দর্পণ ডেস্ক
একটি পূর্ণাঙ্গ ম্যাগাজিন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণামূলক ম্যাগাজিন দর্পণ। ২০১৯ সালে ব্যতিক্রমধর্মী ম্যাগাজিন দর্পণ তার যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে দর্পণ "গল্পবাজ" ম্যাগাজিন আত্তীকরণ করে।
দর্পণ ডেস্ক

সিজোফ্রেনিয়া – রানী সিদ্দিকা ইয়াসমিন

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। ভাগ্নির মেসেঞ্জারে এশা একখানা ছবি পাঠিয়ে লিখলো, তোর বুইড়া বাপ-মা!
উত্তরে ভাগ্নি সাদি লিখে পাঠালো, হি হি হি। পাল্টা সাদি লিখলো, কি করো? তোমার মেয়ে কি করে? প্রশ্নগুলো করেই, ‘বইপোকাদের আড্ডা’ পেইজের একটা স্ক্রিনশট নেওয়া ছবি পাঠিয়ে লিখলো, পড়ো ভালো লাগবে।
এশা লিখলো, থাম, পড়ি।

পাঠানো ছবিতে মাছ নিয়ে একটা গল্প আছে। গল্পটা এমন–‘ডাইনিং হলে খেতে বসেছি। খাবারের আয়োজন খুবই খারাপ। ছোট পিরিচে সবজি নামে এক ধরনের ঘ্যাট, পাতলা জিলজিলে ডাল এবং ছোটবাটিতে শিং মাছ। গল্পের শেষে শিং মাছের মাথাতে বড়শি আর বড়শিতে গাঁথা কেঁচো পাওয়া গেলো।’

গল্পটা পড়ে এশা মুহূর্তে চলে যায় তার নানা বাড়িতে। নানা বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট চন্দনা নদী। বর্ষাকাল। বর্ষায় নদীর দু’কুল ছাপানো পানি। পানির স্রোতে দূর থেকে ভেসে আসছে থোকা থোকা কচুরিপানার চাক। সারাদিন ধরে ঝিরঝির করে ঝরছে বৃষ্টি। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। সেই আধো আলোতে জেলে পাড়ার গুরুপদো দাদা মাথায় মান পাতা দিয়ে তার ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে ডিঙি নৌকায় চড়ে, কচুরিপানার বাঁকে বাঁকে কইজাল বিছিয়ে যাচ্ছে। সকাল হতেই সেই জাল তোলা হবে নদী থেকে। সারারাত ধরে সেই জালের গায়ে বড়শিতে আটকাতে থাকবে বিভিন্ন ধরনের জ্যান্ত মাছ, কিন্তু মুক্ত করতে পারবে না নিজেদের! সে এক বিস্ময়কর দৃশ্য! সেই দৃশ্য না দেখলে কেউ বুঝতে কিংবা অনুভব করতে পারবে না। এশা অনুভব করলো তার গায়ে বর্ষার সেই হিম ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে!

পড়া শেষ করে এশা লিখলো, কেঁচো! ভাবতো কেমন লাগবে, তোর সামনে এমন থাকলে?

উত্তরে আবারও ‘হি হি হি’ লিখলো সাদি।

এশা লিখলো, বাস্তবেও এমন পাওয়া যায়।

সাদি লিখলো, এজন্যই তো পাঠালাম। তোমার হোস্টেল জীবনের কিছু লিখতে পারো না এভাবে?

এশা লিখলো, বুধবার দুপুর বেলা শুধুই ঘন মুগডাল দিতো ডাইনিং হলে!

এভাবে আরও দু’চারটে কথা বলে, শুভরাত জানিয়ে মেসেঞ্জার বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে এশা।

ভালো-মন্দ দুইয়ের সমীকরণে মানুষের জীবন। ভালোর সংখ্যা বেশি বলেই পৃথিবীটা এখনও এত সুন্দর! এত মধুর! এশার ভেতরে সেই ভালোর পরিমাণটা একটু বেশি, তাইতো এশা সবকিছু খুব সহজ সরল ভাবে দেখতে পারে। খুব সহজে সবার সাথে মিশতে পারে এবং বন্ধুত্ব গড়ে হাসির বন্যায় ভাসতে পারে।

ঘর থেকে পর ভালো, পরের থেকে জঙ্গল ভালো– এমন প্রবাদ সমাজে প্রচলন থাকলেও এশার কাছে ঘরের মানুষজনকেই বেশি আপন মনে হয়, পর বা জঙ্গলকে নয়। আত্মীয়তার বন্ধন এবং আত্মার বন্ধনকেও কখনও কখনও বেশি আপন মনে হয় এশার। তাই তো চলার পথে এমন দু’চার জনের সাথে এশার পরিচয় হয় এবং পারিবারিক ভাবে সম্পর্কটা এমন এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে, এশার মনে হয় এরা সত্যিকার অর্থেই আত্মার আত্মীয় সম্পর্কীয় আত্মীয়!

কর্ম সূত্রে এশার পরিচয় হয় তৃপ্তি বোসের সাথে। এশা, তৃপ্তি দু’জনেই সরকারি চাকুরে। ব্যাংকের চাকরি জীবনে গল্প করার সময় নেই। তবুও অফিসে পাশাপাশি টেবিলে বসার সুবাদে দুটো একটা কথা বলতে বলতে একদিন ওদের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

যুগের প্রয়োজনে সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। এ যেন এক নীরব যুদ্ধ কার আগে কে যাবে! এ খেলায় নেমে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সৌহার্দবোধ সব ভুলে যাচ্ছি আমরা। আমাদের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে সন্দেহ, হিংসা আর রেষারেষি!

অফিসে ঘরে ঢুকে চেয়ার টেনে বসতে বসতে তৃপ্তিকে উদ্দেশ্য করে এশা বলে, কি হয়েছে গো দিদি? তোমার গোবেচারা বরকে দেখলাম এদিকে তাকিয়ে আছে। আর চোখ দুটো এমন ভাবে চারপাশে ঘুরাচ্ছে তাতে মনে হলো তিনি কিছু একটা খুঁজছেন! তৃপ্তি বলে, যার যা স্বভাব। কিছুই হয়নি। কাজে মন দে।

ঘড়ির কাটা ঘুরে ঘুরে একটার কাছে আসতেই তৃপ্তি বলে, ওঠ, ওঠ একদিন একটু কম কাজ করলে কিছু হবে না। চল চল ক্যান্টিনে, পেটে ছুঁচো ডাকছে। এশা বলে, কী, ব্যাপারটা কী? মাথা টাথা ঠিক আছে তো? সকালে বললে মন দিয়ে কাজ করতে, আর এখন বলছো কাজ না করলে কোন ক্ষতি হবে না! সত্যি বলোতো কি হয়েছে তোমার? অধৈর্য তৃপ্তি বলে, চল না বাবা, গেলেই বুঝতে পারবি। ‘তুমি এগোও আমি আসছি’ বলে কাগজ পত্র গোটাতে থাকে এশা।

তৃপ্তি বোসের বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশি। শান্ত, ঠাণ্ডা সাদাসিদে কোমল স্বভাবের মানুষ। সাজ পোষাকে নেই তেমন কোনো আড়ম্বর। প্রয়োজনের বাইরে তেমন একটা কথা বলে না, বা বলতে ভালোবাসে না। হৈ চৈ না করে নিরিবিলি থাকতেই বেশি ভালোবাসে। ছেলে-মেয়ে দুজনেরই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তারা এখন ব্যস্ত তাদের সংসার নিয়ে।

এশা খুব বেশি চঞ্চল স্বভাবের না হলেও বেশ চঞ্চল। ন্যায্য কথা বলে ফেলে ঠুসঠাস লোকের মুখের উপর!

এশা ক্যান্টিনে ঢুকেই কোণার টেবিলগুলোর দিকে চোখ বোলাতে লাগলো। এশা জানতো তার তৃপ্তিদির নির্জনতায় পছন্দ। বয়সে বড় হওয়ায় এশা তৃপ্তিকে, দিদি বলেই ডাকে। জানালার দিকে তাকাতেই এশা দেখতে পেল তৃপ্তি হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে। টেবিলের কাছে আসতেই এশার চোখ দু’টো বড় বড় হয়ে উঠলো, বিস্ময় আর অবাকে।

একি কাণ্ড করেছো দিদি! এসব আনলে কখন? আজতো আর কাজ করতে পারবো না। এতকিছু খাবার পর আয়েশ করে একটা ভাতঘুম দিতে ইচ্ছে করবে!

তৃপ্তি বলে, তুই সেদিন বলছিলি না, তোর আউশ চালের গরম ভাতের সাথে, ইলিশ ভাপা আর শুকটি ভর্তা খেতে ইচ্ছে করছে। তাই…

এশা তৃপ্তির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, তাই তুমি কাকডাকা ভোরে উঠে এতসব রান্না করে হট বক্সে ভরে এনোছো শুধুই আমার জন্য।

আমিওতো খাবো তোর সাথে। ঠাণ্ডা হলে ভালো লাগবে না। সুযোগ পেলেই বকর বকর। আচ্ছা তোর মুখ ব্যথা করে না! সস্নেহে কথাগুলো বলতে বলতে এশার প্লেটে খাবার তুলে দেয় তৃপ্তিদি।

খাবার মুখে দিতে দিতে এশা বলে, এত সন্দেহ এত অবিশ্বাস এত কথার গঞ্জনা, তারপরও এসব করে আনো? সাবলিলভাবে তৃপ্তি বলে, ভালোবাসি যে তোকে। দু’জনই চুপ করে খাবার খেতে থাকে।

গোধূলির আলো বেয়ে সন্ধ্যা নামার মুখে এশা বাসায় ফেরে বিষণ্ণ মন আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে। যদিও এশার সংসারে তেমন কোনো ঝুট ঝামেলা নেই। স্বামী বেচারা খুব নিরীহ গোছের মানুষ। আর একমাত্র মেয়ে কলেজে পড়ে। কাজের মেয়েটা খুব লক্ষ্মী, সব কিছু ও-ই করে, তার কিছু না করলেও চলে। তবুও সংসারে সকলের ছোট ছোট চাওয়াকে সময় দিতে ভালোবাসে এশা।

দু’দিন ধরে এশা ভাবছে কিছু একটা লেখা উচিত, ভাগ্নি এত করে বলছে যখন! কিন্তু না, এশার মাথায় কোন কিছুই আসে না। ভাসে না পুরনো কোনো স্মৃতি। হোস্টেল জীবন বলে যে কোনো জীবন ছিল, তা মনেই করতে পারে না! তবু সে মনে করার চেষ্টা করে। ঝুল পূর্ণিমার রাতে আসলে কী হয়েছিল! দারোয়ান মামাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে, ওরা ছাদের তালার চাবি নিয়ে ছাদে যেতে চাইলে, কী নিয়ে যেন হট্টোগোল বেঁধেছিল! কিন্তু কী নিয়ে হট্টোগোল বেঁধেছিল শতবার মনে করার চেষ্টা করেও কিছুই মনে করতে পারছেনা। মনের আকাশে বারবার একটি মলিন মুখ আর সন্দেহে ভরা দুটি চোখ ভেসে উঠছে!

এশা সেদিন মুখে কিছু না বললেও, ওর বুঝতে বাকি থাকেনি, ক্যানো তৃপ্তিদির স্বামী পরিমল বোস ওভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল! একসময় এই মানুষটাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করত এশা। কিন্তু, দিন দিন কমে যাচ্ছে সেই শ্রদ্ধাবোধ! তেত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে পরিমলদা ক্যানো তৃপ্তিদিকে সন্দেহের চোখে দ্যাখে, কোনোভাবেই এর হিসেব মেলাতে পারে না এশা।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে এশা জানতে চেয়েছে তৃপ্তির কাছে, তোমার ছেলে-মেয়ে কিছু বলে না তোমাকে? তোমার হয়ে কোনো প্রতিবাদ করে না, তাদের বাবার কাছে? স্বভাবসুলভ মিষ্টি মলিন হাসি দিয়ে তৃপ্তি বলে, সব চেষ্টাই ব্যর্থ! কিছু বলতে গেলেই ওদের বাবা, সাফ বলে দিতো, মায়ের পক্ষ নিলে তোমাদের এ বাড়িতে থাকা চলবে না, মাকেসহ তোমাদের বের করে দেবো! ওরাও তো ছোট ছিল, অসহায় ছিল। আজ ওরা ব্যস্ত ওদের জীবন, ওদের সংসার নিয়ে। তবু ওরা খোঁজ নেয় দু’বেলা। বলে চাকরি ছেড়ে ওদের কাছে চলে যেতে।

একই সুরে এশা বলে ওঠে, তাই করো দিদি। এই যন্ত্রণার জীবন ছেড়ে তুমি চলে যাও ওদের কাছে। নাতি-নাতনিদের নিয়ে তোমার বেশ সময় কাটবে। খুব নির্লিপ্ত গলায় তৃপ্তি বলে, নাহ্, তা হয় না। আমি ছাড়া ওর আর কেউ নেই। এতদিনের সংসার, মায়া পড়ে গেছে তো! মুহূর্তে এশা রেগে যায়, বলে ওঠে, এই জন্যেই, এই জন্যেই তো তোমাদের বাঙালি নারীদের কোনদিন কিছু হয়নি আর সামনে কিছু হবেও না! আমার ভাই যে বলে না, ঠিকই বলে। কী বলে বলবি তো, না বললে জানবো কী করে, তোর ভাই কী বলে আর ঠিক বলে বল, কাজ করতে করতে কথাগুলো বলে তৃপ্তি। গরম তেলে পানি পড়লে যেমন চটর পটর শব্দ করে তেমনি চটর পটর করে এশা বলতে লাগলো, একশ বছর আগে শরৎচন্দ্র বলেছেন, মেয়েরাই মেয়েদের বড় শত্রু আর একশ বছর পরে আমার ভাই বলে, তোরা মেয়েরা স্বামীর হাতে মার খাবি। এসে বাপ-ভাইয়ের কাছে নালিশ করবি। আবার বাপ-ভাই যখন শালিস বসাবে তখন তোরাই পাল্টি খেয়ে বরের পক্ষপাতিত্ব করবি! সব শুনে মিটিমিটি হাসতে হাসতে তৃপ্তি বলে ওঠে, ওরে আমার জ্ঞানী ভাইয়ের জ্ঞানী বোন, অনেক হয়েছে থামেন এবার।

তৃপ্তি যতই হাসুক তৃপ্তির হাসিতে একটা কষ্ট লুকানো আছে, এশা টের পায়। এশার থেকে তৃপ্তি বছর দশেকের বড়। বয়সে বড় কিংবা জাত-ধর্ম এগুলোর কোনোটা ওদের দু’জনের বন্ধুত্বে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাইতো ওরা দু’জনেই ওদের জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে শেয়ার করতে পারে।

এশা না থেমেই বলে, তোমার তো চাকরি ছিল, তুমি দু’ছেলে মেয়েকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকলেই তো পারতে। তা না করে প্রতিদিন মার খেয়ে মার হজম করো ক্যানো? তৃপ্তি খুব সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেয় ক্যানো বাড়ি ছাড়েনি বা ছাড়তে পারেনি। তৃপ্তি বলে, ছোটবেলায় বাবা-মা আমাকে ছেড়ে চলে যান পরপারে। অন্যের আশ্রয়ে মানুষ হয়েছি। নিজে থেকে জীবনে শখ আহ্লাদ কোনো কিছুই করিনি। কোনো কিছুর অভাব না বুঝলেও বাবা মার স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা কখনো পাইনি। একটা শূন্যতা একটা কষ্ট ছিল সব সময়। আমি হয়তো সবটা দিয়েই ওদের মানুষ করতে পারতাম কিন্তু আমি চাইনি, আমার কারণে আমার সন্তানরা তাদের বাবার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হোক। তাদের মনে আমায় নিয়ে কোনো ক্ষোভ বা কথার জন্ম হোক। সমাজ আর কিছু না পারুক কাদা ছিটাতে বেশ ভালো পারে। ইচ্ছে যে দু’একবার করেনি তা নয়। সব ভেবেই আর আলাদা কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। এখন তো তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছি!

তৃপ্তির যখন বিয়ে হয় তখন বয়স সবে আঠারো! এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে মামা বাড়ি বেড়াতে গেলে দু’দিনের মাথায় তার বিয়ে হয়ে যায় এক কাস্টম অফিসার পরিমল বোসের সাথে। বাবা-মা না থাকায়, অন্যের আশ্রয়ে আশ্রিতা হয়ে যারা মানুষ হয় তাদের ভালোলাগা মন্দলাগার কোনো মূল্য থাকে না, তাদের আর্তনাদ কারো মর্মমূলে গিয়ে পৌঁছায়ও না! তেমনই হয়েছে তৃপ্তির বেলায়। বামা-মা ছিল না, কাকা, মামার আশ্রয়ে বড় হয়েছে তাই নিজের ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তাদের ইচ্ছেকে মূল্য দিতে হয়েছে।

সংসারে কিছু মানুষ থাকে যাদের অকারণ বাতিক, অন্যদের সন্দেহ করা। অন্যের খুঁত ধরা। পরিমল বোস তেমনই একজন মানুষ। অযথা সন্দেহ তার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য! তার অন্তরের কালির খবর বাহির থেকে বোঝার উপায় নেই বরং কর্মক্ষেত্রে তার সুনামই আছে বেশ খানিকটা। তার যত রাগ, ক্ষোভ সবটাই তার বউ তৃপ্তির উপর।

তৃপ্তির জীবনে কোনো কিছুই তার ইচ্ছেতে হয়নি। সে জানতেও পারেনি তাকে না জানিয়েই তার বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল তার মামা-কাকারা। পড়া শেষ না হতেই তাই বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। বিয়ের পর এক প্রকার জোর করেই বি কম ভর্তি করে দেয়, আবার বি কম পাশ করার পর জোর করেই ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকিয়ে দেয় স্বামী পরিমল। শুরু হয় দ্বন্দ্ব! শুরু হয় সন্দেহ!

তখনো তৃপ্তির দু’চোখ জুড়ে দুরন্ত কৈশোরের স্বপ্ন। স্বামী, সংসার বোঝে না। সংসার বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মামা-কাকার সংসার। আর বকা খাওয়ার ভয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে ভাই-বোনদের সাথে দুষ্টামী করা! সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে সমর্পণ করে মন্ত্রচ্চারিত জীবনের কাছে!

দু’দিনের ছুটি শেষ। সকাল থেকেই ঝির ঝির বৃষ্টি। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অফিস করা বিরাট এক ঝক্কির ব্যাপার। বৃষ্টির হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর সব চেষ্টা করলেও মুখ, মাথা, চুল ভিজে যায় এশার।

বৃষ্টির কারণে অফিস আসতে দেরী হয়। তারও পর দু’দিনের পরে থাকা কাজ, সব মিলিয়ে মাথায় যেন পাহাড় সমান বোঝা! ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে, মুখ, মাথা মুছতে যাবে, ততক্ষণে তৃপ্তি নিজের আঁচলটা দিয়ে এশার মুখ, মাথা মুছে দেয় গভীর স্নেহে। অফিসের অনেকেই তাদের এই ভালোবাসা, ভালোভাবে হজম করতে পারে না। হঠাৎ তৃপ্তি বলে ওঠে, এশা, আজ বিকেলে একটু সময় দিবি? তোর সাথে একটু বাইরে ঘুরবো। বিস্ময়ে এশা তৃপ্তির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, সত্যিই যাবে? কাঙ্গালের মতো তৃপ্তি বলে ওঠে, হ্যাঁ।

ছুটি কাটানোর পর, এশা ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাজ নিয়ে। তৃপ্তির সাথে বেশি কথা না বললেও খেয়াল করে, তৃপ্তির চেহারাতে একটা বিষণ্ণ ভাব, চোখের দৃষ্টি একটা সান্ত্বনা খুঁজছে। একটা সময় এশা ডুবে যায় কাজের ভেতর। খেয়াল করতে পারে না তৃপ্তি তার টেবিলে নেই।

তৃপ্তিকে না পেয়ে, এশা একাই ক্যান্টিনে আসে। ক্যান্টিনে ঢুকে খুঁজে নেয় তৃপ্তিকে। তৃপ্তি নিজ থেকে কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময় এশা প্রশ্ন করে, তৃপ্তিদি তোমার বাম হাতের কালো দাগটা কিসের?

আজ, আরও একটু বেশি শান্ত তৃপ্তি। অব্যক্ত একটা যন্ত্রণায় নিজেকে ঢেকে কোথায় যেন হারিয়ে যায় নিমেষে। এশা, তৃপ্তির হাতে হাত রেখে বলে, কি হয়েছে তোমার! বুকের গভীর থেকে একটা আর্তনাদ, একটা হাহাকার অদ্ভুত আবেগী আওয়াজে বের হয়ে আসে তৃপ্তির গলা থেকে। তৃপ্তি বলে, জানিস ও না আগে এমন ছিলো না। যখন বিয়ে হয় তখন তো সংসারই বুঝি না, কোনো কাজ পারি না তবুও একটা সুখ, একটা শান্তি ছিলো ভয় পাওয়া দুরুদুরু বুকে। একে একে খোকা, খুকি জন্ম নিলো, আর আমাদের সংসারটা আরও বেশি হাসি আনন্দে ভরে উঠলো। একটা সময় টের পেলাম আমার জীবনে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ও, ওকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু–
কিন্তু কী দিদি?

একটা সময় টের পেলাম ও বেশ বদলে যাচ্ছে। শুরুতে ওই অফিসে নামিয়ে দিয়ে যেত। কখনো কখনো নিয়েও আসত। একটু একটু করে টের পেতে থাকি, কুৎসিত এক অন্ধকারে নিজেকে ঘিরে রেখেছে ও। একটু দেরী হলেই অকারণ সন্দেহ, চিল্লাচিল্লি আরও কত কি! কখনো কারো সাথে কথা বলতে দেখলে কী করতো ও নিজেই জানতো না! শেষটাতে বাচ্চাদের সাথে পর্যন্ত একই ব্যবহার করতে লাগলো।

কথায় কথায় কতটা সময় পার হয়ে গেলো ওরা তা খেয়াল করেনি। সব প্রশ্নের উত্তর একজীবনে পাওয়া যায় না বা উত্তর পাওয়া সম্ভবও নয়। তবু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। নিজের অজান্তে এশা বলে বসে, কখনো জানতে চাওনি, দাদা এমন করে ক্যানো? তৃপ্তির দৃষ্টি সীমানা ছাড়িয়ে শূন্যে। আজ নিজেকে উজার করে সব বলতে ইচ্ছে করে তৃপ্তির। তৃপ্তি বলে, এই অশান্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য একদিন চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি, বাড়ির সবকিছু তছনছ করে রণক্ষেত্র করে রেখেছে। পরে জানতে পারি, ম্যানেজার ওকে ফোনে সব জানিয়ে, আমার ইস্তফার কাগজটা বাতিল করে দিয়েছে। ওর ধারণা আমিও ওকে ফাঁকি দিচ্ছি, আমিও ওকে ছেড়ে চলে যাবো!

আকাশটা আজ অকৃপণভাবে বৃষ্টির ধারা দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত পাপ, কালিমা ধুয়ে মুছে শুদ্ধ, পবিত্র করে তুলছে। কষ্টের আচ্ছন্নতায় ডুবে তৃপ্তি বলে, ওতো সিজোফ্রেনিয়ার রুগী! ঢেউয়ের ধাক্কার মতোন নিষ্ঠুর এক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একটা বেদনায় এশার সমস্ত শরীর অবশ, অচেতন হয়ে আসে!

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu