মন্ত্রীর অনুরোধেই তাঁর ফেরা; আলমারিতে তুলে রাখা পুরাতন জুতো নতুন করে পায়ে লাগানো। ব্যাপারটা বরং আর একটু সহজ করে বলি। খুব সাধারন একটা ঘটনায় মফিজ তার খেলোয়াড়ী জীবনের ইতি টেনেছিল। সাংবাদিক সম্মেলন করে সাফ সাফ জানিয়েছিল নিজের অবসরের কথা। এমন সিদ্ধান্তে কম বেশি সবাই সেদিন অবাক হয়েছিল। সাংবাদিকরা আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করেছিল, ভাইজান, এমন তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কি? কোচের সাথে কি বনিবনা হচ্ছিল না ?
মনের ভিতর পুঁষে রাখা ক্ষোভ তখন বমি হয়ে বেরিয়ে এসেছিল, আর কোচ; ঐ ব্যাটা খেলার কি বোঝে? সেদিন কেন আমাকে প্রথম একাদশে নামানো হল না? কি করিনি এই দেশের জন্য; জান-প্রাণ উজাড় করে খেলছি। আর আজ কী পেলাম…
দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠলো। মফিজকে তারা ফেরাতে চায়। প্রিয় খেলোয়াড়কে আবার খেলার ময়দানে দেখতে চায় । কিন্তু মফিজের মুখস্ত বাক্যালাপ, না না ভাই, অনেক হয়েছে– আর না। এবার পরিবারকে একটু সময় দিতে চাই।
কোচ জুলমাত খাঁও নির্বাক। মিডিয়াকর্মীদের কৌশলে এড়িয়ে চলে। তার কোচিং পরিকল্পনা বিতর্কিত। ১১ জন খেলোয়াড়কেই ডিফেন্স করতে হবে; এটা আবার কেমন ফরমেশন! কেউ কেউ তার পদত্যাগ দাবি করে। মাঠে ময়দানে কূশপুত্তলিকা দাহ করে। জাত নিয়ে কথা ওঠে। নিজ সিদ্ধান্তে জুলমাত খাঁ তথাপি অবিচল। তার কাছে ভালো খেলা নয় ফলাফলই গুরুত্বপূর্ণ।
যত বেশি সম্ভব ডিফেন্স শক্ত করতে হবে। হাডুডু খেলার জগত থেকে ধরে আনা হয় কালা পাহাড় আর ধলা পাহাড়কে। ওরা নাকি ডিফেন্স ভালো বোঝে। গোলপোস্টের সামনে পিরামিডের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে।
বাদ যায় না রেসলিংম্যান মানিক গদাও। কিছুদিনের জন্য রেসলিং ছেড়ে ফুটবল জগতে। জুলমাত খুশি হয়। পিঠ চাপড়ে সাহস যোগায়, সাবাস মানিক, সাবাস; তুমি একাই ৪/৫ জনের কাম করবা। কার সাহস গোলপোস্ট লক্ষভেদ করে! এমুন বাপের ব্যাটা তো জন্মেও দেখি নাই।
দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে বাংলাদেশের জয় জয়কার। জুলমত খাঁর কৌশলে একের পর এক পরাশক্তি ধরাশায়ী। গ্যালারি জুড়ে লাল সবুজের পতাকার ঢেউ। শাকিরার গানের সুরে দেশবাসী উন্মাতাল। সবাই কাপ চায়, একটা সোনার কাপ।
ফাইনালের আগেই মফিজকে দক্ষিণ আফ্রিকায় উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল। কারণ প্রতি ম্যাচেই একজন স্টাইকারের অভাব অনুভূত হয়।
অবশেষে মন্ত্রীর অনুরোধে সে না করতে পারেনি। ফাইনাল বলে কথা! তাও আবার প্রতিপক্ষ যখন ব্রাজিল! রোবিনহো, কাকাদের বধ করার এটাই মোক্ষম সুযোগ। গেম মিটিং-এ চূড়ান্ত হয় কার কী দায়িত্ব। দীর্ঘদিন পর মফিজ আর জুলমাত খাঁ বুকে বুক মেলায়। বরফের মতো গলে যায় বিভেদের দেওয়াল; ভেঙে যায় বার্লিন প্রাচীর। দেশের স্বার্থই আজ সবার উর্ধ্বে।
– বুজলে মফিজ; তুমারে শুধু একখান কাম করতি হবি; শুধু একখান কাম, তাইলি মোরা চ্যাম্পিয়ান। কেউ ঠেকাইবার পারবি না।
বিচলিত হওয়ার ভঙ্গিতে মফিজ জিজ্ঞেস করে— কাজটা কী, তাই বলেন।
– ফাইনাল ম্যাচে খালি একখান গোল করতি হবি।
কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে জুলমাত খাঁ আবার বলে– ডিফেন্স লইয়া তুমার কোনো চিন্তা নাই। ওরা সারামাঠ আয়েশ কইরি ঘুরবো। আর আমাগো ডিফেন্সে বার বার বাঁধা পাইবো। মাগার গোল ভি হইবো না। এক সময় ওরা কিলান্ত হইয়ি পড়বি। সেই ফাঁকে তুমি চিলর মতোন ছোঁ মাইরি একখান গোল দিয়া ফেলাইবা। দেইখবা কোনোকিছু বুঝবারই পারবি না।
মফিজ আত্নবিশ্বাসে মাথা ঝাঁকায়। তাকে পারতেই হবে!
ফাইনাল নিয়ে বিশ্ব ফুটবলে আলোচনা সমালোচনার ঝড়। ফেবারিটের তকমাটাও বাংলাদেশের গায়ে লটকানো। তাদের ডিফেন্স নিয়ে বিস্তর লেখালেখি। সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। চীনের প্রাচীরের চাইতে শক্ত। তাছাড়া সুন্দরবনের অভিজাত বংশীয় এক হুনুমান ভবিষ্যতবাণী করেছে, এবার বাংলাদেশই চ্যাম্পিয়ন হবে। বেচারা হুনুমানের উপর ব্রাজিল সমর্থকরা বীতশ্রদ্ধ। তারা ভর্তা বানিয়ে খেতে চায়।
বসে নেই দাতা দেশগুলোও; অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে এগিয়ে এসেছে। তারা বিনামুল্যে পনেরো কোটি ভুভুজেলা, ধলা পাহাড় আর কালা পাহাড়ের ছবি সম্বলিত জার্সি, রং বেরঙের প্লাকার্ড আর কয়েক হাজার টন ভেড়ার লোম পাঠিয়েছে। যা কিনা মাথার চুল হিসেবে ব্যবহার করবে এদেশের দর্শকেরা।
গ্যালারিতে দর্শকের উপচেপড়া ভীড়। মুহুর্মুহু করতালি। বাংলাদেশের কৌশল দেখে ফুটবল বোদ্ধাদের চোখ ছানাবড়া। গোলপোস্টের সামনে জমাট বাঁধা বরফ হয়ে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। কোন ফাঁক ফোঁকর নেই। ব্রাজিলের একের পর এক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বল জালের ঠিকানা খুঁজে পায় না। জুলমাত খাঁ নির্ভার। কাগজে মোড়া পান ছাগলের মতো চিবায়। থেকে থেকে জাবর কাঁটে। অন্যদিকে ব্রাজিলিয়ান কোচ বিচলিত। বার বার হাত ঘড়ির পানে তাকায়। মনে মনে রবার্তো কার্লোসের জন্য অনুতপ্ত। একমাত্র সেই পারতো বাংলাদেশের ডিফেন্স গুড়িয়ে দিতে। তাকে দলে না রাখা অন্যায় হয়েছে।
খেলার শেষ মূহুর্তে মফিজ যাদুকরী আলোয় ঝঁলসে ওঠে। ফাঁকা বল পেয়ে আইলার গতিতে প্রতিপক্ষ সীমানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপর সর্বশক্তি নিয়োগ করে গোলপোস্ট লক্ষ করে কিক নেয়। ব্যস, লক্ষ অব্যর্থ। ঘুমিয়ে পড়া গ্যালারি মূহুর্তে জেগে ওঠে।
কিন্তু মফিজের কন্ঠে আর্ত চিৎকার, আমার পা… আমার পা…
ছেলেটি গলাকাটা মোরগের মতো গড়াগড়ি খায়। চিৎকারে অন্ধকার ভেঙে খান খান হয়। খাটের আঘাতে তার ডান পা-টা ভেঙে চুরমার। বাড়িসুদ্ধ মানুষের ঘুম ভেঙে যায়। বাবা মা ছুঁটে আসে। ছেলেটার আবার কী হলো; সাপে কেঁটেছে নাকি? সুইচ টিপতেই অন্ধকার সরে যায়। মফিজ তখন বিছানার উপর বসা। আর বালিশটা ফ্লোরে পড়ে আছে। মা উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে বাবু?
মফিজ কিছু বলতে পারে না, কেবল কৌতুহলী দৃষ্টিতে পায়ে হাত বুলায়।