ে দু’চারটে কটু কথা শোনাতে দ্বিধা করে না। যদিও ঘটনায় ছেলের মুখ্য ভূমিকা থেকে থাকে বেশিরভাগ সময়। তবু সব কিছু গিয়ে মেয়ের উপর বর্তায়।
আসামী হলো সালমা জাহান নিভু। মা-বাবার এক মাত্র আদুরে মেয়ে। বিবাহিত জীবনে বাইশ বছর পর ছোট্ট তুলতুলে নিভুর আগমন। মেয়েকে পেয়ে সাইফুল আলম মিলনের খুশির উপচেপড়া আনন্দ জোয়ার বইছে। স্ত্রী ইসমত জাহান এর একই অবস্থা। সাইফুল আলম মিলন পণ্য আমদানি রপ্তানি সরকারি জাহাজের সারেং। শক্তপোক্ত লোক। ফর্সা ত্বক। তারুণ্য ধরে রাখার মতো যুবক। বিবাহিত জীবনে কোন সন্তান না আসাতে, কোন দিন স্ত্রীর মনে দুঃখ দেয়নি। বরং উপরে যিনি বসে সব কিছু দেখেন, তার উপর ভরসা করতে বলেন।
ইসমত জাহান কেঁদে কেঁদে চোখের নিচে কালির বসবাস করেছে! কখনো নিরাশ হয়নি। আশায় বুক বেঁধে সংসার সামলে নিয়েছে। ভরা সংসারে যখন নতুন বউ হয়ে এসেছে ইসমত জাহান। তখন অনেক জনে অনেক কথা বলেছে গায়ের রং কালো ও উচ্চতায় বেশ লম্বা হওয়াতে। সন্তান না জন্মানোতে আরো কটু কথা শুনতে হয়েছে ! সেই কষ্টের সন্তানের কারণে বাবাকে অপমান সহ্য করতে হচ্ছে !
ইসমত জাহান যদি বেঁচে থাকতো, হয়তো এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে দিত না। স্ত্রী মৃত্যুর তিন মাস পর এমন একখানা কান্ড! সাইফুল আলম কখনো ভাবতে পারে নাই। দুচোখের কূপ থেকে জলগড়িয়ে পড়ছে। মাথা নুয়ে যেন মাটির সাথে মিশে যেতে চায়!
চেয়ারম্যান– আমি যা জিজ্ঞেস করবো, সব ঠিকঠাক উত্তর দিবে। তোমার সাথে সরোয়ার সুমনের সাথে সর্ম্পক আছে, তা কি ধরনের সর্ম্পক? তার একটা কথা গ্রামের সবার মুখে মুখে। এমন কি সেই কথা? সেই কথাটা সত্যি কতটুকু ?
সালমা জাহান নিভু– আপনারা কি শুনেছেন আমি জানি না। আপনি যা জিজ্ঞেস করেছেন, আমি শুধু তাই বলব। আমার সাথে সুমনের মন দেয়া নেওয়ার সর্স্পক তো আছে। হ্যাঁ, কথাটা সত্য। তাছাড়া সুমনকে আমি ভালোবাসি । সেই সাথে আমি তিন মাসের গর্ভবতী। এই সন্তানের জনক সরোয়ার সুমন।
উপস্থিত গ্রামবাসি সকলে তাজ্জব হয়ে গেল নিভুর কথা শুনে। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে চাওয়া-চাওয়ি করছে। কথাটা ঠিক ! নাকি ভুল শুনলো। এর মধ্যে কুজোবুড়ি রহিমের মা বলে উঠলো– তোমাকে তো মাইয়া আমরা গ্রামের সবাই ভালো মনে করতাম। আর তুমি কি না ঐ বাদ্দাইমা ছেলের লগে গোপনে এই কুকর্ম করেছো। ছি…ছি… তোমার লজ্জা শরম বলতে কিছুই নাই ! এমন মেয়েকে কাইট্টা গাঙে ভাসাইয়া দেওয়া দরকার !
চেয়ারম্যান– এই মেয়েটার দুঃসাহস দেখে আমি অবাক। এই রকম ঘটনা আজ পর্যন্ত দেখিনি। আজ নিজের চোখে দেখছি ও শুনছি। মাস্টার সাহেব কি বলেন? মেয়েটার কথা শুনেছেন? এখন বিচারের রায় কি হবে আপনি বলেন ?
মাস্টার– কী বলার বা আছে। যদি কিছু মনে না করেন, আমি একটা কথা বলতে চাই। কথাটা হচ্ছে, মেয়ে ও মেয়ের বাবাকে এক সপ্তাহ সময় দেন।
চেয়ারম্যান– না মাস্টার সাহেব। এক সপ্তাহ হলে বেশি দেরি হয়ে যায়। কালকে সরোয়ার সুমন নিভুকে নিয়ে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে! নইলে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে।
দেলোয়ার হোসেন– মাস্টার সাহেব জ্ঞানী মানুষ। আমার মনে হয় চেয়ারম্যান সাহেব, মাস্টার যেই কথাটি বলেছেন, সেটা ভেবে দেখেন । যদি সময় দেন তাহলে ভালো হতো।
চেয়ারম্যান– এত ভাবার কোন কারণ নেই। যেটা একবার সিন্ধান্ত হয়েছে, সেটা নড়চড় হবে না। এটাই বহাল থাকল। কালকের মধ্যে দু’জনেই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।
উপস্থিত সকলে চেয়ারম্যানের বিচারের রায়কে সঠিক বলে মনে করে। তাই হুঁ হুঁ বলে সম্মতি দিল।
বেশ রাত অবধি বিচার কার্য শেষ হয়। যে যার মতো বাড়িতে ফিরে গেছে। স্থির দৃষ্টি। নির্বাক শুধু সাইফুল আলম মিলন। হাঁটতে গিয়ে পা টলছে। বিচার সভার সমস্ত কথা বার বার ঘুরে ফিরে আসে কানের কাছে। উপর দিকে দু’হাত তুলে বলে আমার মরণ হয় না কেন ! হে খোদা তুমি এক্ষুনি আমার মরণ দাও ! আমি আর বাঁচতে চাই না। এই মুখ নিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচব কিভাবে! তোমরা সকলে আমার জন্য দোয়া করো, যাতে আমার মৃত্যু হয়!
বাকী রাতটুকু অনড় হয়ে আসে। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে সে। ভোরের আলো ফোটার আগে মাঠ পেরিয়ে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে আছে। সম্মোহনী দৃষ্টিতে নদীর জলের গভীরতা পরিমাপ করেছে। ঘটে যাওয়া কোন কিছু ভুলতে পারছে না। ভাবতে ভাবতে নিজের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার অন্ত্যমিল খুঁজে পাচ্ছে না। শূণ্য দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছে। নিজেকে জিজ্ঞেসুর ভঙ্গিতে বললো– আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি। নিভু যদি ঐ ছেলেকে পেয়ে সুখী হয়, তবে তাই হোক। নিভু সুখে থাকলে আমার কষ্ট হবে না। যাই বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে আছে।
পরের দিন সকাল বেলা সাইফুল আলম মিলন মেয়ে নিভুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সরোয়ার সুমন আগেই বলে রেখেছে। কোথায় দেখা করতে হবে। বিকেলে তিনজনই একসাথে বাড়ি ফিরে আসে। তবে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ের কাজটা আগে সম্পন্ন করে। আশেপাশের মানুষের গুঞ্জন শুনা যায়। তার দুই দিন পর আবার চেয়ারম্যানসহ বিচার সভা বসে।
চেয়ারম্যান– সাইফুল। কী বলে ছিলাম গত বিচার সভায়। নাকি আমার কথা কান দিয়ে প্রবেশ করে নাই।
সাইফুল আলম মিলন– জ্বি। শুনেছি আপনার কথা। কিন্তু মেয়ে আমার যাবে কোথায়?
চেয়ারম্যান– কোথায় যাবে মানে ! আকাম-কুকাম করার সময় মনে ছিল না। তোমরা যখন এই গ্রাম থেকে চলে যাও নাই, তাহলে কাল থেকে তোমাকে সমাজ চ্যুত করলাম। তার মানে সমাজের কোন কাজে অথবা অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতে পারবে না তোমরা! তুমি ও তোমার বেহায়া মেয়ে আর জামাইয়ের পরিবারসহ এক ঘরে থাকবে !
দেলোয়ার হোসেন– চেয়ারম্যান সাহেব আপনি হলেন গিয়ে গ্রামের সকলের মাথা। এত রাগ করলে কি চলে। বিষয়টা আর একবার ভেবে দেখলে ভালো হয়।
চেয়ারম্যান– না! আমার সিন্ধান্তের নড়চড় হবে না। বারো বছর পর্যন্ত ওরা দুই পরিবার সমাজ থেকে আলাদা থাকবে। আর যদি কোন ব্যক্তিকে ওদের সাথে মেলামেশা করতে দেখি বা শুনি। তাহলে ঐ ব্যক্তি বিরুদ্ধে একই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
নিভু বাবার মুখে ও চেয়ারম্যানের বলা কথা গুলো শুনে বলে– দেখি কোন বাপের বেটা সাধ্য আছে। আমাকে গ্রাম থেকে বের করে দেবে । বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না!
সুখে-দুঃখে নিভুর সংসার জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। এদিকে আশে পাশের মানুষের গুঞ্জন, এখনো অপয়া মেয়েছেলেটা গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে না। সে মেয়ের জামাইকে দুই লক্ষ টাকা দিয়ে অটো সি.এন.জি কিনে দেয়। বেকার ছেলেকে মেয়ে পছন্দ করে বিয়া করেছে। ড্রাইভার হিসেবে ভাড়া খাটবে।
হঠাৎ বিপত্তি ঘটলো! বাবার একদিন চলে আসে এক বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে। রাগে-ক্ষোভে নিভুর চোখ কপালে উঠে।
নিভু– কে এই মহিলা ?
সাইফুল আলম– ইনি তোমার নতুন মা। আজ থেকে তুমি ওকে মা বলে ডাকবে। শরীয়ত মোতাবেক আমি বিয়ে করেছি।
নিভু– মা ! কে মা ? আমার তো মা মরে গেছে। আমি কখনো ওনাকে মা বলে ডাকতে পারবো না। মা মরে যাবার চার মাসের মধ্যে তুমি বিয়ে করে এনেছো।
সাইফুল আলম– নিভু রাগ করো আর যাই করো না কেন, সব কিন্তু তোমার জন্য হয়েছে। তুমি যদি গ্রামের সামান্য বেকার ছেলেকে নিয়ে এসব কাজ না করতে, তাহলে আমি বাকী জীবনটা তোমাকে নিয়ে সুখে দুঃখে কাটিয়ে দিতাম। তুমি তো আমার কথা ভাবলে না। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। আর একটা কথা না বলে পারছি না ! তোমার তো এখন বিয়ে হয়েছে, চাইলে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারো। এমনিতে তুমি মান-সম্মান সব শেষ করেছো। তোমার জন্য আজ সমাজ চ্যুত হতে হয়েছে।
নিভু অজোরে কাঁদতে থাকে। কখনো মায়ের বিলাপ করে। সান্তনা দেবার কেউ নেই। ঐদিন নিভু শ্বশুর বাড়িতে ফিরে আসে। দিন দিন পেটটা ফুলে উঠতেছে। নড়াচড়া করে ছোট্ট পা দিয়ে লাথি মারে। স্পন্দন বাড়ছে।
কিছুদিন যেতেই সরোয়ার সুমনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আসল রূপটা বেরিয়ে আসে! ইদানিং গায়ে হাত তোলে আর যখন তখন অকথ্য ভাষায় গালি দেয়।
রাগে হিসহিস করতে সরোয়ার সুমন একদিন বলে– ভেবেছিলাম বিয়ে করে রাজ্য পাবো। সাথে রাজকন্যা। দেখি সবই মেকি, ন্যাকামি!
অজানা শঙ্কায় গুটিয়ে যায় নিভু। রাত-দিন ফুরোতেই চায় না। এখনো অনেক সময় বাকী আছে। কিভাবে কাটবে জানি না। এখন সে কী করবে। কয়েক মুহূর্তের ভালো লাগা এখন বিষে পরিণত হয়েছে। নতুন একটা ভোরের অপেক্ষায় আছে সে। ভোরের আলোটা হামাগুড়ি দিতে দিতে এগিয়ে আসবে। কচিমুখ ও হাতের আশায় আছে সে। তলপেটে ভীষণ ব্যথা। কঠিন যন্ত্রনা। অনুভবে কচি ঠোঁটের উষ্ণতা।