মেহেদী ধ্রুব

গোলকধাঁধা

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

এই গল্পের নাম যমজ রাখলে অসার্থক হতো না, হয়তো বেখাপ্পাও মনে হতো না, কারণ, এখানে যমজ গাছ, যমজ ফল, যমজ জ্বিন, যমজ মেয়ে ও যমজ পুরুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে; প্রথমে দেখা যাবে যমজ গাব গাছ, গাছের মাথা দুইটা কিন্তু গোড়া একটা, একটা আরেকটা থেকে আলাদা হয়ে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সেই ছোট্টবেলা থেকে আমি এই যমজ গাছ ও যমজ গাবের রহস্যে আবদ্ধ হয়ে আছি। তখন শোনা কথার জবাব দেয়ার মতো জ্ঞান ছিলো না, কিন্তু আজ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমেরিকা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে এসেছি, এইবার হয়তো আমাকে জবাব দিতে হবে। অবশ্য এই জবাবের জন্য সময় আসতো না কখনো, সময়টা করে দিয়েছেন ভিসি স্যার, তিনি তাঁর ক্ষমতা বলে আমাকে ওএসডি করে রেখেছেন, আমি কোনো রকম উল্টাসিধা চিন্তা না করে সোজা চলে এসেছি নাড়ী পোতার স্থানে। কিন্তু এই মায়াময় ধূলো, উছলা বাতাস ও মহীরুহ প্রাণের মাঝেও আমাকে একটা রহস্য ভেদ করতে হচ্ছে, সকাল-সন্ধ্যা একটা দিঘির পাড়ে বসে আছি, আপনারা সাথে থাকেন, প্লিজ, চলুন, দেখি সামনে কী আছে।

প্রথমেই দুই মাথা এক গোড়াওয়ালা যমজ গাব গাছের কথা বলি, সেই ছোট্টবেলা থেকে আমরা সবাই এই গাছকে যমজ গাছ জেনে আসছি, শুধু তা-ই নয়, তাতে যে দুইটা যমজ জ্বিন কাওলাকাওলি করে তাতে সন্দেহ পোষণ করার শক্তি নাই কারো, তাই আমার মতো ভীতুরা গাছটা দেখেছে অল্প-স্বল্প, ওই দূর থেকে উঁকি মেরে দেখা যাকে বলে। আমাদের মনে হতো, এই বুঝি জ্বিনরা আছর করে বসে, এই বুঝি গাছের ডাল ভেঙে ফেলে মাথার উপর অথবা এক চুমুকে শুষে নেয় সবটুকু রক্ত !

এই গাব গাছ নাকি জ্বিনেরা কুহকাফ থেকে এনেছে। এতো বছর পরে আমার মনে হয় এতো গাছ থাকতে কুহকাফ থেকে গাব গাছ আনতে যাবে কেন? গাছের  যমজ গাব নিয়ে জেহাদি মুন্সি বলে, শনি-মঙ্গলের নিশিতে যমজ গাব পেকে পড়ে মাটিতে, আর সেই যমজ গাবের একটা বিচি মরা মানুষের মুখে দিলে সাথে সাথে জ্যান্ত হয়ে যাবে মানুষটা, শুধু তা-ই নয়, এই গাব খেলে যে কারো ভাগ্য পরিবর্তন হয়ে যাবে, এই গাবে আছে এক জাদুকরী ছোঁয়া, যেন পরশপাথর, ছুঁলেই সোনা আর সোনা। এই কারণেই হয়তো বেপারী বাড়ির জাহাঙ্গির আমাকে জিজ্ঞেস করে ‘ভাইস্তা, তুমি নাকি যমজ গাব পাইছিলা একবার?’ সত্যি কথা বলতে কী, এই যে ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া, বিদেশে যাওয়া, বাড়ি করা এইসব নাকি ওই যমজ গাবের কারণে হয়েছে। আমার কেমন সন্দেহ হয়, একদিন সত্যিই মা আমাকে গাবের বিচি দিয়েছিলেন একটা, আমি জিজ্ঞেস করলে মা বলেছিলেন, ‘তুই এত গাব গাব করছ, এইটা মোড়লদের গাছ থেকে আনছি।’

এই যে আমি এইসব চিন্তা করছি, এই প্রযুক্তির যুগে, যেখানে পৃথিবীটাই একটা গ্রাম সেখানে নিজের গ্রামের এইসব কথা বলতে গিয়ে সংকোচবোধ করছি, এই যে আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে আসার পরেও এইসব কথা বলছি, এই কারণে আমার জরিমানা হওয়া উচিত নয় কি? ভাগ্যিস মনের কথা মনেই আছে। অবশ্য মনের কথা মনে থাকার দারুণ সুবিধা, কতো কী চিন্তা করা যায়, ভাবা যায়, সন্দেহ করা যায়, ঈর্ষা-হিংসা করা যায়, কেউ জানতে পারে না।

ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি যেদিন যমজ গাবের বিচি মুখে দিবে কেউ সেদিন তার মনের আশা পূর্ণ হয় অথবা রোগ-বালাই সেরে যায় অথবা সে নাকি পাওয়া পায়; পিতলের কলসির ভেতরে থাকে সোনা আর সোনা। সংগ্রামের বছরের পরের বছরে নাকি সৈয়দ বরকতুল্লাহ যমজ গাবের বিচি খেয়েছিলো একটা, আর ওই বছরই সে ছনের ঘর ভেঙে টিনের ঘর দেয়, হালের গরু কিনে ৪ জোড়া, জমি কিনে ২১ বিঘা। সে এখন ২/৪ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি, সরকারি দলের কাউন্সিলর। তাই এই রকম পাওয়া পাওয়ার জন্য আমার বাপ-চাচারা ৪৭ বছর ধরে কাঁচা অথবা পাকা গাব খেয়ে আসছে আর মনে মনে নিজের কপালকে গালি দিচ্ছে অথবা যমজ গাব পেয়েও কাঁচা অথবা পাকা গাবের গল্প করছে। এইসব যখন ভাবছি তখন যমজ মেয়ে জুঁই ও জবা দিঘিতে কলা গাছের খোল দিয়ে বানানো নৌকা ভাসায়। তাদেরকে নৌকা বানিয়ে দেয় ফালাইন্না। এই কাজ ছাড়া তার প্রধান কাজ হলো গাব গাছ পাহারা দেয়া। আমি লক্ষ করি ফ্রকপরা ১১/১২ বছরের জুঁই ও জবা নৌকা ভাসানোর পরে সেই নৌকাতে ব্যাঙ উঠে বসে। তখন তারা ভীষণ মন খারাপ করে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। ওদের চলে যাওয়া দেখতে ভালো লাগে না আমার, কখনো কখনো ওরা জেহাদি মুন্সির কাছে গিয়ে গাব চায় : বড়বাপ, আমাদের যদি একটা যমজ গাব দিতেন।

বড়বাপ আতরের খুশবো ছড়িয়ে বলে : কুদরতি গাব তো নাই বাজান, শ্যাষ হইয়া গ্যাছেগা, কাইল দিমুনে।

ওরা মুখটা বিষের মতো করে চলে যায়। তখন আমার ছোটভাই গাব গাছের ছবি তুলে ফেইসবুকে আপলোড করে লিখে : এই যমজ গাছে সারা বছর গাব ধরে, এই গাছের যমজ গাব খাইলে যেকোনো রোগ থেকে মুক্তি মিলে, মনের আশা পূর্ণ হয়, আজব এই ঘটনাটা শেয়ার করে সবাইকে জানিয়ে দিন।

পোস্টটা ভাইরাল না হলেও অনেকে হয়তো মনে মনে বিশ্বাস করেছে, ফলে যমজ গাব সংগ্রহ করার লোক বাড়ে। ভক্তদের আগ্রহ দেখে জেহাদি মুন্সির ছেলে লালাজিৎ গাছের চারদিকে বেড়া দিয়ে একটা টিনের মধ্যে রং দিয়ে লিখে : এই গাছের যমজ গাবের হাদিয়া ১০০১ টাকা।

এতো টাকা দিতে আপত্তি নাই কারো, কিন্তু গাছে যমজ গাব নাই, একটা যমজ গাবও দিতে পারে না মুন্সি। যমজ গাব না পেলেও মুন্সি ভক্তদের বলে যমজ গাব হলে ভালো কাজ করে, তবে কাঁচা বা পাকা গাবও কামের জিনিস, ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে যমজ গাবের চেয়ে কোনো অংশে কম না, কখনো কখনো বেশি। তবে আগ্রহীরা খুব একটা বিশ্বাস করে না, তবু অনেকে যমজ গাব না পেয়ে ৭০১ টাকা দিয়ে কাঁচা অথবা পাকা গাব নিয়ে যায়।

এই পাকা বা কাঁচা গাবের দাম যমজ গাবের চেয়ে কম হলেও ভক্তদের ভিড় বাড়ে, আমি লক্ষ করি, জেহাদি মুন্সির ভক্তরা অনেক কিছু নিয়ে আসে। আমি ঘাটে বসে, জুঁই ও জবাকে দেখি, দেখি এক মহিলা, বোরকা পরে আসছে, বয়স বোঝা যাচ্ছে না। কাঁচা অথবা পাকা গাব খেয়ে নাকি তার ছেলে জেএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেয়েছে। অথচ এই ছেলে নাকি টেস্ট পরীক্ষায় অঙ্কে পেয়েছিলো ৭ নম্বর। সাথে সাথে আমার নিজের কথা মনে পড়ে, তাহলে কি সেই ছেলেও একদিন আমার মতো ভার্সিটির টিচার হবে? ভিসির বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে ওএসডি কর্মকর্তার তকমা লাগিয়ে গ্রামে ফিরে আসবে?

আমি এক ঘোরের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি বোধহয়। ওই যমজ মেয়ে, ওদের চেহারা, আচরণ, হঠাৎ করে ওদের কোমর চওড়া হয়ে যাওয়া, কতো কী দেখছি, ভাবছি, দেখছি, মাজারের মতো মহিলা ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রতিদিন ২০/৩০ জন আসে। আমি তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। তাদের সমস্যা জানার চেষ্টা করি। কারো ছেলে বিছানায় প্রস্রাব করে দেয়, কারো স্বামী জুয়া খেলে, কারো মেয়ের শনি মঙ্গলের আছর আছে। কথা বলে এইটুকু বুঝতে পারি যে, তারা কেউ কোনো দিন যমজ গাব পায় নাই, তবু তাদের কারো কারো সমস্যা সমাধান হয়েছে।

ইদানীং জেহাদি মুন্সির ছেলে লালাজিৎ গাব গাছের খোঁজ-খবর নিচ্ছে। সে ফালাইন্নাকে এটা-সেটা করতে বলে, প্রত্যেক দিন আসরের নামাজে অংশ নেয়। তার সাথে আমার কথা হয়, তাকে চাচা বলে ডাকি। সে আমার সম্পর্কে জানতে চায়, কেন আমি ঘাটে বসে থাকি। ভক্ত অথবা তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলতে দেখেছে সে। তাই হয়তো আমার উদ্দেশ্য বুঝতে চায়। আমিও তাকে বলি যদি কোনো দিন যমজ গাব পাওয়া যায় তবে আমাকে যেন দেয়, টাকার জন্য আটকাবে না। সে খুব খুশি হয় এবং বলে : ঠিক আছে বাবা, তুমার যতো ইচ্ছা এই দিঘির পাশে বসে থাকো, দিঘির পানি নিয়া গবেষণা করে এটা জানতাম না, তুমার মুখে নতুন শুনলাম, তুমি আমাদের গর্ব বাবা।

আমি তাকে গবেষণার কথা বলেছিলাম, বোধহয় বিশ্বাস করেছে। মিথ্যা বলার জন্য আমার কেমন লাগছে, তবে এই ভেবে স্বস্তি বোধ করি যে আমি তো কারো অপকার করছি না, জাস্ট ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি। বারবার মনে আসে, মা আমাকে একদিন গাবের বিচি খাইয়ে ছিলেন। তারপর থেকেই তো আমি ভালো রেজাল্ট করতে শুরু করি, ওই ছেলেটির মতো। আসলে ওই গাবের বিচির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই হয়তো, আর মা তো বলেছিলেন ওই গাব নাকি মোড়লদের গাছের। তবে মোড়লকে জিজ্ঞেস করলে তিনি মনে করতে পারলেন না কেন? আমাকে বলেছেন, ‘কী যে বলো বাবা, একটা গাবের জন্য তুমার মার কাছ থেকে টাকা নিবো কেন? তুমার মা যদি আমারে বলতো তাইলে আমি নিজে পাইরা দিতাম গাব, গাব একটা জিনিস হইলো নাকি!’

মা তো মিথ্যা বলার মানুষ না, তবে কী সেটা মুন্সির গাছের যমজ গাব ছিলো ! আর এই কারণে অকালে মারা গেছে মা, মারা যাবার আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘বাবা, আমি দেখতে পাচ্ছি, তুই একদিন বিদ্যাবুদ্ধিতে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবি’।

এই গাবের রসহ্যটা আমাকে খণ্ডন করতেই হবে। আমি গাছের কাছে থাকার চেষ্টা করি, দেখি, আসরের আযানের অনেক আগেই ভক্তরা ভিড় করলে জেহাদি মুন্সি বলে : চলেন আগে পরকালের কাজ আদায় করি, পরে ইহকালের কাজ।

আমিও ভক্তদের সাথে মসজিদে নামাজ পড়তে যাই, ভক্ত আর ভক্ত, মসজিদের বারান্দাতেও ধরে না, তাই মসজিদের বাইরে খোলা জায়গায় কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে পড়ে। নামাজ শেষে জেহাদি মুন্সির চ্যালা ফালাইন্না ভক্তদের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে : আল্লাহর কথা স্মরণ করেন, রাসুলের কথা স্মরণ করেন, কলেমা পড়তে থাকেন, দুরত শরিফ পড়তে থাকেন, আপনারা আপনাদের পাপের কথা স্মরণ করেন, জিন্দিগির কথা ভুলে যান, এই সময় দিলের মইধ্যে জিন্দিগির কোনো চিন্তা আসলে জ্বিনদের এই কুদরতি গাব কোনো কাজে আসবে না।

প্রত্যেক শনিবারে ফালাইন্না এই মুখস্থ কথাগুলো বলে এবং প্রত্যেক শনিবারে ভক্তরা জ্বিনদের যমজ গাব না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে; তবু তারা এই গাছের যমজ গাব খাবার জন্যে প্রত্যেক শনিবারে ভিড় করে। যারা খালি হাতে ফিরে যায় তারা ফেইসবুকে এই গাছের ছবি শেয়ার করে। তবে কিছু দিনের মধ্যে ভক্তের ঢল নামে, ভক্ত আর ভক্ত, ভক্তের মাথা ভক্ত খায়। দেশ জুড়ে রাষ্ট্র হয় খবরটা : এই গাছের ফল জ্বিনদের দেওয়া, এই ফল খাইলে মনের আশা পূর্ণ হয়।

এইসব অবস্থা দেখে, শুনে ও বুঝে লালাজিতের ছেলে বিহারিদের মতো লম্বা ওয়াসিম গাছের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সাইনবোর্ডে লিখে দেয় : জ্বিনদের গাছে যমজ গাব নাই, একটা কাঁচা গাবের হাদিয়া ৫০১ টাকা, পাকা গাবের হাদিয়া ৭০১।

লালাজিতের হাত থেকে ক্ষমতা চলে আসে তার ছেলে ওয়াসিমের হাতে, কিন্তু শাসকের পরিবর্তনের সাথে সাথে হাদিয়ার টাকা কম বেশি হচ্ছে, প্রথমে ১০০১, তারপর ৭০১, অথবা ৫০১, তবে মৌলিক কোনো পরিবর্তন লক্ষ করছি না, দেখছি, বাড়ছে ভক্তদের তালিম দেয়া। মুন্সি নিশ্চুপ হয়ে গেলেও তালিম দেয়াতে ওস্তাদ, তাকে দেখার পরে এক একজন যেন পাগল হয়ে যাবে। তার মুখভরা সাদা দাড়ি, সাদা চুল, সাদা চামড়ার চেহারা ফেরেশতাদের মতো মনে হয়। তার পাঞ্জাবি থেকে আসে আতর গোলাপজলের ঘ্রাণ। দেখলেই বোঝা যায় কামেল লোক; যেন সাক্ষাৎ ফেরেশতা যেন আল্লাহ্ নূর ঢেলে দিছে পাত্তি পাত্তি। এই সময়ে জুঁই ও জবা আবার আসে এবং কাঁচা অথবা পাকা গাব চায় : একটা গাব দিতেন বড়বাপ।

বড়বাপ গাব না দিয়ে বলে : ছি মা, গাব বলো না, বলো কুদরতি গাব।

আচ্ছা কুদরতি গাবই দেন।

কুদরতি গাব পোলাপাইনদের খাইতে নাই।

তখন জুঁই ও জবা মন খারাপ করে চলে যায় ফালাইন্নার কাছে। ফালাইন্না তাদের জন্য নৌকা বানিয়ে গালে হাত দিয়ে আদর করতে চাইলে তারা ছ্যাং ছ্যাং করে। তারা দৌড়ায় এবং নৌকা ভাসায়। ওদের দেখে আমার মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু ওদের মন খারাপ হয়ে যায়, নৌকাতে ব্যাঙ ওঠে বসে বলে, ওরা বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

এইসব দৃশ্য দেখছি, বুঝছি, সেই ছোট্টবেলা থেকে শুনে আসছি যমজ সব ব্যাপার, শুনে আসছি জেহাদি মুন্সির গল্প। আমি নিজ কানে দাদার মুখে শুনেছি, ‘আমরা নিজেরা দেখলাম যৌবনেও জেহাদি মুন্সির ওপরে কথা কওয়ার মানুষ ছিলো না এই গেরামে, এত্তো লেখাপড়া, এত্তো বড়ো আলেম এই গেরামে পইড়া রইছে এইটা এই গেরামের মানুষের ১৪ গোষ্টির ভাইগ্য, তাছাড়া এতো টাকা পয়সার মালিক ২/৪ গেরামে আর নাই’।

জেহাদি মুন্সির কোরআন শরিফ তেলাওয়াতের সুরে নাকি জ্বিনেরা পাগল হয়ে কুহকাফ থেকে যমজ গাছ এনে দিয়েছে। এই মুন্সির ক্ষমতার সীমা নাই, সংগ্রামের সময়ে নাকি তাকে বিহারিরা পর্যন্ত কিচ্ছু বলার সাহস করতো না, সে নাকি বিহারিদের সাথে সমান তালে উর্দু বলতে পারতো। সে নাকি ইন্ডিয়ার দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে পড়ে আসছে। সংগ্রামের সময়ও নাকি সে গ্রামের মানুষের পাশে ছিলো। সেই সময় আমাদের বাপ দাদারা যখন ভাষণ শুনে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তখন সেও ভাষণ দেয় ‘কইত্তে এক নেতা আইছে, শেখ মুজিব, সে নাকি দ্যাশ স্বাধীন করবো? কচুটা করতে পারবো, এই শালা নিজেই একটা মালাউন, মালাউনগর দালালি করবো নাতো কার দালালি করবো? দ্যাশটারে ইন্ডিয়ার কাছে বেইচ্যা দেওয়ার একটা পায়তারা করতাছে শালারা; এই সময় আপনাদের সাবধান হওয়া দরকার; এইসব নাফরমানি য্যানো আপনাদের না পায়।’

এইসব স্মরণ করে ও ভেবে আমি জেহাদি মুন্সির ৭৮ বছর আগের পাওয়া যমজ গাব গাছটার দিকে চেয়ে থাকি। সংখ্যাগুলো মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। কারণ, ১৯৩৯ সালে নাকি জ্বিনেরা কুহকাফ থেকে বীজ এনে রোপন করেছে। বীজ লাগানোর ৮ বছর পরে বীজ থেকে চারা গাছ হয়েছে, তার ৫ বছর পরে, মানে ১৯৫২ সালে চারা গাছ বিশাল গাছে পরিণত হয়েছে, তার ১৪ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে এই গাছে একটা দুইটা ফুল ধরেছে, তার ৩ বছর পরে ডালে ডালে হাজার হাজার ফুল ধরেছে, তার ১ বছর পরে ফুল পাতায় পাতায় ছেয়ে গেছে এবং তার ১ বছর পরে মানে সংগ্রামের বছরে ফুল থেকে গাব হয়েছে।

এই গাছের ইতিহাসের সাথে নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া তারিখের সম্পর্ক কী? এখানে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন, জেহাদি মুন্সির উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করা প্রয়োজন, তবে এইসব রহস্য অথবা সন্দেহের মাঝেও জুঁই ও জবা তির তির করে দৌড়ায়, একবার বাড়ির ভেতরে ঢোকে তো আরেক বার বের হয়, তাদের নূপুরের শব্দে মও মও করে সবটা জায়গা। আসলে যমজ মেয়ে ২ টা ২ রকম হলেও ওদের দেখে যার ভালো লাগবে না তার মন বলে কিছু নাই। কিন্তু ওদের জন্মের আগের ইতিহাসটা জানা দরকার, অবশ্য তার আগে ওদের বাবা ওয়াসিম ও চাচা জসিমের জন্মের ইতিহাসও শোনা প্রয়োজন।

প্রথমেই বাপ ও চাচার জন্মের কথা, সংগ্রামের সময় গ্রামের মানুষ বিহারিদের ভয়ে আতালে-পাতালে দৌড়ায় আর বউ-বাচ্চা নিয়ে মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে, তখন কিন্তু জেহাদি মুন্সির ছেলের বউকে বিহারিরা ধরে নিয়ে যায়। কী কাণ্ড দেখেন ! সবাই তাজ্জব হয় : জেহাদি মুন্সির পুতের বউরে ধইরা লইয়া গ্যালো গা, কই গ্যালো মুন্সি? কই তার সোলেমানি তাবিজ? কই তার সোলেমানি পাথর, কই তার সোলেমানি তলোয়ার? কই তার জ্বিনরা?

অবশ্য খবরটা পাওয়ার পরে জেহাদি মুন্সি সৈয়দ বরকতুল্লাহকে সাথে নিয়ে ছুটে ভিটিপাড়া স্কুলের দিকে, কুত্তার মতো হাঁপাতে হাঁপাতে ওঠে স্কুলের মাঠে এবং ছেলের বউকে উদ্ধার করে। যে মেজর সাবের সাথে মুন্সির দহরমমহরম সম্পর্ক সেই মেজর সাবের ঘর থেকেই নাকি লালাজিতের বউকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করে আনার পরে বউয়ের চোখে পানি টানি নাই, কোনো আক্ষেপ নাই, কষ্ট নাই, আহাজারি নাই। বউয়ের এই রকম বেহায়া ভাব দেখে স্বামী লালাজিতকে কাছি দিয়েও ধরে রাখা যায় না, সে চিৎকার দিয়ে বলে : এই বউ আমি রাখতাম না বাজান, এই মাগি, ক তরে কী করছে বিহারিরা? ক তুই দিঘিতে গ্যাসস ক্যায়া? তরে না কইছিলাম দিঘি থেইকা আমি পানি আইনা দিমু, তুই দিঘিতে গ্যাসস ক্যায়া? আয়, আমার লগে; আয়, ক্যামন গুসল করতারস; তরে আইজকা জন্মের গুসল করাইয়াম।

তখন ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা কুচকুচে কালো বউকে লালাজিৎ দিঘিতে নিয়ে চুবায় আর গালি দেয়। কয়েক চুবান দেয়ার পরে নাকি লালাজিৎ বউয়ের ভেজা শরীরের দিকে চেয়ে শক্তি হারিয়ে ফেলে। হয়তো বউকে আবার চুবানি দিতে গিয়ে হাত থরথর করে। হয়তো বউকে বাড়িতে নিয়ে আসে সে এবং ঘরে ঢুকে তার আরো মায়া হয় বউয়ের প্রতি। এক সময় হয়তো শুয়ে পড়ে তারা। হয়তো বউকে কাছে টানে লালাজিৎ। তখন হয়তো মনে পড়ে দাদার আমলের কথাটা : যেইদিন বউয়ের পিঠে পড়ে চ্যালাকাঠ, সেইদিন রাতে বউ কয় বাপরে বাপ ।

হয়তো অন্য রকম রাত ছিলো তাদের। তবে এটা সত্যি যে, এই ঘটনার ২ মাসের মাথায় লালাজিতের বউয়ের পেট উতাল-পাতাল করে। যমজ গাছের মতো বউয়ের পেটও বিশাল আকার ধারণ করে। গাবের ভারে গাছ যেমনে নুয়ে পড়ে তেমনি বউও নুয়ে পড়ে। সাথে সাথে দেশ স্বাধীন হয়, ২৪ বছর পরে প্রথম বারের মতো লালাজিতের বউ ছেলে জন্ম দেয়, একটা না, দুই দুইটা আস্ত ছেলে, ২৪ মিনিটের মধ্যে ২ টা ছেলে বের হয়ে আসে। কিন্তু লক্ষ করলে বোঝা যায় ‘দুইটা পোলা হইছে দুই রকম, একটা কালা আরেকটা ধলা, একটার নাক বোঁচা মান্দাইগর মতন আরেকটার নাক লাম্বা বিহারিগর মতন।’ ছেলে ২ টার নাম রাখা হয় ওয়াসিম ও জসিম। কালো কুচকুচে ও বিহারিদের মতো নাক লম্বাটার নাম ওয়াসিম, আর লালাজিতের মতো নাক বোঁচা ধলাটার নাম জসিম।

আমার মনে পড়ছে পত্রিকাতে পড়া সেই রিপোর্টের কথা, কয়েক ঘণ্টা সময়ের ব্যবধানে ১ জন নারী ২ জন পুরুষের সাথে সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্সে গেলে তাতে যমজ সন্তান হলে সেই যমজের বাবা ভিন্নও হতে পারে। আচ্ছা, মেজর সাবের রুম থেকে লালাজিতের বউকে উদ্ধার করার পরের ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়েছি, ওই রাতের প্রথম প্রহরে লালাজিত কী করতে পারে তাও অনুমেয়, এখানে তেমন কোনো ব্যাপার ঘটে নাই তো? শুধু তা-ই নয়, সেই সাথে ওয়াসিমের যমজ মেয়ে জুঁই ও জবার ব্যাপারটাও রহস্যময়।

এইখানে লক্ষ করা যাক। গ্রামের আনাচে-কানাচে মিলফ্যাক্টরি করা শুরু হলে জমির দাম হয়ে যায় স্বর্ণের মতো। টাকাওয়ালা ওয়াসিম জমি-জমার দালালি করে কোটিপতি হয়ে যায় কয়েক বছরের মধ্যে। তার আছে ফেইসবুক গ্রুপ ‘আমরা শ্রীপুরের বাসিন্দা’। সেখানে জমির ছবি, বিকিকিনির খবর পাওয়া যায়। পৌরসভা নির্বাচন আসলে ওয়াসিম সরকারি দলের কাউন্সিলরের পিছনে পাত্তি পাত্তি টাকা খরচ করে, নির্বাচিত কাউন্সিলরের সাথে কোর্ট পরে সভা-সমিতি ও মিটিং-মিছিলে যায়, চোখে সমস্যা না থাকলেও মোটা ফ্রেমের চশমা পরে, মাথার চুল ও গোঁফে কলপ মাখে, সুন্দরী বউ ঘরে থাকার পরেও পার্টি অফিসে রাতের পর রাত কাটায়। তাই অনেকে বলে : ওয়াসিমের বউয়ের বাচ্চা হয় না ওয়াসিমের দোষে, সে রাইতবিরাইতে বাইরে পইড়া থাকে; ১ বছর না, ২ বছর না, ৯ বছর ধইরা বাচ্চা হয় না বউয়ের।

আরো বলে : ওয়াসিমের ২৪ মিনিটের ছোট ভাই জসিম এহনো বিয়া করে না ক্যায়া? ওয়াসিম কি এইটা চোখ্যে দেহে না? আর জসিম বিয়া কইরা কীইবা করবো? তাগোর ২ ভাইয়ের বউ তো একটাই।

এইসব মুখরোচক আলাপ গ্রামের ঐতিহ্য যেন, তবে ৯ বছর পরে ওয়াসিমের বউ যমজ মেয়ে জন্ম দেয়। জন্ম নেয়া এই যমজ নিয়েও কথা আছে : ওয়াসিমের যমজ মাইয়া বড়োটা হইছে ওয়াসিমের মতন লাম্বা, কালা কুচকুইচা, নাক উঁচা; আর ছোটটা হইছে চাচা জসিমের মতো খাডা, নাক বোঁচা ও ধলা।

এই গল্প শুনে আবারো পত্রিকার রিপোর্টের কথা মনে পড়ার কথা, তবে একই পরিবারে এই বিরল ঘটনা কি ২ বার ঘটা সম্ভব? নাকি একবারো ঘটে নাই এই ঘটনা, নাকি আমার পূর্বপুরুষের সাথে আমিও লোকশ্রুতি বিশ্বাস করছি, অথবা করছি না। তবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে আরেকটা কারণে। আমি নিজ কানে শুনেছি সেই সময় বাপ চাচারা বলতো : ওয়াসিমের মাইয়া হইলো ২ টা আর জসিমের বিয়া করার সময় হইলো? জসিম আগে বিয়া করলে এই রকম মাইয়ার বাপ হইতে পারতো কবেই।

এই পর্যায়ে ওয়াসিমকে সক্রিয় হতে দেখা যাবে, সে গাব গাছের দিকে নজর দিচ্ছে, এটা সেটা করছে এবং কিছুদিনের মধ্যে বাবা লালাজিতের স্থান দখল করে। যমজ গাছের দায়িত্ব নেয়ার পরে আমি ভক্তদের আচরণ দেখে যতোটুকু বুঝতে পারি, ভক্তরা মনে করেছে ওয়াসিম যমজ গাব দিতে পারবে, কিন্তু ভক্তদের আশা দুরাশা করে ওয়াসিম পানির দরে কাঁচা অথবা পাকা গাব বেচতে থাকে, ফলে ৫ দিন না যেতেই গাছে একটা গাবও থাকে না। সে বলে : গাব না থাকলেও সমস্যা নাই, গাব গাছের পাতা হলেই চলবে, ঠিক মতো গাবের পাতার রস খেতে পারলে গাবের চেয়ে কম কী।

কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখি, গাবের পাতা কিছু দিনের মধ্যে কমে যাচ্ছে। হিসাব করে দেখেছি, এইভাবে চলতে থাকলে ৫/৭ দিনের মধ্যে গাছের পাতা শেষ হয়ে যাবে, অথচ আমি ভেবেছিলাম শাসকের পরিবর্তনের সাথে সাথে হয়তো ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আসবে।

এইখানে খেয়াল রাখা দরকার যে, গাছের পাতা কমে যেতে থাকলেও ভক্তদের ভিড় কিন্তু বাড়ছে। কেউ পাতার দামের কথা জিজ্ঞেস করলে ওয়াসিম খেপে যায় : দাম বলেন কেন আপনারা? আমরা কি দাম রাখি নাকি? হাদিয়া বলেন, হাদিয়া, এই হাদিয়া খরচ করা হয় জ্বিনদের পিছনে, জ্বিনদের জন্য ডেইলি এক মণ দুধ লাগে, এক ছড়ি সবরি কলা লাগে, যে টাকা হাদিয়া পাই তা দিয়া হয় না, আমরা আরো ভইরা এগুলো কিনি, এই ভোগ না দিলে জ্বিনেরা আস্ত রাখবে না কাউকে, এই কুদরতি পাতা দিয়া আপনাদের কোনো কাজ হইবে না, আপনাদের মনের আশা পূর্ণ হইবে না, আপনাদের রোগ-বালাই দূর হইবে না, মনে বিশ্বাস রাখেন আপনারা, হাদিয়া বলেন, হাদিয়া।

এই কুদরতি পাতা নিতে আসে যারা, তারা জেহাদি মুন্সির সুরত দেখে ওয়াসিমের হুঙ্কার শুনে থরথর করে কাঁপে। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে জেহাদি মুন্সি গাছের সামনে বসে থাকে, আমিও বসে থাকি ঘাটে, দেখি জুঁই ও জবা ওয়াসিমের কাছে গাব চায় : আব্বু একটা গাব দাও না।

আব্বু গাব দিতে চায় না; গাছে পাতাই নাই ঠিকমতো গাব আসবে কোথা থেকে। জুঁই ও জবা কান্না-কাটি করে। গাব না পেয়ে তারা সুরে সুরে ছড়া কাটে : বুলবুলিরে বালা, একটা গাব ফালা, ছোটবেলা মা মরছে আমার বড়ো জ্বালা।

জুঁই ও জবার ছড়া বা কান্না বা আহাজারি কারো কিচ্ছু যায় বা আসে না, তবে এই পর্যায়ে আবারো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়, এইবার জসিম গাব গাছের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাচ্ছে। আমিও চাচ্ছি যেন জসিম গাছের নিয়ন্ত্রণ পায়। জসিমকে তুলনামূলকভাবে শান্ত ও মানবিক মনে হয়। সে ক্ষমতায় আসলে হয়তো গাছের রূপের পরিবর্তন হতে পারে। খুব দ্রুত আমার ইচ্ছে বাস্তবে রূপ নেয়, জসিম গাব গাছের দায়িত্ব পায়, গাব গাছের রূপ আগের মতো ফিরে আসবে বলে আমার মতো ভক্তরা আশা করে, কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি হতে সময় লাগে না। গাছের পাতা শেষ হয়ে গেছে বলে জসিম ডাল-পালা বিক্রি করতে থাকে। তার যুক্তি হলো : পাতার চেয়েও গাছের ছাল বাকল ভালো কাজ করে।

অল্প সময়ের ব্যবধানে জসিমও বড় ভাই ওয়াসিমের মতো, বাবা লালাজিতের মতো, দাদা জেহাদি মুন্সির মতো দাড়ি রাখে, মাথায় পাগড়ি পরে, উচ্চস্বরে কোরআন তেলাওয়াত করে। তখন তার অত্যন্ত কাছের লোক আমিরুল ভক্তদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয় : আজ এই কথা প্রমাণিত যে, জেহাদি মুন্সির সুযোগ্য উত্তরসুরি তারই সুযোগ্য ছেলে লালাজিৎ সাহেব এবং তারই সুযোগ্য নাতি মোহাম্মদ ওয়াসিম ও মোহাম্মদ জসিম যেভাবে মানুষের সেবা দিতাছেন, তাতে বাংলার সাধারণ মানুষ তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ, আপনারা হয়তো জানেন এই কুদরতি গাছের ফল, পাতা, শেকড়, বাকল খেয়ে আমি সন্তান লাভ করেছি, অনেকের ব্যবসার উন্নতি হইছে, এই সব কৃতিত্ব এই জ্বিনদের দেওয়া গাছ ও তাদের মালিক জেহাদি মুন্সি, লালাজিৎ সাহেব, মোহাম্মদ ওয়াসিম ও মোহাম্মদ জসিমের, আল্লাহ্ তাদের দীর্ঘজীবী করুন, আমিন।

একেক জন একেক ফলের কথা বলে। কেউ বলে, ‘এই কুদরতি গাব খাইয়া আমার গোপন রোগ ভালা হইছে’, কেউ বলে, ‘এই কুদরতি পাতা খাইয়া আমার স্বামী আমার ভক্ত হইছে’, কেউ বলে, ‘এই কুদরতি ডাল খাইয়া আমার মাইয়ার মাথা ঠিক হইয়া গ্যাছে।’

অনেকের সাথে আমারও উৎকণ্ঠা বেড়ে যাচ্ছে, যমজ গাব গাছ শেষ হয়ে যাবে যেন, ঠিক সেই মুহূর্তে জেহাদি মুন্সি জেগে ওঠে, দুর্দান্ত গতিতে, আবারো গাছের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে, অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে সে ভক্তদের জানিয়ে দেয়, এই কুদরতি গাছে যতো দিন পাতা না গজাবে ততো দিন এই গাছের গোড়ার ধূলো দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হবে। কারণ, এই ধূলো কোনো সাধারণ ধূলো নয়, জ্বিনেরা কুহফাফ থেকে গাছের সাথে এই মাটি নিয়ে আসছে, আর এই মাটি থেকে যে ধূলো হচ্ছে তা মালিশ করলে গাছের ফল বা পাতার বা ছাল বাকলের চেয়ে কম কাজ করার কথা না।

অনেকে কুহকাফের ধূলো নিতে ভিড় করে। এতে নাকি আরো বেশি উপকার হচ্ছে। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা এসে আগরবাতি ও মোমবাতি জ্বালাতে গেলে মুন্সির নাতিরা হুঙ্কার দিয়ে ওঠে : খবরদার, খবরদার, কেউ গাছের গোড়ায় আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালাইবেন না, এইটা পূজা দেওয়ার জায়গা না, এইসব শিরক এইখানে চলবে না, এই গুনাহর কোন ক্ষমা নাই, এইতা শিরকি কাজ হয় মাজারে, এইটা মাজার না, এইটা হইলো জ্বিনেদের কুদরতি কারবার, আমার দাদা জেহাদি মুন্সি দীর্ঘ ২৪ বছর কঠোর সাধনা করে, ইবাদত বন্দিগি করে জ্বিনদেরকে বশ করেছেন, সেই জ্বিনদের দেওয়া কুদরতি গাছ, মাটি ও ধূলা মানুষের সকল ধরনের সমস্যা সমাধান করতে পারে, কেউ এর পবিত্রতা নষ্ট করবেন না, যদি করেন তবে জ্বিনেরা আপনাদের ক্ষতি করবে, আমরা না করে দিলেও ক্ষতি করবে, খবরদার, হুঁশিয়ার, সাবধান।

এই পর্যায়ের পরিবেশ বেশ থমথমে, আমি বুঝতে পারছি না কিছু, ওএসডির এই সময়ে গাব খাওয়ার রহস্য উদঘাটন করতে এসে কী এক রহস্যের মধ্যে পড়ে যাচ্ছি। গতকাল রাতে কী দুর্ঘটনাই না ঘটে গেলো। আমার স্বপ্নের সাথে এই ঘটনা মিলে যাচ্ছে কী ! স্বপ্নে জুঁই ও জবাকে অনেক আদর করেছি, আর সকালে কি-না দেখি গাব গাছের গোড়ায় জুঁই ও জবা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের শরীর অনেকটা খোলা, উড়ুতে রক্তের ধারা শুকিয়ে গেছে, মাছি ভন ভন করছে। অনেকে বলছে, ‘জেহাদি মুন্সির জ্বিনেরা জুঁই ও জবার ঘাড় মটকাইছে’, কেউ কেউ বলছে, ‘চলাফেরার সময় জুঁই ও জবা জ্বিনদের ছায়ার মইধ্যে পাড়া মারছে’, আবার কেউ কেউ বলছে, ‘হাতে বা পায়ে পাড়া দিলে কিচ্ছু হইতো না, এট্টু-আট্টু আছর করতো, কিন্তু মাইয়া দুইটা কিনা জ্বিনদের মাথায় মারা মারলো’, আবার কেউ কেউ বলছে, ‘জ্বিনরা মেয়ে দুইটাকে ভোগ করছে, এই বয়সের মেয়েদের প্রথম বার শরীর খারাপ হলে জ্বিনেরা নাকি আছর করে, হয়তো মেয়ে দুইটা ধকল সহ্য করতে পারে নাই, আর এই কারণে মারা গেছে।’

আমি আর ভাবতে পারছি না, নাকি রাতে যে স্বপ্নটা দেখলাম তা স্বপ্ন ছিলো না, আমিই কোনো এক ঘোরের মধ্যে পড়ে ওদেরকে ভোগ করে মেরে ফেলছি ! ওফ, মাথাটা ব্যথায় টনটন করছে। মনে হচ্ছে আমার ফিরে যাওয়া উচিত। এখানে থাকলে হয়তো পাগল হয়ে যাবো, এই রহস্য ভেদ করার সামর্থ্য আমার নাই, বরং ভিসির হাতে পায়ে ধরলে সব ঠিক হয়ে যাবে, আর তেলবাজি করলে আমার চেয়ে সুখে থাকবে কে?

এইসব ভাবার সময় জেহাদি মুন্সি তার পুরনো ট্রাংক থেকে সোলেমানি পাথর বের করে বিড় বিড় করে সুরাকেরাত পড়ে জ্বিনদের ডেকে আনে; জেহাদি মুন্সির উপর ভর করা জ্বিনেরা জবাব দেয় : এই মেয়ে দুইটার ওপর আমাদের লোভ ছিলো, গতকাল এরা সাবালিকা হয়েছে, নিজেদেরকে আর ধরে রাখতে পারলাম না, আমরা মেরে ফেলতে চাই নাই, কিন্তু বেশি উত্তেজিত ছিলাম বলে মেয়ে দুইটা মরে গেছে।

জেহাদি মুন্সি নিজের রূপে ফিরে আসে এবং কিছুক্ষণ থুম মেরে বসে থেকে খেপে যায়। সাথে সাথে ঘর থেকে বোতল বের করে আনে একটা; সুরাকেরাত পড়ে জ্বিনদেরকে বোতলে ভরে ফেলে। মুন্সির হাবভাব দেখে অনেকে থরথর করে কাঁপে, কেউ কেউ প্রস্রাব করে দিতে চায়।

এই পরিস্থিতিতেও কুহকাফের ধূলো নিতে আসে অনেকে। মনে হচ্ছে ভক্তের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। জেহাদি মুন্সি উত্তেজিত ভক্তদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয় : উপস্থিত মুসল্লিয়ে কেরাম, আপনারা জানেন আমি আমার দাসত্বকারী জ্বিনদের বোতলে বন্দি করে রাখছি, এ জন্যে আপনাদের কুহকাফের ধূলা দিতে পারলাম না, জ্বিনদেরকে উপযুক্ত সাজা না দিয়ে মুক্ত করছি না, আপনারা বাড়িতে ফিরে যান, পরবর্তীতে আপনাদের জানানো হবে।

দূর-দূরান্ত থেকে আগত ভক্তদের সাথে আমিও মন খারাপ করে বাড়ি ফিরি। তখন পত্রিকা পড়ে জানতে পারি, পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট অনুযায়ী জুঁই ও জবার শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি, তবে সেদিন নাকি জুঁই ও জবার পিরিয়ড শুরু হয়।

 

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu