বেশকিছুক্ষণ যাবৎ তেলচটচটে বালিশটাকে আঁকড়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি কিন্তু ঐ চোখদুটোকে যেন কোনোভাবেই পোষ মানাতে পারছিলাম না। প্রায় ঘন্টা দুই সময় ধরে এভাবেই এক হাত বেডের আধ হাত জায়গায় এপাশ-ওপাশ করেই যাচ্ছি। চোখজুড়ে তন্দ্রা নামে আর হৃদয়জুড়ে নামে পুরনো দিনের স্মৃতি। একটা অজো পাড়া গাঁ। একটা অতি সাধারণ পরিবার। ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়। এরকম একটা অবহেলিত পিছিয়ে পড়া গ্রাম থেকে দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসাটা আমার জন্য মোটেও সুখকর ছিলো না।
হলের একটা ডাবল রুমের এককোণে একটা শক্ত বেডের আধ হাত সম জায়গাটাই এখন আমার ঠিকানা। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পূর্বে কিনা ভেবেছিলাম আর আজ বাস্তবতাই বা কী? এমন প্রশ্নের হিসেব মিলাতে গেলে হিমশিম খেয়ে যাই। আরো বেশী হিমশিম খাই যখন চোখেরে সামনে দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নীতি নৈতিকতা ও আদর্শকে এহেনভাবে পদদলিত হতে দেখি। ভাবতে গেলেই ফুসফুসের কপাট ভেঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস নেমে আসে আমার।
ঘুম আসছে আসছে করে মধ্যরাত পেরিয়ে এখন ভোর রাতের দিকে সময় গড়াচ্ছে। সারা গায়ে ব্যথা অনুভব করছি। রুমমেটদের সবাই দিব্যি ঘুমুচ্ছে, কেবল ঘুম নেই সারাক্ষণ স্বপ্নের মাঝে ডুবে থাকা এই স্বপ্নবাজের। ঘুম আসছে না বলে অতি সন্তর্পণে রুমমেটদের ডিঙ্গিয়ে বাইরে চলে আসলাম। রুমের সামনেই পায়চারি করছিলাম আর জ্যোৎস্না ভরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আপনাকেই যেন খুঁজছিলাম। হঠাৎ নীরবতা ভেঙ্গে কিছুটা দূরের এক রুমের সামনে থেকে একটা আবছা ছায়ামূর্তির পায়ের আওয়াজ কানে আসে। খুব একটা মনোযোগ না দিয়ে আগের মতো করে জ্যোৎস্না দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণ কাটতেই করিডোর থেকে সেই ছায়ামূর্তির টুকটাক শব্দ ভেসে আসছে। কিছু একটা দিয়ে অনবরত মাথায় আঘাত করার মত আবছা ছায়া দেখা যাচ্ছে। যেন নিজের অজান্তেই সমস্ত শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো আমার, কিছুটা ভীত সন্ত্রস্ত। নিজেকে এক জায়গায় স্থির রাখতে না পেরে আস্তে আস্তে ঐ ছায়ামূর্তির দিকে এগুতে লাগলাম আমি। কাছে গিয়ে কোনো কিছুই দেখতে না পেয়ে আরো বেশী অবাক হলাম, পাশাপাশি তখন বড্ড ভয় কাজ করছিলো আমার। বেশ অবাক হয়ে ফিরে আসলাম। আসতে আসতে বার বার পেছন ফিরে তাকিয়ে তাকিয়ে কিছু একটা যেন দেখার চেষ্টা করছিলাম, প্রথমে দূর থেকে মৃদু জ্যোৎস্নার আলোয় যা দেখেছিলাম তাই। মনের মধ্যে একটা দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে সেই আগের জায়গাতেই ফিরে আসলাম আমি। ক্রমশ জ্যোৎস্নার আলোটা ফিকে হয়ে আসছে। সেই সাথে হলের করিডোরটা যেন হাজার বছরের পুরনো ভূতুড়ে করিডোরে রূপ নিচ্ছে।
মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি ফজরের আজানের খুব বেশী একটা সময় বাকি নেই। মনে হচ্ছে যেন চোখদুটো আপনা আপনি বুজে আসছে আমার। মনে হয় শরীরটা একটু এলিয়ে দিতে পারলে ঘুমের রাজ্য চলে যাবো আমি। রুমে গিয়ে দেখি আমার গুণধর বেডমেট পুরো বেড দখল করে আয়েশে ঘুমুচ্ছে। এমন গভীর ঘুমের মধ্যে কিছুতেই ওরে সরিয়ে ঘুমানোর আর ইচ্ছে হলো না আমার। উপায়ন্তর না দেখে আবারো অন্ধকার করিডোরের দিকে বের হয়ে আসলাম। এবার আর জ্যোৎস্নার ফিকে আলোটাও নেই। তবে কেমন যেন একটা মৃদু হাওয়া গায়ে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। শেষরাত্রির রহমতের হাওয়া। মাওলানাদের মুখে শুনেছি শেষরাতে নাকি আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং তার বান্দাদের নাম ধরে ধরে ডাকেন এভাবে… কে আছিস অসুস্থ আমার কাছে চাও আমি তোমাদের সুস্থ করে দিবো, কে আছিস অভাবগ্রস্থ আমার কাছে চাও আমি তোমাদের অভাব দূর করে দেবো। আমি মহান আল্লার কাছে কত কিছু যে চেয়ে নিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সৃষ্টিকর্তার কাছে একটা একটা জিনিস চেয়ে নিচ্ছি আর তার পাওয়ার আনন্দটা অনুভব করছি ঠিক এমন সময় অগত্যা আবার সেই ছায়ামূর্তি এবং আগের ন্যায় মাথায় আঘাত করার মতো শব্দ। এবার যেন আমি আগের তুলনার আরো বেশী সতর্ক আরো বেশী অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠলাম। কী ঘটছে? তার রহস্য উদ্ধার করতে হবে। আস্তে আস্তে সেই ছায়ামূর্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমি কিন্তু একি আমাকে আগের চেয়ে দ্বিগুণ অবাক করে দিয়ে আমার কাছে যাওয়ার সাথে সাথে ছায়ামূর্তিটাও দূরে সরে যাচ্ছে। আমার হৃদস্পন্দন আকস্মিক বাড়তে শুরু করলো। ইতোমধ্যে ছায়ামূর্তিটি করিডোর শেষ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে। আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নই। পিছন পিছন সেই ছায়ামূর্তিটাকে অনুসরণ করে চললাম। এক এক করে পাঁচতলা ছয়তলা পেরিয়ে ছায়ামূর্তিটি একেবারে হলের ছাদে চলে গেছে। ছাদের শেষদিকটার দিকে কাঁটাবনের কাছাকাছি অংশে গিয়ে ছায়ামূর্তিটি বসে পড়লো। এখন কিছুটা অস্ফুট আলোয় ছায়া মূর্তিটিকে পরখ করে দেখতে লাগলাম। একি! এ তো লেলিন ভাই। আমাদের বিদ্রোহী কবি লেলিন ভাই! গত বৎসর ঠিক এমন দিনে একটা চাকরির জন্য বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে হলের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, সেই লেলিন ভাই! ঠিক এই জায়গাটা থেকেই লাফ দিয়েছিল তিনি। ইচ্ছে করছিলো চোখ বুজে দেই দৌড়, কিন্তু ক্রমশ পা দুটো অবশ হয়ে আসছিল।
মুহূর্তের ঘোর কাটতে না কাটতেই হাতে একটা রক্তভেজা চিঠি দিয়ে লেলিন ভাই আবার নিচের দিকে নামতে শুরু করলেন। আমি যেন এক গোলকধাঁধায় আটকে আছি। নিজের অজান্তেই আমি ভাইকে অনুসরণ করতে লাগলাম। হলের মেইন গেইট পেরিয়ে যাওয়ার সময় লেলিন ভাই আমাকে আঙ্গুল দিয়ে আকাশের দিকে কিছু একটা ইশারা করলেন। আমি তার ইশারা মানে বুঝলাম না। তখন মসজিদের মাইক থেকে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে, আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম। লেলিন ভাই মল চত্বর হয়ে নিউমার্কেট পেরিয়ে আজিমপুরের দিকে হাঁটতে লাগলেন। আমি তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছি।
সকালবেলা ঘুম ভেঙ্গে দেখি রুমমেটরা সব ক্লাসে চলে গেছে, কেবল রিজন ঘুমাচ্ছে। আমি এক দৌড়ে হলের ছাদে চলে আসি কিন্তু লেলিন ভাই নেই, নেই তার কোনো পদচিহ্ন, নেই কোনো আল্পনা। চিঠিটার কথা মনে আসতেই আবার রুমে দৌড়ে গেলাম। টেবিলে একটা চিঠি রাখা। আমি ব্যতিব্যস্ত হয়ে খুলতেই দেখি তাতে গাঢ় রক্তবর্ণে লেখা…
“Mr Lelin khan is promoted to afterworld from this world”