রফিকুর রশীদ
জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, মেহেরপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৮৩ সালে সিলেটের এক চা বাগানের অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার হিসেবে শুরু হয় তার কর্মজীবন। মন টেকেনা চা বাগানে। যোগ দেন কলেজ শিক্ষকতায়। এখানো আছেন সেই পেশাতেই, মেহেরপুরের গাংনী কলেজে। একান্ত নিভৃতে কাব্যচর্চা দিয়ে লেখালেখির সূত্রপাত হলেও সত্তর দশকের শেষভাগে পত্রপত্রিকায় গল্প লিখেই আত্মপ্রকাশ সাহিত্যজগতে।
রফিকুর রশীদ

রফিকুর রশীদের গল্প

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

দর্পণ-এর গল্পবিষয়ক বিশেষ সংখ্যা ‘শিশিরভেজা গল্প’-তে প্রকাশিত


মেয়েটির খুব বদনাম ছিল

রফিকুর রশীদ


মেয়েটির খুব বদনাম ছিল।

আমাদের এই দেশে তো মেয়েদের বদনাম রটনার চেয়ে সহজ কাজ আর কিছু হয় না। জন্ম থেকেই শুরু হয় বদনাম দিয়ে। গর্ভবতী মায়ের কন্যা সন্তান দানকে কে কবে হৃষ্ট চিত্তে নিতে পেরেছে! সবাই ঠোঁট উল্টে বলেছে, ‘অমুকের মেয়ে হয়েছে।’ মেয়ে হওয়াটাই বড় বদনাম। তারপর থেকে পায়ে পায়ে বদনাম তার। একটুখানি বড় হয়ে ওঠার পর পান থেকে চুন খসলেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়। অধিকাংশ মানুষ চোখ কপালে তুলে রে রে করে তেড়ে ওঠে–’ছি ছি, অতখানি সেয়ানা মেয়ে…।’

মেয়েটির বদনাম ছিল একেবারে গোড়া থেকেই। ছোটবেলায় মা-বাবাকে খুব জ্বালিয়েছে। মানবশিশুর পক্ষে যত প্রকারে জ্বালাতন করা সম্ভব, তার একটা দিকও সে বাদ রাখেনি। ভয়ানক ডানপিটে দুর্দান্ত ডাকাবুকো। পাড়ার এক দঙ্গল ছেলেমেয়ের সঙ্গে হই চই করতে করতে তার বেড়ে ওঠা। দু’তিন বছরের ছোট কিংবা বড় হলেও ক্ষতি নেই, সবার সঙ্গে তুই-তোকারি, সবার সঙ্গে গলায় গলায় ভাব। যে বয়সে মেয়েরা পুতুলখেলা কিংবা ঘরকন্নার নকল খেলায় মত্ত থাকে, এই মেয়েটি সেই বয়সে পছন্দ করত–গুলতি হাতে গাছের ডালে পাখি শিকার করা অথবা নাটাই হাতে নদীর ধারে ঘুড়ি ওড়ানো। ঘুড়ির লড়াইয়ে তার খুব আনন্দ। কিন্তু কেউ ইচ্ছে করে গোত্তা লাগিয়ে দিলে কিংবা ঘুড়ির সুতো কেটে দিলে রক্ষা নেই, ঘুসি পাকিয়ে তেড়ে আসবে সে, তীব্র আক্রমণে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে। এত যে দুরন্তপনা, তবু তার ভেতরে কী যেন এক অব্যাখ্যেয় মায়া-মমতার জাদু ছিল, কেউ তার উপরে রাগ করে থাকতে পারত না। সকাল হবার সাথে সাথে সবাই আবার মিলেমিশে একাকার। তবুও মেয়েটির খুব বদনাম ছিল।

গ্রামের প্রাইমারি স্কুল পেরিয়ে মেয়েটি যখন এ নদীর ওপারে শহরের হাইস্কুলে ভর্তি হয়, তখন রাজ্যের সমুদয় বদনামও সেই নতুন স্কুলের দরজায় গিয়ে আছড়ে পড়ে। বলা যায় সশরীরে সে পৌঁছুনোর আগেই তার নামের সঙ্গে লেপ্টে থাকা বদনামগুলো হুটোপুটি করে পাল্লা দিয়ে পৌঁছে যায়। সে স্কুলে যাবার পর বেশ কটা পরিচিত মুখের দেখা পায়, তারা আগেই এসে ভর্তি হয়েছে, যেনবা এই বিশেষ বন্ধুটিকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যেই তাদের এই আগেভাগে আসা। নতুন পরিবেশে নতুন বন্ধু জুটতেও দেরি হয় না। বলতে দ্বিধা নেই, এই নতুন স্কুলেও মেয়ে-বন্ধুর চেয়ে তার ছেলে-বন্ধু জুটে যায় বেশি সংখ্যায়। অল্পদিনেই তারা আসর গুলজার করে ফ্যালে বিশাল বন্ধু-সার্কেলের মধ্যে। তাদের প্রাণখোলা হই-চই আনন্দ-উচ্ছ্বাসে একটুখানি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসেন স্কুলের গেমস্যার, সব চেয়ে তরুণ শিক্ষক আবুল মাসুদ মিন্টু স্যার। ও বাবা, নিয়ন্ত্রণ করবেন কী, দিনে দিনে তিনিও দিব্যি যুক্ত হয়ে পড়েন তাদের বৃত্তে, মেতে ওঠেন নানা রকম খেলাধুলা নিয়ে, ইন্টার-স্কুল স্পোর্টসে লড়তে যান, সব মিলিয়ে অন্য রকম ব্যাপার স্যাপার। খেলাধুলায় স্কুলের সুনাম বৃদ্ধি পেতে থাকে, কিন্তু মেয়েটির বদনামের কোনো তারতম্য হয় না।

দিন যত যায় তার বদনামের গায়ে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়, নতুন রঙ ধরে। মানুষের মুখে মুখে নানান প্রশ্ন নানান কৌতূহল; তাতে তার কিছুই যায় আসে না। তাদের গ্রাম থেকে শহরের স্কুলে যাওয়া-আসার পথে নদী পার হবার খেয়াঘাট আছে দুটো। অধিকাংশ মানুষ যায় থানাঘাট হয়ে, সে যাবে যাদবপুর ঘাট হয়ে। স্কুলে যাবার আগে সেও যাবে থানাঘাট হয়ে, ফেরার সময় সে আসবে যাদবপুর ঘাট হয়ে। কেন, কী আছে ওই ঘাটে? সহযাত্রী বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ চেপে ধরলে অবলীলায় সে জানায়–বাঁশিওয়ালা আছে।

বাঁশিওয়ালা! সে আবার কে? অনেকেরই চোখ কপাল–থাকে কোথায়?

আছে, আছে। সে রহস্য করে।

কারো কারো খুবই কৌতূহল, কী নাম সেই বাঁশিওয়ালার?

কিছুতেই সে গিট খোলে না, ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, নাম তো জানিনে, শুধু তার বাঁশি শুনেছি।

একজন বলেই ফ্যালে, বাব্বা! তুই কি তার প্রেমে পড়েছিস?

খিলখিলানো হাসিতে সে শিউলি ঝরিয়ে দেয়। প্রেমে পড়ার ব্যাপারটা ওই বয়সে বুঝে ওঠার কথা নয়, তবে আকাশ-কুসুম কল্পনা এবং কৌতূহল যথেষ্ট আছে। লজ্জ্বা-দ্বিধা আছে তার চেয়ে বেশি। তবু সে দিব্যি জানায়, না না, প্রেমে পড়তে এখনো ঢের দেরি আছে।

শেষে দু’জন গোয়েন্দা প্রকাশ্যেই তার পিছু নেয়, থানাঘাটের বদলে তারাও চলে আসে যাদবপুর ঘাটে। রহস্যের কিছুই কিনারা হয় না। সেই এক বাদল পাটনির খেয়া নৌকায় পারাপার। নদীর পাড়ে বটতলায় সাপ খেলার ঝাঁপি নিয়ে আসর বসিয়েছে এক সাপুড়ে। লোকজন গোল হয়ে ঘিরে ধরেছে, শোনা যাচ্ছে ডুগডুগির বাজনা, কে যেন ভাঙা গলায় গান গাইছে–’খা খা বক্ষিলারে খা…।’ কিন্তু সে বাঁশি কোথায়!

বেশ কয়েক মাস নিবিড় অনুসন্ধানের পর গোয়েন্দাদের একজন আবিষ্কার করে বাঁশিওয়ালা আর কেউ নয়, বাদল পাটনির ছেলে রতনের মাথায় সুরের খেয়াল চাপলে একাকী বাঁশি বাজায়। বড্ড খেয়ালি মানুষ। ইচ্ছে হলে বটতলায় বসে যায় বাঁশি হাতে, আবার ইচ্ছে হলেই উধাও। কোথায় যায়, কোথায় থাকে, সে খবর বাড়ির লোকও জানে না ঠিকঠাক। মাইল দুয়েক পশ্চিমে হরিণবাঁধা মাঠ পেরোলেই ভারতীয় সীমানা, অনেকের ধারণা–রতন গোপনে ইন্ডিয়ায় যায় ওস্তাদের কাছে বাঁশির তালিম নিতে।

মেয়েটির বদনাম হবে না কেন, ওইটুকু বয়সে রতনের বাঁশি শুনে এভাবে মজে যাবার কোনো মানে হয়! আবার হাজার শুধালেও সে কথা স্বীকার করবে না সে। গোপন করতে গেলেই তো মানুষের সন্দেহ বাড়ে। সেই সন্দেহের কথা শুনে হি হি করে হাসিতে লুটিয়ে পড়ে, দু’হাত নেড়ে জানায়, রতন নামের কাউকে নাকি সে চেনেই না। তার বদনামের ডালপালা বর্ষাকালের গাছগাছালির মতো অতি দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে, ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর দূর পর্যন্ত। নইলে ক্লাস সেভেনের ধাপ পেরোতে না পেরোতেই সবার প্রিয় গেমস্যারকে জড়িয়ে এমন উল্টোপাল্টা বদনাম কেন রটতে যাবে! স্কুলে কি আর কোনো মেয়ে নেই! বলতে গেলে প্রতিটি ক্লাসেই তার চেয়ে রূপবতী একাধিক ছাত্রী আছে। কই, তাদের নামে তো এমন বিশ্রী ইঙ্গিত কেউ কখনো করে না! কমনরুমের দেয়ালে গেমস্যারের নামের সঙ্গে যোগচিহ্ন দিয়ে আর কারো নাম লেখা হয় না, লেখা হয় সেই একজনের নাম। যে-ই লিখুক চক দিয়ে, কেন লেখে? প্রায় ভিত্তিহীন সন্দেহের বশে হেডস্যার এ জন্যে ক্লাস নাইনের কামরুলকে বেদম প্রহার করেন,
বেতের ঘায়ে বেচারার পিঠের চামড়ায় রক্ত ফুটে বেরোয়, কিন্তু এ অপরাধের দায় সে মোটেই কবুল করে না। কামরুলকে সন্দেহ করার ছোট্ট একটি সূত্র অবশ্য ছিল। কবে নাকি বইয়ের ভাঁজে ছোট্ট একটি চিরকুট সে চালান করেছিল এবং সে-চিরকুট ধরাও পড়েছিল স্যারদের কাছে। তবে কি সেই জন্যে কমনরুমের দেয়ালে এই মেয়েটির নামের পাশে যোগ চিহ্ন দিয়ে সে গেমস্যারের নাম লিখতে যাবে! কী যে অদ্ভুত যুক্তির ধারা! যাকে নিয়ে এত সব ঘটনা, সেই মেয়েটি কিন্তু একেবারেই নির্বিকার, ভাবলেশহীন।

এত সব বদনামের পাঁক-পঙ্কিলতার মধ্য দিয়েই মেয়েটির বেড়ে ওঠা। তার মা-বাবা গ্রামের সাধারণ মানুষ, মেয়ের বদনামের তপ্ত হাওয়া তাদের গায়েও লাগে। কানে আঙুল দিয়ে কতক্ষণ থাকা যায়, কতদিন! সকল বদনামকে মাটি চাপা দিতে তারা মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কানে কানে সে বার্তা রটেও যায় চারিদিকে।

সে তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। চোখে রঙ ধরার বয়স। আকাশে ডিগবাজি মেরে বশিষ্ঠ নক্ষত্রকে ছুঁয়ে দেখার সময়। গার্জেন বললেই গুটিসুটি মেরে বিয়ের পিঁড়িতে বসার পাত্রী তো সে নয়। হাত-পা ছুঁড়ে তো দেখতেই চাইবে। তার দাবি অবশ্য বেশি কিছু নয়। অন্ততপক্ষে স্কুল ফাইনালে অংশ গ্রহণের সুযোগ চায়। তারপর নার্সিং পড়ার আকাঙ্ক্ষা। মানব সেবার মহৎ পেশা হিসেবে নার্সিং সম্পর্কে বিশদ কিছু জানার অবকাশ গ্রামের মেয়েদের হবার কথা নয়। কিন্তু তার সে সুযোগ হয়েছিল। তার মায়ের দ্বিতীয় সন্তান প্রসবের সময় টানা সাতদিন মায়ের সঙ্গে হাসপাতালবাসের সময় খুব কাছে থেকে নার্সদের কার্যকলাপ সে দেখতে পায়। তখন থেকেই তার সাদা পোষাকের ফুলপরি হবার সাধ জাগে।

সব সাধ কবে পূরণ হয়েছে কার! তাহলে তো অপ্রাপ্তি বা অতৃপ্তি বলে কিছুই থাকত না! আর যে মেয়ের পায়ে পায়ে বদনামের বেড়ি, তার ইচ্ছের মূল্য দেবে কে? কাজেই বিয়ের কথা বহাল রইল। পরপর দুটো প্রস্তাবও জুটে গেল বেশ। পাশের গ্রাম রাজাপুরের মান্নান প্রতিদিন নদীর ওপারে শহরে গিয়ে বিরাট এক কাপড়ের দোকানে দর্জির কাজ করে। তার পৈতৃক অবস্থা ভালো না হলেও বর্তমান আয়-ইনকাম মোটেই খারাপ কিছু নয়। ঘটককে সে জানিয়েছে পথ চলতে চলতে এই মেয়েকে অনেকবার দেখেছে, নতুন করে দেখাশোনার কিছু নেই; গার্জেন রাজি থাকলে অল্প দিনের মধ্যেই বিয়ে করতে চায়। এ প্রস্তাবে পাত্রীপক্ষের আপত্তি নেই বললেই চলে। তবু বিয়ে বলে কথা, ভাবনা চিন্তার জন্যে একটু সময় নেয়া হয়। আর তাতেই বাধে গেরো। থানাঘাটে খেয়া পারাপারের সময় থানার এক অল্প বয়সী পুলিশের সঙ্গে নাকি এই মেয়ের পরিচয় এবং প্রণয় পর্যন্ত হয়েছে। থানাঘাট এড়িয়ে মেয়েটি যেদিন যাদবপুর ঘাটে খেয়াপার হয়, সেদিন এই পুলিশটিও মোটরসাইকেল হাকিয়ে চলে যায় যাদবপুর মোড়ে। অনেকে তাদের কথাবার্তা বলতেও দেখেছে। গায়ে পুলিশের পোষাক দেখে কেউ মুখ খোলার সাহস দেখায়নি। সেই পুলিশও বিয়ে করতে চায় মেয়েটিকে। বর্তমান স্টেশন থেকে তার বদলির কথা চলছে, সেই অর্ডারটা হাতে এলেই সে বিয়ে করে বউ নিয়ে যাবে নতুন কর্মস্হলে, সেখানেই বাসা বাঁধবে। চাকরিজীবী জামাই পাওয়া কি কম ভাগ্যের কথা। তাও কিনা পুলিশের চাকরি। ‘মাছের মধ্যে ইলিশ, আর চাকরির মধ্যে পুলিশ ‘ সেরা এ কথা কে না জানে! মেয়েটির বাবা যখন এ নিয়ে গভীর চিন্তিত সেই সময়ে শহর থেকে স্কুলের গেমস্যার সাইকেল ঠেলে এক সন্ধ্যায় জানতে আসেন তাঁর ছাত্রী স্কুলে যাচ্ছে না কেন? সামনে এ্যানুয়াল স্পোর্টস যে!

প্রিয় স্যারকে কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়েটি। আকুল আবদার জনায় সে, আমাকে বাঁচান স্যার।

ডুবন্ত মানুষ যেভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে অবলম্বন হিসেবে, মেয়েটির হয়েছে সেই দশা। সে হড়বড় করে জানায়, আমার বিয়ে দিয়ে দেবে স্যার। স্কুলে যেতে দেবে না।

মেয়েটির বাবাও সহসা গেমস্যারকে আঁকড়ে ধরে। মেয়ে সেয়ানা হয়ে উঠছে, কাজেই মেয়ের বিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় সে দেখছে না। এখন তার মুশকিল দুই দিকের দুই পাত্র নিয়ে। সে পরামর্শ চায় গেমস্যারের কাছে–এখন তার কী করণীয়! কোনদিকে যাবে সে!

মনে মনে হাসেন গেমস্যার। তার পরামর্শ কিআদৌ নেবে এই লোকটি! মাথায় ঢুকেছে মেয়ের বিয়ের ভূত। সেই ভূতের হাত থেকে তার রক্ষা নেই। স্কুলের শিক্ষক তার ছাত্রীকে স্কুলে যেতে বলবে, পড়াশোনা করতে বলবেসব সমস্যার সমাধান খুঁজবে এই ফর্মুলার মধ্যে; কিন্তু এ সব তার ভালো লাগবে কেন! ভালো লাগবে না জেনেও গেমস্যার দুম করে বলেই ফেলেন, মেয়ে নিয়মিত স্কুলে গেলেই সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।

বাবার মুখে ফুটে ওঠে আতঙ্ক, খেয়াঘাট থেকে যদি পুলিশে থাবা মেরে তুলে নিয়ে যায় মেয়েকে? এতক্ষণে আচনক তথ্য জানায় মেয়েটি। থানার ওই পুলিশের সঙ্গে তার নাকি কোনো প্রকার সম্পর্কই নেই। শুধু একদিন সে পথ আগলে নাম ধাম জানতে চেয়েছিল, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু বদনামের বেড়ি যার পায়ে বাঁধা, সে যাবে কত দূর! যেখানে যাবে, যত দূরে যাবে, বদনাম তার সঙ্গেই যাবে।

‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’-র দশা যেমন, অনেকটা সেই রকম। যে পথে যাবে সে গন্ধ ছড়াতে ছড়াতেই যাবে । শৈশব থেকেই মেয়েটির খুব বদনাম ছিল, যৌবনের প্রথম ধাপে পা দিতে না দিতেই তার পা হড়কাবে এতে আর অবাক হবার কী আছে! বদনাম তো রটবেই যার যা মুখে আসবে তাই সে রটিয়ে দেবে, তার মুখে হাত দিতে যাবে কে! জ্বলন্ত উনুনের মুখে হাত দেবার চেয়ে সেটা শক্ত কাজ। সে কাজ সহসা কেউ করতে যায়! কাজেই বদনামের আগুন চৈতী বাতাসে হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে, ছড়াতেই থাকে।

মেয়েটির বিয়ের ঘটনা নিয়ে কত যে রহস্য আর বদনাম হাত ধরাধরি করে দ্রুত পায়ে ছড়িয়ে পড়ে, তার কোনো হিসেব-নিকেশ নেই। আগ্রহী দুই পাত্রের মধ্যে তুল্যমূল্য বিচার বিবেচনা করে তার বাবা যখন একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে, তখনই বদনামের বড় বোমাটি বিস্ফারিত হয়। শোনা গেল স্কুলে যাবার নাম করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে সে আর বাড়ি ফেরেনি। বিয়ের আগে স্কুলে যাওয়া কেন? কী দরকার স্কুলে? মা-বাবার উপরে খুব জোর খাটিয়েছে, কাঁদাকাটি কিংবা ঝগড়াঝাটি–কিছুই বাদ নেই। অবশেষে বিয়েতে সম্মতি জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, এই শেষবারের মতো স্কুলে যাবে, আবার বিকেল নাগাদ ঠিক ফিরে আসবে। কিন্তুনা, সে আর বাড়ি ফেরেনি।

এইবার বদনামের ষোল কলা পূর্ণ হয়। বদনাম রটনার কাজে মানুষের কল্পনাশক্তি যে কতটা প্রখর আর সৃজনশীল হয়ে উঠতে পারে, তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল এই মেয়েটির নিরুদ্দেশ হবার পর থেকে। গোভীপুরের স্বভাবকবি ইনসার উদ্দিন এই ঘটনা নিয়ে পয়ার ছন্দের কবিতাও লিখে ফ্যালে দু’পাতা। হাটে-মাঠে-ঘাটে গ্রাম্য সেই কবিতা তাৎক্ষণিক জনপ্রিয়তাও লাভ করে। কিন্তু নিরুদ্দিষ্ট মেয়েটির কোনো সন্ধান-সুতো কেউ আবিষ্কার করতে পারে না। তাদের স্কুলের কেউ তাকে দেখেনি সেদিন, কোনো ছাত্রছাত্রীর নজরেই পড়েনি ; গেমস্যার তো আকাশ থেকে পড়ার মতো অবাক হন। নিজ উদ্যোগে ছুটে যান থানায়, অন্যতম আগ্রহী পাত্র সেই পুলিশটির সঙ্গে কথা বলেন; কোনো কাজ হয় না। থানায় ডায়েরি করার পরামর্শ দিয়ে সে গেমস্যারকে বিদায় করে। কী আশ্চর্য ঘটনা–একজন মানুষ এ চরাচর থেকে উধাও হয়ে গেল দিবালোকে, কেউ জানবে না কোনো খবর! স্কুলে সে যাক বা না যাক, স্কুলের নাম করেই তো বাড়ি থেকে বরিয়েছে! থানাঘাট বা যাদবপুর ঘাটের পারানি-পাটনি কেউ কিছু বলতে পারে না। দু’জনের কেউ নাকি তাকে সারা দিনে দেখেইনি। কানকথার উপর ভর করে বাদল পাটনির ছেলে বাঁশিওয়ালা রতনেরও খোঁজখবর সংগ্রহ করা হয়। না, সে বাড়ি নেই। সাতদিন আগে বাঁশি হাতে কোথায় যে গেছে, কেউ সে কথা জানে না। সাতদিন আগেই উধাও! সময়ের সঙ্গে সমন্বয় হয় না।

দু’ তিন মাস পরে কোথা থেকে কী ভাবে যেন খবর ভেসে আসে–নিরুদ্দিষ্ট এই মেয়েটিকে দেখা গেছে দর্শনায়, রেলবাজারে। সে রিক্সায় চেপে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। সঙ্গে কেউ ছিল না? এবার সংবাদদাতা আরো অবাক করা তথ্য জানায়। তার সঙ্গে নাকি মোশতাক বিহারির ছেলে মনজিলকে দেখা গেছে। অনেকে তাকে নাদিম বলেও ডাকে। ঊর্দু ছবির নায়ক নাদিমের সঙ্গে চেহারার সাদৃশ্যের কারণে মুখে মুখে এই নামকরণ হয়েছে তার। স্কুলের গন্ডি পেরুনোর আগেই লেখাপড়ার পাট গুটিয়ে বাবার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। মোশতাক বিহারি দর্শনার কেরু কোম্পানির সুগারমিলে মেকানিক্সের কাজ করেছে জীবনের অর্ধেকটা সময়। চিফ ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে গোলমাল করে চাকরি ছেড়ে সে চলে আসে মেহেরপুরে, বড়ভাই মোহাম্মদ কসাইয়ের কাছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানে সংসার বাঁধলেও সে ভাইয়ের পেশা গ্রহণ করেনি। বড় বাজারের এক গলির মধ্যে ইলেক্ট্রিক্সের দোকান দিয়ে বসেছে। বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি বিক্রির পাশাপাশি সেলাইকল পাওয়ার টিলার হ্যাজাক লাইট প্রভৃতি যন্ত্রপাতি সারাইয়ের কাজও সে খুব যত্নের সঙ্গে করে। মেকানিক্স হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেলে মনজিলকে সে হাতে ধরে এই কাজ শেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু কালিঝুলি মাখা কাজে ছেলের বড়ই আপত্তি। নায়ক নাদিমের মধ্যে নিজেকে আবিস্কারের পর মিস্তিরিগিরি কি ভালো লাগে! তবে সে মাঝেমধ্যে দোকানে বসে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিক্রির কাজে বাবাকে সহযোগিতা করে। তা সেই মনজিল ওরফে নাদিমের সঙ্গে ভৈরবপারের গ্রাম গোভীপুরের এই সাধারণ মেয়েটির সম্পর্ক কী! অঙ্ক মেলে না কিছুতেই। প্রত্যক্ষদর্শী জোর দিয়ে বললে মেয়েটির বাবা তখন কী করে! প্রবাদ আছে ‘গরু হারালে শোকার্ত কৃষক নাকি কলসের মধ্যেও গরু খোঁজে।’ কন্যাহারা বাবারও তো সেই একই দশা। অল্প কয়েক ঘর বিহারির বাস আছে বটে মেহেরপুরে, তাদের কারো সঙ্গেজানাশোনা নেই তার, মনজিলের খবর সে পাবে কেমন করে!

এর ওর মাধ্যমে নানান ডালপালা ধরে মোশতাক বিহারির কাছে পৌঁছানোর পর জানা গেল, মনজিল গেছে সৈয়দপুরে, মেজো খালার বাড়ি।

সৈয়দপুরে তার খালাবাড়ি হতেই পারে, সেখানে বিহারিদের বিরাট আস্তানা, অনেক প্রভাব। ভয়ে ভয়ে জানতে চায়, এখান থেকে মনজিল গেল কবে?

মোশতাক বিহারি চোখ পিটপিট করে তাকায়। তার চোখের উপরের ভুরু জোড়া সজারু কাঁটার মতো নড়ে ওঠে। কোনো উত্তর দেয় না।

সেদিন কি সোমবার ছিল?

দু’আঙ্গুলের ফাঁকের জ্বলন্ত সিগারেটে জোরে দম কষে মোশতাক বিহারি উল্টো প্রশ্ন করে, কী ব্যপার বোলো তো!

সত্যিকারের ব্যাপারটা যে কী, কেন এই খোঁজাখুঁজি সে কথা আর খোলাসা করে বলা হয় না। তবে কথার ফাঁকে জানা যায় দর্শনায় মনজিলের মামাবাড়ি, তারই মামাতো ভাই অবাঙালি হয়েও ছাত্রলীগের রাজনীতি করে, জয়বাংলা বলে স্লোগান দেয়। এই সব নিয়ে তাদের মধ্যে সাংঘাতিক পারিবারিক বিরোধ আছে, অশান্তি আছে।
কাজেই মনজিলের পক্ষে দর্শনায় যাবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

মেয়েটির নামের সঙ্গে আরো অনেক বদনাম যুক্ত হতে তখনো বাকি। এত শিগগিরই তাকে খুঁজে পেলে চলবে কেন! দেশে তখন চরম উত্তেজনা। সামনে ভোট। বহু প্রতীক্ষিত এবং প্রত্যাশিত সাধারণ নির্বাচন। গোটা বাঙালি জাতি মেতে উঠেছে নির্বাচনী ডামাডোলে। ছাত্র-যুবকেরা লেখাপড়া, এমন কি খেলাধুলার চেয়ে বড় করে দেখছে এই নির্বাচনকে। অফিস-আদালতের অফিসার কেরানি উকিল পর্যন্ত ফাইলের কাজের চেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে নির্বাচনকে। কলকারখানার শ্রমিক এবং ছোট বড় ব্যবসায়ীরাও রাস্তায় নেমে এসেছে নির্বাচনের জন্যে। গ্রামগঞ্জের কৃষক-তাঁতি-জেলে সবাই ভাসছে নির্বাচনী হাওয়ায়। সবার বুকে আশা ভরসার বাতি জ্বালিয়েছেন প্রিয় নেতা শেখ মুজিব। সবার প্রিয় বঙ্গবন্ধু। মিথ্যে মামলায় সরকার তাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল। এ দেশের ছাত্র-জনতা রুখে দিয়েছে সেই অপচেষ্টা। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে মওলানা ভাসানী ঘোষণা দিয়েছে–’জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’ সারা জাতির বুকের ভেতরে সেই তালাভাঙা আবেগ টগবগ করে ফুটছে, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তারা স্বৈরাচারী সরকারকে দাঁত ভাঙা জবাব দিতে চায়। নির্বাচনী প্রচারণার প্রবল জোয়ারে গোভীপুর গ্রামের ঘরপালানো মেয়েটির কেচ্ছা কাহিনি এক রকম আড়ালে চাপা পড়ে যায়। এমন কি স্বভাবকবি ইনসার উদ্দিনও তার জনপ্রিয় পয়ার ছেড়ে জনগণের প্রত্যাশার ভাষা অনুযায়ী আসন্ন নির্বাচন এবং আশা-ভরসার প্রতীক নৌকা মার্কা নিয়ে নিত্যনতুন গান বেঁধে যাদবপুর ঘাটের বটতলায় দাঁড়িয়ে উদাত্ত কন্ঠে ছড়িয়ে চলেছে। মানুষ সেই গান মুখে মুখে বয়ে নিয়ে চলেছে গ্রাম-গ্রামান্তরে, পথে-প্রান্তরে।

তবে বদনামেরও নিজস্ব একটা ধর্ম আছে, নিঃশেষে নিভে যায় না, ঘুঁটের আগুনের মতো দৃশ্যমানতার আড়ালে ধিকি ধিকি জ্বলতেই থাকে। পেট গুড়গুড়ি রোগের মতো, ভালো আছে ভালো আছে, কখন যে নিম্নগামী বেগ এসে ফাসিয়ে দেবে সে কথা বলা মুশকিল। সর্বদা বদনামের সঙ্গে বসবাস করা মেয়েটির ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং নির্বাচনী ডামাডোলে সবাই যখন মহাব্যস্ত, অন্য কোনো দিকে মনোযোগ দেবার অবকাশ কারো নেই, তারই মধ্যে নির্বিরোধী এক ব্যক্তি সহসা একদিন অতিশয় নির্দোষ ভঙ্গিতে দুর্গন্ধযুক্ত নর্দমার ঢাকনা আলগা করে দেয়। বলব না বলব না ভাব দেখালেও অতি কৌশলে সে কুৎসিত কথাটি ঠিক পরিকল্পনামতো ছড়িয়ে দেয়। সে নাকি ঢাকা থেকে ফেরার পথে গোয়ালন্দ ঘাটে নাকি দৌলতদিয়ায় ঘর-পালানো এই গ্রামের মেয়েটিকে দেখেছে। একই গ্রামে জন্ম-বেড়ে ওঠা, তার দেখায় কোনো ভুল নেই। এখন বেশ স্বাস্থ্যবতী হয়েছে, ঢলো ঢলো লাবণ্যমাখা চেহারা। গ্রামের ইজ্জতের কথা ভেবেই এ কথা প্রকাশ করতে তার খুব দ্বিধা যে মেয়েটি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, সে এখন নিষিদ্ধ পল্লির বাসিন্দা।

সত্যি সে এক আশ্চর্য সময় এসেছিল আমাদের এই চরাচরে। নির্বাচনের আর কয়েক দিন বাকি, বঙ্গোপসাগরের রাক্ষুসী জলোচ্ছ্বাস অকস্মাৎ দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষকে গিলে খেয়েছে, তবু সবার মুখে মুখে নির্বাচনী আলোচনাই চলছে, এর বাইরে অন্য কিছু শুনতে কেউ রাজি নয়। ফলে গোভীপুর গ্রামের মানুষ মুখরোচক দিল্লির লাড্ডু হাতে পেয়েও সেদিকে মনোযোগ দেবার অবকাশ পায় না। সে কারণে এত বড় বদনামটা পিঠের উপরে চাপিয়ে দেবার পরও সেটা সেই মেয়েটির গায়ে মাখে না, সময়ের স্রোতে ভেসে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়।

অথচ মেয়েটির খুব বদনাম ছিল সেটাই সত্যি।

সীমাহীন বদনামের অথই বেনোজলে নিমজ্জিত এবং দেশের উথাল পাথাল রাজনৈতিক ঢেউয়ের তোড়ে বিস্মৃতপ্রায় মেয়েটিকে অনেকদিন পর পাওয়া গেল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত শহর মেহেরপুরেই। ততদিনে যুদ্ধ শুরু হয়েছে সারা দেশে, বাঙালির মুক্তির যুদ্ধ। পাকিস্তানি সৈন্যরা অস্ত্রের জোরে দখল করে আছে গোটা দেশ। তারা ছড়িয়ে পড়েছে এ দেশের শহর-নগর-গ্রামে। মেহেরপুরেও তারা আস্তানা গেড়েছে নজরুল স্কুল, ভোকেশনাল এবং কলেজে।

প্রতিদিন অভিযানে যায় গ্রামে গ্রামে, সঙ্গে থাকে এ দেশীয় রাজাকার ও বিহারি; হত্যা অগ্নিসংযোগ লুটপাট নারীনিগ্রহ তাদের নৈমিত্তিক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের অত্যাচারে ভৈরবের পশ্চিম পারের গ্রাম গোভীপুর যাদবপুর-রাজাপুর-রাধাকান্তপুর জনশূন্য হয়ে পড়েছে। অগ্নিদগ্ধ বসতভিটে ছেড়ে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে সীমান্তের ওপারে।

মেহেরপুর তখনো গ্রামের আঁচল সরিয়ে ফেলে পুরোপুরি শহর হয়ে ওঠেনি, তার শরীর জোড়া গ্রাম্যতার ছাপ তখনো স্পষ্ট। ওয়াপদার মোড় থেকে কালিবাজার হয়ে কোর্টপাড়া পর্যন্ত বিস্তৃত মিউনিসিপালিটির এইটুকু এলাকার মানুষ জন সবাই সবার চেনাজানা। বাঙালি-বিহারি কি হিন্দু-মুসলমান কেউ কারো অচেনা নয় বললেই চলে। এরই মধ্যে গেরিলা যোদ্ধারা সীমান্ত পেরিয়ে দেশের মধ্যে ঢুকছে, গ্রামে কিংবা শহরে তারা বাগে পেলে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করছে, দু’একটা রাজাকার ধরে দৃষ্টান্তমূলক সাজাও দিচ্ছে; তাই বলে মোশতাক বিহারির বাড়িতে হানা! পাকিস্তানি মেজরের সঙ্গে তার সখ্যতার কথা কে না জানে! নিজের ছেলে মনজিলকে শুধু নয়, দর্শনা-চুয়াডাঙা থেকে আরো বেশ ক’জন বিহারি যুবককে এখানে নিয়ে এসে বিশেষ ব্রিগেড গঠন করেছে। প্রথমে দোভাষীর দায়িত্ব নিয়ে এলেও এই ব্রিগেড অচিরেই হয়ে ওঠে সব চেয়ে বড় নিপীড়ক বাহিনী। মনজিল তাদের প্রধান। খোঁজ নিয়ে এ সব তথ্য জেনেশুনেই কোনো এক শ্রাবণদিনে মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে মোশতাক বিহারির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। যুদ্ধের শুরুতেই জ্বরাজীর্ণ পুরাতন বাড়ি ত্যাগ করে সম্ভ্রান্ত এক হিন্দুর পরিত্যক্ত বাড়ি দখল করেছে সে। শোনা যায় স্বাধীন বাংলা বেতারের অভিনেতা বাবুয়া বোসের দ্বিতল প্রাসাদটি দখলে নেবার চেষ্টায় আছে মনজিল। হয়তো সে সফলও হবে অল্পদিনেই। সব দিকের খোঁজখবর নিয়ে একেবারে সময়মতো হাজির হয় কামরুল। ভাগ্যক্রমে মনজিলের স্ত্রী নিজেই ভিক্ষে দিতে আসে। গেরিলারা সময় নষ্ট করে না। তাদের থিওরি–হিট এ্যান্ড রান। গৃহকর্ত্রীর চোখে চোখ রেখে কামরুল ঝটপট বলে ফেলে, কুসুম, আমি কামরুল।

গৃহকর্ত্রী আপাদমস্তক চমকে ওঠে, আগন্তুকের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলে, কামরুল ভাই!

হ্যাঁ, ক্লাস নাইনের কামরুল।

তুমি এখানে?

একদিন আমি তোর জন্যে হেডস্যারের হাতে মার খেয়েছি, আজ আমার জন্যে তোকে ঝুঁকি নিতে হবে।

কুসুমের দু’চোখ কেঁপে ওঠে। তার কন্ঠে স্ফুট হয় আর্তনাদ, তোমার বিপদ হবে কামরুল ভাই। তুমি এখান থেকে যাও।

কামরুল বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলে ওঠে, তুইও কি বিহারি হয়ে গেছিস কুসুম?

দু’চোখ ছলছল করে ওঠে কুসুমের, বুঝিবা একটুখানি ফুঁপিয়েও ওঠে সে। কামরুল আশ্বস্ত করে,
ভয় নেই, তোর স্বামীকে মারতে আসিনি। আমরা যুদ্ধ করছি দেশের জন্যে। দেশের কথা ভেবে তুইও আমাদের সহযোগিতা করবি কুসুম।

আমি কোথায় যাব বলতে পার কামরুল ভাই! আমার তো মা-বাপ কেউ নেই। কোথায় যাব আমি?

গোভীপুর অপারেশনের দিন গ্রামের আরো পনের জন নিরীহ মানুষের সঙ্গে কুসুমের মা-বাবাকেও হত্যা করে বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা। সে খবর তাহলে কুসুমের কানেও পৌঁছেছে! মুখটা নামিয়ে কামরুল বলে,
তুই এখানেই থাক কুসুম। এখান থেকেই আমাদের সহযোগিতা করবি। আর্মির গতিবিধির খবর সংগ্রহ করে দিবি।

কুসুম এতটাই আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে যে স্থান-কালের সীমাবদ্ধতা ভুলে সে খপ করে হাত চেপে ধরে কামরুলের, অদ্ভুত এক দাবি জানায়, আমাকেও নিয়ে চলো ভাই। মেয়েমানুষ কি যুদ্ধ করে না?

কামরুল একটু গলা চড়িয়ে বলে, হ্যাঁ, করে। কিন্তু তোর যুদ্ধ এখানেই। আমি আবার আসব ইনফরমেশন নিতে। তোকে খুব দরকার হবে বোন।

আর একটুও দাঁড়ায় না কামরুল। ভিক্ষের ঝুলি টেনেটুনে ঠিকঠাক করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। তার কানের দরজায় লেপ্টে থাকে কুসুমের ব্যাকুল কন্ঠস্বর–’আমাকেও নিয়ে চলো ভাই! ‘

মাথার উপরে শ্রাবণ আকাশ নুয়ে আছে মেঘভারে। যে-কোনো মুহূর্তে নামতে পারে বৃষ্টিধারা। তবু তাড়াহুড়ো করার কোনো উপায় নেই কামরুলের। সে এখন ন্যাংড়া ভিখিরি, জোর করে হাঁটলে তো চলবে না। নকল গোঁফ দাড়ির আড়াল থেকে কামরুলকে এতদিন পরে কুসুম এক ডাকেই চিনল কী করে! তবে কি তার ছদ্মবেশ নিখুঁত হয়নি? নাকি অতি সংগোপনে মনের কোনো নিভৃতে কোণে স্কুলজীবনের দুরন্তপনার স্মৃতি ধরে রেখেছে বলেই কামরুলকে চিনতে কুসুমের একটুও দেরি হয়নি! কত যে বদনামের বোঝা বয়ে চলেছে এই মেয়েটি! আজো কিন্তু জানা হয়নি–অবাঙালি মনজিল তাকে কব্জা করেছিল কোন মন্ত্রে! কেউ জানে না কুসুম সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর কেমন করে মনজিলের খপ্পরে পড়েছিল! ব্যাপারটার মধ্যে কতটা জবরদস্তি আর প্রতারণা ছিল, তাই বা কে জানে! নাকি নায়ক নাদিমের চেহারার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কুসুম নিজেই সর্বনাশের অনলে ঝাঁপ দিয়েছিল! তার তো বদনামের সীমা-পরিসীমা ছিল না কখনোই।

সবাই জানে, মেয়েটির খুব বদনাম ছিল।

সে রাতে নিজস্ব শেল্টারে ফিরে আসার পর কামরুলের মনে হয়–একদিন কুসুমের গোয়েন্দাগিরি ধরা পড়ে যেতে পারে মনজিলের কাছে। তখন কি সে স্ত্রীবলে ক্ষমা করবে তাকে! নাকি ভেট হিসেবে তুলে দেবে পাকিস্তানি মেজরের খাসকামরায়? তখনও কি তার খুব বদনাম হবে? কী সেই বদনাম হতে পারে? কুসুম স্বেচ্ছায় আর্মি ক্যাম্পে গিয়েছিল মেজরকে দেহদান করতে? কেন, তা সে করতে যাবে কেন? কী স্বার্থ তার?

সবাই তখন এক কথায় বলবে–মেয়েটি চরিত্রহীন ছিল যে!

কামরুল পরের দফায় দেখা করতে গিয়েও কুসুমের কাছ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়। দু’দিনের মধ্যে কবে কোন এলাকায় আর্মিদের অপারেশন আছে, কবে রেশনের গাড়ি মেহেরপুর থেকে বামুন্দি ভাটপাড়া ক্যাম্পে যাবে, এ সবেরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তবু সে হুট করে জিগ্যেস করে বসে,
সত্যি তুই যুদ্ধে যাবি কুসুম?

কুসুম খুব স্থিরভাবে জানায়, যুদ্ধের মধ্যেই তো আছি, এই যে তোমাদের সঙ্গে আছি।

কামরুল খুব অবাক হয়ে যায় উচ্চারণের এ রকম স্বচ্ছতায়। এই তো মাত্র সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই কুসুমের মধ্যেকী যেন একটা পরিবর্তন এসেছে। কত সহজেই সে বলতে পারে, বদনাম তো আমার হবেই জানি, তবু আমার যুদ্ধটা আমাকে করতে দাও। দালাল তো আমার সঙ্গেই আছে ভাই, ওই মেজর পর্যন্ত আমি একবার দেখতে চাই। এ জন্যে আমাকে একটা পিস্তল যোগাড় করে দিও।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu