(অসমে নাগরিকত্ব সংকটকে ভিত্তি করে লেখা গল্প)
চরলাপাং-এর মিয়াজি বাড়ির বাতেন মিয়াজির মাণ্ডব ঘরে বসে থাকতে দেখা গেল অপরিচিত একজন পুরুষকে। লোকটির বয়স আনমানিক সত্তরোর্ধ হবে। তার সাথে একজন নারী ও অন্য আরও একজন অল্প বয়স্ক অপরিচিত মানুষ। তিনটি বেতের মোড়ার একটিতে বসে আছেন আগন্তক ও অন্যটিতে তার সাথের মহিলাটি। সামনে বাড়ির গৃহকর্তা বাতেন মিয়াজি। তাদের চারপাশ ঘিরে বেশ কিছু উৎসাহী নারী-পুরুষ। পাড়ার মেয়ে-ছেলেরাও ভির করেছে সেখানে। মিয়াজি বাড়ির কাজের লোকজনও আছে।
অপরিচিত পুরুষ লোকটি বাতেন মিয়াজির বাল্য বন্ধু-শৈশবের খেলার সাথি ও দুস্ত আর মহিলাটি তার স্ত্রী। সুদূর অসম রাজ্য থেকে তারা এসেছে চরলাপাং। তাদের পৈর্তৃক ভিটে এক সময় এদেশেই ছিল। অর্থাৎ এই চরেই ছিল তাদের আদি বসতি। নদী ভাঙ্গনের কারণে ভিটেমাটি শূন্য হয়ে, অভাবের তাড়নায়, জীবিকার আশায় তারা অসমে দেশান্তরি হয়েছিল।
লোকটির নাম দানেস মিয়া। দানেস মিয়ার বাবা যখন তার স্ত্রী, তিনটি কন্যা ও দানেসকে নিয়ে দেশান্তরি হয়ে অসমে পাড়ি জমায় তখন দানেসের বয়স বার তের বছরের বেশি না। দুঃখ-কষ্টের সে এক সকরুণ ইতিহাস। দানেস যখন তার বাবা-মার হাত ধরে তার বড় বোন আয়েশা, সাফিয়া ও ফাতেমাকে সাথে নিয়ে অসমের উদ্দেশে দেশান্তরি হয় তখন তার মতো চরের সকলের মনেই কিছু না কিছু কষ্ট হয়েছিল। বিশেষ করে তার বন্ধু বাতেন মিয়াজি ও তার চাচাত বোন মমতাজ বেগমের মনের কষ্টের কথা, তাদের ছলছল নয়নে চাহনির কথা কোনো দিন ভুলেনি দানেস। সবাই তখন কান্না-কাটি করছিল। মমতাজ এখন বাতেনের স্ত্রী। নিজের জন্মভূমি ছেড়ে দূরদেশে দেশান্তরি হওয়ার যে কি কষ্ট তা মর্মে মর্মে টের পেয়েছে তারা জীবনভর। তবু নদী যখন কেড়ে নিয়েছিল তাদের জমি-জামা এমনকি বসত ভিটেটুকুও তখন তাদের নিয়ে দেশান্তরি হওয়া ছাড়া দানেসের বাজানের আর কোনো উপায়ও ছিল না। সেই কত বছর আগের কথা! তখন তো ব্রিটিশের যুগই শেষ হয়নি। মেঘনার ভাঙনে তারা বাস্তুহারা হয়েছিল। এরপর এলো দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ, যুদ্ধের কারণে এলো দুর্ভিক্ষ। ব্রিটিশরা বিদায় হলো। দেশ ভাগ হলো। এমনকি পাকিস্তান রাষ্ট্রও টিকলো না। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়ে পূর্ব পাকিস্তান হলো বাংলাদেশ। সেদিন কতই বা ছিল বাতেনের বয়স। অভাবের তাড়নায়, এক মুঠো ভাতের আশায়, তার বাজানের হাত ধরে অরণ্যবাসী হয়েছিল সে। জীবিকার তাগিদে গিয়ে হাজির হয়েছিল অসমের শীলচরে। বসতি করেছিল সেখানকার অরণ্যাঞ্চল কেটে পরিস্কার করে। সে যে কি নিদারুন কষ্টের এলিজি তাদের দুঃখভেজা জীবনের সকরুণ কাহিনী।
অরণ্যবাসী কেবল তারা একাই হয়নি। অরণ্যবাসী হয়েছিল অখন্ড ভারতের বৃহত্তর নোয়াখালি, কুমিল্লা, ময়মমনসিংহ, ফরিদপুর ইত্যাদি জনপদের কৃষিজীবী পরিবারের বহু লোকজন। ব্রিটিশ শাসকরাও চেয়েছিল অসমে গিয়ে এসব অঞ্চলের লোকজন যেন বসতি স্থাপন করে এবং জঙ্গল কেটে সেইখানের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষবাসের পরিবেশ তৈরি করতে পারে। দেশান্তরি হওয়া তারা সকলেই ছিল বাঙালি এবং হিন্দু মুসলিম জনগোষ্ঠীভুক্ত। তাছাড়া ব্রহ্মদেশ থেকে শান উপজাতিরাও অসমে এসেছিল, সে তাদের অনেক আগে-তেরশ শতাব্দিতে। তারা অসমে অহোম নামে পরিচিতি পেয়েছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার প্রায় সর্বত্রই তাদের বসবাস। তারা বলিষ্ঠ, দেখতে সুন্দর ও কাজে দক্ষ। তারা হিন্দু বলে পরিচয় দিলেও হিন্দুদের জীবনাচারের সাথে তাদের জীবনাচারের অনেক তফাৎ লক্ষ করা যায়। তবে কৃষিই তাদের অধিকাংশের জীবিকা। একটি কথা অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের অসমে তো দানেসরা মূলত অনুপ্রবেশকারি বা বহিরাগত ছিল না। সেই যুগের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের অসম গমন এবং সেখানে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত হওয়াই ছিল সবার কাম্য ও কাক্সিক্ষত।
তাদের মতো আরো কতজন যে তখন অরণ্যবাসী হয়েছিল তার খোঁজÑখবর কে রাখে? অভাবী মানুষ মেঘনার স্রোতের মতো গিয়ে হাজির হয়েছিল-কাছাড়ের শিলচর, শিয়ালটেক, রাণীর বাজার, হাইলাকান্দি ইত্যাদি এলাকায়। ছাতাচূড়া ও লুসাই পাহাড়ের পাদদেশে অসংখ্য মানুষ আশ্রয়গ্রহণ করেছিল। মোঘল সম্রাটদের আমল হতেই কৃষিকাজের জন্য বনাঞ্চল আবাদে উৎসাহ দেয়া হতো। মোঘল আমলের শেষে আসে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরে ব্রিটিশ শাসন। গোড়ার দিকে জাহাজ নির্মাণ ও রেলের স্লিপার তৈরির জন্য ব্যাপক পরিসরে বন ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এবং সেই কাজে লাগানোর জন্যই তো দানেসদের মতো সর্বহারাদের বেশি প্রয়োজন পড়েছিল।
দানেসরা সেখানে গিয়ে দেখতে পেয়েছিল অধিবাসী-কাছাড়ী, নাগা, কুকী, মিকির, লুসাই তাদের অধিকাংশই পাহাড়ে এবং তার পাদদেশে বাস করে। এছাড়া বাউরী, চামার, মুণ্ড, মুছর প্রভৃতি কুলী জাতি-যারা সেখানে কৃষি ও ছোট খাট ব্যবসার সাথে জড়িত। সমতলেও কিছু হিন্দু-মুসলমানের বাস ছিল। সমতলে ততদিনে নতুন বসতির জন্য আর কোনো জাগা ছিল না। তাই তারা কাটিগোরা অরণ্যাঞ্চলে বসতির জন্য জঙ্গল কেটে সাফ করে বসতি করেছিল। সর্বহারাদের কেউ কেউ আবার একই জেলার করিমগঞ্জ কিংবা হাইলাকান্দিতেও বসতি গড়ে তুলেছিল। সে এক কষ্টকর অভিজ্ঞতা, দাসেন মিয়ারা যখন অসমে যায় তার কয়েকদিন পরই শুরু হয়েছিল বর্ষাকাল। অসমের জলবায়ু তখন মোটেই সুখকর ছিল না। রাত নেই, দিন নেই, কেবল মেঘ-বৃষ্টি হচ্ছিল। ওখানকার চেরাপুঞ্জি পাহাড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। টানা বৃষ্টির কারণে তাদের জীবন প্রথমেই হুমকির মুখে পড়েছিল। আয়-রোজগারের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না দানেসের বাজান। কাটিগোরা অরণ্যাঞ্চলের আশপাশে বন্য হিংস্র জীব-জন্তুর ভয়তো ছিলই। বৃষ্টির দিনগুলিতে পাহাড়ি চিনা জোকের আক্রমণ ছিল ভয়ানক। ঘরের ভিতর-বাইরে শোয়া-বসাতো দূরের কথা, হাঁটা-চলার মধ্যেই ঐসব জোক পায়ের মধ্যে আঁকড়ে ধরে কখন যে শুষে নিয়ে যেত চাকা চাকা রক্ত তা টেরও পাওয়া যেত না। আর বর্ষাকালটা শেষ হয়ে যখন আশি^ন মাস এলো, তখনই শুরু হতে থাকল রাত্রিতে বরফের আক্রমণ। দানেসদের মতো নদী তীরের মানুষের জন্য এমন ভয়াবহ শীত নিবারণ ছিল সত্যিই কষ্টকর। শীতের কাপড়ের অভাবে, পাহাড়িয়া এ শীতের প্রকোপে সত্যিই তাদের অবস্থা ছিল জবুথবু। শীতের রাতে বস্ত্রহীনতায় দানেস মিয়াদের মতো অরণ্যবাসী মানুষের অবস্থা হয়েছিল মধ্যযুগের কবি গোবর্ধন আচার্যের কবিতার মতো-‘ধোঁয়ায় চোখে পানি ঝরে, দহনে দেহ উত্তপ্ত (দগ্ধ) হয়, অঙ্গারে দেহবর্ণ মলিন হয়,/ তবু দুর্গত গৃহিনী সারা শীতরাত্রি (হে অগ্নী) তোমাকে জ¦ালিয়ে রাখে।
শীত নিবারণের জন্য সারারাত্র আগুন জে¦লো রেখেও তাদের কেউ কেউ শীত নিবারণ করতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল। প্রকৃতির এই লিলা-খেলার মাঝে প্রতিকূল-অনুকূল বুঝে শিলচরের জঙ্গল কেটে জমি তৈরি করে, চাষাবাদ করতে গিয়ে, যেমন তারা নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছিল, তেমনি সেখানকার বন্য গাছপালাও তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়েছিল। সেখানকার বিভিন্ন জঙ্গলের পাইন, ফার, দেবদারু গাছের সমাবেশ তাদের জীবিকার অংশ হয়েছিল। অংশ হয়েছিল গভীর জঙ্গলের এখান সেখান দিয়ে এঁকে বেঁকে ছুটে চলা নদীগুলোও। নদীগুলো সেখানকার জনজীবনের বেঁচে থাকার চমৎকার অনুষঙ্গ ছিল। বনোমোষ কিংবা সম্বর-চিত্রল হরিণরাও ছিল তাদের জীবিকার উৎস। যদিও অরণ্যের বাঘ, গণ্ডার, অজগরের হাতে প্রাণও দিতে হয়েছে অনেককে। কাছাড়ের দক্ষিণস্থ ও উত্তরস্থ পাহাড়ে বন্যহাতি, বন্যমহিষ, বৃষ, ব্যাঘ্র, ভল্লুক, বানর ইত্যাদির হাত হতে জীবন রক্ষা করে, সংগ্রাম করে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যপৃত হয়ে গিয়েছিল তারা।
অচিন দেশের অচিন কোনো মানুষের জীবনের নিদারুন কষ্টের এলিজি শুনছে চরলাপাং-এর লোকজন। দুঃখ-কষ্ট তো তাদেরও জীবনের পরমতম অনুষঙ্গ হয়ে আছে। তাদের কষ্টের পেক্ষাপট নদী, নদী ভাঙ্গন এবং নদী তীরবর্তী জীবন-জীবিকার প্রেক্ষাপট। আর দানেস মিয়ার প্রেক্ষাপট অরণ্যাঞ্চল এবং অরণ্যাঞ্চলের প্রতিকূল প্রাকৃতিক জীবনে টিকে থাকার বিপ্রতীব প্রেক্ষাপট।
ইতোমধ্যে বাতেন মিয়াজির কাজের মেয়ে হনুফা হুক্কা জ¦ালিয়ে কলকিতে ফুঁ দিতে দিতে অত্যন্ত আদপের সাথে এগিয়ে ধরে বাতেন মিয়াজির সামনে। মিয়াজি হুক্কা হাতে নিয়ে এগিয়ে দেয় দানেস মিয়ার হাতে। দানেসের বাজান তাদের নিয়ে শিলচরে যাওয়ার পর প্রথমেই দেখা হয়েছিল হরিচরণ বাবুর সাথে। হরিচরণ তাদের কয়েক বছর পূর্বে মেঘনা তীরবর্তী অঞ্চল চরচানপুর থেকে দেশান্তরি হয়েছিল। হরিচরণ তার সাথে দেশান্তরি হওয়া ক্ষুদ্র ক‘ঘর জলদাসদের নিয়ে সহযোগিতা করে দানেসদের। যদিও দেশান্তরি হওয়ার পূর্বে তাদের পূর্ব পেশা ছিল মেঘনা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা। কিন্তু দেশান্তরের ফলে তাদের পেশায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। তারা ততদিনে জঙ্গল সাফ করে চাষাবাদের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। হরিচরণই ব্রিটিশের আঞ্চলিক অফিসারের সহযোগিতায় দানেসদের জঙ্গলের চৌহদ্দি দেখিয়ে দিয়েছিল। এরপর তারা জঙ্গল কেটে সাফ করে নিজের ভিটে বাড়ির জন্য এক টুকরো স্থান খালি করেছিল। জঙ্গলের ছোট ছোট গাছ ও গাছের ডালা কেটে, বাঁশ কেটে থাকার জন্য তৈরী করেছিল ঘর। অদূরের জীরি নদীর তীর হতে ছন কেটে এনে সেই ঘরের ছাউনি দিয়েছিল। কিন্তু দেশান্তরি হওয়ার স্মৃতি এক মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হয়নি দানেস মিয়ার। সেই ব্রিটিশ আমলের কথা। পুরো বর্ষাকালটা সারা দিনমান দানেস তার প্রিয় বন্ধু বাতেনকে সাথে নিয়ে নৌকা বাইচালি করে সময় কাটাত। কখনও রাস্তার পাশে লাটিম খেলা বা ডা¹ি খেলায় মেতে ওঠত। আবার সুদিন এলে বাড়ির বিরচায় ডাং-গুলি খেলা এবং দাড়িয়াবান্দা কিংবা গোল্লাছুট খেলা নিয়ে মেতে থাকত। কখনও গুলতি নিয়ে ঘুরে বেড়াত বনে বাদাড়ে। সুযোগ পেলেই গুলতি তাক করে ছুড়ে মারত কাঁচের মারবেল বা চিকনা মাটি দিয়ে হাতে তৈরি মারবেলাকৃতির গুলি। মাটিতে ফেলে দিতে পারত কোনো একটি বিলেতি ঘুঘু, আমসারষ, দোয়েল বা অন্য কোনো পাখিকে। একবার হল কি একটি হলুদ বর্ণের পাখি দানেস মিয়াদের বাড়ির পিছনের ডালিম গাছের ডালে বসেছিল। পাখিটির দুইটি পাখনায় দুইটি কালো রঙের পোঁচ। দানেস মিয়া গুলতি নিয়ে গিয়ে কলাগাছের চিপায় দাঁড়িয়ে মারবেলের গুলি ছুড়ে মারল পাখিটিকে লক্ষ্য করে। পাখিটি সামান্য আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। দানেস খপ করে সেটাকে ধরে ফেলল। বিকেল বেলা বাতেন দানেসের হাতে ধরে রাখা সুন্দর পাখিটিকে দেখল। বাতেন তার দুস্ত দানেস মিয়ার কাছ থেকে দু‘পয়সা দিয়ে কিনে নিল সেটিকে। কিন্তু পরের দিন সকালে মক্তব থেকে ফিরে দানেস মিয়া পাখিটিকে দেখতে পেল তার মহরম চাচার মেয়ে মমতাজের হাতে। অবাক বিস্ময়ে সে জিজ্ঞেস করল মমতাজকে, তুই এ পাখি পাইলি কই? মমতাজ ফটাফট জবাব দিল, পাখিটি আমাকে বাতেন মিয়াজি দিয়েছে। সে নাকি এটিকে গুলতি দিয়ে শিকার করেছে। নাক-মুখ খিঁচিয়ে চেচিয়ে উঠল দানেস। কি এত বড় মিথ্যুক, পাখি শিকার করছি আমি। আর সে কিনা কই সে শিকার করছে। তার কি শিকার করার মরুদ আছে নাকি? পাখি তুকে উপহার দিতে অয় তো আমি দেব। ওর পাখি তুই নিছস কেরে?
– আমার ইচ্ছা, উত্তর দিল মমতাজ।
– না তর ইচ্ছা না। তরে বাতেনের পাখি নিতে আমি দিমু না।
– কেরে দিবি না?
– কারণ তরে পাখি দিতে অয় আমি দিমু। তুই আর কারো কাছ থেকে কোনো কিছু নিতে পারবি না।
– কেন পারুম না?
– কারণ তুই আমার। আমি ছাড়া কেউ তরে কোনো কিছু দিলে তারে পিডাইয়ার আমি তক্তা বানাইয়া দিমু। তুই নিলে তরেও তক্তা বানামু।
– তুই আমারে মারবি কেরে? আমি তর খায় না পড়ি? আর আমি তর অইলাম কেমনে?
– হে তুই আমারই, তর মায়ে কইছে বড় অইলে তরে আমার লগে বিয়া দিব। এই জন্যঐত আমি প্রতিদিন তরে কবরস্থানের গাছ থাইক্কা কাঁচা আম পাইড়া দেই। বান্নিত থাইক্কা লুকাইয়া লাল ফিতা তরে কেডা আইন্না দে? এসব কথা বার্তার অর্থ দুইজনের কেহই তখনও স্পষ্ট করে হয়তো বুঝে না। তবু খারাপ কিছু বলেছে মনে করে দানেস মিয়ার পিঠে দুম করে একটি কিল বসিয়ে দিল মমতাজ। কিল দিয়ে দৌড়ে পালাতে পালতে ঠ্যাং উঁচিয়ে বলল, তর লগে আমার ঠ্যাঙের বিয়া অইব।
দানেস মিয়াও জেদি গোয়াড়ের মতো বলল, দেখিস পাগলি বড় অইলে আমি তরে ঠিখঐ বিয়া করুম।
কোনো একবার শীতকালে চরের জমি থেকে মাস কলাইয়ের কাঁচা ছড়ি তুলে এনেছে দানেস ও বাতেন মিয়াজি মিলে। এরপর এই মাস কলাই মাটির পাতিলে সেদ্ধ করার জন্য বাড়ির সামনে বিরচায় গর্ত করে চুলা তৈরি করল। ফসলি জমির বেড়া থেকে ভেঙে কয়েকটি শুকনো ডাল, কিছু খর-বিচালি সংগ্রহ করে আনল। এরপর হাঁড়িতে পানি ও মাস-কলাই দিয়ে সেদ্ধ করার চেষ্টা করল। মমতাজকে দায়িত্ব দেওয়া হল মুলি বাঁশে মুখ লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে আগুন তাতানোর। অনেক চেষ্টার পরও আগুনকে তাতাতে পারল না মমতাজ। এদিকে তার ঘাড়, গলা গেমে সপসপ হয়ে গেল। ধোঁয়ার কারণে দু‘চোখ দিয়ে জল আসতে থাকল। এমন সময় দানেস তার কানের কাছে গিয়ে বলল, করনা একটু কষ্ট পাগলি। সংসারত এমনই অই।
সংসার! কিয়ের সংসার? কার সংসার? রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে মমতাজ।
দানেস মৃদু হেসে জবাব দিল, কেরে তর আর আমার সংসার। একদিন আমার সাথে তর সংসার করতে অইব না। আর এমনি দানেসের পিঠের উপর দুম করে কিল বসিয়ে দিল মমতাজ। দিয়ে ঠ্যাং দেখিয়ে দৌড়ে পালাতে পালাতে বলল, কইছিনা দানেইচ্ছা তর লগে আমার ঠ্যাং-এর সংসার অইব। এমনি অসংখ্য খুনসুটির মধ্য দিয়ে দানেসের সাথে কি যেন একটি অদৃশ্য সুতোই বাঁধা পড়ছিল মমতাজের জীবন।
নিয়তির কী করুন পরিহাস, সেই দানেস আর মমতাজ, তাদের শৈশবেই হয়ে গিয়েছিল দুই জগতের বাসিন্দা। নদী ভাঙনের ফলে অভাব তাদের ছিটকে ফেলে দিয়েছিল দুই নক্ষত্রে।
সেই অনেক বছর আগের কথা। চার-পাঁচ পুরুষ ধরে সুখে-শান্তিতে বসবাস করে আসা গৃহস্থ, আধা গৃহস্থ এমনকি মুনিষ-কামলা খাটা মানুষের চরলাপাং গ্রামের ফসলি জমিতে হঠাৎই দেখা দিল মেঘনার ভাঙন। ভাটি অঞ্চলের ধানি জমি ও উজানের বারজাতের ফসলি জমির কোনো অংশই ভাঙন থেকে বাদ রইল না। অব্যাহত ভাঙনের কবলে পড়ে দ্রুত গতিতে ভূমিহীন হতে থাকল গ্রামের গৃহস্থ পরিবারগুলি। অভাব তার অদৃশ্য কালো হাত বাড়িয়ে দিতে থাকল প্রতি পরিবারের দিকেই। গৃহস্থ বাড়িতে যে সমস্ত মুনিষ কামলারা খেটে খেতো তারাও বেকার হয়ে পড়ল। কেউ কেউ রুটি-রোজগারের আশায় অন্যত্র পাড়ি জমাতে থাকল। ক্রমে ক্রমে বেশ কিছু অবস্থাসম্প্ন্ন গৃহস্থ পরিবারও তাদের ফসলি জমি হারিয়ে রিজিকের সন্ধানে বউ-বাচ্চা নিয়ে পাড়ি জমাতে থাকল সুদূর অসমে। সেখানে নাকি কষ্টসাধ্য কৃষিকাজ করার জন্য দুর্গম অরণ্যাঞ্চল কেটে সাফ করতে পারলে জমিদারের কাছ থেকে জুমচাষের জমি বরাদ্দ পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ গেল মুট বহনসহ কুলি-কামিনীর কাজে, বাসা-বাড়িতে দারোয়ান-পাহারাদার এবং ঝি-চাকরের কাজে সুদূর কলকাতায়। নদী তীরের জমিতে যারা একদিন সোনার ফসল ফলাত-ভাঙনের কবলে পরে তারা হতে থাকলো অসমে অরণ্যবাসি।
যেদিন দানেস মিয়ার বাবা মোতালেব মিয়া তার স্ত্রী, তিনটি মেয়ে ও একমাত্র ছেলে দানেসকে নিয়ে অসমের উদ্দেশ্যে দেশান্তরি হতে রওয়ানা দেয়, সেদিন গ্রামের অনেকে জড়ো হয়েছিল মিয়াজি বাড়িতে। বাতেন মিয়াজির বাবা সেমেদ মিয়াজি বাধা দিয়ে বলেছিল, তুই গ্রাম ছেড়ে যাইসনা মোতালেব। তরে গ্রাম ছাইড়া চইলা যাইতে আমাদের মনে কিছুতেই সায় দিতাছে না। তুই না তর ছেলে দানেস মিয়ারে আমার বাতেনে সাথে দুস্তি পাতাইছস। ওদের কথা কি একবার ভাবছস! দানেসকে ছাড়া আমার বাতেন কেমনে থাকব? তই কি করুম ‘ক’। ফসলি জমিতো আর এক ইঞ্চিও বাকি নেয় দেখতেই পাইতেছস। তুই তর ভিটে বাড়িটুকুও হারিয়ে আমাদের বাড়িতে আশ্রয়গ্রহণ করছস সত্য। থাকতে চাইলে থাকতে পারবি। আমাদের পক্ষ থাইকা কোনো বাধা নাই। তই আমাদের এই অবশিষ্ট ভিটে বাড়িটিই যে কতটকু রক্ষা অইব হেই বিষয় নিয়া ভাবতেছি। তবু কই যদি থাকতে চাস তই থাক। প্রয়োজনে সকলে মিলে এদেশেই, নদীর তীরেই কোনো না কোনোভাবে বসতি গড়ে তুলে মিলেমিশে বসবাস করব। অচেনা অজানা দেশের অরণ্যবাস কেমন অইব তারত কোনো কিছুই জানি না আমরা। সাপ-কুপেই কাটে না বাঘের পেটেই যাস তার কি ঠিক-ঠিকানা আছে! মমতাজের বাবা মহরম মিয়াও বাধা দিয়েছিল তার ছোট ভাই মোতালেবকে। বলেছিল তুই যাইসনা ভাই, আমার যদি সামান্যতম সাধ্যি থাকত, তরে কিছুতেই আমি অসম যাইতে দিতাম না।
খুব কান্নাকাটি করেছিল মোতালেবও। তার বউ-বাচ্চারাও টিপে টিপে ফেলছিল চোখের জল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল দানেস মিয়া। দূরে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল মমতাজও। আর মনে মনে বলছিল, তুই একটা গাড়ল, কা-পুরুষ দানেস। তুই না কইতি আমারে তুই বিয়া করবি। হেই কথা ভুইল্লা তুই কেমনে জঙ্গলের দেশে যাইতাছস? সেই দৃশ্য দেখে বাতেনেরও চোখের পানিও টলমল করছিল। তবু কি আর ঠেকানো গিয়েছিল দানেসদের। মেঘনার অব্যাহত ভাঙন যেমন ঠেকানো যায় না। তেমনি অভাবী মানুষের দেশান্তরও ঠেকানো যায় না। অভাব-যন্ত্রণাকাতর মানুষেরা শত হাহাকার এবং কষ্ট বুকে চেঁপে ধরে বাপ-দাদার স্মৃতিবিজড়িত প্রিয় জন্মভূমিকে পিছনে ফেলে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে পাড়ি জমায় অজানার উদ্দেশ্যে এক মুঠো ভাতের সন্ধানে-মাথাগুজার ঠাঁইয়ের আশায়।
কাছাড়ের দক্ষিণস্থ লুসাই পাহাড়ে প্রায়ই হাতীর উপদ্রপ ছিল তাদের জীবনের জন্য নিত্যদিনের ঘটনা। এছাড়া উত্তর কাছাড়ের জয়ন্তীয়া পাহাড়ে বাঘ, ভল্লুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তু এবং প্রচুর বানরও ছিল তাদের মতো সমতল অঞ্চলের মানুষের জন্য চরম দুর্গতির কারণ। তবে এসব হিংস্র জীব-জন্তুর হাত থেকে বেঁচে থাকার কৌশল সম্পর্কেও হরিচরণই তাদের ধারণা দিয়েছিল। আবার মানুষের জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সেখানে বন্যহংস, কাঁদাখোচা পাখি এবং গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, মাহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদিও পর্যাপ্ত থাকায় এইসবকে নির্ভর করেই শুরু হয়েছিল চাষবাসের জন্য তাদের জমি তৈরির কাজ। পাহাড় ও অরণ্যাঞ্চলে জুম চাষের জন্য পাহাড়ে জুমিয়ারা গড়ে তোলেন অস্থায়ী মাচাং ঘর। এই মাচাং ঘরে চাষাবাদের জন্য জুমিয়ারা একই সঙ্গে যেমন ফসলের দেখবাল করেন, তেমনি বুনো পয়মাল বা অন্য জীব-জন্তু ও পাখ-পাখালি যেন ফসলের ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকেও তারা লক্ষ্য রাখেন। জুমের জমি ঘিরে এ জন্য ‘কাবুক’সহ নানা ধরণের ফাঁদ পাতত জুমিয়ারা। তঞ্চঙ্গ জুমিসহ অন্যান্য জুমিদের জন্য এসব ফাঁদ পাতা সহজ হলেও দানেসদের মত নদীভাঙা মানুষ এধরনের কাজে অভ্যস্ত ছিল না বলে অনেক কষ্টকর ছিল তাদের প্রাথমিক জীবন।
পাহাড়ে এ জুম চাষ সত্যিই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য বিষয়। জুম চাষে একটি পরিবারের নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর সকলকেই অংশগ্রহণ করতে হয়। চাষের মৌসুমে প্রথমে নির্বাচিত পাহাড়টির জঙ্গল ও আগাছা বিশেষ কৌশলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিতে হয়। কৌশলে আগুন ধরাতে হয়, সমগ্র বনাঞ্চলে যেন এই আগুন ছড়িয়ে না পড়ে সে দিকে খেয়াল রাখতে হয়। পোড়া শেষ হলে থাকতে হয় বৃষ্টির অপেক্ষায়। বৃষ্টি হলে পরে বিশেষ ধরনের ছোট দা’ দিয়ে আগাছার গোড়া কেটে ফেলতে হয়। এরপর এসব জমিতে ধান, গম, ভুট্টা, আলু, কলার চাষ করতে হয়। সেই কঠিন জুমচাষে নদী তীরবর্তী চরলাপাং হতে দেশান্তরি হয়ে গিয়ে তাদের অভ্যস্ত হতে হয়েছিল। এভাবে কেউ কেউ দু‘চার খণ্ড জমির মালিক হয়েছিল। কাউকে কাউকে বন্য হিংস্র প্রাণি-সাপ, কোপ বা ভাল্লুক, শুকরের কামড়ে জীবন দিতে হয়েছে। জীবন দিতে হয়েছে ম্যালিরিয়া, প্লেগ, গুটি বসন্ত ইত্যাদি রোগ-শোকে। তাদের সাথে দেশান্তরি হওয়া রমজান প্রাণ হারিয়েছিল ম্যালেরিয়া জ¦রে, তার বড় ছেলেটি একদিন ঢলে পড়েছে গোখরার ছোবলে। মন্নাফ মিয়ার দুই ছেলে প্রাণ হারাল গুটি বসন্তে আক্রান্ত হয়ে। ঘর বান্দার কাজ শেষ হলে হরিচরণের সহায়তায় মোতালেব মিয়া তার বড় মেয়ে আয়েশাকে বিয়ে দিয়েছিল আক্কাস আলী নামের এক ছেলের সাথে। আক্কাস আলীও চানপুর থেকেই অভাবের কারণে তার বাবার সাথে শিলচর গিয়েছিল। তার বাবা শরাফত আলী সেখানে গিয়া ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। আক্কাস আলী তার মাকে নিয়ে হরিচরণের সহায়তায় সামান্য জমি চাষাবাদের উপযোগি করেছিল। আয়েশার সাথে বিয়া হওয়ার পর চেয়েছিল আরো দু‘একটি নতুন জমি চাষাবাদের জন্য। তাই দিন-রাত খেটে যাচ্ছিল আক্কাস আলী ও আয়েশা। কিন্তু নিয়তি তাদের স্বপ্ন সফল হতে দেয় নি। আয়েশা তার স্বামীর সাথে প্রত্যহ জুম চাষের কাজে যেত। অরণ্যাঞ্চলের লতাগুল্ম কেটে সাফ করে পাহাড়ি জামিকে ফসল চাষের আওতায় আনতে তাকে পায়ে হেঁটে, পাহাড় ডিঙ্গিয়ে প্রতিদিন বহুদূরের পথ পাড়ি দিতে হত। পথের এ কষ্ট স্বীকার করা ছাড়া তার আর অন্য কোনো উপায়ও ছিল না। এমনকি সে যখন গর্ভবতী তখনও তাকে এমন কঠোর পরিশ্রম করতে হত। তখন আয়েশার পাঁচ মাসের গর্ভাবস্থা চলছিল। একদিন তার প্রচন্ড জ¦র হল। এক পর্যায়ে তার শরীরে শীত শীত অনুভূত হল এবং কাঁপুনি দিয়ে জ¦র আসতে লাগল। এই জ¦র তাকে কবরে নিয়ে ছাড়ল। মোতালেব মিয়ার মেঝো মেয়ে আনুর মৃত্যুর পর তার স্বামী এক প্রকার পাগলের মত হয়ে গিয়েছিল। এভাবে সাফিয়া ও ফাতেমাকেও তারা হারাল ম্যালেরিয়ার কারণে। কারো বিয়া হয়েছিল, কারো আবার বিয়ের আগেই দুনিয়ার মায়া পরিত্যাগ করতে হয়েছিল। অভাব আর রোগ-শোকের কাছে হার মেনে একদিন মোতালেব মিয়া এবং তার স্ত্রীও চির বিদায় নিয়েছিল। একা হয়ে পড়েছিল দানেস মিয়া। পাহাড়সম দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন নিয়ে একদিন নিজেও সংসার করে সে। তারা দু‘জনই জলেভাসা মানুষ। দানেসের স্ত্রীর বাড়ি ছিল ফরিদপুরের ভাঙা অঞ্চলে। তারাও দানেসদের মত নদীভাঙার কারণেই দেশান্তরি হয়েছিল। পদ্মার সর্বানাশা ভাঙন তাদেরও ভিটেমাটি ছাড়া করেছিল। এরপর এলো ঊনিশ সাতিচল্লিশ সাল। সাতচল্লিশের আগে ও পরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় আরো কতজনের যে কতদিক দিয়ে মরণ হল। কেউ কেউ বেঁ”ে গেছে শত প্রতিকূলতার বিপরীতে। এই বেঁচে থাকা দেশান্তরিদের মধ্যে শত কষ্ট আর লাঞ্চনা-গঞ্জনার ভেতর বেঁচে রইল দানেসের মতো হতভাগারা। দেশ ভাগ হয়েছিল দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। মুসলমান হিসেবে অত্যন্ত প্রতিকূলতা ও ঝুকিপূর্ণ জীবন-যাপন করতে হয়েছে তাদের। তথাপি মা-বাবা ও বোনদের হারিয়ে শাদী-বিয়ে করে শিলচরেই নিজের সংসার পেতেছিল দানেস। এবং পাহাড়ের কঠিন জুম চাষ করে পাড় করতে চেয়েছিল অরণ্যের কষ্টকর জীবন। কিন্তু দুঃখের বিষয়-এতকিছুর পরও সেই অসম দেশ নাকি তাদের নিজ দেশ না। তারা নাকি ভারতীয় না!
সত্যিই অসমে ব্রিটিশ শাসন শেষ হবার কিছুদিন পর, ঊনিশ পঞ্চাশ সালে গোয়ালপাড়ায় আরম্ভ হয়েছিল ‘বাঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন। বাঙালি সংস্কৃতি আর ভাষার আধিপত্য অসমিদের মনো:পত হবার কথাও নয়, হয়ও নি। অসমিরা মনে করেছিল, বিপুল সংখ্যক বাঙালির বাস তাদের অধিকারকে খর্ব করছে। আর বাঙালিদের যখন আলাদা একটি রাজ্য আছে, তখন অসমে থাকা বাঙালিদের বিষয়ে জাতিবিদ্বেষী মনোভাব ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে। তাছাড়া হিন্দুত্ববাদ মনোভাবের দ্বারা মুসলমানদের ঘৃণা এবং বিদ্বেষও সেখানে প্রকট হতে থাকে। ‘বাঙ্গাল খেদা’ শুরু হয়েছিল বাঙালিদের দখলে যেন বিধানসভা চলে না যায় সেই আশঙ্কা থেকেই। অথচ ঊনিশ সাতচল্লিশের অনেক আগেই অবিভক্ত বাংলা থেকে দলে দলে বাঙালিরা অসমে গিয়েছিল। চাষবাস শুরু করেছিল সেখানে। কলকাতা শাসিত অসমে অহমিয়া ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। অসম শাসনের শুরুতেই অসমের জন্য বাংলা ভাষাকেই স্থানীয় মূল ভাষা আর শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলো ব্রিটিশরা। অথচ অসমের মাত্র উনিশ শতাংশ মানুষ তখন বাঙালি ছিল। সেই সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মারপ্যাচ। সেই মারপ্যাচ বুঝার সাধ্যি কি আর আছে দানেস মিয়ার মতো জুমচাষী ও খেটে খাওয়া সামান্য মানুষের।
ঊনিশ পঞ্চাশ সাল থেকেই অহমিয়াকে রাজ্যভাষা বানাতে গণদাবী উঠে আসতে থাকে অসমে। সেই রাজ্যের কাছাড় জেলার শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দিতে হাজার হাজার বাঙালি থাকতেন। অসমীয়দের জাতিবিদ্বেষী এই মনোভাব ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে এবং অসমে বাঙালিদের বহিস্কারের আশঙ্কা বাড়তে থাকে। প্রকটিত হয়ে যায় আলী, মালী ও কুলী খেদাও ধারনাটিও। আলী মানে বাঙালি মুসলমান, মালী মানে বাঙালি হিন্দু এবং কুলী মানে চা বাগনের অবাঙালি শ্রমিক। তাদেরও ভালো চোখে দেখেনি অসমীরা। আর পূর্ববঙ্গ থেকে অসমে যাওয়া উদ্বাস্তুদের কখনোই ভালো চোখে দেখেনি অসমের অন্যান্যরা। উদ্বাস্তুরা হয়েছিল তাদের দু‘চোখের কাঁটা ও বিষ। কিন্তু সেখানকার প্রধান শান উপজাতি অহোমরাও স্থানীয় নয়। তারাও তো ব্রহ্মদেশ হতে এসে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কামরূপ জয় করে রাজত্ব করেছে। তখনই প্রাগ্জ্যোতিষ পরিচিতি পায় অসম নামে। খাসিয়া উপজাতিরাও পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মুসলমানদের ঘৃণা করতো। মুসলমানরা কথা দিয়ে কথা রাখে না, তারা বিশ^াস ভঙ্গকারি হয়-এই হল খাসিয়াদের মনে বদ্ধমূল ধারনা।
অসমের বাস্তুহীন, অরণ্যবাসী কিংবা শরণার্থী মানুষদের উচ্ছেদের বিষয় যে নির্মম ও অমানবিক তা তাদের নৃশংসতা ও অত্যাচারের মাত্রা না দেখলে অনুমান করা যাবে না। তাদের দেয়া হুমকি, খুন, শারীরিক, মানসিক নির্যাতন সর্বদাই সীমা লঙ্ঘণ করে। মানবাধিকার বলতে নূন্যতম কোনো কিছুর উপস্থিতি দেখা মিলে না তাদের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে। আর সেসব যাদের উপর করে তারা মূলত: দানেস মিয়াদের মতো আদাড়বাদাড়ে খেটে খাওয়া, সহায় সম্বলহীন, হতদরিদ্র প্রান্তিক মানুষ। নদীভাঙা, বন্যা, খরার কারণে বাস্তুহীন পরিবার। যারা কখনো বনাঞ্চলে, কখনো পাহাড়ে, কখনো নদীর তীরে, কখনো দীর্ঘদিনের অব্যবহৃত সরকারি জামিতে, অনেকে আবার মেয়াদীপাট্টা পাওয়া জামিতে বসবাস করছে।
সত্যিই আজ এত বছর পর তৎকালিন অখণ্ড ভারতের শীলচরে বসতি স্থাপনকারি মানুষের দেশ নাকি অসম না। দেশ থেকে বিতারণের আতঙ্ক সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরে তাদের। সিএএ এবং এনআরসি-তে তাদের নাম বাদ পড়ে। এতদিন পর সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে দেশে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি উদ্বুদ্ধ হয়। এত বছর পর নাকি নাগরিকত্বের জন্য তাদের কাছে এদের আবেদন করতে হবে। অথচ তারা প্রত্যেকেই অসমের নাগরিক। তাদের কাছে ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড ও প্যান কার্ড সব রয়েছে। রয়েছে পাসপোর্টও। তারা ইনকাম ট্যাক্সের টাকা জমা দেয়। তাদের টাকায় সরকার চলে। তথাপি শিলচরের কাগজে লক্ষ লক্ষ বাঙালি বাদ পড়ার খবর প্রকাশিত হয়।
মোগল-রাজত্বের অধিকারভুক্ত থাকা কালেও শ্রীহট্টের মুসলমান ফৌজদারগণের সহিত ঐ পর্বতবাসিগণের সর্বদাই বিবাদ এবং যুদ্ধাদি হত। শ্রীহট্ট, ব্রিটিশ শাসনাধীনে এলেও তারা সময় সময় আক্রমণে বিরত হয় নি। সেখানের বিবাদ-বিসংবাদ আর শেষ হবার নয়। আর দানেসদের জীবনের নিরাপত্তাও সেখানে আসার নয়। তাই এবার উপায়ান্তর না দেখে সেই শৈশবের স্মৃতিকে মনের কোণে ধারণ করে দানেস চলে এলো বাপ-দাদার জন্মভূমিতে। চরলাপাং-এর মানুষ হয়ত জীবন সংগ্রামে পরাজিত হয়ে যাই নি সেই বিশ^াস ছিল দানেসের মনে। সত্যিই দানেস আজ আনন্দিত। বাতেনের ঘরে আছে তার আদরের চাচাত বোন এবং শৈশবের ভালোবাসার মানুষ মমতাজ, তা-ও এক সুখের সংবাদ। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে এ চরেই তারা এখন ভাল আছে। ভাল নেই কেবল দানেসরাই। কেন যে তার বাজান দেশান্তরি হয়েছিল? মরতে যখন হতো এদেশে থেকেই, না খেয়েই মরত। অভাব, ধর্ম এবং জাতিভেদের আগুনে জ¦লে-পুড়ে নিঃশে^স হতে হতো না। এসব ভাবতে ভাবতে এক সময় দানেসের দু‘চোখের কোণে জমে উঠে দু‘ফোটা অশ্রু বিন্দু। এরপর গলে গাল সয়লাব করে গড়িয়ে পড়ে নিচের দিকে।