পিন্টু রহমানের গল্প


দর্পণ-এর গল্পবিষয়ক বিশেষ সংখ্যা ‘শিশিরভেজা গল্প’-তে প্রকাশিত


বিসর্জন

পিন্টু রহমান


মন্ডপের বহুবর্ণিল আলোকছটা দিপিকার পিঠের উপর মুর্হুমুর্হু হোঁচট খায়, যে আলোয় তার শরীরের ছায়া মাটির উপর ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর; নেশার ঘোরে আলতামাখা পা দুটোও নিয়ন্ত্রণহীন! নাড়িভুড়ি ভেদ করে এক-একবার উঠে আসে চোলাই মদের গন্ধমাখা ঢেঁকুর। গন্ধটুকুন হাতছাড়া করতে মেয়েটি নারাজ; জোরে-জোরে শ্বাস টেনে পুনরায় তা নিজের মধ্যে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে। একচিলতে মদের জন্যই তো সারাবছর মনের মধ্যে আকুপাকু করে, রাজ্যের হা-হুতাশ, কাজে-কর্মে অনীহা, স্বামীর কোলে মুখ লুকিয়ে আগুনরঙা দীর্ঘশ্বাস ঝরানো– শুদু শুদু বালা লাহে না, ইট্টু মদ না অইলে কি মজা অয়; নাহি খেলা জমে!

খেলার মঞ্চে অনিমেষ নিরুপায়। আর কতো খেলবে! সাধ আর সাধ্যের সীমারেখা বহুক্রোশ বিস্তৃত। ইচ্ছে করলেই দিগন্তরেখার নাগাল পায় না। বাধ্য হয়ে দিপিকার কথা না শোনার ভান করে শুয়ে থাকে। দিপিকা তথাপি স্বামীর শরীর ধরে ঝাঁকি দেয়– কী অইলো গো মরদ, গুমায়ি পইড়িছো নাহি?

পলকহীন চোখে জানালা ভেদ করে অনিমেষ আকাশের পানে তাকায়। নিজের দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে। দুবেলা ভাতই জোটে না, মদ আনবে কিভাবে! অথচ পূজোর দিনগুলো অন্যরকম; দিপিকা ইচ্ছে করলে মদের উপর সাঁতরাতে পারে! হোঁচট খেয়ে পড়তে-পড়তেও মেয়েটি কোনমতে নিজেকে সামলে নেয়, অনুচ্চ স্বরে গালমন্দ করে– খানকি মাগীর ম্যাইয়ি, মরনে দইরিছে না, শালা!

ব্লাউজের ভিতর থেকে এক-এক করে কুচড়ানো-মুচড়ানো টাকাগুলো উদ্ধার করে; অনেক টাকা! মনের মধ্যে খুশির উচ্ছ্বাস। ভগবানের উদ্দেশ্যে শূন্যে দু’হাত তুলে ভক্তিভরে প্রণাম জানায়। সদ্য সমাপ্ত গানের রেশ এখনো সক্রিয়, গুনগুন করে তার ভগ্নাংশের জাবর কাটে। দিপিকা একা না; পাড়ার সবারই প্রায় অভিন্ন অবস্থা– তাল-লয়হীন গদ্যময় জীবন; তবু পূজোর সময়টা অন্যরকম, আটপৌরে বাঁধা জীবনের শৃঙ্খল ভেঙে যায়, অনুভূতির অচল চাকা নতুন করে সচল হয়, দিনরাত ব্যস্ততা, বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত দিপিকার অবসর থাকে না। শহরের মন্ডপগুলোয় তাকে নিয়ে রিতীমতো টানা হ্যাঁচড়া চলে। সবাই নিজের করে রাখতে চায়। কারণ শরীরের ভাঁজে-ভাঁজে লুকানো যৌবন আর নাচে-গানে একাই চতুর্দিক মাতিয়ে রাখতে কিংবা দ্বীপের শিখা হয়ে অন্যের বুকে আগুন জ্বালাতে ওস্তাদ সে। জাতপাত ভুলে মাড়োয়ারীদের বৌ-ঝিরা যখন শাঁখ বাজায়, উলুধ্বনি দেয়, টাকা-পয়সার সাথে ছুঁড়ে মারে ফুলের পাঁপড়ি, দিপিকার তখন খুব ভাল লাগে; নিজেকে আরো শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করে– যেনো স্বর্গের কোনো অপ্সরী! কেউ-কেউ গ্রীনরুম পর্যন্ত ঢুঁ মারে– ইস, কী সন্দর ম্যাইয়ি গো! যেন স্বাক্ষাৎ দেবী!

কথার স্বপক্ষে অন্য একজন ফোঁড়ন কাটে– অবি না আবার; বগমান (ভগবান) যে অরে নিজ আতে (হাতে) গইড়িছে!

আবেগঘন মুহূর্তে বৃদ্ধা তার গাল স্পর্শ করে, মাথায় হাত বুলিয়ে আশির্বাদ করে– শুহি (সুখি) অও (হও) মা। বগমান তুমার ভালা করবি, সারাজেবুন দুদিভাতে থাকবা!

আশির্বাদবাণী শুনতে তার মন্দ লাগে না, কিন্তু ওই ভাললাগাও ক্ষণস্থায়ী। সে হাড়ে-হাড়ে জানে, রাতের কথাগুলো দিনের আলোয় বিবর্ণ হয়ে যাবে, জাতপাত নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন উঠবে। দিপিকা তথাপি একরোখা; এসবের তোয়াক্কা করে না, কারো ধার ধারে না; পূবালী বাতাসে কেঁপে ওঠা ফসলের মতোই সে চঞ্চল, পাহাড়ি ঝর্নার মতো উচ্ছ্বল। গোঁসাইদের বাগানের মধ্যে সস-সড় শব্দ শুনে দিপিকা চকিত হয়, ভয়ে শরীরের লোম কাটা দিয়ে ওঠে, কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা পুরুষালী শরীর তাকে সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরে। গলা ফুঁড়ে চিৎকার করতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত থেমে যায়; শরীরের ঘ্রাণ শুকেই মানুষটাকে সে চিনতে পারে– সুখেন দা, গোঁসাইদের বড় বাবু। সুখেনই প্রথম কথা বলে– কতা কওনা ক্যান গো ম্যাইয়ি; বোবা অইয়া গেলা নাহি?

দিপিকার সারামুখে অনুরাগের ছোঁয়া– তুমার লহে আবার কিয়ের কতা? সবডিরে আমার চিনা শ্যাষ; মুহে কবা এক আর করবা আরেক। দুনিয়ায় হ’লেই স্বাত্তপর, খালি ঠহাইবার চায়।

সুখেনবাবু হাসতে-হাসতে মাথা নাড়ে– মুই আবার কি কইরলাম?

অভিমানী কন্ঠে দিপিকা জানায়– আইজকা মন্ডপে যাও নাই ক্যান!

সুখেন আরো শক্ত করে দিপিকাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে, গালে আলতো করে মুখ ঘষে, দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে আলো-আধারীর মাঝে দোল খেয়ে বলে– যামু না ক্যান; গিইছিলাম তো!

অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে দিপিকা ঘাড় কাত করে সুখেনের পানে তাকায়– হ্যাঁচা কইতিছো, সত্যই গিইছিলা?

মুখে শব্দ না করে সুখেন বারকয়েক হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। দিপিকা তথাপি অবিশ্বাসী; কামনার আগুন মেশানো চোখে বাবুকে নিবিড় আলিঙ্গনে জিজ্ঞেস করে– তয়, মোর লগে দেহা অয় নাই ক্যান?

সুখেনের মধ্যে অস্বস্থি; অস্বস্থি দূর করতে দিপিকাকে ছেড়ে দিয়ে গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়, গলার স্বর আগের তুলনায় অনেক বেশি ভারি– গিইছিলাম, তয় চলি আইছি।

উতলা হয়ে দিপিকা জানতে চায়– কেনেরে বাবু, কি অইছিলো তর?

কী আর অবি, তর রং ডং আমার বালা লাহে না, শরীলের মইদ্দে খালি জ্বালাপুড়া করে।

মাথার খুব নিচ দিয়ে পাখা ঝাঁপটিয়ে একটা রাতপাখি উড়ে যায়। আলোর বিপরীতে ঘন অন্ধকার। জ্বোনাকী ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব বোঝা যায় না। সুখেন থেকেও নেই, যেনো অনেক দূরের কোন মানুষ। অনেক দিনের চেনা মানুষ কেনো যে হুঁট করে বদলে যায়। বদলে যাওয়া পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে সচেষ্ট সে।

একখান কতা কইতাম, দিপি!

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দিপিকা মুখ তুলে তাকায়। অনুমতি ছাড়াই সুখেন বলতে আরম্ভ করে– ভাবতিছি, তুমারে আর নেত্য কত্তি দিমু না; মাইনষে খারাপ কয়, শুনতে শরম লাহে।

দিপিকা মুখ নিচু করে বলে– তাতে কী অইছে, মুই তো খারাপই; তা না অলি কি আর তর লহে পিরিত অইতো? তাছাড়া এট্টু নেত্য না কল্লি অইবে ক্যান! আমগোরে কী শাদ-আল্লাদ নাই। নাহি আমগোরে এ জেবুন কোনো জেবুন না?

জীবনের অধিকার সম্পর্কে লোকটি শক্ত মুখে জানান দেয়– হ জেবুন, তয় ওই জেবুন শুদু আমার! তর লগে অদিকারী (অধিকারী) মশায় এত গুর-গুর করে ক্যান! হালার পো কী কইবার চায়! আড়গোড় কইলাম বাইঙা দিমু!

সুখেনের মতলব এতক্ষণে পরিষ্কার, বুঝতে বাকি থাকে না যাত্রাদলের অধিকারীর সাথে কথা বলতে দেখে বাবু কষ্ট পেয়েছে। সুখেন তাকে ইনিয়ে-বিনিয়ে বিবিধ জ্ঞান দেয়, ভালবাসার মাপ পরিমাপ বোঝানোর চেষ্টা করে, মুখে কথার ফুলঝুরি– বুজলি দিপিমনি, মুই তরে বিয়া কইরবার চাই।

বাগানের নির্জনতা ভেঙে দিপিকার অট্টহাসি চর্তুদিকে প্রতিধ্বনিত হয়। আজব, মানুষ বড় আজব জিনিস! হাসির রেশ নিয়ন্ত্রণ করে জিজ্ঞেস করে– বাবু, তুই আমারে সত্যি সত্যি বিয়া কইরবার চাস!

২.

অন্যদিন ঘুম ভাঙলে দিপিকা আড়মোড়া দিয়ে বিছানোর উপর উঠে বসে, প্রাত্যহিক কাজকর্মে মনোনিবেশ করে, কিন্তু তার শরীরে আজ রাজ্যের ক্লান্তি, উঠতে মন চায় না, দেওয়ালে লটকানো রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তিটার পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়- দেখে যেনো সাধ মেটে না! ছবিটা দেখতে-দেখতে প্রতিদিন যেমন ঘুমায় তেমনি ঘুম ভাঙতেই ছবিটা আবার নজরে পড়ে। কৃষ্ণের স্থলে এক-এক করে অনিমেষ, অধিকারী মশায়, সুখেন বাবু, কমলেশ, বিজয় ঠাকুরসহ অনেকগুলো মুখ ভেসে ওঠে, তথাপি কাউকেই ঠিকঠাক মেলাতে পারে না, কোথাও না কোথাও গড়মিল! কোলবালিশ বুকে জড়িয়ে পাশ ফিরে শোয়। ছড়ানো-ছিটানো চুলে মুখ ঢাকা পড়েছে। পিঁড়ির উপর থেকে ভেসে আসে অনিমেষের আদরমাখা কণ্ঠস্বর- আর কত গুমাইবিরে বৌ; বেলা তো কম অইলো না! চাঁনদান কইরা আয়, দেকবি বালা লাগবি, কেলানতি দূর অবি।

বাম হাত দিয়ে কেশরাজি সরিয়ে দিপিকা স্বামীর মুখ বরাবর তাকায়। দোষে-গুণে মানুষটা কিন্তু মন্দ না, দিলে দয়া আছে। সাত-সকালে চাটাই নিয়ে বসেছে। মাঝে মধ্যে তার নিজেরও সংসারী হতে মন চায়। কিন্তু ওই ইচ্ছেটাও ক্ষণস্থায়ী। শূন্য কোলে আর কতোদিন! এত বছরেও একটা বাচ্চা-কাচ্চা হলো না! নির্জন মুহূর্তে দিপিকার মনের আকাশে আওলা বাতাস ওঠে। গাল বেয়ে তখন অঝর ধারায় চোখের নোনাজল গড়িয়ে পড়ে, নিঃশব্দ কান্না; বুকের মধ্যে তীব্র হাহাকার। অনিমেষ পিঠ চাপড়ে বউকে শান্তনা দেয়- কান্দিসনি দিপি, দৈর্য্যি দর, বগমানরে ডাক, তেঁনার কিরিপা অলি দুনিয়ায় সব অতি পারে!

কোন কোনদিন দিপিকার সব রাগ গিয়ে পড়ে ভগবানের উপর- হেরে ডাকতি অবি ক্যান; বগবান কি অন্ধ; চক্ষে দেহে না?

গোসলের পর থেকেই দিপিকার শরীরটা বেশ সতেজ। চোখেমুখে ক্লান্তির চিহ্ন পর্যন্ত নেই। মেজাজটাও ফুরফুরে। নিত্যদিনের অভ্যাস মতো পাড়ার মধ্যে একবার চক্কর দিয়ে আসে। ঘরগেরস্তি নিয়ে সবাই ব্যস্ত। একটা বিষয় ভেবে দিপিকা অবাক হয়, বাচ্চাদের হাতের বেলুন আর খেলনা ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে, বছর ঘুরে আবার পূঁজো এসেছে! অথচ পূঁজো বিষয়ক কত না গালভরা গল্প– ইবার বোদঅয় গোসাইগো লগে মুখুজ্জিরা পারবিনানে!

কেউ একজন অবুঝের মতো প্রশ্ন করে- কেনে গো কাহা?

আহা, কি সন্দর পতিমা! দেকলি পরাণ জুড়াইয়ি যায়! আর আমগো দিপিকা তো রয়ছেই, কী কও?

অয় গো, চান্দের নাহাল ম্যায়য়ি; হ’লের মুখে-মুখে তার নাম।

চাঁদমুখের সাথে যোগ হয়েছে ছন্দময় নাচ– হায় হায়, কি চমেৎকার নাচরে বাই, একনজর দেকার জন্যি পাবলিক পাগল অয়ি যায়!

রামদয়াল তার বুকের কুচকে যাওয়া চামড়া টানটান করে বলে- দ্যাকতি অবি না কাগো ম্যায়য়ি! আমাগো; এই আমাগো ম্যায়য়ি!

দিপিকাকে দেখে উঠতি বয়সের ছেলেরা হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে আসে, চোখে কৌতূহল মিশিয়ে বলে– বৌদি, তুমারে দ্যাখতি ঠিক দেবীর মতোন মনে অয়। নাচ গানে হ’লে তো মাতাল। খালি ভিড় আর ভিড়। পা ফেলোনের জায়গা থাহে না।

রমেশের হাতটা দিপিকা তার নিজের হাতের মধ্যে খপ করে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করে– মিছা কইতিছো ঠাহুর পো?

ছিঃ ছিঃ মিছা কমু ক্যা; দেহো না, কুশি (খুশি) অইয়ি বেবাক মাইনষে তুমার বেলাকুচের মইদ্দে ট্যাকা গুইজ্যা দেয়। মাতায় আত বুলিয়ে আশিব্বাদ করে। আর অদিকারীর মুহে তো খালি তুমার গপ্প।

রমেশের কণ্ঠে হতাশার ব্যাঞ্জণা– ইস বৌদি, আমার যদি মেলা ট্যাহা তাকতো গো!

কি অইতো তালি?

তুমার বুহিক মইদ্দ্যে আমিও মাইনষের সামনে ট্যাকা গুইজ্জ্যা দিতাম!

ফেরার পথে মালতীর সাথে দেখা, স্টেশনের নিকটবর্তী রেল-লাইনের উপর বসে চুল শুকাচ্ছিল। মাত্রই গোসল করে এসেছে। মুখটা ভার ভার। দিপিকা তার পাশ ঘেঁষে বসে। শরীরে রহস্যপূর্ণ টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করে– কিরে কী অইছে তর; এমুন দেহা যায় ক্যান?

মালতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে– কী আর অইবো! মনডা বালা না। কয়দিন অয়, তর দাদা নিখোঁজ। মানুষটার কুনু দিশি নাই।

তামাশার ছলে দিপিকা বলে– তাইলে তো বালায় অইছে, ইচ্চা মতোন গুরতাছো। তা, আয়-ইনকাম ক্যামুন অইতাছে গো?

নাহ বালা না, বাজার মন্দ, মাইনষে খালি তুমার কতা জিগায়।

এর পরেও মালতি অনেক কথা বলেছিল। কিন্তু সবটা দিপিকার মাথার মধ্যে ঢোকেনি। ফলে অনেক ভাবনার যোগফলে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল মাত্র।

৩.

হাসি-হাসি মুখ করে অনিমেষ স্ত্রীর পাশে এগিয়ে এসে বলে– তুমাক তো কওয়া হয়নি; জব্বর একখান কতা!

কী কতা গো পিরিতির মাঝি?

অদিকারী মশাই আয়ছিল।

অধিকারীর নাম শুনে দিপিকার কৌতূহল মুহূর্তে মিইয়ে যায়। বুঝতে পারে না, হাসবে নাকি কাঁদবে। অধিকারীর নাম মুখে আনতে তার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না। সমাজের জটিল ও কুটিল প্যাঁচে অনিমেষের মতো মানুষগুলো অদক্ষ, তা না হলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠতো। স্বামীকে উদ্দেশ্য করে জানতে চায়– সে কী কইবার চায়; কিছু শুইনিছো?

হ শুনছি, তুমারে নাকি ডাকায় (ঢাকা) লইয়ি যাবি।

ক্যান, সে কী আমাক চিড়িয়াখানায় লইবার চায়। নাকি আমার শিং গজায়িছে!

অনিমেষ থতমত খায়। মানুষের কী সত্যি সত্যি শিং গজায়? নাকি তাকে চিড়িয়াখানায় রাখা যায়– তা অবি ক্যান? কইছে তুমারে নাকি ফিলিমের কাম দিবি। আইচ্চা ফিলিমের কামডা আবার কি রকম অয়?

প্রতিউত্তর আসার আগে অনিমেষ পুনরায় বলে– তয় শুনছি, সিকানে নাকি ট্যাহা আর ট্যাহা! সারাজেবুনেও অভাব অবি না, সুহে তাকবা।

দিপিকার ভেতরটা হঠাৎ-ই যেনো আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসে ওঠে। লাভাস্রোতে ভেসে যায় অধিকারীর জাত-কুল- শুয়ারকা বাচ্চা! শালা হারামি! ব্যাডা আস্ত একখান দড়িবাজ (ধড়িবাজ)!

অনিমেষ মানসিকভাবে আহত হয়, রামনাম আওড়ায়– ছেঃ ছেঃ বিরাম্মন পুতরে এ্যামুন কইতে নাই গো বউ! বগমান নারাজ অবি।

তাচ্ছিল্লের স্বরে দিপিকা বলে– হ, এই আত দিয়া এমুন কত বিরাম্মন পার অইলো! সবডারে আমার চিনা অইছে। বেক্কল কনেকার!

অনিমেষ বোকার মতো কিছুক্ষণ থ মেরে দিপিকার মুখের পানে তাকিয়ে থাকে। সাত বছরের সংসার জীবন; আজ পর্যন্ত মেয়েটিকে ঠিকঠাক চিনতে পারলো না! এই মোমের মতো নরম তো মুহূর্তেই বজ্রের মতোন কঠিন! পাড়া-পড়শীদের মুখে ভিন্ন কথা– দিপিকার উপর কালি দেবীর আছর আছে। কিন্তু অনিমেষ একথা বিশ্বাস করে না, তার ধারণা– এ বয়সে মেয়েরা এক-আধটু উল্টা পাল্টা বকতেই পারে। বিয়ের কিছুদিন পর শ্বশুর মশাইয়ের বলা কথাগুলো এখনো তার মনে আছে– বাপরে, আমার মা মরা ম্যাইয়ডারে ইট্টু দেইখ্যা রাহিস। অর মনে দুখ দিস না। সংসারের কামকাজ এহনো বুজবার পারে নাই, খালি পাড়ায়-পাড়ায় গুইরা বেড়ায়, কেউ কিচু কইতে গ্যালে তার লহে ঝড়গা বাঁদায়। তয় বাবা, তার দিলডা খুব ভালা, দুদির মতোন শাদা।

শ্বশুরের কথাগুলো সে অক্ষরে-অক্ষরে পালন করে চলেছে, সহজে দিপিকাকে ঘাঁটাঘাঁটি করে না; কোনো কারণে ঝগড়া-ঝাটি বাধলে অনিমেষ উচ্চবাক্য করে না, খুঁটিতে হেলান দিয়ে হাসির ভান করে। ওই হাসিটাও দিপিকার তখন সহ্য হয় না; চলমান ঝগড়ায় যোগ করে নতুন মাত্রা– অ আমার লহে তামশা অয়তিছে, না? আমিও দেহুম, কেডায় তুমার ভাত রান্দে! কেডায় তুমার সংসার করে!

এরপর দু’এক দিনের জন্য রান্না-বিরতি। সংসারের কাজকর্ম সব বন্ধ। বালিশ বুকে জড়িয়ে চোখে শ্রাবণের জল ঝরায়। থেকে-থেকে কপাল চাপড়িয়ে আক্ষেপ করে। এক-একসময় মনে হয়, দিপিকা যেন রহস্যাবৃত মেঘ! কোনো-কোনো কথার মাথমুন্ডু পর্যন্ত বুঝতে পারে না। অধিকারীকে নিয়ে বলা কথাগুলোও ঠিক সেরকম– হেমন্তের ধুয়াটে কুয়াশা। তুলশীতলায় নিমগ্ন হয়ে নিজ কাজে অনিমেষ ব্যতিব্যস্ত। অনেকগুলো ডালা-সরপোশ জমা হয়েছে; বাকি শুধু রঙের কাজ। বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত সেগুলোয় আর হাত দেওয়া হবে না, কারণ রঙের কাজটা দিপিকারক আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সংসারের নিত্য ব্যবহারের দ্রব্যাদিতে সে রঙ মাখায়, বিক্রির উপযোগী করে তোলে। চিন্তার অতলান্ত থেকে ফিরে এসে অনিমেষকে লক্ষ্য করে দিপিকা বলে– একখান কতা কইতাম।

অনিমেষ তার দিকে না তাকিয়েই জানতে চায়– কী কতা?

অদিকারী না অয় সুখেনের লহে আমি যদি বাইগ্যা পড়ি, আর যদি ফিরা না আসি, তাইলি কি তুমার বহুত দুখ অইবো, কষ্ট অইবো?

কাজের প্রতি নিবিষ্ট দৃষ্টি এবার দিপিকার অভিমুখে দিক পরিবর্তন করে, জিহ্বায় ছোট্ট করে কামড় দিয়ে বলে– এমুন বেহুদা কতা কইতে নাইরে বৌ। বগমান নারাজ অবি। তরে কী এমনি-এমনি বউ কইরিছি। পুরত ঠাহুরের সামনে সাতপাক গুইরা, তার বাদেই না বিয়া! এ বড় শক্ত বান্দন। ইচ্ছা অইলেই কী ছিড়া ফেলোন যায়। না, যায় না।

৪.

দিপিকা পালিয়েছে!

নবমীর উৎসব ম্লান করে দিয়ে বাতাসের ডানায় ডানায় খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। গোঁসাইদের কপালে হাত। এ যেনো তীরে এসে তরী ডোবা! দিপিকাকে ছাড়া পূজোর আকর্ষণ মাটি হতে বাধ্য। জনশূন্যপ্রায় মন্ডপ। সুনসান নিরবতা। বুকের মধ্যে হাহাকার। খুঁটিতে হেলান দিয়ে অনিমেষ টুলের উপর ঝুঁপ ধরে বসে আছে। হাতের লাঠিটাও অসাড়! জলভরা নয়নে প্রতিমাগুলোর পানে এক-এক করে তাকায়। মিল-অমিল লক্ষ্য করে। কোন-কোনটার মুখের সাথে দিপিকার মিল খুজে পায় বটে ওই মিল খুব সামান্যই। বরং মায়ের মুখচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। কাঁদে অনিমেষ; গভীর রাতে দেবী দুর্গার চরণে লুটিয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ঝরায়। ভক্তিভরে মিনতি করে– নক্ষে করো মা দুগগা, এই বিপদ থিইক্যা আমারে নক্ষে করো। শুইনিছি তুমি নাকি মাইনষের দু’তি নাশ করো; কইতে পারো আমার দু’তির শ্যাষ কুতায়; কবে শ্যাষ অবি এই যন্ত্রণা!

অনিমেষের যন্ত্রণাগুলো চোখের জল হয়ে ফোঁটায়-ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ে। দেবীর পদতলে ফোঁটা-ফোঁটা অশ্রু আর তার বুকের মধ্যে অহর্নিশ দহন। সাতপাকের সুতোঁয় পচন ধরেছে। চারপাশ ঘিরে অন্ধকারের রাজত্ব; ওই রাজ্যে অনিমেষ যেনো অসহায় প্রজা! বুক গভীর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস আলগোছে খসে পড়ে। দু’চোখে ঘোর অন্ধকার। রাত্রির দৈর্ঘ্য ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। অনিমষের নিরবতা ভাঙতে কেউ একজন ধীরপায়ে এগিয়ে আসে, পিঠের ওপর আলতো করে হাত রাখে, খুব শীতল হাতের স্পর্শ।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

মৃতদেহ

পরিতোষ বারান্দা থেকে দেখল রাস্তায় এখানে ওখানে দু’একটা জটলা। পরিতোষ বুঝতে পারে ওরা অলোকেশকে নিয়ে কথা বলছে। আরও কয়েক ঘন্টা

কবিতা

পরবাসী

যাহাদের পায়ে পায়ে চলে চলে জাগিয়াছে আঁকাবাঁকা চেনা পথগুলি দিকে দিকে পড়ে আছে যাহাদের দেহমাটি—করোটির ধূলি, যাহারা ভেনেছে ধান গান

কবিতা

অন্ধকার

গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার; তাকিয়ে দেখলাম পান্ডুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া

হিন্দু-মুসলমান

মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে-পুণ্য ভারতপুরে পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নমাজের সুরে-সুরে! আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে, মুয়াজ্জেনদের উদাস ধ্বনিটি