সাথে সাথে পরিকল্পনা হলো পরের দিন আমাদের যাত্রা পুরান ঢাকা ভ্রমণ, বৈশাখের এক সকালে আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়লাম পুরান ঢাকা দর্শনে। উদ্দেশ্যে ছিল পুরাতন ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় সময় কাটানো। আমরা তাই চললাম বুড়িগঙ্গা ঘাটের দিকে। এই নদীটার নাম কেন যে বুড়িগঙ্গা দেওয়া হয়েছে জানি না। তবে গঙ্গার পাড়ে কোলকাতা আর বুড়িগঙ্গার পাড়ে ঢাকা, ভাবলে ভালোই লাগে− যেন জলপানির স্বাদ পাই। এখানকার নদী বন্দরটির নাম ‘সদরঘাট’। মালপত্রের পাশাপাশি এখানে রয়েছে যাত্রীবাহী লঞ্চ। লঞ্চগুলো রয়েছে বরিশালসহ বাংলাদেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গার জন্য। পাশে বিরাট ফলের বাজার। রাস্তাঘাট এতটাই জনবহুল যে চলতে বেশ বেগ পেতে হয়। সদরঘাট পেরিয়ে খানিকটা যাওয়ার পর বাংলা বাজার, ঢাকার বই পাড়া। মিনি কলেজ স্ট্রিট বলা যেতে পারে। তবে বই ও ক্রেতা বিক্রেতাদের রকমফের দেখে মনে হলো, মূলত স্কুল কলেজের বইয়ের সম্ভারই এখানে বেশি। নোমান বলল, ‘আগে এই পাড়ায় যাতায়াত ছিলো অনেক স্বনামধন্য মানুষের। চলুন খেয়ে নেওয়া যাক।’ তখন সবে দুপুর একটা বাজতে চলেছে। স্থানীয় লোকজন মসজিদে নামাজ পড়তে চলেছেন। নোমান বলল, ‘আমরা বিউটি বোর্ডিংয়ে খাবো।’ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কেন জানি না আমার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জয় মা কালি বোর্ডিং’ নাটকটির কথা মনে পড়ল। নোমান বলল ‘এখানে ভানু বাবু কিন্তু নিজেও আসতেন আড্ডা দিতে।’ আমি তখনও জায়গাটা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। নোমান নিজেও এসেছেন অনেকদিন আগে তাই সঠিক গলিটা চিনতে সমস্যা হচ্ছিল। দু-তিন জন যুবক দোকানদার ও পথচারীদের প্রশ্ন করে আমরা তেমন কিছু জানতে পারলাম না। তখন প্রশ্ন করা হলো একজন বয়স্ক মানুষকে। বোধ হয় নামাজের সময় এগিয়ে আসছে বলে ভদ্রলোক একটু ব্যস্তই ছিলেন। তবুও দুই কদম এগিয়ে হাসিমুখে পথ দেখিয়ে দিলেন।
রাস্তাটির নাম শ্রীশদাস লেন। এই বিশাল পুরাতন দোতলা ইমারতটি এই রাস্তার ১নং বাড়ি। গেট পেরিয়ে দেখলাম পাঁচিলের ভিতরে বেশ খানিকটা বাগান আর বসার জায়গা। বাগানে বসে কয়েকজন বয়স্ক মানুষ আড্ডা দিচ্ছেন। একদিকে নোনা ধরা উঁচু দেওয়াল আর অন্যদিকে একটা অফিস ঘর। অফিসের দরজায় রবীন্দ্রনাথের যুবক বয়েসের ছবি। বাগানের সামনের দিকে রেস্টুরেন্ট আর তার পিছনের দিকে একতলা দোতলা জুড়ে বোর্ডিংয়ের থাকার ঘর। রেস্টুরেন্টটি বোর্ডার ছাড়া অন্যদেরও ক্ষুধা মেটায়। আড়ম্বরহীন টেবিল চেয়ারে বসে খেতে খেতে অনেক কথা জানলাম। কথা হলো বোর্ডিংয়ের বর্তমান মালিক, তারক সাহার সঙ্গে। ‘বিউটি বোর্ডং’-নামের এই দোতলা বাড়িটার সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির ইতিহাস অনেকটাই জড়িত। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির গুণী মানুষদের কে না এসেছেন এই আড্ডাখানায়। বাংলাদেশের আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাসে বিউটি বোর্ডং যে এক উল্লেখযোগ্য পীঠস্থান সে কথা মানতেই হবে। অফিসের দেয়ালে লাগানো পোস্টারে নাম রয়েছে সেই সব আড্ডাপ্রেমী প্রথিতযশা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংবাদিক, চিত্রপরিচালক, নৃত্যশিল্পী, গায়ক, অভিনেতাসহ বিভিন্ন মানুষের। একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম সেখানে। সবাইকে যে আমি চিনি এমন নয়, তবে কিছু কিছু মানুষকে নিশ্চয়ই চিনি। নাম শুরু হলো কবি শামসুর রাহমানকে দিয়ে। তারপর রণেশ দাসগুপ্ত, ফজলে লোহানী, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, ব্রজেন দাস, হামিদুর রহমান, বিপ্লব দাশ, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা, আহমেদ ছফা, হায়াৎ মাহমুদ, সত্য সাহা, এনায়েত উল্লাহ খান, আল মাহমুদ, আল মুজাহিদী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ড. মুনতাসীর মামুন, ফতেহ লোহানী, জহির রায়হান, খান আতা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ শামসুল হক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নির্মল সেন, ফয়েজ আহমদ, গোলাম মুস্তাফা, খালেদ চৌধুরী, সমর দাশ, ফজল শাহাবুদ্দিন, সন্তোষ গুপ্ত, আনিসুজ্জামান, নির্মলেন্দু গুণ, বেলাল চৌধুরী, শহীদ কাদরী, ইমরুল চৌধুরী, সাদেক খান, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শফিক রেহমান, মহিউদ্দিন আহমেদ, আসাদ চৌধুরী, সিকদার আমিনুর হক, জুয়েল আইচ প্রমুখ। নাম পড়া শেষ হলে বিউটি বোর্ডিং কানে কানে ফিসফিস করে বলল, ‘প্রমুখ’ শব্দটির মধ্যদিয়ে আরও কত মানুষ যে এ মুখো হয়েছেন সে কেবল আমিই জানি!
বর্তমান এই বাড়িটি এককালে ছিল নিঃসন্তান জমিদার সুধীর চন্দ্র দাসের। দেশভাগের আগে এই বাড়িতে ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকার অফিস ছিল। কবি শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতাও ছাপা হয়েছিল এই পত্রিকায়। দেশভাগের সময় পত্রিকা অফিসটি কোলকাতায় চলে যায়। এরপর পঞ্চাশের দশকে দুই ভাই প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহা ও নলিনী মোহন সাহা এই বাড়িটি ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন বিউটি বোর্ডিং। ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বিউটি বোর্ডিংয়ে পাকিস্তানি সেনার হাতে নিহত হন প্রহ্লাদ চন্দ্র সাহাসহ ১৭ জন মানুষ। সেই সময় প্রহ্লাদ চন্দ্রের পরিবার জীবন বাঁচাতে চলে যান ভারতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে প্রহ্লাদ চন্দ্রের স্ত্রী শ্রীমতি প্রতিভা সাহা দুই ছেলে সমর সাহা ও তারক সাহাকে নিয়ে বিউটি বোর্ডিংটি আবার চালু করেন। তারাই এখনও চালিয়ে নিয়ে চলেছেন এই সংস্থা। রোজগার বাড়াতে বিউটি বোর্ডিংয়ে খুলেছে ঢাকা কোলকাতা বাসের টিকিট বুকিং অফিস। বোর্ডারদের সংখ্যা কিন্তু নেহাৎ কম নয়। আগে ভাগে বুকিং না করলে বোর্ডিংয়ে জায়গা পাওয়া খুব মুশকিল। অঞ্চলের ভোজনরসিকদের রেস্টুরেন্টটি আকর্ষণ করে সন্দেহ নেই। আমরা বসতে না বসতেই আশপাশের টেবিলগুলো এক এক করে ভরে গেল। সুন্দর রান্না, চমৎকার স্বাদ আর প্রচুর আয়োজন। তারক বাবু জানতে চাইলে নোমান বলল, ‘অনেক দিন পরে আইছি, আইজ সব খামু। এক এক কইরা দিতে থাকেন।’ খাবার শুরু হলো সাদাভাত, ডাল ও শাক দিয়ে। এরপর কয়েক প্রকার ভর্তা এল। বেগুন ভর্তা, টাকি ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এরপর মাছের পালা। ‘মেনি মাছ আছে’, বললেন তারক দা। ‘মেনি আবার কী, দিন দেখা যাক।’ খেতে গিয়ে বুঝলাম সেটি রয়না বা ভেদা মাছ নামেও পরিচিত। ভেদা তো আর হুলো হতে পারে না তাই মেনি। ইলিশ মাছের ডিম ভাজা খেলাম বেশ খানিকটা। আমি সরষে ইলিশ নিলাম আর নোমান কাঁটা বাছার ভয়ে কাতলা। খাওয়া শেষ করলাম পুরনো ঢাকার সাদা রঙের মিষ্টি দই দিয়ে। হোটেলের বিল নিয়ে নোমানের সঙ্গে খানিকটা টানাপোড়েন চলল আমার। শেষে তিনি বললেন, ‘ঢাকায় বিল আমিই দিমু। মাত্র তো ছয়শত। কোলকাতায় নয় আপনি দিয়েন।’ বিউটি বোর্ডিংয়ের থেকে বেরিয়ে অনুভব করলাম শুধু পেট নয়, মনও ভরে গেছে টইটুম্বুর হয়ে। নোমান বলল, ‘চলেন দাদা রিকশা ধরি।’ আমি বললাম, ‘এখন খানিকটা হাঁটাহাঁটি করি চলুন। এখুনি উঠলে আমরা বোধহয় এক রিকশাতে আটবো না।’