শহরের বাতাসে একটা খবর ভেসে বেড়ায়; কহরদরিয়া গাঙের পাড়ে, মানে রাজধানী থেকে উত্তর-পশ্চিমে যে আটকুঁড়ে প্রফেসর রাজা-বাদশার মতো জীবন অতিবাহিত করছে সে নাকি ভাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, গত তিন মাসে একটা দানাও স্পর্শ করেনি, সকাল-সন্ধ্যা লতাপাতা খেয়ে থাকছে।
তবে এর চেয়েও ভয়ংকর খবর হলো, সে নাকি মানুষের ভবিষ্যৎ অথবা অতীত অথবা খাসলত বলে দিচ্ছে, গল্পের মাধ্যমে। তার নাকি গায়েবি শক্তি আছে, সেই শক্তির জোরে পশু, পাখি, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি তার হয়ে গল্প বলছে মানুষের কাছে।
এইরকম সাংঘাতিক খবর শোনার পরে আমরা একদিন প্রফেসরের আস্তানায় হানা দেবো। আপাতত তার সম্পর্কে যে খবরগুলো জানা গেছে তা শোনা যাক।
প্রফেসর, স্ত্রী মারা যাবার পরে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে আস্তানা বানিয়েছে একটা। নাচ, গান, নাটক, পালা, জারি, সারি, গম্ভীরা এমন কিছু নাই যে তার ওখানে হয় না। নাই খাওয়া দাওয়ার কোনো কমতি, শিষ্য ও চ্যালাপ্যালারও অভাব নাই। টাকা উড়ছে তুলোর মতো। সে নাকি বলে তার কাছে টাকা পান পাতার মতো, যখন তখন খাওয়া যায়, ঠোঁট রাঙানো যায়। অবশ্য এই কথার পক্ষে জোরালো প্রমাণও আছে। উত্তরা তের নম্বর সেক্টরের পাঁচ নম্বর রোডে বাড়ি আছে দুইটা; নয়তলা বাড়ির পাঁচটা করে দশটা ফ্লোর তার নিজের নামে রেজেস্ট্রি করা। মাসে মাসে লাখ লাখ টাকা ভাড়া আসে, ব্যাংকেও আছে কোটি কোটি টাকা। অথচ তার বউ নাই পোলাপান নাই, বলার মতো আত্মীয়-স্বজনও নাই। এই কারণেই নাকি কহরদরিয়া গাঙের পাড়ে ছাপান্ন হাজার বর্গমিটারের যে জায়গাটা আছে সেখানে আস্তানা গেড়েছে সে; যেখানে প্রস্তুত করা হয়েছে চিত্রশালা, সংগীতশালা, নাট্যশালা, বৈঠকশালা, পরামর্শশালা, অতিথিশালা ও নানান পদের কামরা।
এইসব খবর শুনে ও নিজ চোখে দেখে মানুষ শুধু একটা কথাই বলে ‘প্রফেসরের বউ পোলাপান নাই, শেষ বয়সে একটু ফুর্তিফার্তা করে যেতে চায় আরকি।’
এই কয়দিনে বহু শিষ্য জুটে গেছে তার। কেউ কেউ তার জন্য লতাপাতা সংগ্রহ করে। গাঙের পাড়ে এখন আগের মতো লতাপাতা নাই, সবখানে তো বিল্ডিং হয়ে গেছে, তাই লতাপাতা আনার ভার পড়ে বালিয়াপাড়া গ্রাম থেকে আসা জয়নুদ্দিনের ওপর, একসময় তার হালের গরু ছিলো ছয় জোড়া, এখন হালের দরকার নাই, তাই গরুও নাই, আগের দিনও নাই।
আস্তানার প্রত্যেক বিভাগের হেড আছে। এই যেমন, পরামর্শশালার একজন, নাট্যশালার একজন, সংগীতশালার একজন, চিত্রশালার একজন অথবা অতিথিশালার জন্য একজন। তবে প্রফসরের হুকুম ছাড়া একটা কণাও এদিক-ওদিক হয় না। যারা সমস্যা সমাধান করতে চায় বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চায় বা অতীত ইতিহাস বা খাসলত সম্পর্কে জানতে চায় তাদের আগে থেকেই সিরিয়াল দিতে হয়। একদিনে একটার বেশি গল্প শোনানো হয় না। এইসবের জন্য কোন টাকা বা হাদিয়া বা উপহার, উপঢৌকন নেয়া হয় না। প্রফেসরের কড়া হুকুম, কেউ কোনো কিছু নিয়ে আসলে অথবা লতাপাতা নিয়ে আসলেও তাকে যেন গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয়। কয়েকজনকে নাকি গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার পর আর কোন ব্যক্তি এ কাজে পা মাড়ায় না।
আস্তে আস্তে সমস্যা সমাধানের রকমফের বাড়তে থাকে, ভবিষ্যৎ শোনার চেয়ে সমস্যা সমাধানের প্রতি বেশি মনোযোগী হয় প্রফেসর, বিশেষ করে মানুষের মনে কোন সমস্যা থাকলে তার সমাধান ভালো দিতে পারে সে। কে কেমন মেয়ে কেমন ছেলে বিয়ে করলে সংসার সুখের হবে তাও বলে দিতে পারে। এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য তার কাছে ওই ব্যক্তিকে কয়েক ঘণ্টা ঘুমাতে হয়। প্রফেসর এক ঘণ্টা যাবত ওই ব্যক্তির ঘুমানোর পদ্ধতি, শোয়ার ভঙ্গি পরীক্ষা করে কাগজে নোট নেয়, প্রয়োজনে কিছু বই দেখে এবং এক এক করে সব বলে দেয়।
এই ব্যাপারগুলো দেখার জন্য ঘরের আশে-পাশে ভিড় করে অনেকে, কিন্তু সিকিউরিটি গার্ড লাইসেন্স করা বন্দুক নিয়ে তাদের তাড়িয়ে দেয়, আর কতোক্ষণ পরে পরে অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে কৌতূহলী জনতাকে ধমক দেয় : স্যারের কাজে ডিস্টার্ব করবেন না, স্যার ভণ্ডপীর বা ফকির না, আপনারা সরে দাঁড়ান।
নির্বাচন, জমি দখল, খুন ও অপহরণ বিষয়ে ভবিষ্যৎ জানতে চাইলে অন্য পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, অতীত ইতিহাস ও খাসলতের জন্যও একই পদ্ধতির প্রয়োগ চালু আছে। এইরকম কোন ব্যাপার নিয়ে কোনো ব্যক্তি আসলে তাকে একটা গল্প শোনানো হয়। এই গল্প থেকে ওই ব্যক্তিকে তার অতীত ইতিহাস বা খাসলত বা ভবিষ্যতে করণীয় বা অকরণীয় সম্পর্কে বুঝে নিতে হয়।
প্রফেসরের আস্তানায় যাবার আগে তার সম্পর্কে এটুকু জানতে পারলাম। ঠিক হয় আমাদের মধ্য থেকে পাঁচজন ব্যক্তি যাবে। যেহেতু প্রফেসর একদিনে একটির বেশি গল্প বলে না সেহেতু আমাদের পাঁচজনকে পাঁচদিন যেতে হবে। আমাদের পাঁচজনের মধ্যে একজন পশ্চিমের একজন পুবের একজন দক্ষিণের একজন উত্তরের লোক সাজি এবং আরেকজনের নাম রাখি সাম্যজাহান।
পরিকল্পনা মতো আমরা একদিন প্রফেসরের আস্তানায় ঢুকে পড়ি। এক এক করে ঘুরে দেখি সব, ব্যতিক্রম বলতে অনেক ধরনের গাছ আছে, বেশির ভাগ গাছই ঔষধি। হাঁটতে হাঁটতে জয়নুদ্দিনের সাথে দেখা হয়ে যায়। একটা ঘরে অনেক প্রকারের ঘাস, লতা-পাতা ও কচিবাঁশ আছে। সে আমাদের জানায় এগুলোই প্রফেসরের খাবার।
রাজপ্রাসাদের মতো আস্তানা দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিই, প্রথমে সাম্যজাহানকে পাঠানো হবে ভেতরে। এবার তাহলে বাকি কথা সাম্যজাহানের মুখ থেকে শোনা যাক :
তো, কথামতো আমি ভিতরে ঢুকে শুভেচ্ছা বিনিময় করে নিজের পরিচয় দিতেই প্রফেসর উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি অন্য কোন বাঙালির সাথে পরিচিত হলে যেভাবে খুশিতে টকবগ করে বা চোখ-মুখ উচ্ছল হয়ে পড়ে প্রফেসরের একই অবস্থা। প্রথমেই অদ্ভুত একটা ঘ্রাণ পেলাম, কেমন মাদকতা, আমাকে এক গ্লাস শরবত খেতে দিলেন, চোখ দুটো ঢুলুঢুলু করছে যেন, যেন ঘুম পাচ্ছে আমার, আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম, চোখ খুলতে পারছি না, মনে হলো একটা কাঠঠোকরা আমার বুকের উপর বসে মানুষের মতো কথা বলছে, আমি বুঝতে পারলাম গল্প বলা শুরু হয়েছে :
এক দেশে ছিলো এক কাঠঠোকরা। সে মামার বাড়িতে খেয়ে-দেয়ে ঘুরে বেড়ায় আর বড়ো বড়ো কথা বলে। একবার সে মামা মামিদের কথা দেয় যে সাত মামার জন্য সাতটা নৌকা ও সাত মামির জন্য সাতটা নৌকা বানিয়ে দিবে। এটা তার জন্য এমন কী আর। তাছাড়া মামা ও মামির জন্য এতোটুকু কাজ করতে পারবে না তো কার জন্য পারবে? কতো জনকে কতো নৌকা বানিয়ে দিয়েছে সে, আর নিজের মামা-মামির কিনা নৌকা নাই। এই অপমান সে কোথায় রাখবে।
তারপর, নৌকা বানাতে যায় সে, এক একটা ঠোকর দেয় কাঠে আর ঠক ঠক শব্দে কাঠ কয়, ‘মামির জন্য এতো দরদ, তুমি হইলা এমন মরদ।’ মামিদের চেহারা মনে হলেই তার মনটা কেমন করে। তার মামারা তার মতো এতো সুন্দর না, অথচ মামারা কিনা পাইছে এতো সুন্দর সুন্দর বউ। কাঠঠোকরা মামির কথা চিন্তা করে আর কাঠে ঠোকর দেয়। দেখতে দেখতে সাত দিন পার হয়ে গেলেও একটা নৌকাও বানানো হয় না; তাই সে মামার বাড়িতে গিয়ে বলে যে সে ভুল করে ফেলেছে, মামিরা মহিলা মানুষ, তারা ঘরে থাকবে, ঘরের কাজ করবে, বাইরে গেলে মানুষ দেখবে, পর্দা নষ্ট হবে, দোযখের খড়ি হবে, তাই সে চিন্তা করে দেখেছে, মামিদের নৌকার দরকার নাই, সাত মামার সাতটা নৌকা দিয়াই সাত মামি যাইতে পারবে। সে আগামী সাত দিনের মধ্যে সাত মামার জন্য সাত নৌকা নিয়া আসবে। তারপর সাত দিন পার হয়ে গেলেও একটা নৌকাও তৈরি হয় না। পরের দিন সে জানায়, সে অনেক চিন্তা করে দেখেছে, সাত মামার জন্য সাত নৌকার দরকার নাই, মামারা জ্ঞানী মানুষ, চাকরি বাকরি করে, নৌকা দিয়া কী করবে, নৌকা দরকার তো মাঝিদের। মামারা কি মাঝি? একটা নৌকা হলেই তো সব মামা-মামি যাইতে পারবে। এইবার সে ঠিক ঠিক কথা দেয় যে সাত দিন পরে সুন্দর একটা নৌকা নিয়া আসবে। আবার সে ঠক ঠক করে কাঠ কাটে আর মামিদের কথা ভাবে, তারপর আবারো সাত দিন পার হয়ে যায়, কিন্তু কোন কাঠই কাটতে পারে না সে, আবারো মামার বাড়ি গিয়ে বলে, সে অনেক চিন্তা করে দেখেছে মামারা সম্মানী ব্যক্তি, সমাজে তাদের একটা অবস্থান আছে, এখন তাদের নিজের যদি নৌকা থাকে আর তারা নিজেরাই যদি বায় তাহলে মান-ইজ্জত কিচ্ছু থাকবে না, তারচেয়ে বরং মামা-মামিরা মাঝিদের নৌকায় চলাফেরা করবে, তাতে মানসম্মান যাবার কোন ভয় থাকবে না।
এইসব যুক্তি শুনে মামারা উত্তেজিত হয়ে কাঠঠোকরাকে অভিশাপ দিয়া তাড়ায়া দেয় এই বলে যে, এই কাঠ কেটেই তার জীবন যাবে।
এই গল্প আমরা সাম্যজাহানের মুখ থেকে শুনি। আমরা রহস্যের গন্ধ পাই, সাম্যজাহান কি সত্যিই এই গল্প শুনেছে নাকি বানিয়ে বানিয়ে বলেছে, তবে সে তো আমাদের দলের, মিথ্যা বলবে কেন? নাকি প্রফেসর মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে তাকে? না, আপাতত আমরা এইরকম ভাবতে পারি না।
আমরা চিন্তা-ভাবনা করেছি অনেক, পরের দিন পশ্চিমের লোককে পাঠানো হলো। তার অভিজ্ঞতা শুনলেই অনেক কিছু আন্দাজ করা সহজ হবে। এইবার তার মুখ থেকে তার অভিজ্ঞতা শুনবো :
আমি ভিতরে গিয়া সালাম দিলাম, উনি সালামের উত্তর না দিয়া আমাকে ইশারাতে বসতে বললেন। উনার বাম পাশে মানুষের কঙ্কাল আর ডান পাশে একটা ডোরা সাপ। আমার কেমন ভয় ভয় করছে, মনে হচ্ছে মাথাটা ঘুরছে। মুখ দিয়ে রা বাইর হচ্ছে না। মদের গন্ধের মতো একটা গন্ধ নাকে আসে। আমি শরবতের গন্ধ ভেবে সান্ত¦না খুঁজি। উনি এক গ্লাস হাতে নিয়া আরেক গ্লাস আমার হাতে দিয়া পান করতে বলেন, কিন্তু এটা সম্ভবত শরবত না, কোন নেশা হতে পারে, যাক, পরে, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো বাদুড় উল্টো হয়ে ঝুলে থাকে কেন? কেন মুখ দিয়ে খায় আবার মুখ দিয়েই মল ত্যাগ করে? আমি থতমত খেয়ে উত্তর দেই, হ্যা স্যার, জানি, এই তামাম দুনিয়ার কোন কিছুই আল্লাহ্র হুকুম ছাড়া হয় না, বাদুরের খানা খাওয়া ও তা ত্যাগ করাও আল্লাহর হুকুমে হয়, হয়েছে কী, আল্লাহ তো সব কিছুই বানিয়েছেন, একবার এক ফেরেশতা বললো, আল্লাহ্ আপনি তো সব বানালেন, এই দেখেন আমরা একটা পাখি বানিয়েছি। আল্লাহ্ দেখলেন, সব ঠিক আছে কিন্তু পাখির পায়খানা করার রাস্তা নাই, এরপর থেকে এই পাখির এই অবস্থা। আমার এই গল্প শুনার পর উনি ক্ষেপে গেলেন আর জিজ্ঞেস করলেন এই কথা কোন হাদিস-কিতাবে আছে? আমি ভয়ে মুখে মুখে শোনা বলতে পারি নাই। উনি সাথে সাথে রাগ সংবরণ করে বলেন, না, আরেকটা ঘটনা আছে। আমি জানি উনি আমাকে গল্প শোনাবেন, আমি বললাম, ঘটনা থাক অন্য কিছু বলেন। ততক্ষণে আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে, মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাবো, উনি মনে হয় বিছানা দেখায়া দিলেন, ভালো মনে পড়ছে না, হতে পারে আমি নিজেই বিছানায় শুয়ে পড়ি; আমি কি জেগে আছি নাকি স্বপ্নে দেখছি বুঝতে পারছি না, তবে কে যেন কথা বলছে :
একবার জঙ্গলে আগুন লাগে, লাগে মানে মানুষ লাগায় আরকি। পরে, বনের সব পশু পাখি একজোট হয়ে মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। শুধু বাদুড় প্রজাতি মানুষের পক্ষ নেয়। আমি, আমার বাপ দাদা চৌদ্দগুষ্টি মানুষের পক্ষ নিই, ভাবলাম, মানুষ কতো শক্তিশালী, যদি মানুষের পক্ষ নিই তাইলে পুরা জঙ্গল আমাদের দখলে আসবো, মানুষ কয় দিন আর জঙ্গলে থাকবো। তাই আমরা গাছের আগাতে ঝুইলা থাকলাম, যাতে নিচ দিয়া পশু পাখি গেলে খবর দিতে পারি। মাঝে মাঝে পাখির বাচ্চা বা রোগা পাখি বা কীটপতঙ্গকে আমরাই মেরে ফেলছি, মানুষদের খবর দেই নাই। এইভাবে সাত দিন ঝুইলা থাকার কারণে আমাদের পায়খানা বন্ধ হয়ে যায় এবং একসময় দেখি সেই পায়খানা মুখ দিয়াই বাইর হইতে থাকে। নয় দিন পরে মানুষ কুত্তার মতো পালায়া যায় জঙ্গল ছাইড়া, কিন্তু বিপদ হয় আমাদের। জঙ্গলের সব পশু পাখি আমাদের উপর হামলা করে, আমাদের কেউ কেউ মানুষের পরিত্যক্ত ঘরে আশ্রয় নেয় আর আমাদের মধ্যে যারা রিষ্টপোষ্ট আছিন তারা বনের বড়ো বড়ো বট গাছে আশ্রয় নেয়। এরপর থেকে আমরা ঝুইলা থাকি আর মুখ দিয়াই খাই, মুখ দিয়াই হাগি।
পশ্চিমের লোকের মুখ থেকে এইরকম গল্প শুনে আমাদের কাছে একেবারে নতুন মনে হয় এবং এ নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। আমরা ভাবি, পশ্চিমের বিপরীতে পুবের লোক না পাঠিয়ে উত্তরের লোক পাঠাবো। দেখি এইবার কী হয়।
পরের দিন আস্তানাকে আরো জমজমাট মনে হয়। গেইটের বাইরে উৎসব উৎসব ভাব। জয়নুদ্দিনকে লতাপাতা পরিষ্কার করতে দেখি। সিরিয়াল মতো উত্তরের লোককে যেতে বলি। উত্তরের লোকের অভিজ্ঞতায়:
আমি ভেতরে ঢুকতেই দেখি প্রফেসর বাজ পাখি নিয়া বসে আছে। পাখিটা আমার দিকে এক দৃষ্টি দিয়া উড়াল দেয়। প্রফেসর আমাকে শরবত খেতে দেয় না, সে বাঁশের কেরুল খাচ্ছে। আমাকে এক টুকরা দেয়, আমি খেতে চাই না, তিনি জোরাজুরি করতে লাগলেন, অবশেষে এক কামড় দিতেই মনে হয় আমি যেন অমৃত খাচ্ছি, এইরকম সুস্বাদু খাবার জীবনেও খাই নাই। আমি সবটুকু মুখে দিয়া দিলাম, প্রফেসর হাসতে লাগলো। এরপরে আমার আর কিছু মনে নাই। তবে ছবির মতো একটা কিছু ঘটে গেছে যেন। সবটুকু মনে আসছে না। আমি আমার মতো করে বলি :
দেখি, একটা জনসভা বা এইরকম কিছু একটা আর সেখানে এক লোক, কেমন জানি চেহেরা, ঠিক নেতাগোছের কেউ মনে হয় না, তবে সে মানুষকে একটা গল্প বলছিলো। গল্পটা ছিলো এইরকম :
এক দেশে এক রাজা ছিলো। তার অনেক উজির নাজির আছে। আছে অনেক বুদ্ধিদাতা ও রাজকবি। তারা সবাই রাজাকে খুশি রাখতে ব্যস্ত। রাজা যদি বলে আজ সূর্য উঠবে না তারা সাথে সাথে বলে মহারাজ আজ কেয়ামত হয়ে যাবে কিন্তু সূর্য উঠবে না। রাজা যদি বলে আজ আকাশ থেকে পুষ্প বৃষ্টি ঝরবে তারা সাথে সাথে বলে কিছুক্ষণের মধ্যে পুষ্পবৃষ্টিতে রাজ্য ছেয়ে যাবে। রাজা যদি বলে তিন আর তিন যোগ করলে পাঁচ হয় তবে তারা বলে নিশ্চয় হবে একটা তিন থেকে মনে মনে এক বাদ দিলেই পাঁচ হয় এবং এটা নতুন এক পদ্ধতি, এতে গণিতের নতুন সমীকরণ বের করা যাবে। রাজার এই উদ্ভাবনের জন্য রাজাকে সংবর্ধনা দেয়া হোক।
এইরকম পরিস্থিতিতে রাজাকেই সব দিক সামাল দিতে হয়। একটা গাছ কাটার ক্ষেত্রেও রাজার হুকুম দরকার। একটা ইট সরাতেও রাজার হুকুম লাগে। তো, এই রাজার একান্ত সরকারী হিসেবে রাজ্যের সবচেয়ে বুদ্ধিমান যুবককে নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। সাত দিন ধরে সাত হাজার শিক্ষিত যুবকের পরীক্ষা নেয়া হয় এবং চূড়ান্তভাবে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। চূড়ান্তভাবে যে নিয়োগ পায় তাকে রাজা স্বয়ং বাছাই করেছেন এবং তিনি ঘোষণা করেন যে, তিনি যে ছেলেকে নিয়োগ দিয়েছেন সেই ছেলে হলো এই রাজ্যের সবচেয়ে বুদ্ধিমান। কিন্তু বুদ্ধিমান ছেলেটি রাজার সহকারী হিসেবে নিয়োগ পাবার প্রথম দিন থেকেই কাজেকর্মে ভুল করতে থাকে। রাজা বিপদে পড়ে গেলেন, তিনি সবার সামনে ঘোষণা দিয়েছেন এই ছেলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান, এখন যদি একে বাদ দেয়া হয় তবে তার মানসম্মান আর কিছুই থাকে না। তাই তিনি চিন্তা করে বের করলেন এই সহকারীকে একটা কাগজে লিখে দিবেন কী কী কাজ করতে হবে তাকে।
পরের দিন, রাজা শিকারে গেলে ঘোড়া থেকে তার মাথার পাগড়ি পড়ে যায় মাটিতে। রাজাপ্রাসাদে ফিরে রাজা তার পাগড়ি চাইলে সহকারী তার কাগজ দেখায় এবং বলে মহারাজ এই কাগজে ঘোড়া থেকে কিছু পড়ে গেলে উঠানোর কথা বলা নাই, তাই আমি উঠাই নাই। রাজা মহাবিরক্ত হয়ে এই বুদ্ধিমান সহকারীর কাগজে একটা সংশোধনী আনেন এবং তাতে লিখে দেন, ঘোড়া হইতে কিছু পড়িলে তাহা সংগ্রহ করিয়া রাজাকে দিতে হইবে।
তারপরের দিন প্রাসাদে রাজা বিশ্রাম করার সময় তার সহকারী এক গামলা গোবর এনে রাজার সামনে পেশ করে। রাজা ক্ষিপ্ত হলে সহকারী বলে, মহারাজ আপনি নিজ হাতে গতকাল লিখে দিছেন যে ঘোড়া হইতে কিছু পড়িলে সংগ্রহ করিতে হইবে। তাই আপনার নির্দেশ মতো এইগুলা সংগ্রহ করলাম। রাজা রাগ সংবরণ করে এই নিয়ম সংশোধন করে লিখলেন, ঘোড়া হইতে কিছু পড়িলে সংগ্রহ করিতে হইবে, কিন্তু ঘোড়ার পায়ুপথ দিয়ে কিছু পড়িলে সংগ্রহ করিতে হইবে না।
এইভাবে একশ বার নিয়ম পরিবর্তন করা হলো। তবু রাজা তার ভুল কথাকে শুদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেলেন। এইভাবে নিয়ম সংশোধন করে করে রাজা তার সহকারীকে নিয়া রাজ্য শাসন করতে লাগলেন।
উত্তরের লোকের মুখ থেকে এইরকম কথা শুনে আমরা বিভ্রান্ত হই, প্রফেসরকে সত্যিই রহস্যজনক মনে হচ্ছে, তাকে আর ভণ্ড ভাবতে পারছি না। এক এক করে আমাদের তিন জন ব্যক্তির ভুল হবার কথা নয়। কিংবা তিন জনই বিক্রি হবার কথা নয়। তবে রহস্যটা ভেদ করতে আমরা আরো তৎপর হই এবং পরবর্তী ব্যক্তিকে আরো নির্দেশনা দেই।
পশ্চিমের লোকের পরে উত্তরের লোক পাঠিয়েছি আমরা, এইবার পাঠাবো পুবের লোক। পরের দিন পুবের লোক আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে। বাকিটুকু তার মুখে শোনা যাক তবে :
আমি গিয়ে দেখি বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছেন উনি। উনার চোখ দিয়া যেন আগুন বাইর হবে। উনার খাটের স্ট্যান্ডে একটা সাপ, ও মাগো, আমি ভয়ে থরথর করি, উনি আমাকে ভয় পেতে না করলেন, সাপটি জিভ বাইর করছে। এমন সময় আমাকে একটা প্রশ্ন করলেন, তুমি কি জানো একসময় ডোরা সাপ ছিলো সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ? আজ কেন সে নির্বিষ? আমি জবাব দেই, জ্বি, জানি; একবার সে তার সব বিষ কচু পাতায় রেখে আদার খেতে যায়; কিন্তু এসে দেখে তার সমস্ত বিষ অন্য সাপ, বিচ্ছু খেয়ে ফেলছে; এরপর থেকে সে নির্বিষ। হু, তোমার এই গল্প সবাই জানে, তবে এটা আসল গল্প না, বানানো গল্প, তুমি চাইলে আসল গল্পটা শুনতে পারো; কী শুনবে নাকি? আমি বলি, জ্বি স্যার, আমি গল্পটি শুনতে চাই, গল্পটি আমার মুখ থেকে শুনবে নাকি ডোরা সাপের মুখ থেকে শুনবে? আমি ভয় পেয়ে যাই, বলে কী লোকটা, তবে আগ্রহ কাজ করে, মনে সন্দেহ ও ভয় নিয়া উত্তর দেই, সাপের গল্প সাপের মুখ থেকেই শোনা ভালো। তারপর আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে আর দেখি আমি আসমানে উড়ে বেড়াচ্ছি। আমি উড়তে চাইলেই উড়তে পারছি। আমার সাথে কয়েকটা বরফখণ্ড নাকি মেঘ উড়াউড়ি করছে। আমাদের ধাওয়া করছে কিছু সাপ। একি বাস্তব নাকি স্বপ্ন, বুঝতে পারছি না, তবে আমি ঘামছি, হাঁপায়া গেছি। হঠাৎ যেনউড়ারশক্তিহারায়াফেলছি, কই, আমি তো মাটিতে পড়ে যাচ্ছি, মনে হলো আমি একটা সাগরে পড়ছি, আর পানির নিচে তলায়া যাচ্ছি। মনে হয় স্বপ্ন দেখছি, আবার দেখা শুরু করি, পাতালে একটা সভা হচ্ছে। একটা সাপের জবানবন্দি রেকর্ড করা হচ্ছে। যতোদূর মনে পড়ে, তা গুছিয়ে বললে গল্পটা এইরকম হবে :
আমার জন্মের পর হতে নয় বছর মানুষ মারছি প্রায় হাজার খানেক; কিন্তু একদিন মানুষ আমাকে ধাওয়া করে; আমি জান নিয়া কোনরকমে বাঁচি; আমার মনে হয় অনেক পাপ করছি; অনেক মানুষ মারছি; এইভাবে মানুষ মেরে টিকে থাকা সম্ভব না; তাই মানুষের কাছে ভালো সাজবার জন্য অনেক ফন্দিফিকিরি করি; কিন্তু কোন লাভ হয় না; আমাকে দেখলেই মানুষ ধাওয়া করে; অবশেষে চিন্তা করে দেখলাম এই মানুষের কাছ থেকেই তালিম নিবো; এর জন্য সবার আগে তালিম দিতে পারে এমন জ্ঞানীলোক খুঁজে বের করতে হবে। তারপর আমি এক এক করে এই শহরের সমস্ত জায়গা খুঁজেও এমন কোন জ্ঞানীলোক পেলাম না; তাই মন খারাপ করে কহরদরিয়া গাঙে আশ্রয় নিতে গিয়া এক দার্শনিকের সাক্ষাৎ পাই; তিনি আমাকে বুদ্ধি ও পরামর্শ দিয়েছেন; কিন্তু আমার বুদ্ধির কারণে আজ আমার এই অবস্থা; হয়েছে কী, আমি মুরিদ হলাম দার্শনিকের কাছে। তিনি আমাকে বুদ্ধি দিলেন, তুমি আর কোন দিন কোন মানুষকে ছোবল দিবে না; স্যারের কথামতো আমি ছোবল দেয়া ছেড়ে দিলাম; কয়েক বছর হয়ে গেছে, অথচ আমি কাউকে ছোবল দেই নাই, কারো সামনে ফনা তুলেও দাঁড়ায় নাই; তাই আস্তে আস্তে মানুষের ডর কমতে থাকলো; এইভাবে দিন যায় দিন আসে; মানুষের ডর আরো কমে; একসময় মানুষ আমাকে দেখে আর ডরায় না; পথের ধারে আমাকে দেখলে লাথি মারে, উষ্ঠা মারে; আমি ছোবল দিতে গিয়েও দিতে পারি না; কারণ, আমি দার্শনিক স্যারকে কথা দিছি আর কাউকে ছোবল দিবো না; এরই মধ্যে একদিন বিপত্তি ঘটে; এক কাঠুরে কাঠ কেটে বাড়ি নিয়া যাবে; ভালো কথা, তুই যা, আমি কী তোরে না করছি, নাকি ছোবল দিছি; তো, সেই কাঠুরে তার কাঠ বাঁধার জন্য কোন লত খুঁজে পাচ্ছে না; আমি পাশেই শুয়ে ছিলাম; আমাকে দেখে কাঠুরে একটা হাসি দিয়া আমাকে দড়ি হিসাবে ব্যবহার করে কাঠগুলা বেঁধে নিলো; আমি কিচ্ছু করলাম না; কিন্তু তার ডেরায় গিয়া সে এই বাঁধন খুলতে পারে না, পরে, ওই কাঠুরে একটা কাচি দিয়া আমার লেজ থেকে কেটে ফেলে; এই কাটা লেজ নিয়া আমি বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াই; কিন্তু এর চেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে আরেকদিন; ওইদিন কয়েকটি বিচ্ছু ছোকরা বড়শি দিয়া মাছ ধরছিলো, আমি আমার কাটা লেজ নিয়া কোনমতো পড়ে আছি; তো হয়েছে কী; ওই বিচ্ছুদের একজনের বড়শি বোয়াল মাছে নিয়া যায়; তার আর কোন বড়শিও নাই, কী করা যায় কী করা যায়, ছোকরাটা আমার কাছে আসলো আর আমার ঘাড়ে ধরে আমার বিষদাঁত উঠায়া নিলো; আমার দাঁত দিয়া সে বড়শি বানায়া মাছ ধরলো; একদিকে লেজ হারাইলাম, আরেকদিকে বিষদাঁতও হারাইলাম; আমি আর সহ্য করতে না পাইরা স্যারের কাছে আসলাম। স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলো কিভাবে এমন হলো; আমি দুইটা ঘটনাই খুলে বললাম; কিন্তু স্যার রেগে গিয়ে বললো, আমি তোমাকে ছোবল দিতে না করছিলাম; কিন্তু ফনা তুলতে, ফোঁস ফোঁস করতে তো না করি নাই; তুমি যদি ফনা তুলতে আর ফোঁস ফোঁস করতে তাহলে আজ তোমার এই অবস্থা হতো না; স্যারের কথা একদম ঠিক; আমিই বেকুবের মতো কাজ করছি; কী আর করার; এখন আমার বিষ নাই, বিষ দাঁতও নাই; ফোঁস ফোঁস করলেও কেউ ডরায় না।
শোধ আসলে আমার মাথার মধ্যে ছবির মতো ঘুরপাক খায় এইসব, ভাবলাম, আমি ঘরেই শুয়ে আছি, পরে সব মনে পড়ে, আর অনেক চেষ্টা করে এইটুকুই মনে করলাম।
পুবের লোকের কাছে আমরা এই গল্প শুনি এবং আরো অবাক হই, আমাদের বন্ধু-বান্ধব এরা, এরা তো মিথ্যা বলার লোক না, সত্যিই একটা রহস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এই প্রফেসর। নাকি গোপন কোন তন্ত্রমন্ত্র জানে লোকটা? নাকি সাধনা করে গোপন কোন শক্তির? আমরা ভেবে পাই না। তবে শেষ ব্যক্তি হিসেবে পরের দিন দক্ষিণের লোককে পাঠানো হয়েছে। তার মুখ থেকে শুনি :
আমাকে দেখে তিনি খুশি না বেজার বুঝতে পারছি না, আগের চারজনের অভিজ্ঞতার কারণে আমার ভয় লাগছে না, তবে তার পাশে একটা বেজি শুয়ে আছে, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। তিনি আমাকে এক গ্লাস পানি খেতে দিলেন। খুব ক্লান্তি লাগছে, আমি জানি আমি ঘুমিয়ে পড়বো, ঘুমানোর আগে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জানো তেলাপোকা সহজে মরে না কেন? কেন তাদেরকে সব স্থানে পাওয়া যায়? আমি বলি তেলাপোকা যেকোন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে; তিনি বলেন, এই শক্তি সে পেলো কোথায়? আমি কিছু বলি না বরং তার দিকে তাকায়া থাকি, ওকে ঠিক আছে, তুমি তাহলে মূল গল্পটা শোনো :
আমি তেলাপোকা, ডাইনোসরের মগজ খেয়ে অমর হইছি। তোমরা হয়তো জানো না, আমাদের ইতিহাস পুরানা। আমাদের রাজ্যে একদিন এক ডাইনোসরের মগজে লক্ষ লক্ষ মশা ঢুকে পড়লে মাথার যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে ওঠে সে। সবাই ভয় পাচ্ছে, কেউ এগিয়ে আসে না, অথচ মগজ থেকে মশা তাড়ানো দরকার। হঠাৎ করে কে বা কারা ধাক্কা মারলো আমাকে, আমি এক ধাক্কায় তার নাক দিয়া মাথার ভিতরে ঢুকে গেলাম, গিয়ে দেখি তার মাথার ভিতরে একশ পঁয়ত্রিশটা মগজ, এতো মগজ দেখে আমি আঁতকে ওঠি, আরে শালা, একটা মাথার ভেতরে এতো মগজ থাকে কেমনে? আমার দেখাদেখি অসংখ্য তেলাপোকা ঢুকে গেলো মাথার ভিতরে, আমরা মশাদের সাথে যুদ্ধ করে নতুন একটা মগজ আবিষ্কার করলাম, আমরা তিরানব্বই হাজার মশাকে বন্দি করলাম। পরে, আমি খেয়াল করি মগজের মধ্যে অনেক রেখা, যেন এক একটা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা; কেমন গাঢ় সবুজ আর লাল রক্তের শিরা। আমার কেমন যেন লাগছিলো, বাইর হইতে ইচ্ছা করছিলো না, একসময় বাইর হয়ে আসলে আমাকে বীরের মর্যাদা দেয়া হয়, ঘটনাচক্রে আমি হই শ্রেষ্ঠ বীরের একজন, তবে মগজের চিন্তা মাথা থেকে যায় না আমার, আবার মগজের কাছে যেতে ইচ্ছা করে। একদিন সুযোগ বুঝে মগজে ঢুকে পড়ি, মগজের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সবুজ জমি আর লাল রক্তের শিরা আমাকে মাতাল করে ফেলে, আমি চিন্তা করে দেখলাম, এই মগজ যদি কোন রকমে বাইরে আনা যায় তবে আর কোন চিন্তা নাই। একদিন নিশুতি রাইতে চুপি চুপি মাথার ভিতরে ঢুকে গেলাম, আর সুযোগ বুঝে মগজের সব রগ কেটে যেই নাক দিয়া বাইর করবো সেই বিরাট এক চিৎকার দেয় সে, তার চিৎকারে নাক দিয়া একশ ছত্রিশ নম্বর মগজটা বাইরে চলে আসে, কয়েক দিনের মধ্যে সে মারা যায়। এইভাবে ডাইনোসর পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং আমরা তেলাপোকারা পাই খুঁটে খাওয়ার মতো এক আশ্চর্য মগজ।
হয়তো গল্পটা এমন না, হয়তো আজগুবি গল্প, নাকি অন্য কিছু, তবে এই গল্পটাই বারবার মাথায় আসে আমার, তার রুম থেকে বাইর হয়ে আসার সময় আমি আর কিছুই মনে করতে পারি না।
দক্ষিণের লোকের কাছ থেকে শেষ গল্পটি শুনে আমাদের মনে হয় প্রফেসরের অন্য নাম অপার রহস্য। তবে আরো ছয় মাস পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পেলাম যে, আবারো শহরের বাতাসে একটা খবর ভেসে বেড়ায়। প্রফেসরের আস্তানায় নাকি অসামাজিক কার্যকলাপ হয়, সে যা বলে সব বানোয়াট ও মিথ্যা, মানুষকে ভালো ভালো কথা বলে ভুল পথে ঠেলে দিচ্ছে, মানুষ তার কথায় বিভ্রান্ত হয়ে সংসারধর্ম ত্যাগ করছে, তরুণেরা বিপথে যাচ্ছে। শরবতের নাম করে এক ধরনের অপবিত্র মেডিসিন খাইয়ে মানুষকে ঘোরের মধ্যে ফেলে নিজেই গল্প বলছে। এই ধরনের ছল চাতুরী মেনে নেয়া যায় না।
কিছুদিনের মধ্যে তার আস্তানাকে পাপের আস্তানা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তার বিরুদ্ধে নাস্তিকতা ও মানুষকে ভুল পথে প্ররোচিত করার অভিযোগ তুলা হয়; কিন্তু সে এই অভিযোগ থেকে মুক্তি পাবার কোন চেষ্টা না করে সব কিছু মেনে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
আমরা খবর পাই, প্রফেসর নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার আগে তার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে গেছে। এই আস্তানাটা কিনেছে পশ্চিমের এক লোক। সেই লোক একজন পুণ্যাত্মাকে আস্তানার দায়িত্ব দিয়েছে। সেই পুণ্যাত্মা আবার সবার সামনে আসে না, আড়ালে আবডালে থাকতে পছন্দ করে। তবে আস্তানাটা সাত মাসের মধ্যে নতুন রূপে সজ্জিত হয়; ভাষ্কর্য, নাট্যশালা ভেঙে গড়া হয় কারুকার্যময় উপাসনালয়। পুণ্যাত্মার আদর্শ বাণী শোনার জন্য হাজার হাজার ভক্ত ভিড় করে। শিল্প সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস সব বিষয়ে তার পান্ডিত্য থাকলেও ধর্মবিষয়ক আলোচনা বা তর্কে ধর্মগুরুরা পর্যন্ত তাকে হারাতে পারে না কিংবা তার সাথে টক্কর দিতে সাহস করে না। সময়ের সাথে সাথে তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়তে থাকে। নিজস্ব হেলিকপ্টারে তাকে যাতায়াত করতে দেখা যায়। আস্তে আস্তে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তার মত গুরুত্ব পায়। এই খুশিতে সে সাংবাদিক সম্মেলন করে। দেশের প্রথম সারির সকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডার শত শত সংবাদকর্মী ভিড় করে। তার মনের গহীনে এক উৎকণ্ঠা ছিলো, এইসব ধান্দাবাজ সাংবাদিক যদি না আসে। কিন্তু উৎকণ্ঠা পরিণত হয় নির্মল আনন্দে। তার বক্তব্য এতো গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হবে এটা আগে জানলে সে আরো কঠিন ও শক্ত কথা তৈরি করে রাখতো।
খুব দ্রুতই রাতের আঁধারে তার সাথে দেখা করে উত্তরের লোক, দক্ষিণের লোক, পশ্চিমের লোক, পুবের লোক এবং আমাদের সাম্যজাহানের মতো হাজারো সাম্যজাহান। দেশের সকল মানুষ বিশ্বাস করতে থাকে যে দেশে পুণ্যাত্মার বিজয় বেশি দূরে নয়, মানুষ যেভাবে ধর্মের রাস্তায় আসছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে দেশ শাসনের মহান দায়িত্ব পালন করবে পুণ্যাত্মার শিষ্যরা।
তবে পুণ্যাত্মার সাথে প্রফেসরের চেহেরার মারাক্তক সাদৃশ্য আমাদেরকে নতুন করে চিন্তার মধ্যে ফেলে, কেবল বেশভূষা ও কথা বলার ভঙ্গিতে যা একটু পার্থক্য।