আমারা যে আবদুল গনি ওরফে হউদ্যা গনির কথা বলছি আদতে সে একজন সাধারণ মানুষ। গাঁয়ের মানুষ আবদুল গনির ‘অউদ্যা’ নামধেয়টি প্রথম শুনেছে ফেকু মুন্সীর মেয়ে ফুলির কাছে। ফুলি একদিন আবদুল গনির উঠানে হোগলার ওপর মেলে দেয়া ধান নাড়তে নাড়তে বলেছিল, কই অউদ্যা গনি, গেলা কৈ? খাজুর রসের সিন্নি খাবা নি?
ফুলির মুখের অউদ্যা গনি শব্দটি প্রতিবেশির একান ওকান হয়ে পাড়ায় রটে যায়। ফুলিদের থেকে আরেকটু শিক্ষিত শ্রেণি শব্দটিকে ভদ্রতার প্রলেপ পরিয়ে হউদ্যা বনিয়ে ফেলল এবং সেই থেকে গাঁয়ের মানুষ আবদুল গনিকে হউদ্যা গনি কিংবা অউদ্যা গনি বলে ডাকতে শুরু করে। তার মত সাধারণ গ্রাম্য কামলাকে দু’চার গ্রামের মানুষের চেনার একমাত্র কারণ তার পেশা। এবং পেশা-ই তাকে বাপমায়ের দেয়া নাম পরিবর্ধন করে দিয়েছে। গ্রামবাসী তার নাম নিয়ে যে কৌতুক করছে তাতে লজ্জাশরমে তার মাথা কাটা যায়। কিন্তু উপায় কিছু নেই, মানুষের সঙ্গে বেহুদা বিবাদ করতে তার ভালো লাগে না।
শীত মওসুম এলেই আবদুল গনি নিরুদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। বসন্তের আগে আর নাগাল পাওয়া যায় না। বিলের একপাশ ঘেষা নিঃসঙ্গ বাড়িটিতে গাছের পাতা হলদে হয়ে খড়ের চালের ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে জমা হয় উঠানে। যখন রাত নামে; কাকরঙা অন্ধকারে র্নিঘুম বাড়িটি এতটুকু বিশ্রাম করে না। শীতবাতাসে মাটি শুকিয়ে যখন রুক্ষ হয়ে ওঠে তখন বাড়ির এখানে ওখানে দেখা দেয় চোরা ফাটল। সেইসব ফাটল থেকে বের হতে থাকে অদ্ভুত মায়াবী শিস। প্রকৃতি যখন রাতের কালো চাদর বিছিয়ে দেয়, মানুষের অভাবে নিঃসঙ্গ বাড়িটি কেঁদে কেঁদে গাইতে থাকে চিরন্তন সংগীত। জাদুকরি সুরের মূর্ছনায় নুয়ে পড়ে বাড়ি ঘরদোর, উঠান এবং গাছপালা। সেই সুরে উদাস হয়ে ছুটে আসে কয়েকটি বেওয়ারিশ কুকুর। কুকুরগুলো মানবশূন্য বাড়ির চারপাশে নির্দ্বিধায় ঘুরে নিজেদের শব্দে থেমে থেমে ডাকে। তখন নিশিকন্যার সঙ্গ কামনায় উন্মুখ কতিপয় রাতজাগা যুবক জাদুকরি সংগীতের মায়াবী টানে ছুটে আসে বাড়িটিতে। ফিসফিসে আলাপে যুবকদের সঙ্গে থাকা মেয়েটি খুটখুট করে হাসে। আর হোগল পাতার বেড়া খুলে যুবকেরা নির্জন ঘরটিতে প্রবেশ করে কাঁচা খাটালে ছেঁড়া নেকড়ার মত পাতলা কাঁথা বিছিয়ে শুয়ে পড়ে। এবং সেই কাঁথা থেকে উৎকট গন্ধ ঘরময় ছড়িয়ে যে মাদকতা সৃষ্টি করে তাতে আধমরার মত নেশায় ঢলে পড়ে তারা। তারপর খলসে মাছের মত খলবল করতে থাকে মেয়েটির চারপাশে। একটু পরে মচমচে হোগলের বেড়ার ফাঁক দিয়ে উড়ে যায় মিলনোন্মত্ত মেয়েটির কাঁপাকাঁপা গোঙানির শব্দ। শরীরে যখন বল শক্তি আর কিছু থাকেনা তখন শুকনো কাঠের গুড়ির ওপর মোমবাতি জ্বালে ছেলেগুলো। বিলের ওপারের দূর প্রতিবেশি আবদুল গনি ওরফে হউদ্যা গনির বিরাণ বাড়িতে লালচে মৃদু আলো দেখে ভুতের আখড়া ভেবে ভুল করে। তারপর ছাই খসে পরা সিগারেটের ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে চারপাশ। নিশিকন্যা কোমড়ের খুঁতিতে টাকা গুঁজে রাস্তায় উঠে দ্রুত পা চালায়। ধীরে ধীরে আকাশ থেকে মিলিয়ে যেতে থাকে তারাদের মেলা। দিগন্তে লুকিয়ে পড়ে মায়াবী আঁধার। খলখল করে হেসে উঠতে থাকে প্রকৃতি। রোদের আলোর ঝকমকিতে আবার চেতানা ফিরে পায় বাড়িটি।
আবদুল গনি ওরফে হউদ্যা গনি নিরুদ্দেশে কোথায় যায়? তার আগে বরং বলি কবে থেকে আবদুল গনির নিরুদ্দেশের পথ চলা শুরু।
বছর পাঁচেক আগের ঘটনা কিংবা আগে পরে হবে হয়ত! পৌষের প্রায় বিদায় মুহূর্ত; মাঘ মাসের দ্বারদেশ। কদিন আগে হাঁপানিতে ধুকে ধুকে মরল আবদুল গনির বুড়ো মা। বাবা গত হয়েছে সে-ই কবে। নিঃসঙ্গ বাড়িটি একা ক্ষুধার্ত কুকুরছানার মত কুইঁকুঁই করে। আবদুল গনি কারো সঙ্গে দুদণ্ড আলাপ করবে এমন কেউ নেই। একদিন বিকেলে আধবোজা চোখে রৌদ্দুরে দখিনমুখী হয়ে বসে বসে কী যেন ভাবছে আবদুল গনি। আনমনে তাকিয়ে দেখছিল চারিদিক। সে খেয়াল করে দেখে, সামনের শুকনো পাতার স্তুপে কিছু একটা খচখচ করছে। মনযোগ দিয়ে তাকালে তার চোখে পড়ে ঢাউস সাইজের একটা ইঁদুর। ইঁদুরটির মুখে সিনজুরি গাছের পাতার ফাঁকে লুকোনো চিকণ সাপের মত ছেঁড়া একটি সোনালী চেইন। চেইনের ওপর পশ্চিমা লালচে আলো পড়লে কেমন ঝিকমিক করে ওঠে।
আবদুল গনি ভাবে, এমন অদ্ভূত ইঁদুর ইতোঃপূর্বে আর কখনো সে দেখেনি এবং সে গভীরভাবে চিন্তা করে ইঁদুরটির মুখে যে চেইনটি দেখা যায় আদৌ সেটা সোনার চেইন কি-না। না-কি গাওয়ালে ফেরী করা সাজিঅলার সাজিতে যে চেইনগুলো গোল করে সাজানো থাকে সেসবের কোনো একটি। আবদুল গনি বিষয়টিকে সুরহা করার জন্য উঠে দাঁড়ায় এবং হুসহুস করে ইঁদুরটিকে তাড়া করে। ইঁদুরটি তখন গতিপথ পরির্বতন করে এবং যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে অর্থাৎ বিলের ভেতরে দ্রুত চলতে থাকে। আবদুল গনি পা টিপে টিপে ইঁদুরটির পেছন পেছন যায়। কিন্তু কৃপণ ইঁদুরটি কোনোক্রমেই মুখ থেকে চেইনটিকে আর মাটিতে ফেলে না। আবদুল গনিও নছরবান্দা কম নয়, শরীরে জড়ানো পাতলা কাঁথাটি সে গুটিয়ে দলা করে কাঁধের ওপর রেখে ইঁদুরটিকে অনুসরণ করে আরো জোরে জোরে পা চালাতে থাকে।
তখন পশ্চিমে গাছ-পালার মাথার ওপর লাল সূর্যটা কুসুমরঙা হয়ে গেছে। এখনো ঘাসের ওপর কুয়াশা পড়তে শুরু করেনি। পুরো বিলের আমনক্ষেত ফাঁকা। মাঝখানে কাঠা পাঁচেক ভূঁইয়ের ওপর লম্বা ধানগাছগুলো প্রতিবেশিহীন দাঁড়িয়ে আছে। শীষগুলো এখনো সবুজাভ, পুরোপুরি পাঁকেনি। হয়ত আশ্বিন মাসের বাতলাহারার আগে কৃষক আধমরা লালচে চারাগুলো রোপন করেছিল ওখানে। তবে খোন্দ একেবারে মন্দ হয়নি। নগ্ন বিল থেকে ইঁদুরটি সেই ধানগাছগুলোর ভেতর ঢুকে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যায়। আবদুল গনি হাল ছাড়ে না; সে ধানক্ষেতের ভেতর হাত দিয়ে ছিলা কেটেকেটে নুয়ে নুয়ে পথ চলতে থাকে। ধান গাছের মিষ্টি ঝাঁজালো গন্ধে ক্ষেতের ভেতরটা ম’ম করছে আর কাছেই কোথাও ছোট্ট একটা পোকা কানে তব্ধ লাগানো ঝি’ঝি ডাক ডেকে চলছে। উষ্ণ স্তব্ধতায় চারপাশটা ভরে রেখেছে ধানফড়িংয়ের অক্লান্ত গুঞ্জন। তখন আবদুল গনির চোখে পড়ে ধানক্ষেতের আরেকটু ভেতরে, যেখানে ধানগাছগুলো আরো ঘনো জংলার মত, সেখানে। আবদুল গনি দেখে চারপাঁচটি ধানগাছ একটু পরপর দুলে দুলে উঠছে এবং কেমন যেন মানুষের ফিসফিসানির আলামত পাওয়া যায় সেখানে।
একটু বাদে ফিসফিসানিটা আরেকটু সচকিত হয়। একটি মৃদু কণ্ঠস্বর শুনে আবদুল গনি চমকে ওঠে। কেননা নারী কণ্ঠটা তার অদ্ভুতরকম চেনা। না, ঠিক কথাটা-যে চেনা তা নয় তবে বলার ধরনটা বেশ পরিচিত। ধানক্ষেতের খুব কাছে যে বাড়িটি সে বাড়ির ফেকু মুন্সীর বড় মেয়ে ফুলি। ফুলির গলাটা ফ্যাসফ্যাসে এবং সে ওভাবে কথা বলে। আবদুল গনি ধন্ধে পড়ে যায়; তার মাথায় আসে না ফুলি ধানক্ষেতের জঙ্গলে কী করে! তার একবার মনে হয়, ধানের শীষ নীরবে চুরি করতে ফুলি ওখানে এসেছে কিন্তু পরক্ষণে ভাবে এই স্বভাব যে তার আছে এমনটা কখনো শোনা যায়নি। আবদুল গনি পা চালিয়ে নড়ে ওঠা ধান গাছের দিকে এগিয়ে যায়। সে দেখে স্যাতস্যাতে মাটির ওপর রংচটা একটুকরো কাপড় বিছিয়ে বসে আছে ফুলি। বনে-জঙ্গলে ঘুঘু শিকারী ধুরন্ধর সফেজ ফুলির শরীরের এখানে ওখানে হাতায়। পাশে কোপ দিয়ে রাখা কাঁচিটা হাতে তুলে আবদুল গনি আগুনের ফুলকির মত জ্বলে উঠে এবং কাঁচি দিয়ে একগোছা ধানের কোমড়ে পোচ বসায়। আবদুল গনি হুংকার ছাড়ে,— ভালো অইবে না কইলাম সবেইজ্যা। ভুলাইয়া ভালাইয়া ফুলিরে ধান খেতে লইয়াইছ? কথা শুনে ফুলি যেন আর লজ্জায় বাঁচে না। মাটির ওপর থেকে রংচটা কাপড়ের টুকরোটা তুলে বুকের ওপর দেয় এবং সে বলে,– সবেজ মোরে ঘরে নেবে।
– মুইও নেতে পারি। আবদুল গনি বলে।
— আহা! সোনার চান্দু, ঘর আছে তোমার? কুডার ঘরে থাহো আবার ঘরে নেতে মন চায়। ইস, শহের ঢেহি কোহানের। ফুলির মুখে কথাটা শোনার পর আবদুল গনির মাথায় খুন চড়ে। কাঁচি নিয়ে ধাওয়া করে সফেজকে। সফেজ যেতে যেতে বলে , তোরে গউন্যা খুন হরমু দেহিস।
সফেজের চলে যাবার পর আবদুল গনি ফুলিকে ফুসলায়, তোরে সোনার চেন দেতে পারি জানো। এক্কেরে খাডি সোনা।
— দেও-না দিহি সোনার চেন। তইলে তোমার ঘরেই যামু। আবদুল গনি ফুলির ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা মেরে বলে, এহোনই দিমু, ল আউগ্যা।
ফুলি কথায় সায় দেয় এবং দুজনে আরেকটু পা চালিয়ে ধানক্ষেত থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় আসে। আবদুল গনি তখন পাশের কোথাও ইঁদুরের কিচকিচ শব্দ শুনতে পায় এবং কান খাড়া করে অবস্থা নির্নয় করে সেদিকে আগায়। ইঁদুরটি দেখতে পেয়ে আবদুল গনির মুখ খুশিতে ঝলক দিয়ে ওঠে। সে ভালোভাবে লক্ষ করে দেখে ওটা সেই ইঁদুরটা এবং এখনো সোনালী রঙের চেইনটা ওটার মুখে রয়েছে। আবদুল গনি ইঁদুরটাকে অনুসরণ করে সামনে আগায় এবং ফুলিকে আরো জোরে হাঁটার জন্য শাসায়।
আবদুল গনি দেখে ইঁদুরটা দৌঁড়ে একটা গর্তের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেছে। ভেতর থেকে থেমে থেমে আসছে কিচকিচ শব্দ। ফুলিকে বাড়ি থেকে খোন্তা আনার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে আবদুল গনি গর্তের কিণারায় পাহারা দেয়।
বিকেলটা লম্বা ঘুমের প্রস্তুতি নিয়েছে। সূর্যটাও টুপ করে হারিয়ে গেছে একটু আগে। দিগন্ত বিস্তৃত বিল, উত্তর থেকে আসা হিম বাতাস কলিজায় লাগে। আবদুল গনির কোমড়ে ব্যাথা কি-না তাই খোন্তা নিয়ে সে কায়দা করে কোপ বসাতে পারে না। সে ফুলিরে বলে,– দেখ ফুলি, ভোলাভালা মাইয়া মানু তুই। খ্যাচার ফান দিয়া ঘুঘু শিকারী সবেইজ্যা কইলো তোরে রাকপে আর অমনে তুই রাজি অইলি? সবেইজ্যা ডাহাইত এট্টা। দিনে ঘুঘু ধরে আর রাইতে করে ডাহাতি। অর কতায় ভুলিস না কইলাম।
ফুলি মাথা নাড়ে। আবদুল গনি বলে, ল, কোপ চালা। অদের মধ্যে সোনার খনি আচে। চেন দেতে চাইলাম না তোরে? ইন্দুর একটা চেন লইয়া এইডার মধ্যে ঢোকচে। ফুলি গায়ের জোড়ে খোন্তা দিয়ে মাটি কোপায়। আবদুল গনি কোপানো মাটি হাত দিয়ে সরায় আর ফুলির চেকন শরীরের দিকে তাকায়। দিব্যি সুগঠিত চওড়া কাঁধ ফুলির। ছিপছিপে দেহের গাঁথুনি। সরু কোমড়ের কাছে যৌবন খেলা করে। ঠান্ডায় গালদুটো ভেজা আপেলের মত হয়ে গেছে। ভি আকারের খোলা জামার উপরে গলার সাদা কোমল ভাজদুটো আধমরা চাঁদের আলোয় কি সুন্দর দেখতে! মাটি কোপানোর তালেতালে শরীরটা ঢেউখেলে দোলে! আবদুল গনির চোখ দুটো উজ্জ্বল চকচকে হয়ে উঠল। এরকম নির্জন পরিবেশে জীবন্ত যৌবনের সান্নিধ্য পাওয়ায় মাথার উপর তাকিয়ে ঈশ্বরকে মনেমনে ধন্যবাদ জানায়।
ফুলি আর কোমড় সোজা করে খোন্তা চালাতে পারে না। মাটি অনেকখানি খুঁড়ে গর্তের গভীরে চলে এসেছে। এখানে দু’একটা ধানের শীষের নাগাল পাওয়া যায়। আবদুল গনি ফুলির মুখের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে তারপর ইয়া আলি বলে গর্তের ভেতর হাত ঢুকায়। ভেতর থেকে বের হয়ে দুটো ইঁদুর কিচকিচ শব্দে অন্ধকারে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। বাতাসে উড়ে যায় ভেপে ওঠা ধানের গন্ধ। ভেতরের ফাঁকা অংশে আবদুল গনি দেখে বিস্তর ধানের শীষ। সেগুলি মুঠো করে উপরে তোলে আর রংচটা কাপড়টায় ছড়িয়ে দেয় চেইনটার খোঁজে।
পৌষের কুয়াসাচ্ছন্ন চাঁদের ম্লান আলো উঁকি দেয় শিশিরে আধভেজা বিলে। আবদুল গনি গর্তের ভেতর থেকে টেনেটেনে তুলছে ধানের শীষ। কাপড়টার ওপর ছোট একটি ধানের স্তুপ হয়ে গেলে আবদুল গনি শীষগুলোকে আরেকটু নেড়েচেড়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে। তখন চিকন সুঁতোর মতন কিছু একটার ওপর চাঁদের ম্লান আলোর হালকা ঝিকিমিকি। আবদুল গনি হাতে তুলে দেখে সেই সোনালী চেইন। আদতে চেইনটা সোনার কিংবা ইমিটিশন সেসবের গভীর চিন্তায় না গিয়ে সে ওটা ফুলির গলায় পরিয়ে দেয়। নিজের লুঙ্গি থেকে টেনে বের করে সেলাইয়ের সুতা। ঘাড় থেকে চুলগুলো একপাশে করে সুতা দিয়ে চেইনের দু’মাথা বাঁধে।
তখন বিলের অপর মাথায়, সেই দূরের গ্রামখানা চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসে। চাঁদের অপূর্ণ আলোয় ধোঁয়াসা হয়ে ওঠে বিলের আধভেজা মাটি। সদ্য-সোনারঙের পাকধরা ধানবাগানে উত্তরা বাতাস ঢেউ খেলে যায়। আর আনন্দে ফুরফুরিয়ে ওঠে ফুলির মন। যেহেতু মাটির গর্তকে আবদুল গনি, ফুলি, পাদ্রীশিবপুর গ্রামের মানুষ “অদ বা হদ বলে জানে তাই ফুলি সশব্দে চেঁচিয়ে উঠে,- চেনডা বড় ভালো অইচেরে ’অউদ্যা গনি’। এবার দিহি তোর ঘরেই ওডন লাগবে।
কিন্তু ফুলির মুখে খুশির উজ্জ্বল রেখা দেখে আর লচি কথায় সহজে ভুলে যাওয়ার মত অতটা সৌখিন মানুষ নয় আবদুল গনি। সে বিকেলে সফেজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষয়টি তুলে ফুলিকে কয়েক কথা শুনিয়ে দেয়। ফুলি তখন গাল ফুলায়। নাকের ছিদ্র দুটি স্ফিত করে বলে, খোডা দেবা না কইলাম। আবদুল গনি খোটা আর দেয় না। সে বাড়ি থেকে আনা বেতের টুকরিতে ভরে ধানগুলো নিয়ে যায়। পরেরদিন থেকে কামলার কাজ বাদ দিয়ে কুইড়া খাতায় নাম লেখায় আবদুল গনি। বিলের পর বিল সে ইঁদুরের গর্ত খুড়তে থাকে ধানের খনির আশায়। ফুলিও মাঝেমধ্যে রাতের বেলা আবদুল গনির কাজে সাহায্য করে কিন্তু লোকের ভয়ে দিন দুপুরে কাজটি করা মোটেও সম্ভব নয়।
তবে এই অসম্ভব ফুলির কাছে সাধারণ বটে। দুপুরের রোদে গর্ত খুড়ে আবদুল গনি যখন কাবু হয়ে পড়ে; ফুলি তখন গেলাসে জল ঢেলে আবদুল গনিকে দিয়ে প্রাণ শীতল করে। ধাড়ি ইঁদুরগুলো মাঠে গর্ত খুঁড়ে ধানের শীষ জমিয়ে লক্ষ্মীর ঘর গড়ে তোলে। আর আবদুল গনি ভাগ্য ফেরাতে গিয়ে ঘরামী হয়ে ভাঙে সেই ঘর। এই তার এক নেশা। বিলের পর বিল সে বিরামহীন গর্ত খুঁড়ে যখন ক্লান্ত হয়, তখন কতগুলি তাজা শীষ তার চোখে নেশা ধরায়। গলে পড়া রোদের দুপুরে ঘর্মাক্ত নোনাজল তার মুখ বেয়ে পড়ে। পিঠটা পুড়ে হয়ে যায় তামাটে আর চুলগুলো কাকের বাসা। কেউ এসে তার পরিশ্রমের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলে সামনের পাটির দাঁত বের করে হাসে আর বলে, হেইয়া ম্যালা ধান পাইছি মেয়া। উন্দুর ব্যাডা মাডি খাইয়া থাকপে।
দিনেদিনে আবদুল গনির তুষের ডাংরি, বাঁশের তৈরি ধানের গোলা এবং মাটির তৈরি বড় ঘড়া ধানে ভরে যায়। সে ধানগুলো বাজারে বিক্রি করে এবং কানের কাছে শোনে নতুন পয়সার ঝুনঝুনানি। সে ভালো একটা গামছা কেনে এবং ভাঙা রিক্সার এক্সেল দিয়ে বানায় একটা সাবল। আর কেনে কয়েকটা বাঁশের ডোলা। ফুলির জন্য কিনে আনে চকচকা একখান শাড়ি। ফুলি কাপড়টা পেয়ে আবদুল গনিকে চুপিচুপি কথা শুনতে মুখের কাছে টেনে নেয়। আবদুল গনি যখন এক নিশ্বাসে চোখ বন্ধ করে থাকে; ফুলি তার ঘর্মাক্ত খসখসে গালে চুমু খায়। এ অবস্থায় আবদুল গনি ভ্যাবলাকান্ত হয়ে ফুলির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে এবং সে বিনিময় দিতে ভুল করে না।
একদিন সকালে আবদুল গনি খুব ভয় পেয়ে যায়। তখন রোদ-বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া হোগলের বেড়ার ফাঁক দিয়ে সকালের রোদ পড়েছে ঘরে। আবদুল গনি আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে দরজায় কান পেতে শুনে ঘরের বাঁ দিকটায় অনেকগুলো মানুষের থপথপ পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। কেউকেউ গলা খাকড়ি দিয়ে হোগলার বেড়া ধরে টানছে। পরিচিত পায়ের আওয়াজগুলো আবদুল গনির চেনা। সে চোখ মেলে শরীরটাকে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বড় করে হাই তোলে। বাইরে পদশব্দে মুখরিত লোকদের জানায়- সে তাদের কথাবার্তা শুনছে। ফেকু মুন্সীর একটু বেশী ঘা কি-না। ফুলি মেয়েটা একদম কথা শোনে না তার। রাত-বিরাতে, যখন-তখন হউদ্যা গনির সঙ্গে মেয়েটা বের হয় আর বিলে বিলে ইঁদুরের গর্ত খোড়ে। সমাজে আর জাতকুল বাঁচে না ফেকু মুন্সীর। আরেকজন লোক নিয়ে সে হোগলার দরজাটা ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢোকে। উঠান থেকে গ্রামের মেম্বার ডাক ছাড়ে,– রে হউদ্যা গনি, ঘুম এহোনো ভাঙে নাই তোর? তারতাড়ি বাইরে আয়। এলাকার বেবাকে আইচে।
আবদুল গনি হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে ওঠে। গায়ের ছেঁড়া কাঁথার নিচে যে চটের ছালাটা দিয়ে সে ঘুমিয়েছিল, ফেকু মুন্সী সেটা লাথি মেরে দূরে ঠেলে দেয়। আবদুল গনি ফেকু মুন্সীর দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে শুধু বলে, রহেন মেয়া, বেইন্যাকালে কইলাম না কিছু। আবদুল গনিকে দেখে মেম্বারের গলার স্বর গমগম করে। সে রক্তবর্ণ চোখে আবদুল গনির দিকে তাকিয়ে বলে– দেখ হউদ্যা গনি, খবরদার। হদ ছালাও ঠিক আছে, তয় মাইনসের জমি খেতের জিরাইত নষ্ট হরো ক্যা? তুই এই কাম হরতে পারবি না। পেশা বদলান লাগবে তোর।
মোটাসোটা, গদমা চেহারার টাকওয়ালা চেহারার মাঝবয়সী লোকটি মেম্বারের চ্যালা। সে আরেকটু এগিয়ে আবদুল গনির মুখের কাছে গিয়ে বলে,– অদ ছালাবি তো দ্যাশ ছাড়বি। ঠিকাচে?
আবদুল গনির তখন রাগে তখন শরীরটা গজগজ করে এবং সে ঝাঁঝালো গলায় বলে– হ, ঠিকাচে।
দিগন্তে রোদ বাড়ায় গ্রামটা একটু একটু করে শান্ত হতে থাকে। কিন্তু আবদুল গনির ঘরে মন টেকে না। বাড়ির সীমানা ভেড়িতে দাঁড়িয়ে কপালের ওপর তেরছা করে হাত রেখে রোদ আড়াল করে বিলের দিকে তাকায়। পুরো বিল খেসারি ক্ষেতের সবুজ বিছানা। মাঝেমাঝে চোখে পড়ে গর্ত খোড়ার চিহ্নগুলো। কিন্তু গর্তের ভেতর যে ধানের ক্ষণির লালসা সে পেয়েছে সেখান থেকে তাকে ফেরায় এমন সাধ্য কার! লুঙ্গিটা মালকোচা দিয়ে আবদুল গনি সাবলটা পিঠের নিচ দিয়ে লুঙ্গির ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। কাপড়ে গিট দিয়ে বানানো ঝুলিটা কাঁধে ঝুলিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে নতুন গর্তের সন্ধানে। পুরো নয়দিন সে শ্যামপুর, রুনসী, চামটা, দুধলমৌ গ্রামের বিলগুলো বিরামহীন খুঁড়তে থাকে। ধানের তাজা শীষে তার ঝুলি বোঝাই হলে পাশের বাড়িতে গিয়ে ঝি-বউ কাউকে পেলে বলে– ভাউজ, একখান হাজি দেবা? কিন্তু সাজি তাকে কেউ দেয় না। ফেরার পথে তার মনে হয় বাড়ির মালিককে বেঁধে বুউটাকে চোখের সামনে এন্তারমত সোঞ্জাতে পারলে মনে সুখ পেত। তবে খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পাত্র সে নয়। ক’বছর আগে যখন গ্রামে অভাব পড়েছিল তখন কাঞ্চন চোরার সঙ্গে সে কয়েকদিন নদীর ওপারে গিয়েছিল চুরি করতে। দিনকয়েক চুরি করে একরাতে কুকুরের তাড়া খেয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আর জানে পানি থাকে না। শেষে কাঞ্চনের সঙ্গ ত্যাগ করে চলে যায় শহরে। পুরাণবাজার নৌকায় বস্তা তোলার কাজ নিয়ে কিছুদিন সুখে দিনাতিপাত করে। তারপর একদিন কোমড়ে ব্যাথা পেয়ে মাসখানেক বিছনাপড়তা। তবে চুরির কায়দাটা সে এখনো ভোলেনি। ঝি-বউরা যখন দুপুরের রাঁধা-বাড়া শেষ করে পুকুরে গোসল করতে যায়, আবদুল গনি সুযোগ বুঝে রান্নাঘরে ঝুলানো ছালা নিয়ে বিলে সটকে পড়ে। সন্ধ্যায় শীষভর্তি ধানের ছালাটা মাথায় করে বাড়ি নিয়ে যায়। রাতে শীষ থেকে ধান ছাড়িয়ে উঠানে খামাল দেয় আর মনের সুখে যেমন মনে আসে সেইসব শব্দ মিলিয়ে স্বরচিত গান গায়। একদিন সকাল থেকে হেলেপড়া দুপুর পর্যন্ত অনেকগুলো গর্ত খুঁড়ে আবদুল গনি মোটেও ধানের শীষের দেখা পায় না। বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে পাদ্রীশিবপুর গ্রামের শেষ মাথায় ধুলট ক্ষেতের কাছে সে বড় একটা খোড়ল দেখতে পায়। সন্ধ্যার আগে-ই সেই খোড়লটা খুড়ে আধামন ধান পায় সে। ভাগ্যের ফের, সে যাত্রায় একটা বেকায়দায় পড়ে সে। সন্ধ্যায় ধুলট ক্ষেতের মালিকের কাছে সে ধরা পড়ে। মালিক তার গোঁয়ার ছেলেকে দিয়ে আবদুল গনিকে এন্তার সোঞ্জায়। মার খেয়ে সে সে ধুলট ক্ষেতে লুটিয়ে পড়ে। মালিক তার ধানগুলো নিয়ে যায়, বিকেল ও সাঝের মিলন মুহূর্তে সে খোড়াতে খোড়াতে বাড়ি ফেরে। তারপর চারপাঁচ দিন সে আর কোথাও বের হয় না।
তখন উত্তরের বাতাস মোড় নিয়ে চলে যায় পূবে, তারপর দিশা পেয়ে তীরতীর করে বইতে শুরু করে দখিন থেকে। শীত বিদায় নিয়ে বসন্ত আসি আসি করছে। আবদুল গনির পাদ্রিশীবপুর গ্রামের পুরো বিল খোড়া হয়ে গেছে বহু আগে। অন্য গ্রামে না গিয়ে এখন আর উপায় নেই। সে একদিন দুপুরে ঝুলিটা কাঁধে ঝুলায় এবং সাবলটা বগলে নিয়ে পুইয়াউডা গ্রামের দিকে পা চালায়। বিলের পথ ধরে সোয়া মাইল পথ হেঁটে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। দুপুর নাগাদ সে পুইয়াউডা গ্রামের ওয়াবদা রাস্তার নাগাল পায়। ওয়াপদার কিণার ঘেঁষে সমতল জমিটা প্রায়মৃত নদীর চর। সেই বহু বছর আগে, আবদুল গনির বাপ-দাদার আমলে এখানে ছিল খরস্রোতা নদীর গুদি। জনশ্রুতি আছে, এখানে গুদির আশেপাশে দেখা মিলত কুমিরের। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণিগুলো এখন কোথায়! আবদুল গনি দীর্ঘ চরের দিকে চেয়ে ভাবে। ধীরে ধীরে মানুষের অবহেলা আর শাসনে নদীটা হয়ে গেছে খালের মত সরু। আবদুল গনি চরের শেষে আধমরা শ্রীমন্ত নদীটার ওপারের দিকে তাকায়। সেখানে দীর্ঘ বিলে বিছানো ঘাসের জমিন, কোথাও খেসাড়ি ক্ষেত নেই। দূরের আকাশটা পরিষ্কার, নির্মল। বিলের পশ্চিম দিকে তাকালে আবদুল গনির চোখে পড়ে, নীল আকাশের নিচে দাঁড়কাকগুলো কয়লার মত বিলের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। মনে হয় কাকগুলো তার রোদে পোড়া আত্মীয়। ফসলহীন দীর্ঘ বিল দেখে আবদুল গনির মন বাকুম বাকুম করে। সে শ্রীমন্ত নদী পাড় হয়ে ওপারের বিলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত তার। প্রায়মৃত শ্রীমন্ত নদীর ধার ঘেষে কেয়া গাছের ঝোপের আড়ালে এক চিলতে ছায়ায় আবদুল গনি একটু জিরিয়ে নেয়ার জন্য বসে। ঝুলি থেকে দেশলাইটা বের করে যখন বিড়িটা ধরাবে অমনি সে ঝোপের আড়ালে শুনতে পায় ইঁদুরের কিচকিচ। আবদুল গনি বিড়িটা ফেলে আরেকটু দূরে সড়ে আসে। গাঁও-গেরামের মানুষ বলে কথা, সে জানে ঝোপে জঙ্গলে যেখানে ইঁদুরের বসবাস সেখানে সাপের আনাগোনা থাকে। তাই একটু দূরে থেকে ইঁদুরের কিচকিচ শব্দটা গভীর মনযোগে খেয়াল করে। সে দেখে খানিকটা দূরে ঠিক শ্রীমন্ত নদীঘেষা আরেকটি কেয়া ঝোপের কাছে সরু একটা গর্তের ভেতর দুটো ইঁদুর কোথা থেকে দৌঁড়ে এসে অদৃশ্য হয়ে যায়। আবদুল গনি কিছুদূর গর্তটা খুঁড়ে বড় একটি মাটির খোড়লের সন্ধান পায় এবং সে বুঝতে পারে নদীর ধার ঘেষে এতবড় খোড়লের ভেতর অনেক ধান পাওয়া যেতে পারে। যেহেতু পাদ্রীশিবপুর গ্রামের মানুষ নেই এখানে, আবার পুইয়াউডা গ্রামের মানুষ অলস দুপুরে প্রিয়জনের সঙ্গ পেতে ঘরে ফিরেছে। আবদুল গনি নিশ্চিন্তে বিরামহীন সাবল চালায়। সে দেখে, ঝোপের আরেকটু দূরে কয়েকটি ইঁদুর আবদুল গনিকে দেখে ঘাড় নাড়িয়ে বিড়বিড় করছে। মনে হয় ইঁদুরগুলো যেন তাকে দেখে হতাশ এবং মহাবিরক্ত। আবদুল গনি ইঁদুরের কেঁপেকেঁপে বিড়বিড় করা দেখে মনের ভেতর আমোদ অনুভব করে এবং ফিক করে হাসে। সে দুহাতে থুত্থুরি দিয়ে থুথু ছিটিয়ে সাবলটা শক্ত করে ধরে এবং মাটি কোপাতে কোপাতে মুখে মুখে ছড়া কাটে,
রাইত দুপারে হুলো বিলাই উন্দুর করে তাড়া
উন্দুর কয় বাঁচাও বাঁচাও পানে গেলাম মারা।
সন্ধ্যায় বাসন্তী আকাশ থেকে ফুরিয়ে যেতে থাকে তৃষিত সূর্যের প্রাণ। মাটি থেকে যে গরম ভাপ ওঠে তাতে ফাল্গুনের ঘুর্ণি বাতাস দোল খেয়েখেয়ে রূপকথার সুখ আর মায়া রচনা করে। আবদুল গনি তখন আরাম করে সাবল চালায়। যখন সে হাপিয়ে ওঠে বারবার দুহাতে থুত্থুরি ছিটায়। আর বিকেলটা নিঃশব্দে মিলিয়ে যেতে থাকে সন্ধ্যার আঁধারে। দখিনা বাতাসের ফুরফুরে মেজাজে আবদুল গনি এলোমেলোভাবে কতগুলো ধানের শীষ গর্তের ভেতর দেখতে পায়। বড় একটা মাটির চাকার নিচে আড়আড়িভাবে সাবল ঢুকিয়ে চাড়ি দিয়ে সড়াতেই তার চোখ ঝলমল করে ওঠে। সে আগে কখনো এতগুলো শীষের খনি আর দেখেনি। সোনারঙের আধভেজা ধানগুলোও কি সুন্দর তাজা! পাশের নদীর জল শুষে মাটিটা ভিজে ধানগুলো যৌবন ধরে রেখেছে। কিন্তু রাত্রি যে বেরহম নিষ্ঠুর! শ্রীমন্ত নদীর ওপার থেকে ধীরেধীরে উঁকি মারছে রাতের মায়াবী আঁধার।
সন্ধ্যার আকাশে তারাগুলো মিটমিট করতে শুরু করেছে অনেক অনেক দূরে। কেয়া বনে হু হু করে দোল খাচ্ছে বসন্ত বাতাস। আবদুল গনি পানির পিপাঁসায় ঢোক গেলে আর দূরের আকাশের দিকে তাকায়। তার মনে হয়, শ্রীমন্ত নদীর ওপাড় গ্রামের গাছ-পালা যেন নিঝুম বন। এপাড়ের মানুষগুলো কুপি জ্বালিয়ে ঘর গেরস্থ সামলায়। আর ফুলি? ফুলিতো এখন ফেকু মুন্সীর আপারে শুয়ে ফ্যাসফ্যাস গলায় গান করে। এতবড় ধানের খনি ফুলিকে না দেখিয়ে তুলে ফেলা ভাড়ি অন্যায়! ফুলি নতুন কিছু দেখলে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে আর বলে, রে হউদ্যা গনি, বিয়ার আলতা স্নো কেনছ? আবদুল গনি সাবল আর ঝুলিটা কেয়া ঝোপের আড়ালে রেখে শ্রীমন্ত নদীর ওপার নীরব তাকিয়ে থাকে। কী যেন একটা স্মৃতি তার মনের মাঝে ছলাত করে ঢেউ খেলে যায়। সে শান্ত বালকের মত আস্তে করে হাসে। মালকোচা খুলে লুঙ্গিটা ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করে পাদ্রিশীবপুর গ্রামের দিকে। আবদুল গনি যখন পাকা সড়কের ওপর উঠল, দূরে কালিগঞ্জ বাজারের দিকের আলোয় ফর্সা হয়ে ওঠে তার সামনের শূন্যপথ। দোকানের ঝুলন্ত বাতিগুলোর আলো এতদূরে নিষ্প্রাণ হয়ে চোখে পড়ে তার। পেটে যে ক্ষুধা তাতে দুএক প্লেট ভাত সে সাবাড় করে দিতে পারে অনায়াসে। কিন্তু কালিগঞ্জ বাজারে কারো চোখের সামনে সে পড়লে রক্ষা নেই মোটেও। বিলের পর বিল ইঁদুরের গর্ত খুড়ে সে সকলের কাছে হয়েছে এক দাগী আসামী। এত রাতে শরীরে, মুখে ধুলি-কাদার চিহ্ন দেখলে তাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুনতে হবে। কেউকেউ চোর সাব্যস্ত করতেও দ্বিধা করবে না। সে কারণে আবদুল গনি রহমগঞ্জ ভাঙা পুল পেরিয়ে সুপারি বাগানের ভেতর দিয়ে চলল বাঁকা এবং সংক্ষিপ্ত পথে। সামনের বড় বিল পেরিয়ে ফেকু মুন্সীর বাড়ি যখন আসে তখন রাত গাঢ় হয়েছে। আবদুল গনি উঠানে মেহেদী গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে নিজের নাম ধরে নিজেই ডেকে অস্তিত্ব জনান দেয়– রে হউদ্যা গনি। বাড়িটা তখন নির্জন, ঘোর শূন্যতায় উঠান খাখা করছে। আকাশে উঠেছে কমলার চাঁদ। আবদুল গনি ঠোঁট চেপে শিস বাজায়। পোঁকায় কাটা কালো দাঁতের ফাঁকে শিস দেয়া শব্দটা ফসকে যায়। ফুলি বাইরে এসে দেখে সারাদিনের ঘর্মক্লান্ত পিরিতের আবদুল গনি তার সামনে দাঁড়িয়ে। ফুলি ফ্যাসফ্যাসিয়ে বলে, মাডে-ঘাডে আর মন টিকলনারে হউদ্যা গনি। খালি মোর লগে কুতকুত হরতে মন চায়। না? আবদুল গনি ফুলির মুখ চেপে ধরে উঠান পেরিয়ে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। ঝিরঝিরে বাতাসে তারা খেসারি ক্ষেতের পথ ধরে পুইয়াউডা গ্রামের দিকে পা চালায়। যেতে যেতে ফুলির শরীরের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে ফাল্গুনের প্রকৃতি আবদুল গনির মনে তালগোল পাকিয়ে দেয়। বিলের ভেতর ঢোল কলমি গাছের পাতায় বাতাস দোল খেতে খেতে উড়ে যেতে থাকে। সেই বাতাসে ছড়িয়ে পড়া ফুলির মেয়েলী গন্ধ আবদুল গনির মনে আগুন ধরায়। সে ফুলিকে বাহুর সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে এবং পয়ের তলার দুর্বা ঘাসগুলো পিষে ফেলে। তখন আকাশের কমলার চাঁদ গোলাপী হয়ে ওঠে, বাতাস দম খেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। আবদুল গনি ও ফুলি দুজনে পিপাসার্ত শুকনো ফাটল ধরা মাটির ওপর কিছুক্ষণ নীরাবতা পালন করে। শ্রীমন্ত নদীর কিণারে পৌঁছে আবদুল গনি ও ফুলি দেখে নদীর চর থেকে আরেকটু দূরে ঊচু রাস্তার ঢালে কয়েকজন মানুষ গোল করে মাটি খুঁড়ছে। লোকগুলোর চেহারা না দেখে অনুমান করার উপায় নেই, তারা কারা। অথচ সফেজের গলাটা শুনে ফুলি শরীরটা ঝাকিয়ে বলল– রে অউদ্যা গনি ওহানে সবেইজ্যা না? আবদুল গনি ফুলিকে বলে– তোর চোপাডা এট্টু থামা। রাস্তার অপর পাশের ঢালে তারা চুপ মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বিষয়টি সুবিধার নয়। সফেজ এবং তার দলবল মাটি খুঁড়ে কী জিনিষ পেয়েছে কে জানে! কলার মোচার মত দেখতে একটা জিনিষের মাথায় চাঁদের আলো পড়ে আয়নার প্রতিবিম্বের মত কেঁপেকেঁপে উঠছে। দলের একজন গলাটা ঝেরে বলল– ও সবেজ, এইডাই তো পিলার। আবদুল গনি যেন আর বসে থাকতে পারে না। সে কপাল কুঁচকে শব্দ করেই বলে উঠল,– পিলার! সে জানে ছোটবেলা তার বাবার সঙ্গে যখন প্রতিবেশির বিবাদ হত তখন মৌজার পিলার থেকে আমিনব্যাটা শিকল ধরে মেপে আসত তাদের বাড়ি পর্যন্ত। তখন তার মনে হয় এটা খুব দামি জিনিষি। তাছাড়া সে এটাও শুনেছে পিলার বিক্রি করলে লাখলাখ টাকা পাওয়া যায়। কথাটা গুজব কি সত্য তার সঠিক জানা নেই। লাখ টাকার লোভে আবদুল গনির গর্ত খুঁড়তে খুঁড়তে অনেক সময় মনে হত– আহা, একখান পিলার যদি পাইতাম! তইলে ধনী অইয়া যাইতাম। জীবনে বহু গর্ত সে খুঁড়েছে এবং একটা পিলার পাওয়ার জন্য মনের ভেতর হা হুতাশ কম ছিল না। কিন্তু এই নির্জন রাতে তার মনে পড়ে হাতেম গাজীর কথা। আবদুল গনির বাবা তখনও জীবিত। হাতেম গাজী দলবলসহ পুরনো পুকুরের পাড় সীমানা ধরে জমি মেপে আবদুল গনির বাবার বাড়ির অর্ধেক দখল করেছিল বহু বছর আগে। হাতেম গাজী ধমক দিয়ে বলেছিল, পরের জায়গায় বাড়িঘর করে তারা যে অন্যায় করেছে তাতে আদালতে কেইস করা উচিৎ ছিল। হাতেম গাজীর দিলে বড় রহম ছিল কী-না তাই আবদুল গনির বাবাকে আদালতে যেতে হয়নি। কিন্তু যেদিন হাতেম গাজী বাড়ির আঙিনা ও রান্না ঘরের চুলা সহ আইলের খুঁটি গাড়ল সেদিন চৌহদ্দির পিলারের সীমানা তাদের দিশা দেখিয়েছিল। নকশা দেখে পরতাল আমিন পিলার থেকে মেপে আবদুল গনিদের বাড়ি হাতেম গাজীর গ্রাস থেকে রক্ষা করেছিল।
আবদুল গনি মাথা নাড়ে। পিলার সে কিছুতেই নিতে দেবে না। একটু ঘুরে শ্রীমন্ত নদীর কোলের কাছে কেয়া গাছের ঝোপ থেকে সাবলটা এনে সবেজের সামনে মাটিতে কোপ দিয়ে রাখে। সে বলে, এই পিলার সে কিছুতেই নিতে দেবে না। বিবাদ যখন চরমে তখন সফেজের মনে হয়, আবদুল গনি পিলার বেচা পয়সার ভাগ চায়। সঙ্গে ফুলিকে দেখে সে গলার শিরায় খিচ দিয়ে বলে– রে অউদ্যা গনি ফুলির প্যাড বাজাইতে পারলি?
– অ, পারলাম। হেতে তোর কী রে ঘুঘু ধরা সবেইজ্যা? আবদুল গনি রাগে গজগজ করতে করতে বলে।
এই রাতের নিস্তব্ধ প্রহরে আরো দুতিনজনের সামনে কথাটা আবদুল গনি এবং ফুলির কাছে নিতান্তই লজ্জার। তখন আদুল গনির ধানক্ষেতের জঙ্গলের ঘটনাটা মনে পড়ে কিন্তু এই পরিবেশে কথাটা তুলতে চেয়েও সে চেপে যায়। আবদুল গনি বলে– পিলার মাডির মধ্যে গাড়বি নাইলে তোরে মাডিতে গারমু। বিবাদ যখন চরমে, সফেজ সঙ্গীদের নিয়ে আবদুল গনিকে চেপে ধরে ফুলিকে বিশেষ আড়া কোল করে কব্জা করতে চায়। ধানক্ষেতে তার উদ্দেশ্য সফল হয়নি সে কথাটা সে ভোলেনি। অবস্থা বেগতিক দেখে ফুলি সাবলটা দিয়ে সফেজের মাথায় আঘাত করে। এক বাড়িতে সফেজ কাৎ হয়ে লুটিয়ে পড়ে আর ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে ফুলির মুখে ছড়িয়ে যায়। আবদুল গনি নিজেকে ছাড়িয়ে মুখে হাত দিয়ে ধরফর করা সফেজের দেহের দিকে ভয়ে, বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। সফেজের অন্যান্য সঙ্গীরা তার অচেতন দেহের পাশে পিলার ফেলে চলে যায়। আবদুল গনি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দুহাতে মুখটা চেপে ধরে বলে, খুন। অথচ, সফেজের দেহটা এখনো ধরফর করে আর মুখ দিয়ে গোঙায়। আবদুল গনি ঝোপের ভেতর থেকে ঝুলিটা বের করে ফুলির হাত ধরে রাস্তায় উঠে। তারা হাঁটতে করে উত্তরের পথ ধরে। আধমরা শ্রীমন্ত নদীর ওপার দীর্ঘ বিলের শেষে যে বাড়িগুলো দেখা যায় সেখানকার গাছপালার উপরে ফাল্গুনের চাঁদ। দূরে সফেজের ঘটনাটি হয়ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে একাটা কুকুর উ-উ-উ শব্দে বিলাপ করছে। আবদুল গনি ও ফুলি আকাশের তারার পথ ধরে চলতে থাকে।
তারা হাঁটতে থাকে গোটা রাত ধরে। সফেজ মরে গেছে কিংবা বেঁচে আছে সেসব নিয়ে তারা মোটেও ভাবে না। রাস্তায় ধারে অচেনা বাড়িটির দিকে তারা উঁকি মেরে দেখে একজোড়া নর-নারী পুকুরে ঝুপঝুপ করে ডুব দিয়ে গোসল করছে। সফেজের তখন গোসল করা দম্পতির শেষরাতের সঙ্গমের কথা মনে পড়ে। ফুলি দম ফেলতে ফেলতে আবদুল গনির বাহুলগ্ন হয়ে হাঁটছে আর আবদুল গনি ফুলির মাথাটা বারবার চেপে ধরছে তার বুকের সাথে। তারা পরস্পর চুমু খায় মরা চাঁদের আলোয় রাস্তায় দাঁড়ানো গাছের নিচে। আবার তারা পথ চলতে শুরু করে উদ্দেশহীন। তাদের পথ চলা সবে শুরু। দীর্ঘ, অমসৃণ, ক্লেদাগ্ধ বন্ধুর পথেও তারা সুখ রচনা করতে জানে। তাদের এই দীর্ঘ পথের শেষ হতে পারে শুধু মরণে।