রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক। মূলত কবি হিসেবেই তাঁর প্রতিভা বিশ্বময় স্বীকৃত। ১৯১৩ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এশিয়ার বিদগ্ধ ও বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পুরস্কার জয়ের গৌরব অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের প্রেক্ষাপটেই তাঁর কবিমানস ও সাহিত্যকর্মের স্বরূপ অনুধাবন সম্ভব। জীবনের পর্বে পর্বে তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা ও সাহিত্যাদর্শের পরিবর্তন ঘটেছে। যুগে যুগে পৃথিবীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে রূপান্তর ঘটেছে, রবীন্দ্রনাথ সবকিছুকেই আত্মস্থ করেছেন গভীর অনুশীলন, ক্রমাগত নিরীক্ষা এবং বিশ্বপরিক্রমার মধ্য দিয়ে। তাই তাঁর সাহিত্যজীবনের নানা পর্যায়ে বিষয় ও আঙ্গিকের নিরন্তর পালাবদল লক্ষণীয়। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, চিঠিপত্র এবং দেশে বিদেশে প্রদত্ত বক্তৃতামালা। রবীন্দ্রনাথের অন্তর্নিহিত জীবনবোধ ছিল স্থির এবং বহু পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিয়েও আপন আদর্শে প্রতিষ্ঠিত; অন্যদিকে তাঁর সৃজনশীল রূপটি ছিল চলিষ্ণু ও পরিবর্তনশীল। রবীন্দ্রনাথ কেবল তাঁর কালের কবি নন, তিনি কালজয়ী। বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যৌবন রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :
যৌবন রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে।
     তুই যে পারিস কাঁটাগাছের উচ্চ ডালের ‘পরে
                    পুচ্ছ নাচাতে।
     তুই পথহীন সাগরপারের পান্থ,
     তোর ডানা যে অশান্ত অক্লান্ত,
          অজানা তোর বাসার সন্ধানে রে
              অবাধ যে তোর ধাওয়া;
          ঝড়ের থেকে বজ্রকে নেয় কেড়ে
              তোর যে দাবিদাওয়া।
 
যৌবন রে, তুই কি কাঙাল, আয়ুর ভিখারী।
     মরণ-বনের অন্ধকারে গহন কাঁটাপথে
                    তুই যে শিকারি।
     মৃত্যু যে তার পাত্রে বহন করে
     অমৃতরস নিত্য তোমার তরে;
          বসে আছে মানিনী তোর প্রিয়া
              মরণ-ঘোমটা টানি।
          সেই আবরণ দেখ্‌ রে উতারিয়া
              মুগ্ধ সে মুখখানি।
 
যৌবন রে, রয়েছ কোন্‌ তানের সাধনে।
     তোমার বাণী শুষ্ক পাতায় রয় কি কভু বাঁধা
                     পুঁথির বাঁধনে।
     তোমার বাণী দখিন হাওয়ার বীণায়
     অরণ্যেরে আপনাকে তার চিনায়,
          তোমার বাণী জাগে প্রলয়মেঘে
              ঝড়ের ঝংকারে;
     ঢেউয়ের ‘পরে বাজিয়ে চলে বেগে
          বিজয়-ডঙ্কা রে।
 
যৌবন রে, বন্দী কি তুই আপন গণ্ডিতে।
     বয়সের এই মায়াজালের বাঁধনখানা তোরে
          হবে খণ্ডিতে।
     খড়গসম তোমার দীপ্ত শিখা
     ছিন্ন করুক জরার কুজ্‌ঝটিকা,
     জীর্ণতারি বক্ষ দু-ফাঁক ক’রে
              অমর পুষ্প তব
     আলোকপানে লোকে লোকান্তরে
              ফুটুক নিত্য নব।
 
যৌবন রে, তুই কি হবি ধুলায় লুণ্ঠিত।
     আবর্জনার বোঝা মাথায় আপন গ্লানিভারে
                         রইবি কুণ্ঠিত?
     প্রভাত যে তার সোনার মুকুটখানি
     তোমার তরে প্রত্যুষে দেয় আনি,
          আগুন আছে ঊর্ধ্ব শিখা জ্বেলে
              তোমার সে যে কবি।
          সূর্য তোমার মুখে নয়ন মেলে
              দেখে আপন ছবি।
 
 
শান্তিনিকেতন, ৪ চৈত্র, ১৩২২

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu