রুবেল প্রায় চার শতাংশ জমি আর একটা টিনের ঘর পেয়েছে। আজই সে তার বাড়িতে উঠেছে। কিন্তু চোখে ঘুম আসছে না।
রুবেলের এই অভিজ্ঞতা জীবনে একেবারেই নতুন এবং ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। ছোটবেলা থেকেই সে পরের বাড়িতে মানুষ হয়েছে। কোনোদিন মাটির সাথে সম্পর্ক ছিল না। কোনোদিন কোথাও একটা গাছ লাগায় নাই। এমনকি একটা বীজও বপন করে নাই। কোনোদিন গাছে উঠে ফল পাড়ে নাই। গাছেই সে ওঠে নাই। আজ সে চার শতাংশ জায়গাসহ একটা ঘর পেয়েছে। ছোটবেলা সে বাবাকে হারিয়েছে। বাবা শুধু নিজেই চলে যান নাই। দুরারোগ্য লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তিনি জমি-টমি বেচে দিয়ে পরিবারটাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেছেন।
রুবেল বড় হয়েছে মামাবাড়ি। মামিদের আচরণে ছোটবেলা থেকেই তার কইলজা চিপি খেয়ে আছে। কথায় কথায় তার মরা বাবাকে নিয়ে তারা বাজে কথা বলত। মায়ের সাথে তাদের অনেকবার ঝগড়াও হয়েছে। এসব দৃশ্য দেখে সে স্কুলে যেত-আসত আর সারাদিন ঘরের ভিতর চুপচাপ থাকত। মামাতো ভাই-বোনদের সাথে মিশতই না। ছোটবোন রুনার সাথে ঘরেই থাকত। তবে রুনা ছিল বেহায়া। সে বড় মামা, মেজ মামা, ছোট মামা সবার ঘরেই যেত। রুবেল বিষয়টা তখন ভাবত না। এখন সে বোঝে রুনার বুদ্ধি ছিল তার চেয়ে বেশি। বাবা নাই, মামাদের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে ভবিষ্যতের ভারও মামাদের হাতে পড়বে। কোনো চাচা জীবিত নাই। চাচাতো বোনেরা ঢাকায় আলিশান বাড়ি-গাড়ি নিয়া পরের মতোই আছে। যোগাযোগ নাই।
রুনার চিন্তায় ভুল ছিল না। ওকে ভালো সম্বন্ধ দেখে মামারা বিয়ে দিয়ে দিয়েছে মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার আগেই। জামাই ইউরোপকান্ট্রিতে থাকে। বাড়িঘরের অবস্থাও ভালো। রুনা দেখতে সত্যি অনেক সুন্দর। মামাদের যৌতুকের বোঝা বইতে হয় নাই। রুবেলের সমস্যা হয়েছে– আসলে বলা ভালো গোপন সমস্যাটা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে– মায়ের মৃত্যুর পরে। এইচএসসি রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার আগেই মা মারা গেলেন। গ্যাসট্রিক-আলসার আগে থেকেই ছিল। তার ওপর হার্ট অ্যাটাক।
একেবারেই এতিম হয়ে রুবেল ভবঘুরের মতো বন্ধুদের বাড়ি রাত কাটাতে শুরু করল। ছোটবেলা থেকে সে মামা-মামিদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলত বলে তাদের কাছ থেকে এ সময় রূঢ় আচরণ পেতে লাগল। বাইরে রাত কাটানোর কারণে তারা অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পরে পাস করার সংবাদটা নিয়া রুবেল রুনার সাথে দেখা করতে গেল। রুনা শ্বশুরবাড়ি ভালোই আছে।
এতিম ভাইটাকে ভবঘুরের মতো দেখে ঐশ্বর্য আর প্রাচুর্যে নিমজ্জিত রুনার চোখেও পানি এসে গেল। সে প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলল, “কিরে ভাই, পাস করছত? তুই ফোন করোছ না; আমি ফোন করলেও ধরোছ না। কী অবস্থা হইছে তোর, খাওয়া-দাওয়া করোছ না?”
রুবেল কোনো কথা বলল না। শুধু নিজ হাতে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি ঢেলে খেয়ে দামি গেলাসটার দিকে চেয়ে রইল। রুনা বুঝল তার ভাই কান্না লুকাতে চাইছে। সে বলল, “বড় মামি বলল তুই বাড়িতে থাকোছ না। বাইরে বাইরে রাত কাটাছ। মামাগো বাড়িতে থাইকা তাগো লগে রাগ কইরা পারবি?”
রুবেল এবারও কোনো কথার উত্তর দিল না। সোফায় হেলান দিয়া চোখ বন্ধ করে বসে রইল। এমন সুন্দর সোফায় বসে রুনা! ছোট মামিদের বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া সোফায় আইসক্রিমের রস ফেলেছিল বলে রুনাকে একবার মামি চড় দিয়েছিলেন। রুনা সত্যিই বেহায়া ছিল, না হলে আবার সেই ঘরে কেউ যায়! আজ রুনার ঘর কত সুন্দর। দোতলা দালান। শ্বশুরদের ঢাকায় ব্যবসা। ওর জামাই ডেনমার্কে আছে। ওকে নিয়ে যাবে। কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। ওকে হলেই নিয়ে যাবে।
রুনা রুবেলকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইল না। শুধু জিজ্ঞাসা করল, “ভাই, ভাত খাবি? দেই?”
রুবেল অনেক গভীর থেকে গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বলল, “দিবি? দে।”
“টেবিলে গিয়া ব।”
মাটিতে ছালার চটে বসে, জলচৌকিতে বসে বা বিছানায় পাটিতে বসে সারাজীবন ভাত খেয়েছে রুবেল। কোনো বন্ধুর বাড়ি হয়ত ডাইনিং টেবিলে খেয়েছে। কিন্তু এত দামি টেবিল কখনো দেখে নাই। কাঠের ফ্রেমে পাথর বসানো টেবিল। রুবেল চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। খাওয়া শুরু করার আগে জোহর নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে এসেছেন ঘিয়ারঙা পাঞ্জাবি পরা তালইসাহেব। রুবেল সালাম দিয়া জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছেন?”
তালই বললেন, “ভালো আছি। তুমি কেমন আছে তালই?শুনলাম তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট দিছে!”
“জ্বি, পাস করেছি। বেশি ভালো না। এ পাইছি।”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ। এখন কী করবা চিন্তা করতাছো?”
“দেখি কী করা যায়, কই ভর্তি হইতে পারি।”
রুবেলের হাত ধোয়া হয়ে গিয়েছিল। দেখে তালই বললেন, “আগে খাওয়া দাওয়া কর, পরে কথা বলা যাবে।”
রুনাকে বললেন, “বউ, তালইরে দেইক্কা-দুইক্কা খাওয়াইয়ো।” এই বলে তিনি চলে গেলেন।
তালইর সাথে দেখা হল, কিন্তু মাঐয়ের সাথে হল না। রুবেল রুনাকে জিজ্ঞাসা করল, “তোর শ্বাশুড়ী বাড়িতে না?”
“না। আজ সকালে আমার বড় ননাসের বাড়ি গেছে।”
খেতে খেতে রুবেল ভাবল, দুনিয়াতে সবাই সুখী। শুধু আমিই না। না আমি একলা না, আমার মাও সারাটা জীবন দুঃখ পেয়ে গেছেন। বাবাও কত কষ্টে সংসার চালাইছেন। খাওয়া শেষ করে বিছানায় শুলো রুবেল। কিন্তু ঘুম এল না। সে এক ফাঁকে রুনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করল, “তুই কি জানোছ, মামাগো বাড়িতে জাগা আছে কতখানি?”
“না, জানি না।” অন্যমনস্কভাবে উত্তরটা দিয়েই রুনা সতর্ক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ক্যান?”
“না কিছু না। এমনিতেই।”
এর পরে রুবেল আর বেশিক্ষণ রইল না রুনার শ্বশুরবাড়ি। আসার সময় তালইয়ের সাথেও দেখা করল না। রুনা রুবেলের হাতে দুটি হাজার টাকার নোট দিয়া বলল, “নে ভাই, এখন এইটা রাখ। তুই ফোন করিস। আর মামাদের সাথে মিলে যাওয়ার চেষ্টা কর।”
রুনার বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পরে রুবেলের দুই চোখ ফেটে পানি এল। বারবার হাতের তালুতে মুছল। দুইজন ভাইবোন এতিম। কিন্তু তাদের মধ্যেও আজ দেয়াল। রুনা ধনী আর রুবেল নিঃস্ব। সে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা চলে গেল। রামপুরায় রেহানা আপাদের বাড়ি। জীবনে কোনোদিন যায় নাই। রেহানা আপা রুবেলের চাচাতো বোন। বড় কাকার মেয়ে। রেহানা আর রেশমা দুটি মেয়েই শুধু বড় কাকার। তারা নাকি অনেক ধনী। রেহানা আপা রামপুরা থাকেন। রুবেলের কাছে ফোন নম্বর ছিল না, বাসার নম্বর জানা ছিল না। শুধু একটা স্কুলের ঠিকানা মনে রেখে সেখান থেকে কয়েকটা বাড়ি এদিক-সেদিক খুঁজে পেয়ে গেল রেহানা মঞ্জিল। নিচ তলায় কয়েকটা গাড়ি। এগুলো কি ভাড়াটেদের নাকি আপাদেরও কে জানে। রিসেপশনে কথা বলে তেতলার ফ্ল্যাটে উঠে আপার সাথে দেখা করল।
রেহানা আপা বয়সে অনেক বড়। গ্রামে সবাই বলে ‘পুরীর বড় মাইয়া’। চুলে পাক ধরেছে। শরীরও ভীষণ মোটা হয়ে গেছে। বাবা মারা যাওয়ার পরে চারদিনের মিলাদে দেখা হয়েছিল। রুবেলকে দেখে রেহানা আপা প্রথমে ঠিক চিনতে পারে নাই। পরিচয় পাওয়ার পরে আপা বলল, “কাকি মারা যাওয়ার পরে যাইতে পারি নাই। মনটা খারাপ হইছিল। তুই এইবার পরীক্ষা দিছস না, কেমন হইছে?”
“এ পাইছি। রেজাল্ট জানাইতে আইলাম আপনার কাছে।”
কথাটা রেহানার মনে গেঁথে গেল। সত্যি তো রুবেল আর কার কাছে যাবে? রেহানা জানে মামা-মামিদের সঙ্গে রুবেলের ছোটবেলা থেকেই বনিবনা নাই। পরম আদরে বলল, “ব ভাই, ব। তুই তো আহছ না। তোর দুলাভাই মাঝে মাঝেই তোর কথা জিগায়, রুনার কথা জিগায়। ও কেমন আছে রে?”
“আছে বেশ ভালোই আছে।”
“যাক আল্লাহ সবারে ভালা রাখুক। তুই তো মাঝে মাঝে আসতে পারোছ। এখন কী করবি? কোথায় ভর্তি হবি? কী করবি? ব। তোর সাথে কথা আছে।”
রুবেল দেখছে তার বোনেরা ভালোই আছে। সেই ভালো নাই। রেহানা আপা নিজে নানা রকম খাবারের আয়োজন করে ফেলল। এত অল্প সময়ে এত কিছুর আয়োজন কেমনে করে সে অবাক না হয়ে পারল না। পরে আপা একান্তে জিজ্ঞাসা করল, রুনার বিয়েতে দেওয়া-থোওয়া কী হয়েছিল এইসব ব্যাপারে। রুবেল জানাল, “না, তেমন কিছু দিতে হয় নাই।”
“মামাবাড়িতে তোর মায়ের ওয়ারিশ নাকি তোর মামারা আগেই লিখিয়ে নিছে?”
রুবেল অবাক হয়ে বলল, “জানি না তো!”
রেহানা আপা বলল, “হ রে ভাই। আমি খবর সবই রাখি। কাকি মারা যাওয়ার আগেই তোর মামারা তার কাছ থেকে লিখে নিছে।”
রুবেল আশা করেছিল মামাদের কাছে এই ব্যাপারে কিছু দাবি করবে। এখন শোনে এই কাহিনি। রেহানা রুবেলের পরবর্তী সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তবে আপা নিজেই বুঝল যে, রুবেল এখন ঠিকানাহীন। সে বলল, “এখন তুই কী করবি? কোথায় থাকবি?”
“জানি না আপা। আমি চাইছিলাম আর পড়া হবে না। ঢাকায় এসে কোনো কাজ করমু।”
“আরে না। তুই ভর্তি পরীক্ষা দে। আমার এখানে থাকতে পারবি? বিড়ি-সিগ্রেট নিশা-টিশা নাই তো? এখানেই থাকতে পারবি। আমার দুইটায় সারাদিন ফেসবুক নিয়া থাকে। মাইয়াটায় তো ইডেনে পড়ে। আর পোলাডায় এইবার আইএ দিব।”
রুবেল মনে মনে একটা ঠিকানা পেল। রেহানা আপা একটু পরে বলল, “শোন তোরে যে জন্য খুঁজছিলাম। তুই তো আহোছ না। একটা গোপন কথা বলি কারো কাছে বলবি না। এখন তো তোর পাও রাখার জাগা নাই। তুই একজন উকিলের লগে কথা ক। আব্বায় তো মারা গেছে কাকার মারা যাওয়ার আগে। আমরা আব্বার ঘরে শুধু দুই মাইয়া। আব্বা আগে মারা যাওয়াতে আর কোনো পোলা না থাকাতে কাকার বেরাদরি হক আছে আব্বার সম্পত্তিতে। তুই আলাপ কইরা জিনিসটা বাইর করতে পারস কিনা দেখ। কাকার হকেরটা তুই আর রুনা পাইবি, বুঝলি?”
রুবেলের চোখ অবিশ্বাসে ভরে উঠল। রেহানা আপা বলছে, “আমাগ ইনশাল্লাহ বাপের বাড়ির ওয়ারিশ না নিলেও চলব। তোর দুলাভাই তো একেবারে এসবের নামও শুনতে পারে না। কিন্তু তোর রেশমা আপার জামাইটা ওয়ারিশ খাওনের জন্য পাগল হইয়া রইছে। তুই থাকতে জামাইগো দেওন দরকার কী? রেশমার জামাইর কি কিছু কম আছে? এরপরেও এত্ত লোভ? এখন তোরই বেশি দরকার ঠিক না? তুই আমার কথামতো কাজ কর। লাভ হইব।”
রুবেলকে অবশ্য কিছু করতে হয় নাই। রেহানা আপাই ঢাকায় বসে লোক লাগিয়ে সব ব্যবস্থা করেছে। তারপর ভাগাভাগিতে দাদার আমলের ঘরটাসহ রুবেলের ভাগে প্রায় চার শতাংশ জমি পড়েছে। চালের ওপর একটা পুরনো আমগাছ। সামনে গাছ লাগানোর মতো জায়গা আছে। পাকা পায়খানা, কল, পুরনো রান্নাঘর সবই তাকে দেওয়া হয়েছে। ঘরের দিকটা তাকে দেওয়া হয়েছে। আর খালি অংশটা রেহানা আপা আর রেশমা আপার ভাগে রাখা হয়েছে। যদি তখনো বেড়াতে আসে সে জন্য তারা একতলা কোঠা তুলে নেবে।
রুবেলের কিছুতেই ঘুম আসছে না। টপ বারান্দাঅলা এত বড় ঘর। ঘরের ভেতরও দাদার আমলের পুরনো মটকা, কাঠের সিন্দুক, পুরনো খাট আর কী কী আছে। লেপ-কাঁথা-কম্বল-বালিশও আছে। রুবেল ভাবছে এবার সে গাছে ওঠা শিখবে। আম পাড়বে নিজ হাতে। ভালো জাতের কয়েকটা চারা কিনে লাগাবে। এত কম বয়সে সে নিজের নামে মিউটেশন করা জমির মালিক এটা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। চোখে ঘুম না থাকলেও চোখে স্বপ্নের সীমা নাই।