এলিজা খাতুনের তিনটি কবিতা ‘বিম্বিত ক্ষণে’, ‘হেমন্ত চলে না যায়’ এবং ‘সভ্যতার উপকরণ’
আয়নার সামনে এসে দাঁড়াতেই ওপার থেকে
সে বললো– ‘তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে।’
গাঢ় সংকটে, অনটনে–
সম্মুখে নৃত্য করবে বিবমিষা তলোয়ার,
সুদীর্ঘ রাত ফুরোতে চাইবে না
পিঠের উপরে পড়তে থাকবে আঁধারের চাবুক
তবু তোমাকে দাঁড়াতেই হবে সহ্যের পাললিক তীরে
চোখের নালা কেটে
কিছুক্ষণ ঝরিয়ে নিতে পারো অশান্ত প্লাবন
কিংবা হৃদয়ের গভীরে খুঁড়ে খুঁড়ে
জমিয়ে নিতে পারো স্বপ্নময় অপেক্ষা
যেভাবেই কালক্ষেপণ করো না কেন;
হাঁটুর ভাঁজে ভিড়তে দিও না ভঙ্গুরতা
তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে
দু’পায়ে ভরের সাথে দৃঢ়তা যোগ করে করে
সোনালী গন্তব্য শুধু পায়ের ছাপ পেয়েই খুশি থাকে না
সিদ্ধান্তের কাঁথায় অটল-সুতোর বুনন চায়
আয়নার ভেতর থেকে পুনঃ পুনঃ শুনছি–
তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে।
ধান ঘ্রাণময় প্রখর দুপুর ঝুলিয়ে রেখেছি
নিঃশব্দ নিঃশ্বাসের নিচে
তুমি চলে এলে সচল হতো রোদের চঞ্চলতা
তুমি এলে পচা ভাদ্রের ছিঁচকে জল শুকাতো
তুমি আসার পর বেসামাল বেদনার গায়ে
পরিয়ে দিতাম হিমেল শিশির
হেমন্তের উঠোনে কুয়াশার কানাঘুষা শুনছো!
এদিকে ধান রং আমাকে বড় এফোঁড় ওফোঁড় করছে
আঁটসাট জামার মতো নবান্ন সেঁটে
শীত আকাঙ্ক্ষায় মাতোয়ারা যে দুর্বা;
তার ডগার স্বচ্ছ কণা স্বপ্ন দেখায় বড্ড!
হীরক শিশিরে বিভোর হতে গিয়ে
স্বর্ণালী হেমন্ত না ফসকে যায় আমার থেকে!
অবশেষে শিশির মাড়িয়ে কুয়াশা ছিঁড়ে–
হাতে তুলে নিই কুলো ভরা ধান
ক্ষুধাতুর আমি যে ধানের বড় কাঙাল!
ভীষণ অসুখে পড়েছে সময়ের শরীর
অশুভ কলরব সিঁদ কাটছে;
ভোর থেকে খোয়া যাচ্ছে সাদা রং
কিংবা ঝলমল সোনালী আলো
রোদ্দুরহাসি মুখে নিয়ে সময়শিশু ছুঁতে চেয়েছে
পবিত্র মাটি, নিষ্পাপ সকাল, সবুজ ঘনঘাস
পশমি কাশবন কিংবা নীলগিরির তুলো তুলো মেঘ
পক্ষান্তরে ক্যাসিনোহাঙ্গরের কালো রোষ
চষে গেছে সময়ের নরম পাঁজর
একটু স্বস্তির বাতাস চেয়েছিল বুক ভরে; অথচ–
নিঃশব্দ ঘামক্লান্ত চিৎকারে সময়-শিশু কাতরাচ্ছে খুব
জুয়াড়ির নির্লজ্জ সাফাই, সভ্যতার ছিন্নভিন্নতা,
পোড়া-ক্ষত, অথবা রক্তচোষা প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য, নাম
ওসব স্পর্শ করার আগেই গল্প হয়ে যায়!
পেছনে থমকে দাঁড়ায় বাক প্রতিবন্ধী সময়
গল্প অতীত হয়,
গল্প সেলাই হয়
গল্প ধৌত হয়,
গল্প শুকায়
… … … …
অতঃপর ভাঁজ হয়ে ঢুকে যায় ইতিহাসের ড্রয়ারে–
এইসব সভ্যতার উপকরণ।