এক.
এটা সবার জানা হয়ে গেছে যে, মোরগটার মৃত্যুর পেছনে মোরগটা নিজেই অনেকটা দায়ী। যদিও নাজনীন ভাবি এই সরল সত্যটা না মেনে নিয়ে তিনি বরং আরেকটা মুরগিকে দোষী ভাবতে শুরু করেছেন। কারণ, তার ভাবনায় মোরগটার কোন দোষ নেই বরং দোষ যা দেখেন, তা পাশের বাসার কানার বউয়ের মুরগির। সেইসাথে এ মোরগটার মৃত্যুর পিছনে আরেকজন ব্যক্তির হাত থাকতে পারাটাকে সবচেয়ে দুর্বল ক্লু না হলেও খানিকটা জোরালো যুক্তি বলা যেতেই পারে। কারণ, এ পর্যন্ত যে কয়টা মোরগ কিংবা মুরগি হারিয়ে গেছে তার বেশিরভাগ আলামত তার বাসার পাশে থেকেই পাওয়া গেছে। কারণ, অন্যের পোষা কোন মোরগ, মুরগি, কবুতর কিংবা হাঁস তার ঘরের কোণে পেলেই সেগুলোকে সে অভিনব কায়দায় ধরে এবং নিজের উদরপূর্তি করার ব্যবস্থা করে। তবে মোরগটাকে আহত অবস্থায় যখন তার বাড়ির সীমানার কাছাকাছি কিংবা সীমানার বাইরে থেকে আবিষ্কার করা হলো তখন দেখা গেলো মোরগটা চোখ খুলতে পারছে না। এমনকি মাথাও উঁচু করতে পারছে না। সেইসাথে, মোরগটার মুখ দিয়ে লালা ঝরছে, পাখনাগুলো ছোট ছোট করে ছাঁটা, শরীর থেকে মাঝে মাঝে খাপছাড়া রকমের পালক বিচ্ছিন্ন করা। একটা ভরাট জমির মাঝ থেকে মাটি তুলে ফেললে যেরকম হয় ঠিক সেরকম দেখতে হয়েছিল মোরগটার শরীর। অথচ মোরগটার ছিল রাজকীয় চলন। পিছনের লম্বা লাল পুচ্ছ দুলিয়ে মোরগটা হাঁটতো। ফুটন্ত গোলাপের রং নিয়ে মাথার মউল নাড়িয়ে মুরগিকে আকৃষ্ট করবার চেষ্টা করতো। ফলে কানার বউয়ের মুরগির আসার রাস্তা জাল দিয়ে বন্ধ করা হলেও কিংবা মোরগটার কাছে আসতে না দিলেও মুরগিটা ঠিকই পথ বের করে আসতো। মোরগটার অভ্যাস ঠিক এমন হয়ে গিয়েছিল যে, বাড়িতে আরো তিনটি লাল, সাদা ও কালো রঙের মুরগি সঙ্গী হিসেবে থাকলেও বাদামি কিংবা ফোটকাফুটকি রঙের কানার বউয়ের মুরগি লিলি ফুপুর টিনের চালে এসে খাঁটো অথচ সেই খাঁটো গলাকে লম্বা করে মোরগটাকে নিজের বাদামি কিংবা ফোটকাফুটকি শরীরের দিকে আকর্ষণ করার সর্বপ্রকার চেষ্টা করতো। মাঝে মাঝে মুরগিটা তার তীক্ষè কিংবা ধারালো বা বাঁকানো নখ দিয়ে লিলি ফুপুর টিনের চালায় আঁচড় কেটে অথবা ঠোঁট দিয়ে টিনের চালে শব্দ করে কিংবা গলায় হালকা আওয়াজ করে মোরগটাকে নিজের আয়ত্তে আনার সর্বপ্রকার চেষ্টা করতো। আর অন্য যে তিনটা লাল, সাদা ও কালো রঙের মুরগি মোরগটার আশেপাশে থাকতো সেগুলো এক ধরনের বিকট অথচ অর্থহীন ধ্বনি কট কট কট কট কট করে ডাকাডাকি করতো। অবশ্য মুরগি তিনটি প্রথমে দ্রুত শব্দ করে আওয়াজ করতো, পরে ধীরে ধীরে আওয়াজ করে কিছুক্ষণ পর থেমে তারপর মুরগিটার দিকে চেয়ে চেয়ে নিরুত্তাপ দাঁড়িয়ে থেকে ডাকাডাকি করতে থাকে। মোরগটা কোন শব্দ না করে শুধু গম গম করে মুরগিগুলোর এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাতায়াত করতো আর মাঝে মাঝে কোন কিছু ঠোঁটে দিয়ে ঠোক্কর দিয়ে মুরগিগুলোকে থামবার চেষ্টা করতো। মোরগটার এতটাই সম্মোহনী শক্তি ছিলো যে কিছুক্ষণের মধ্যেই মুরগি তিনটা চুপচাপ হয়ে যেতো। এর মধ্যেই যার ডিম পাড়ার সময় আসতো সে বাসায় বসতো ডিম পারতে আবার আরেকজন বাচ্চাকে সামলানোর চেষ্টা করতো অন্যটা এখনো অত বেশি দায়িত্ববান হয়ে ওঠে নি। কোন কোন দিন মুরগিটা জালের ছেঁড়া অংশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলে মোরগটার আনন্দের সীমা থাকতো না। এই সময় মোরগটা অন্য লাল, সাদা এবং কালো রঙের মুরগিকে সময় না দিয়ে বরং ফোটকাফুটকি রঙের মুরগিটাকে আলাদাভাবে সময় দিতো। সময় দেওয়া বলতে বুঝানো যেতে পারে, একত্রে দুইজনার মাটিতে স্নান করা কিংবা ধুলার মধ্যে পাখা ঝাপটানো অথবা কাঁঠাল গাছের নিচু ডালে বসে ঠোঁট দিয়ে পালক পরিষ্কার করা বা একত্রে আদার (খাবার) খাওয়া এসবকে বুঝানো যেতে পারে।
দুই.
যদিও নাজনীন ভাবি কানার বউয়ের মুরগিটাকে পছন্দ করতেন না, তারপরেও মোরগটার কাছে যখন মুরগিটা আসতো তিনি আর কিছু বলতেন না। অবশ্য মাঝে-মধ্যে কানার বউয়ের অনুপস্থিতিতে তাকে নিয়ে দু’চার কথা শুনিয়ে দিতেন। তাঁর প্রশ্ন, কেন কানার বউ মুরগিটাকে আটকিয়ে রাখতে পারেন না কিংবা আটকিয়ে রাখবার চেষ্টা করেন না। সেইসাথে এটা বলতেও তাঁর মুখে বাধতো না যে, এই ফোটকাফুটকি রঙের মুরগিটার কারণেই মোরগটার অভ্যাস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এর বেশি কিছু তিনি বলার সময় ও সুযোগ পেতেন না। কারণ, পরক্ষণে তিনিই আবার সবগুলো মুরগিকে আদার দিতেন।
মোরগটা ঠিক যেদিন আক্রান্ত হয়, সেদিন অবশ্য কানার বউয়ের মুরগি আসেনি কিংবা তার আগের দিন কিংবা তারও আগের দুই দিন আসেনি। মুরগিটার না আসার পেছনের ভাবনা এরকম হতে পারে মুরগিটা ডিম দিতে দিতে ডিমে তা দেওয়া আরম্ভ করেছিল কিংবা কানার বউ তার মিরগি (রোগ) ব্যারামে আক্রান্ত ছেলেকে একটা ডিম ব্যতীত সবগুলো ডিম সিদ্ধ অথবা ভাজি করে খাইয়েছে নতুবা বড় মেয়ের স্কুলের ড্রেস বানিয়ে দেবার জন্য ষাট টাকা হালি দরে বিক্রি করে দিয়েছিল। ফলে মুরগিটা একটা ডিমকে নিয়ে কিংবা ডিম ছাড়াই একলা শক্ত ভাঙ্গা মাটির পাতিলে বসে ডিমের শরীরে তাপ দিয়ে মা হবার মানসিকতা নিয়ে বসেছিল। ফলে গত এক সপ্তাহ কিংবা এক সপ্তাহ চারদিন যাবৎ মুরগিটা মোরগটার কাছে আসতে পারে নি।
তাহলে মুরগিটার সাথে ঠিক কিরকম সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল তার একটা সরল সমীকরণ হয়তো করা যায় এভাবে মোরগ ও মুরগিটার মাঝে একটা প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আরো একটু গভীরে প্রবেশ করলে বলা যেতে পারে, যেহেতু কানার বউয়ের কোন মোরগ ছিলো না, ফলে মুরগিটা মোরগটার কাছে আসতো। সাধারণ অর্থে জৈবিক তাড়না থেকেই মোরগটার কাছে মুরগিটা আসতো। আর মোরগটাও তাকে কামনা করতো তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য।
যেহেতু মুরগিটা ডিমে তা দিতে বসেছিল সে কারণে মোরগটা আর কোনভাবেই ফোটকাফুটকি রঙের মুরগির সাথে সাক্ষাৎ করতে পারছিল না। ফলে মোরগটা মুরগিটার সাক্ষাৎ লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল কিংবা তাকে কাছে পাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। এমনকি আরো যে তিনটি লাল, সাদা ও কালো রঙের মুরগি ছিল তাদের সঙ্গও পছন্দ করতো না। এই মুরগি তিনটার একটাও যদি কাছে আসার চেষ্টা করতো তখন তাকে তার বাঁকানো তীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে কখনো কখনো ঠোক্কর দেবারও চেষ্টা করতো।
তিন.
কোন এক সোমবারে কিংবা মঙ্গলবারে সূর্য যখন পূর্ব গগন থেকে পশ্চিম গগনে যাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল ঠিক সে সময়ে মোরগটা তার সীমানা অতিক্রম করে অথবা জালের ছেঁড়া অংশ ভেদ করে ফোটকাফুটকি রঙের মুরগিটাকে খোঁজ করার জন্য নিচের ফাঁকা জায়গায় অবস্থান না করে পিছনের লাল ও নীল রঙের পাখনা দুলিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে তিনশত এগারো দিন বয়সে প্রথম ছাদে ওঠে। ছাদে উঠে মোরগটা টমেটো কিংবা বেগুন অথবা মরিচ গাছের সাথে কিংবা গাঁদা ফুলের সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। অবশ্য তারা তাকে ফোটকাফুটকি রঙের মুরগিটার কোন খোঁজ দিতে না পারলেও তাদের সৌন্দর্যে তাকে মুগ্ধ করে। অবশেষে মোরগটা গলা উঁচু করে নিচের দিকে তাকায় কিংবা কাঁঠাল গাছের ঘন পাতার মধ্যে শৈশবের স্মৃতিকে খুঁজতে গিয়েও ধূসরতার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। কারণ নাজনীন ভাবি তার বাবার বাড়ি কামদিয়া চৌধুরী বাড়ি থেকে যখন দুই মাস বয়সের চেয়েও কম বয়সে তাকে কৈশোর অবস্থায় আনেন, তখন সে কাঁঠাল গাছকেই আশ্রয়স্থল করে নিয়েছিল। এমনকি বৃষ্টির মাঝেও কাঁঠাল গাছটাকে ভরসাস্থল মনে করে সে রাত অতিবাহিত করতো। কারণ যখন সে কামদিয়ায় ছিল, তখন সবাই মিলে গাছেই থাকতো। কৈশোর অবস্থায় বাড়ির সবচেয়ে বৃদ্ধ মোরগের কাছ থেকে সে শেখা শুরু করেছিল, কীভাবে ঘন পাতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয় হিংস্র অথচ তাদের মতো দুই পাখা ও দুই পাওয়ালা ধারালো ঠোঁটের পাখির কাছ থেকে। আর সে কারণেই, শহরের আসার তিন দিনের মধ্যেই সে তার আস্তানা হিসেবে কাঁঠাল গাছটাকেই বেছে নিয়েছিল। যদিও ভাবি তার থাকার জন্য আলাদা বাসা করে দিয়েছিল কিন্তু সেটি তার পছন্দ হয়নি। ফলে, পাখা ঝাঁপটিয়ে সে প্রথমে টিনের চালে ওঠে তারপর সেখান থেকে কাঁঠাল গাছের ঘন পাতার নিচে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।
চার.
বাড়ির পশ্চিম ও উত্তর কোণে বাঁশ বাগান, ঝোপ-জঙ্গল ও কচুর বাগানের কারণে বেজির উপদ্রব অনেক বেশি। আবার কাক ও চিলের ভয় তো আছেই। ফলে হিংস্র কোন সরীসৃপ কিংবা কাক-চিল-বাজ পাখির তীক্ষ্ণ থাবা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য মোরগটার শৈশবে যতটা প্রশিক্ষণ নেওয়া দরকার ছিলো কিংবা চৌকস হওয়া দরকার ছিলো ঠিক ততোটা না পারলেও কিছুটা চৌকস হয়ে উঠেছিল। একদিন বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা নামছে ঠিক এমনি সময়ে কোথা থেকে যেন একটা বেজি মোরগটার কিংবা অন্য মুরগির তাজা মাংসের লোভ সামলাতে না পেরে ছুটে এসে মোরগ-মুরগির বিচরণের জায়গায় হানা দেয়। বড়ো মুরগিগুলো নিজেদের নিরাপদে আড়াল করলেও ছোট মোরগটা কোন কিছু না ভেবেই টিনের চালে উড়ে ওঠে। তারপর সেখান থেকে হেলেনের বাড়ির পিছনে উড়ে যায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেও মোরগটা আর ফিরে আসে নি। তখন ভাবিসহ বাড়ির সকলে ভেবে নিয়েছিল ওটাকে আর পাওয়া যাবে না। রাতের অন্ধকারে কোন প্রাণী হয়তো খেয়ে ফেলবে। পরদিন সকাল গড়িয়ে আবার দুপুর হলো তবুও বাচ্চা মোরগটা ফিরে আসেনি। তখন সবাই ধরেই নিয়ছিল মোরগটাকে আর ফেরত পাওয়া যাবে না। সবাই যখন দুপুরের খাবার পর একটু বিশ্রাম নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঠিক এমনি সময়ে মোরগটা পথ চিনে বাড়িতে এসে হাজির। এমনকি তার চিকনাই গলায় সবাইকে জানান দিচ্ছিলো, আমি এসে গেছি।
এরপর তার গলার স্বরের পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমে চিকনাই শব্দ হতো। গলা উঁচু করে ডাকলেও তেমন আওয়াজ হতো না কিংবা বেশিদূর পর্যন্ত গলার স্বর পৌঁছাতো না কিংবা বলা যায় কোন মুরগিকে আকর্ষণ করার মতো তেমন ডাক সে ডাকতে পারতো না। সেখান থেকে সময়ের পরিক্রমায় গলার স্বরের পরিবর্তন হয়েছে। রহিমের বউয়ের কিংবা বাড়ির সকলের ঘুম ভাঙ্গার মতো সে ডাকতে পারতো। তার ডাক শুনেই কানার বউয়ের ফোটকাফুটকি মুরগিটা তার কাছে আসার সুযোগ পেয়েছিল কিংবা তার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিল। এমনি আরো নানা কিছুর ভাবনার মধ্যেই সে ফোটকাফুটকি রঙের মুরগিটাকে খুঁজতে থাকে। এর মধ্যেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। ভাবি মোরগটার অনুসন্ধান করতে করতে ছাদে উঠে মোরগটাকে দেখতে পায়। মোরগটাকে টি…টি…টি… বলে ডাকতে থাকে। এরপর মোরগটা ভাবির কাছাকাছি আসলে মোরগটাকে ভাবি চাল ছিটিয়ে দেন। মোরগটা মাথা নিচু করে একবার দুইবার খাবারে ঠোক্কর দেবার পর কী মনে করে উড়ে গিয়ে একটা ছাদের পর অপর ছাদের নিচে গিয়ে হাঁপাতে থাকে কিংবা তার সঙ্গীকে খোঁজার চেষ্টা করতে থাকে। এই সময় নেড়ে মাথার শাহজাহানের ছাই রঙের মুরগি মোরগটার কাছে এগিয়ে আসে। মোরগটা কি মনে করে ছাইরঙের মুরগিটার সাথে মিতালি করতে থাকে। এক সময় বেঁটে-খাটো শরীরের শাহজাহান তার ছাইরঙের মুরগিটাকে আদার দেয়। মোরগটা শাহজাহানের চরিত্র সম্পর্কে না বুঝেই ছাই রঙের মুরগিটার পিছু পিছু খানিকটা ভয় নিয়েই অচেনা পরিবেশে যায়। শাহজাহান মোরগটার সুঠাম শরীরের লোভ সামলাতে না পেরে ঘরের দরজা বন্ধ করে। মোরগটা যেন না উড়তে পারে সেজন্য মোরগটার রঙিন পাখনার পালক ও পিছনের লম্বা লেজের পালক কেটে দিয়ে মুহূর্তেই মোরগটাকে একটা লিলিপুট রাজ্যের প্রাণীতে পরিণত করে। অবশ্য মোরগটা অনেক দাপাদাপি করেও শাহজাহানের শক্ত হাতের মুঠি ও ধারালো চাকুর নিচে থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে নিয়তির কাছে নিজেকে সঁপে দেয়।
এর মধ্যেই ভাবি ছাদের ওপাশে গিয়ে মোরগটার খোঁজ করতে থাকেন। কিন্তু কোন ভাবেই মোরগটাকে তিনি খুঁজে পান নি। অবশ্য তিনি সবাইকে বলে আসেন, মোরগটার কোন খোঁজ পেলে যেন জানায়। সেইসাথে শাহজাহানকেও ভাবি জিজ্ঞেস করেন– মোরগটাকে দেখেছেন কিনা। কিন্তু শাহজাহান জোর করে বিস্মিত হয়ে চোখ দুটো খানিকটা বড়ো করে ভুরু দুটো কুঞ্চিত করে মুখটা হা করে ‘আ…আ’ করে ওঠে। এরপর বলে, ‘দেখলে অবশ্যি অবশ্যি কোম্ ভাবি।’ তারপর, কি মনে করে দ্রুত গতিতে সরু রাস্তা দিয়ে পিচ ঢালা রাস্তার দিকে যেতে থাকে।
পাঁচ.
মোরগটাকে কেউ খাঁচায় বন্দি করে রেখেছে কিংবা বেঁচে থাকলে ও নিশ্চয়ই ফিরে আসবে অথবা কানার বউয়ের মুরগির খোঁজে মোরগটা যখন ওদের বাসায় গিয়েছে তখন কানা নিজে মোরগটাকে আটকিয়ে রেখে মিথ্যা বলছে এমনি নানা সম্ভাবনার কথা যখন আলোচনা করা হচ্ছিল ঠিক এর দশ কিংবা বারো মিনিট পর দুইটি পাঁচ-সাত বছরের ছেলে চিৎকার করতে থাকে এভাবে ‘আপনাদের মোরগকে কুত্তা ধরছে। আপনাদের মোরগটাকে কুত্তা ধরছে।’ তখন সবাই হুড়মুড় করে ছাদে উঠে দেখি ছেলেটা মোরগটাকে হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মোরগটাকে দেখে আঁতকে ওঠার মতো অবস্থা হলো সবার। একি হাল মোরগের, এ্যাঁ। এর লেজ, পাখনার একি অবস্থা। হাইফা তাড়াতাড়ি একটা মোটা রশি ও একটা বড় ব্যাগ ছাদের উপরে থেকে নিচে নামিয়ে দিল। যেন ছেলে দুটি ব্যাগের মধ্যে মোরগটাকে দিতে পারে। মোরগটাকে উপরে তোলার পর দেখা গেলো ওর ডানার পালক ছোট ছোট করে কাটা, পিছনের লেজ নাই বললেই চলে। শরীরে আঘাতের ক্ষত চিহ্ন। মোরগটা মাথা তোলার মতো শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
মোরগটাকে ছাদ থেকে নিচে নামানোর পর মোরগটার শরীরের বিভিন্ন ক্ষতস্থানে ভায়োডিন লাগিয়ে দেবার পর ব্যথা নাশক ঔষধ খায়ানো হয়। এরপর মোরগটার জন্য আলাদাভাবে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করা হয়। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসলে মোরগটাকে রাখার পর আমরা সকলে ঘর থেকে বের হয়ে আসলাম। রাতে দুই একবার ওর অবস্থা জানার জন্য ভাবি মাঝে মধ্যে মোরগটাকে দেখে আসেন। সবাই নিশ্চিত ছিল মোরগটার বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই।
যখন ভোরের আলোয় আলোকিত চারদিক, বাবুই ও দোয়েল পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছিল, এমনি সময়ে ভাবি সবাইকে বিছানা থেকে ডেকে তোলেন। বিশেষ করে মোরগটাকে দেখার জন্য। মোরগটাকে দেখে কারও বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, মোরগটা সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কানার বউয়ের মুরগিটা মোরগটার কাছে এসে মাথা নাড়িয়ে অস্ফুট স্বরে মোরগটার শরীর ঘেঁষে অর্থহীন অথচ ওদের কাছে অর্থপূর্ণ শব্দ করছে। এরপর মোরগটার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বেদনায় পালক নাড়ছে আর মোরগটার চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মোরগটা তার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে প্রথমে মাটিতে ঠোঁট তারপর মাথা দিয়ে নিজের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। এরপর ফোটকাফুটকি রঙের মুরগিটা মোরগটার নিথর দেহের পাশে দুই তিনবার ঘুরপাক খেয়ে বেদনার্ত কণ্ঠে দীর্ঘ ডাক দিয়ে কক কক কক করে ওঠে। এরপর হয়তো কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মুরগিটা ডানা ঝাপটিয়ে টিনের চালের উপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। মোরগটার নিথর শরীর সবার চোখের সামনে পড়ে থাকে। বিষন্নতায় সবার চোখে অশ্রু চলে আসে। হাইফা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে আমার মোরগ। অ্যা হ্যা।