আদনান সহিদ
কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং পেশায় শিক্ষক। জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুমিল্লা, বাংলাদেশে। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে 'স্নাতক' এবং ইংরেজি সাহিত্যে মিডিয়া, ফিল্ম ও কালচারাল স্টাডিজ বিষয়সহ 'স্নাতকোত্তর' সম্পন্ন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবস্থায় সম্পাদনা করেছেন কবিতার মাসিক ভাঁজপত্র 'আমরা ক'জন অথবা একা'। প্রকাশিত গ্রন্থ : অনূদিত গল্প সংকলন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের নির্বাচিত গল্প’ (বেহুলাবাংলা, ২০২০), ষোলো গল্পকারের গল্প সংকলন, ‘এলোমেলো ষোলো’ (বিবর্তন প্রকাশনী, ২০২০) এবং সম্মিলিত কাব্য সংকলন, ‘এলোমেলো ভাবনা (বিবর্তন প্রকাশনী, ২০১৯)‌ এবং সাহিত্য সংকলন, 'কথা ও কাব্য' (বিবর্তন প্রকাশনী, ২০২১)‌।
আদনান সহিদ

কাফির (Kaafir): নিরাপরাধীর শেকলে প্রেম ও মানবতার ঝনঝনানি (ওয়েব সিরিজ রিভিউ)

বার পড়া হয়েছে
শেয়ার :

লোগ লাড়তে হ্যায় মিলনে কি খাতির,
পার আপনি তো বিছার জানে কি লাড়াই থি।

[মানুষ লড়ে যায় মিলিত হবার বাসনায়
আর আমার লড়াই তো বিচ্ছেদের তাগিদে]

ভারতীয় গীতিকার ও কবি সানন্দ কিরকিরের দ্য কাফিরকবিতার চমৎকার এই পংক্তিটুকুকে যুক্তিযুক্ত প্রমাণ করতেই যেন নির্মিত হয়েছে Kaafir (কাফির) শিরোনামের ভারতীয় হিন্দি ড্রামা,থ্রিলারধর্মী ওয়েব সিূরিজটি। ১৫ জুন,২০১৯  ‘কাফির’ সর্বপ্রথম অনলাইন ওটিটি (OTT) প্ল্যাটফর্ম  ZEE5-এ সম্প্রচারিত হওয়ার পর বেশ প্রশংসিত ও দর্শকনন্দিত হয়।

আবহমানকাল ধরে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কলমে দাগাঙ্কিত বিভেদ ও ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ সীমারেখায় বিভক্ত ভারত-পাকিস্তান অধ্যূষিত ‘ভূস্বর্গ কাশ্মীরের’ নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ছাপিয়ে ‘কাফির’ ওয়েব সিরিজটি প্রেম,মানবতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও বিচ্ছেদের এক হৃদয়গ্রাহী দৃষ্টান্ত হয়ে ধরা পড়েছে সোনম নায়ারের পরিচালনায় ও ভবানী আয়ার রচিত চিত্রনাট্যে।

ভুলক্রমে সন্ত্রাসী সন্দেহে ভারতীয় কারাগারে বিনা দোষে আট বছর আটক পাকিস্তানি নারী শেহনাজ পারভীনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে ‘কাফির’ ওয়েব সিরিজটির কাহিনী আবর্তিত যেখানে শেহনাজ কারাগারে ধর্ষিত হয়ে ‘মবিন’ নাম্নী এক কন্যাশিশুর জন্ম দেন এবং ভারতীয় এক আইনজীবীর সহায়তায় ন্যায়বিচারের মুখ দেখতে পান। ‘কাফির’ সিরিজে শেহনাজ পারভীনের ভূমিকায় ‘কায়নাজ আখতার’ নামে অভিনয় করেছেন দিয়া মির্জা। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আইনজীবী,’ভেদান্থ রাঠোর’ চরিত্রে মোহিত রায়না ও কন্যাশিশু ‘সেহের’ চরিত্রে দিশিতা জেইন অভিনয় করেছেন।

এক সিজন ও আট পর্বে সমাপ্ত ওয়েব সিরিজ, ‘কাফির’ দর্শকদের  বলবে:

* পরিচয়হীন, সুতো ছেড়া ঘুড়িরূপী এক নারীর দেশ, কাল, সীমানা পেরিয়ে নিষিদ্ধ রাজ্যে পতনের গল্প

* নাড়ী ও নারীর ‘খুব কাছে’ এসেও না আসতে পারার গল্প

* অপ্রত্যাশিত প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও পরিত্যাগের গল্প

* সীমান্তে তথাকথিত ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের’ নামে নিরাপরাধ মানুষের বিচারের বাণী নীরবে নিভৃত কাঁদার গল্প

* সংগ্রামী মাতৃত্বের মায়াবী ও নিরাপদ ছোঁয়ায় শিশুর নিষ্পাপ, কোমল হাসিমুখের গল্প

* হারানো প্রিয়জন ও পারিবারিক মূল্যবোধের গল্প

* বারবার ছুঁয়ে যাওয়া প্রেমের চূড়ান্ত নৈকট্য অর্জনের অব্যক্ত, অপারগতার গল্প

* সর্বোপরি, দেশ-জাতি ও কালোত্তীর্ণ মানবতার জয়লাভের গল্প।

ওয়েবসিরিজটির সিনেমাটোগ্রাফি এককথায় অসাধারণ, আবহ সঙ্গীত শ্রুতিমধুর। পুরো কাহিনীর ঘটনাস্থল পার্বত্য কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত বিধায় সুউচ্চ পর্বতশৈলী, স্বচ্ছ প্রবহমান পাহাড়ী নদী,সর্পিল পাথুরে রাস্তা,পাহাড়ী জনপদ ও সংস্কৃতি দর্শকচোখে দৃষ্টিনন্দন এক বাড়তি পাওনা হয়ে ধরা দেবে। অভিনয়ের কথা বললে, কেন্দ্রীয় চরিত্রে দিয়া মির্জা নিজেকে মেলে ধরেছেন সগৌরবে। হালকা মেকআপ,সাধারণ জুতসই পোশাক-পরিচ্ছদে তার অভিনয়,মুখভঙ্গি এবং কথোপকথন নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তার সাথে পাল্লা দিয়ে মুখ্য পার্শ্বচরিত্রে মোহিত রায়না সমানতালে মেলে ধরেছেন নিজেকে। বিভিন্ন ঘটনাক্রমে দিয়া মির্জার ‘চাহনি’ এবং অবস্থাভেদে মোহিতের ‘নিরবতা’ চিত্রনাট্যকে যথার্থ ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করেছে। কন্যাশিশু ‘সেহের’ চরিত্রে দিশিতা জইনের উপস্থিতি সিরিজটিকে দিয়েছে বাড়তি মাত্রা। পার্শ্ব চরিত্রে ভেদান্ত রাঠোরের বাবা এবং রফিক চরিত্রটি নজর কেড়েছে।

পরিচালকের পক্ষ থেকে কয়েকটি ছোট খাটো ইস্যুতে মনোযোগী হলে হয়ত নসিরিজটি আরও নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা যেত। কেন্দ্রীয় চরিত্র কায়নাজের ছোট্ট আদুরে মেয়ে ‘সেহেরকে’ শিশুশিল্পী হিসেবে আরও কিছু দৃশ্যে বা কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত করা যেত যা নিঃসন্দেহে দর্শক লুফে নিতেন। পার্শ্বচরিত্র ভেদান্তের ভাই এবং মোহাম্মদ শফিক চরিত্রটি আরেকটু সুদৃঢ় করার সুযোগ ছিল‌। চরিত্রের সাথে দৃশ্যের সমন্বয় সাধনে ব্যর্থ হয়েছে এমন দৃশ্য চোখে পড়লেও তা খুবই নগণ্য। প্রথম চারটি এপিসোড বেশ গতিশীল হলেও শেষ চারটি এপিসোড অপেক্ষাকৃত ধীর গতির অনুভূত হয়েছে। কয়েকটি ‘ড্রোন শট’ অস্পষ্ট লেগেছে তবে সম্পূর্ণ সিরিজের চমৎকার দৃশ্যধারণের সাপেক্ষে সেগুলো উপেক্ষণীয়।

প্রকৃতপক্ষে, ‘কাফির’ সিরিজে দৃশ্যমান স্বল্প ত্রুটি-বিচ্যুতির তুলনায় প্রকৃত সৌন্দর্যই বেশি ফুটে উঠেছে এর মূল চরিত্রগুলোর সূক্ষ্ম গঠনশৈলীতে, তাদের মাঝে বিদ্যমান আবেগের ভারসাম্য রক্ষায় এবং প্রতিটি বিপর্যয়ের মুহূর্তে আশায় ভর করে এগিয়ে চলার মাধ্যমে। গোটা সিরিজেই সংকট নিরসনের চরম মুহূর্তে মানবিকতা ও বন্ধুত্বের প্রকৃত ছোঁয়ায় বারবার জেগে ওঠা এবং ‘না ছুঁয়েও পুরোটা ছুঁয়ে দেওয়া’ অধরা রোমান্টিকতা দর্শক হৃদয় আন্দোলিত করবে বারংবার।

সর্বসাকুল্যে, ‘কাফির’-কে চিত্তাকর্ষক প্রেক্ষাপট,সবল চিত্রনাট্য, নিপুণ অভিনয় ও হৃদয়গ্রাহী ডায়ালগের এক পূর্নাঙ্গ প্যাকেজ বলা চলে।উপরন্তু,’কাফির’ এক ‘নীরব অথচ শক্তিশালী’ প্রেমাখ্যানও বটে। ভালোবাসা মাত্রই সবসময় প্রিয়জনকে জোরপূর্বক আঁকড়ে রাখা নয়, বরং ভালোবাসা কখনও প্রিয়জনের সুখ-শান্তির নিমিত্তে নিজ আশা-আকাঙ্ক্ষা অবদমন করার দাবিও তোলে-‘কাফির’ সার্থকভাবে বিষয়টি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় ওয়েব সিরিজগুলো বিশেষ করে ওটিটি (OTT) প্ল্যাটফর্মের সিরিজগুলো সাফল্য ও দর্শকপ্রিয়তার যে জোয়ারে ভাসছে, ‘কাফির’ নিঃসন্দেহে সেই জোয়ারের পানি আরেকটু উপচে দিয়েছে। সেই উপচানো পানি গায়ে না মাখলে ‘বেশ বড় মিস’ হয়ে যেতে পারে বলে ‘কাফির’ ভারতীয় ওয়েব সিরিজের দর্শক-ভক্তদের সতর্ক করছে। ওয়েব সিরিজটির আইএমডিবি রেটিং রয়েছে ./১০।

ট্যাগসমূহ

magnifiercrossmenu