প্রচন্ড শীতের সকাল। রাস্তার পাশের ডাস্টবিন। খাবার খুটে খাচ্ছে ওরা দুই ভাইবোন, সেলিম আর কুলসুম। বয়স কতইবা হবে, ভাইয়ের দশ, বোনের বারো কি তেরো।
বোন বলে ওঠে— ভাই দেখ মুরগির রান!
অনেক খানি মাংস জড়ায় আছে। পচা গন্ধও নাই।
ভাই বলে— আয় ভাগ কইরা খাই।
উজ্বল চোখে অর্ধমাংস জড়ানো টুকরায় ওরা তাকিয়ে থাকে। ওদের চোখে ভাসে ওদের বয়সী কোনো বাচ্চা। হয়তো খেতে না পেরে বন প্লেটে টুকরাটা রেখে দিয়ছিল। মায়ের বকুনিও পুরা মাংসটা খাওয়াতে পারেনি বাচ্চাটিকে।
তৃপ্তির ঢেকুর তুলে অল্প সাদা ভাত মেখে ওরা খেতে থাকে। চারপাশে ভোরের ক্ষুধার্ত কাক-কুকুরগুলোও জড়ো হয়েছে। ভাত খেতে খেতেই ভাইয়ের চোখে পড়ে ময়লা স্তুপে আধা ঢাকা আধা ভাঙ্গা বেশ বড় একটি খেলনা গাড়ির দিকে। মুখে শেষ লোকমাটা না নিয়েই ও এগিয়ে যায়। খেলনা কুড়িয়ে আনে। রাস্তার পাশেই পড়ে থাকা অর্ধগ্লাসের কালো চশমাটাও আনে। চশমা চোখে দিয়েই বোনের কাছে ভাঙ্গা গাড়িটা নিয়ে এগিয়ে আসে।
— আপা আমারে কেমুন লাগতাছে?
— ফাইন লাগতাছে নায়ক এর লাগান।
— আপা এই গাড়িডা কিন্তু আমি ভাংগাড়িতে বেচুম না কইয়া দিলাম।
— ভাই গাড়িডার ভালো ওজন আছে। বেচলে ভালো দাম পামু। প্লাস্টিক এর বোতলের ওজন কম হয়।
— না আমি বেচুম না। খেলুম এইডা দিয়ে। কালা চশমা পইরা গাড়ি ডেরাইভ দিমু।
— ভাই ওর চাইতে রাইতে পেট ভইরা ভাত খামুনে। খাওন ডা কিন্তু আগে।
—আইচ্চা বস্তা খুলো ঢুহাই দেই।
— ভাই বউনি ডা কিন্তু ভালো হইলো সকাল সকাল। ভাগ্যিস এত সকালে আইছিলাম। তাজা মুরগির রানের সাথে বড়ো গাড়ি।
— আপা দিনডা কিন্তু ভালোই যাইবো আজ।
দুটি সাদা বস্তা নিয়ে ওরা এগিয়ে যায়। রাস্তার এপাশ ওপাশ করে হরেক মাল জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। দিন শেষে এই জড়ো বস্তাগুলো ওদের অন্য যোগাবে।
শীতের চাদর ভেঙে তপ্ত রোদ উঁকি মারে আকাশে। রাস্তার পাশ দিয়ে ওরা জীবিকার ভাংগারি খুঁজে যায়।
— আপা আমি রাস্তার ওইপাশে যাই আর তুই এই পাশে থাক। তাড়াতাড়ি অনেক মাল কুড়াইতে পারবানে।
— হ যা তুই ওই পাড়ে, আমি এই পাড়ে আছি।
— আপা গাড়ির ব্যাগটা আমারে দে। ওইডা তো দিয়েই দিতে হইব ব্যাচার লাইগা।
— নে তাইলে।
সেলিম সাদা বস্তা কাঁধে নিয়ে রাস্তার পাশে চলে যায়। দুইজন দুইপাশে জীবিকা অন্বেষণে ব্যস্ত। ফুটপাত দিয়ে কুলসুম বস্তা নিয়ে হাটতে থাকে। চিন্তা করে আজ ভালো সংগ্রহ হইলে প্লাস্টিকের ভাংগা গাড়িটা বেচবে না। ওর ভাই ওর মাথার পাশে বসে গাড়ি নিয়ে খেলবে। বুম বুম আওয়াজ করে গাড়ি চালাবে। ভাবতে ভাবতে রাস্তার দেয়াল ঘেষে ওর চোখ আটকে যায়। একটু ময়লার আড়াল মেখে একটা মানিব্যাগ। জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে থেকে খেয়াল করে টাকাও বেশ আছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখে আগে পিছনে কেউ নাই। যারা পথচারী তারাও বেশ দূরে। নিজের উত্তেজনা সংবরণ না করেই ওপারে সেলিম কে ডাক দেয় একটু উচ্চস্বরে।
— সেলিম ভাডি দেইখা যা কী পাইছি!
ওপারে সেলিমের কানে বোনের আনন্দ উত্তেজনার ডাক। কোনো দিকে না তাকিয়ে সাদা বস্তা কাঁধে দৌড় দেয় মাঝ রাস্তা বরাবর। ‘ওরে মা’ বলে একটা চিৎকার শোনা যায়। দুপুরের ক্লান্ত কাকের আর্তনাদ খেলে যায় আকাশে।
কুলসুম নির্বাক ভাবে তাকিয়ে থাকে রাস্তার মাঝে। ভাইয়ের থেতলে যাওয়া মাথার পাশে প্লাস্টিকের গাড়িটি পড়ে আছে। গাড়িটায় একটু রক্ত মেখে আছে।