প্রবাসিনীর আমবৌলা দর্শন-৩


লেখিকা শেলী জামান খান আমেরিকা প্রবাসী। স্বদেশে এসে বরিশালের আগৈলঝাড়া’র আমবৌলা গ্রাম তাকে মোহিত করে। আমবৌলা গ্রামকে নিয়েই তার তিন পর্বের ভ্রমণ কাহিনি। এটি তৃতীয় পর্ব (শেষ পর্ব)।


কুসুম রাঙা সকাল

কিন্তু রাতের অন্ধকার কেটে সকালের মিষ্টি আলোয় নিজের ভীতু স্বভাবে নিজেই লজ্জা পেলাম। কুসুমরঙা সূর্য উঠল। পাখি গান শুরু করল। পুকুরের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম, মাছেদের প্রাতরাশ পরিবেশিত হচ্ছে। বস্তায় বস্তায় অতি সুস্বাদু খাবার ছড়ানো হচ্ছে পুকুরের কিছু নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে। ঝাঁকে ঝাঁকে রুই, কাতল, পাঙ্গাস, তেলাপিয়া এসে পানির উপর ভাসমান খাবার খেতে লাগল প্রতিযোগিতা করে। তাদের ঝাপটা-ঝাপটিতে পানিতে আন্দোলন তৈরি হল। ঝিলিক দিয়ে উঠতে লাগলো মাছেদের রূপালি শরীর। হা করে অদ্ভুত কায়দায় খাবার গেলার দৃশ্যটিও চমৎকার। অগুনতি মাছের হা করা আর মুখ বন্ধ করার কারণে পানির বুকে হাজার হাজার বুদবুদ তৈরি হতে লাগল। একসময় পানিতে ভেসে থাকা সব খাবার শেষ হলেও খাবার ছুঁড়ে দেয়া জলাশয়কে কেন্দ্র করে মাছেদের জটলা চললো বহুক্ষণ ধরে।

আজ রান্না হচ্ছে লাউ শাক দিয়ে ছোট চিংড়ি, মেনি মাছ আর বেগুন ভেজে দোপেঁয়াজি, ধনেপাতার ভর্তা, আমডাল, গরুর মাংস ভুনা আর নতুন ওঠা ‘ভোজন চাল’-এর লালরঙা সুগন্ধি ভাত। মাটির চুলার লাকড়ির গনগনে আগুনে ভাতে বলক উঠলেই হাল্কা মিষ্টি ভাতের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে রান্নাঘরের দাওয়া পর্যন্ত। বাবুর্চি ডাগলেস আর উলু (ওয়ালিউল্লাহ) দু’জনে মিলে প্রতিদিন রান্না করে। তাদের রান্নায় পেঁয়াজ রসুন কেটে, বাটনা বেটে সহযোগিতা করে ডাগলেসের বউ সঞ্চিতা। এছাড়াও মাছের ঘেরের অন্যান্য কর্মচারী আর কেয়ারটেকারদের বৌ-ঝিরাও গল্প করতে এলে শাকসবজি কোটা-বাছায় হাত লাগায়। তাই রান্নাঘরের সামনের দাওয়ায় প্রতিদিনই একটা সবজি কাটার আসর বসে। রমা, কল্পনা বা মোনালিসা আসার পথে পুকুরপাড়ের সবজিক্ষেত থেকে একমুঠো কচুর লতি, লালশাক বা গোটাকতক ঢেঁড়শ, বেগুন বা টমেটো তুলে নিয়ে আসে।

মাছ রান্না, ছবিসূত্র: Shelly Zaman Khan

প্রতিদিন সকালে ঘেরের পাড়ের সবজির বাগান থেকে নানা জাতের সবজি তুলে আনা হয় মাছের সাথে সামঞ্জস্য করে। কোন মাছে কোন সবজি ম্যাচ করবে তা দুই পাকা বাবুর্চি খুব ভালোই জানে। তাই প্রতিদিনের দুপুরের খাবারটা হয় আলীশান। সতেজ শাকসবজি, তাজা মাছ, পাটায় বাটা তাজা মসলা সহযোগে যখন লাকড়ির আগুনে রান্না হয় তার স্বাদ, ঘ্রাণ আর গুণ এক কথায়  অনন্য। এই সব তরকারি আর মাছের ঝোলটুকুও অসাধারণ, জিভে জল আনা।

রাতের খাবার সংক্ষিপ্ত এবং আড়ম্বরহীন। হাতে বানানো লাল আটার রুটি বা ভোজন চালের চিতই পিঠা। সাথে পাঁচমিশালী সবজি, দেশী মুরগীর ঝোল বা গরুর মাংসের ভুনা। যেদিন দুপুরের খাবার গুরুপাক হয়ে যায়, সেদিন পাকস্থলির বিশ্রামের জন্য রাতের খাবার হয় স্রেফ গাছপাকা পেঁপে বা কলা-মুড়ি।

সকাল হতেই উলু বা ডাগলেস এসে লাকড়ির চুলোয় আগুন ধরিয়ে দিয়ে ভাজি কুটতে শরু করে। বড় একটি লোহার কড়াইয়ে লাকড়ির চুলোয় ভাজি হতে থাকে। অন্য আরেক চুলোয় তখন ফুটন্ত গরম পানিতে আটা সেদ্ধ করা হয়। সেই সেদ্ধ আটা মসৃণ করে ময়ান দিয়ে বড় একটি কাঠের পিঁড়িতে রুটি বেলতে শুরু করে উলু। চুলোয় লোহার তাওয়া বসিয়ে সদ্যবেলা রুটি সেঁকতে শুরু করে ডাগলেস। গরম গরম ফুলো রুটি, সবজি ভাজি, দেশী মুরগীর ডিম পোচ সাথে ধোঁয়া ওঠা গরম চা। আমাদের নাস্তা খাওয়া শেষ হলেই দ্বিতীয় ব্যাচে নাস্তা খেতে বসে যায় ডাগলেস, উলু আর সঞ্চিতা। স্কুল ছুটি থাকলে নাস্তার টেবিলে এসে যোগ দেয় সঞ্চিতা-ডাগলেসের দুই কন্যা প্রথমা ও স্নেহা।

ছবিসূত্র: Shelly Zaman Khan

সকাল থেকে দুপুর অব্দি সঞ্চিতা এখানেই বাবুর্চিদের সহকারী হিসেবে কাজ করে। তারপর মেয়ে প্রথমা আর স্নেহা স্কুল থেকে ফিরে এলে ওরা সবাই এখানেই খেয়ে নেয়। কখনও মেয়েরা ওদের মিশনারি স্কুল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে আসে। রাতে সঞ্চিতা বারন্ত সব ভাত-তরকারী নিজের ঘরে নিয়ে যায় বা সপরিবারে এখানেই রাতের খাবার খেয়ে নেয়।

অবশ্য বাংলোর গেস্ট চলে গেলে ওদের আর বাংলোর রান্নাবান্না করতে হয় না। তখন ওরা যার যার সংসারে এবং নিজের কাজে ফিরে যায়। ঘেরের কর্মীদের মধ্যে গারো সম্প্রদায়ের লোকই বেশি। তারা সবাই খ্রিস্টান ধর্মালম্বী। বাকি কয়েকজন আছে মুসলিম এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। সিঙ্গেল পুরুষ সদস্যদের জন্য মেস সিস্টেম চালু আছে। তাদের জন্য তিনবেলাই মেসে রান্না হয়। বাকি বিবাহিত কর্মীদের সবার জন্য থাকার আলাদা আলাদা বাড়ীঘর, জমি দেয়া হয়েছে। সেখানে তারা শাকসবজি বোনে, হাঁস মুরগী পালে। হাবিবুল্লাহ, সোহেল আর সিকসাং দেখে মুরগীর ফার্ম। সমবীরের দায়িত্ব মাছের খাবারদেয়া।

ঘেরের কর্মচারীরা তাদেরকে দেয়া জমিতে ধান চাষও করে। বাড়ীর মেয়েরাই ধানক্ষেতের দেখাশোনা করে। পুরুষরা মাছের ঘের, গরুর ঘরের কাজ করে।  শীতল আর অসীম; দু’জনই  মুরগীর ঘর আর হ্যাচারির কাজ করে। গ্রামে খুব ঘনঘন ইলেকট্রিসিটি চলে যায় বলে এখানে সোলার ইলেকট্রিসিটি ব্যাবহার করা হয়। সারা দিন সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ সংগ্রহ করে লাইটগুলো রিচার্জ হয় প্রতিদিন। তারপর রাতে বিদ্যুৎ চলে গেলেই অটোমেটিকভাবে সোলার লাইটগুলো জ্বলতে শুরু করে। নিখিলবাবুসহ আরও  দু’তিনজন গাছপালা, ফলমূল আর সবজির তদারকি করে।

দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি বেলা দ্বিপ্রহর

আজ বিদায়ের দিন। সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। দরজায় দর্শনার্থীদের ভীড়। এই ক’দিন যে সব ক্ষুদে সংগীত আর নৃত্যশিল্পীরা আমাদের গান গেয়ে আর নাচ দেখিয়ে আনন্দ দিয়েছে তারা স্কুলে যাবার পথে আমাদের বিদায় দিতে এসেছে। সাথে এসেছে এদের মায়েরা। এদের বিদায় দিতে গিয়ে আমার চোখ ভিজে এলো। ক’দিনের এই সহঅবস্থানের কারণে যে মায়া মমতার বন্ধন গড়ে উঠেছে এর মূল্যও নেহাত কম নয়। মানব জীবন কিছুটা গাছের মতোই। গাছ যেমন যেখানে মাটি, জল, হাওয়া পায় সেখানেই শিকড় বিস্তার করে বেড়ে ওঠে;  মানুষও তেমনি। খাদ্য, বস্ত্রের পাশাপাশি আদর, স্নেহ, ভালোবাসাও মানুষকে শিকড় বিস্তারে সাহায্য করে। তাই যেই মানুষের শিকড় যেখানে গ্রোথিত হয় সেই মানুষ সেই স্থানটি আর ভুলতে পারে না। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ একস্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যায় ঠিকই। কিন্তু শেকড় ভোলে না। তার বুকের গহীনে শেকড়, মাটি আর জলকণার জন্য একটি কষ্টবোধ, মমতা সুপ্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকে। তাই যখনই সময় পায় মানুষ তার শেকড়ের সন্ধানে বার বার ফিরে আসে।

ছবিসূত্র: Shelly Zaman Khan

এই বারো দিনের গ্রামীণ জীবনে আমারও শেকড় গজাতে শুরু করেছিল। এখানকার গাছপালা, পুকুর, সবজিক্ষেত, আলো-হাওয়া, জলকণা, মানুষ সবাই যেন আমার শেকড়কে উজ্জীবিত করে তুলছিল। শুনেছি গাছগাছালির মোহমায়া খুবই ভয়ঙ্কর এক মায়া। যে একবার এই মায়ায় পড়েছে তার পক্ষে আর এর থেকে বের হওয়া সম্ভব হয় না।

কিন্তু আমরা ঝাড়াপাড়া দিয়ে বেড়িয়ে এলাম। আমার ভগ্নিপতি সিরাজ কখনও এই বনের মায়া থেকে বের হতে পারবে কি-না সন্দেহ। তার সকাল শুরু হয় মোরগডাকা ভোরে। দিনরাত কাটে ঘেরের পাড়ে, গাছের ছায়ায় ঘুরেঘুরে। কানাডার মন্ট্রিল প্রবাসী ছেলের ডাক, ঢাকার বাড়ি কোনো কিছুই তাকে তেমন করে ডাকে না; বেঁধে রাখতে পারে না। যতটা এই গ্রাম, এই সবুজ অরণ্য তাকে টানে। এ যেন বনদেবীর মোহ; সবুজের মায়াডাক!

এবার ফেরাও মোরে

শুধু গ্রাম ছেড়ে নয়; ঢাকায় ফিরে কিছুদিনের মধ্যেই আমায় আবার ফিরে যেতে হবে নিউইয়র্কে। নিজের বাসস্থানে। জীবনের প্রয়োজনে এখন সেটাই আমার “হোম টাউন”। কিন্তু যখন আবার লাগেজ প্যাক-ইন শুরু করব তখন ফিরে যাবার আনন্দের পরিবর্তে বুক ধুকপুক করা একটা দুঃখবোধ শুরু হবে। মন কাঁদবে এই মৃত্তিকা আর জলকণার জন্য। শেকড় ছেঁড়ার ব্যথায় হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে উঠবে। চোখ ভরে উঠবে জলে। তবুও মনের অতল গভীরে একটি আনন্দ আর সুখবোধ মনকে প্রবোধ দিয়ে বলবে, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে– এই বাংলায়!’


প্রথম পর্ব দ্বিতীয় পর্ব তৃতীয় পর্ব


 

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

কে বাঁচায়, কে বাঁচে!

সেদিন আপিস যাবার পথে মৃত্যুঞ্জয় প্রথম মৃত্যু দেখল-অনাহারে মৃত্যু! এতদিন শুধু শুনে আর পড়ে এসেছিল ফুটপাথে মৃত্যুর কথা, আজ চোখে

কবিতা

এই জল ভালো লাগে

এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে ধুয়েছে আমার দেহ — বুলায়ে দিয়েছে চুল — চোখের উপরে

গল্প

বিষয়, মিকিমাউস

প্রাককথন সকালে, ডিজিটাল ঘড়ি দশ ঘটিকার সিগন্যাল দিলে মান্না মুমিন মিকিমাউস হয়ে স্টোর রুম থেকে বাহির হয়ে আসে। ততোক্ষণে ডিজিটাল