প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধশক্তি ও চিন্তাচর্চার গতিপথ

মত ও ভিন্নমত সমন্বিত হলেই সৃষ্টি হয় নতুন মত। নতুন মত মানেই হলো নতুন চিন্তা। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ এটাকে ‘থিসিস-এন্টিথিসিস-সিন্থিসিস’ সূত্রাকারে উপস্থাপন করেছে। সেই হিসেবে চিন্তার বিবর্তন বা বিনির্মাণের জন্য ভিন্নমত বা ‘এন্টিথিসিস’-এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। সহজবোধ্য করার জন্য ‘এন্টিথিসিস’-এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘ভিন্নমত’ বলা হলেও এর সঠিক বাংলা আসলে বিরুদ্ধমত। বিরুদ্ধমতকে আপাতদৃষ্টিতে নেতিবাচক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নেতিবাচক নয়। প্রচলিত মতবাদ যখন অকার্যকর কিংবা অকল্যাণকর হয়ে ওঠে তখন সেই মতবাদের বিরুদ্ধে যে জনমত গড়ে ওঠে সেটাই বিরুদ্ধমত। বিরুদ্ধমত চায় নতুন কিছু। এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনআকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে এবং নতুন চিন্তার উৎপত্তি ঘটায়। নতুন চিন্তা একদিকে প্রচলিত চিন্তাকে অস্বীকার করে অন্যদিকে প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকেও পাল্টে দিতে চায়। এই পাল্টে দেওয়ার প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায় প্রগতিশীলরা। প্রগতিশীলতার মানেই হলো পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এই এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা আছে। কে বাধা সৃষ্টি করে এবং কেন বাধা সৃষ্টি করে সেটা বুঝতে পারা খুব কঠিন নয়। স্বাভাবিকভাবেই বুঝে নেওয়া যায় যে, নতুন ব্যবস্থায় যাদের কায়েমি স্বার্থ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, পরিবর্তিত ব্যবস্থায় যারা বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে ভীত থাকে তারাই প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। এরা পুরোনো চিন্তা ও পুরোনো সমাজব্যবস্থাকে রক্ষা করতে চায়। এ কারণে এরা রক্ষণশীল হিসেবেও পরিগণিত হয়। এই রক্ষণশীল গোষ্ঠীই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী।

স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সব সময় বিদ্যমান ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে চায়। আর বিদ্যমান ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হলে প্রথমেই নতুন চিন্তা বা নতুন ধ্যান-ধারণা বিকশিত হওয়ার পথ বন্ধ করতে হয়। কোথাও নতুন চিন্তার উদ্ভব হলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি প্রথমেই সেই নতুন চিন্তার মূলে কুঠারাঘাত করে থাকে। কিন্তু মানুষের চিন্তা কখনোই এক জায়গায় থেমে থাকতে পারে না। চিন্তাচর্চার মানেই হলো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। নতুন কিছুর উদ্ভাবন করা। একমাত্র নতুন কিছুর উদ্ভাবনই পারে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে বদলে দিতে। নতুন কিছুর উদ্ভাবন হলেই সামাজিক পরিবর্তন তরান্বিত হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে চিন্তার পরিবর্তন মানেই বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন। এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায় প্রগতিশীল শক্তি। প্রগতিশীলতা যেমন একটি শক্তির নাম। প্রতিক্রিয়াশীলতাও একটি শক্তি। এই দুই শক্তির দ্বন্দ্ব চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। প্রথম যখন সমাজব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল তখন থেকেই এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই দ্বন্দ্বের নিরসন হয়নি। বরং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই দ্বন্দ্ব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। কারণ সর্বযুগেই একটি শ্রেণি বিদ্যমান ব্যবস্থায় সামাজিক মর্যাদা ও রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়ে থাকে। অন্য একটি শ্রেণি শোষিত-বঞ্চিত হয়। সুবিধাভোগী শ্রেণি কখনোই পরিবর্তন চান না। কিন্তু শোষিত-বঞ্চিত শ্রেণি সব সময় পরিবর্তন আকাঙ্ক্ষা করেন এবং পরিবর্তনের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করেন। এ লড়াইটার সাথে নীতি-আদর্শিক কিছু বিষয় জড়িত বলে সুচিন্তা বা বোধবুদ্ধি কখনোই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে সমর্থন করতে পারে না। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সব সময় শাসকগোষ্ঠীর প্রচ্ছন্ন সমর্থন পেয়ে থাকে। কারণ শাসকগোষ্ঠীও বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন চান না। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আর একটি প্রবল সমর্থক হলো ধর্ম। ধর্ম অনেক সময় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উৎসও হয়ে ওঠে। কারণ ধর্ম বিধিবদ্ধ। ধর্ম বিষয়ে কোন পরিবর্তন কখনোই মানবেন না কোন ধার্মিক কিংবা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ। সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীলতার দুটি প্রবল সহযোগী শক্তি হলো রাষ্ট্র ও ধর্ম।

প্রগতিশীল চিন্তা বা শক্তির পেছনে রাষ্ট্রও নেই, ধর্মও নেই। তাই প্রগতিশীল শক্তি সব সময় আত্মরক্ষা করে চলে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মতো আগ্রাসী হয়ে ওঠে না। তবে লড়াইটা কখনো শেষ হয় না। তাই ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ থেকেও প্রগতিশীল শক্তি নতুন নতুন পথ খুঁজে নেয়। নতুন চিন্তার দ্বারা বিদ্যমান সমাজকে বদলাতে চায় কিংবা সামাজিক অসঙ্গতি দূর করতে চায়। এই চিন্তাচর্চার মাধ্যমেই ঘটে চিন্তার বিবর্তন। চিন্তার বিবর্তনের সাথে প্রতিক্রিয়াশীলতার একটি বৈরী সম্পর্ক চলে আসছে গোড়া থেকেই। নতুন চিন্তাকে কখনোই সাদরে গ্রহণ করেনি কোন রাষ্ট্র বা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ। নতুন চিন্তাকে সমূলে নস্যাৎ করতে গিয়ে চিন্তাচর্চাকারীর জীবনকেও বিপন্ন করেছে। চিন্তাচর্চার ইতিহাস থেকে জানা যায়, যখনই কোন নতুন চিন্তা বা মতবাদ নিয়ে হাজির হয়েছেন কোন চিন্তাবিদ বা বিজ্ঞান-দার্শনিক তখনই ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ও ধর্মপ্রভাবিত রাষ্ট্র মিলে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।

অষ্টাদশ শতকের ইউরোপীয় নবজাগরণ বা নতুন চিন্তা বিকাশের কালে এমন অনেক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক জীবন দিয়েছেন যাঁরা মানবজাতির জন্য কল্যাণকর চিন্তা করেছিলেন। বিশিষ্ট রোমান দার্শনিক বীথিয়াস (৪৭০-৫২৬)কে অন্যায় ও সম্পূর্ণ কাল্পনিক অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। দণ্ডিত বীথিয়াস তখন উদার ও মহান চিন্তার ওপর দর্শনের সান্ত্বনা (The Consolation of Philosophz)) নামে একটি বই লিখেছিলেন। আত্মার অমরত্ব বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করার দায়ে দার্শনিক ভ্যানিনি (১৫৮৪-১৬১৯)কে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। কোপারনিকাসের (১৪৭৪-১৫৪৩) সূর্যকেন্দ্রিক মতবাদ সমর্থন করার দায়ে ইটালীয় দার্শনিক ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০)কে জীবন্ত দ্বগ্ধ করে মারা হয়েছিল। মধ্যযুগে চার্চ বা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ও রাজতন্ত্র মিলে এভাবেই আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তারপরও প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশ থেমে থাকেনি। কারণ ব্যক্তিকে হত্যা করা সম্ভব হলেও ব্যক্তির চিন্তা বা মতবাদকে হত্যা করা যায় না। চিন্তা বা মতবাদের উত্তরাধিকার সৃষ্টি হয়ে যায় সময়ের প্রয়োজনেই।

উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁ বা সংস্কার আন্দোলনের বিপক্ষে ছিলেন একটি প্রভাবশালী রক্ষণশীল গোষ্ঠী। রামমোহন-বিদ্যাসাগর গোষ্ঠীর সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে ঐ প্রভাবশালী মহল প্রবল শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমাজ, ধর্ম এমনকি রাষ্ট্রও ছিল তাদের পক্ষেই। কিন্তু তাদের অবস্থান অমানবিক ও মানবকল্যাণের বিপক্ষে ছিল বলে শেষ পর্যন্ত তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। নতুন যুগ নতুন চিন্তাকেই গ্রহণ করেছে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে, অনেক বৌদ্ধিক সংগ্রামের মাধ্যমে সংস্কার আন্দোলন সফল হয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ ধর্মীয় মর্যাদায় পালিত হয়ে আসা সতীদাহ প্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে। রক্ষণশীল সমাজপতি ও গোঁড়া ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের অপকৌশলে নিষিদ্ধ থাকা বিধবাবিবাহ প্রবর্তিত হয়েছে। বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ যথাসম্ভব কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তাই বলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিলুপ্তি ঘটেনি। রুশ বিপ্লব (১৯১৭) বিশ্বজুড়ে যে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ও সাম্যবাদী দর্শন ছড়িয়ে দিয়েছিল তা এক শতাব্দীও সফলভাবে টিকে থাকেনি। আবার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে- এ কথাও বলা যাবে না। মানবজাতির জন্য কল্যাণকর কোন চিন্তাই ব্যর্থ বা বিলুপ্ত হয়ে যায় না। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে লড়াই করেই টিকে থাকে। প্রগতিশীল শক্তি চিন্তার বিবর্তনকে মেনে নেয়। পুরোনো ব্যবস্থাকে বর্জন করে নতুন ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে। পুরোনো ব্যবস্থামাত্রই খারাপ না হলেও যে কোন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে সেখানে একটি কায়েমি স্বার্থবাদী শ্রেণির জন্ম হয়। শোষণের একটি স্থায়ী সিস্টেম গড়ে ওঠে। তখন বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুবিধাপ্রাপ্তদের সুবিধা আরও বেড়ে যায় এবং বঞ্চিতরা আরও বঞ্চিত হতে থাকে। এই বৈষম্যমূলক চিত্র দেখা গেছে পুরো পাকিস্তান আমল জুড়ে। বাইশ পরিবারের হাতে দেশের প্রায় সব সম্পদ চলে গিয়েছিল। দেশের দুই অংশের (পূর্ব ও পশ্চিম) মধ্যে এই বিরাট বৈষম্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল কায়েমি স্বার্থবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী। শাসক শ্রেণিও যুক্ত ছিল তাদের সাথে। চিত্রটা আসলে একই। শোষিত-বঞ্চিতরা পরিবর্তন চাইলো। সুবিধাবাদীরা বিদ্যমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চাইলো। পরিবর্তনাকাঙ্ক্ষীরা প্রথমে থাকে সংখ্যায় অল্প এবং অসংগঠিত। রক্ষশীলগোষ্ঠী ও তাদের অনুসারীরা সংখ্যায় অসংখ্য এবং তারা দারুণভাবে সংগঠিত। কায়েমি স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তারা বরাবরই সংগঠিত থাকে। তারা শাসকগোষ্ঠীকে ব্যবহার করে। শুধু শাসকগোষ্ঠী নয়; ধর্মকেও তারা ব্যবহার করে। ধর্মের এই অপব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে খোদ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেও। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্মকে ব্যবহার করে একটি রাষ্ট্র কায়েম করলেও নিজে ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক ছিলেন না। পাকিস্তান কায়েমের পর যারা মুসলিম লীগের রাজনীতি করেছেন তারাও জিন্নারই অনুসারী ছিলেন। ধর্মকে তারা একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করেছেন।

বিদ্যমান ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাই প্রতিক্রিয়াশীলতা। আর বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে কিংবা বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাই প্রগতিশীলতা। প্রগতিশীলতার সঙ্গে চিন্তার বিবর্তনের একটি সম্পর্ক আছে। মানুষের চিন্তাশক্তি কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না। আবার পেছনের দিকেও যায় না। মানবীয় চিন্তার বৈশিষ্ট্যই হলো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। চিন্তা সামনের দিকে এগিয়ে গেলেই তা সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। তারপরও প্রগতিশীল চিন্তার বিপক্ষ শক্তি হিসেবে টিকে আছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যখন আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয় তখন সামাজিক প্রগতির পথ সংকীর্ণ হয়ে যায়। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি প্রবল হলে তা কখনো কখনো সমাজকে পেছনের দিকেও চালিত করে। কারণ সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে পেছনে ফিরে যাওয়া তার জন্য নিরাপদ। প্রতিক্রিয়াশীলরা সর্বাগ্রে তাদের নিরাপত্তার কথা ভাবে। সম্পদের নিরাপত্তা, সামাজিক অবস্থানের নিরাপত্তা ও বিদ্যমান ব্যবস্থার নিরাপত্তা বিধান করার জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। প্রয়োজনে তারা ধর্ম ও রাষ্ট্রশক্তির সাহায্য নেয়। ধর্মকে তারা খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারে। কারণ ধর্মের বিধিবদ্ধ নিয়মের প্রতি সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতি ও আস্থা সীমাহীন। ধর্মের জন্য জীবন দিতে অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষ কুণ্ঠাবোধ করেন না। ধর্মান্ধ মানুষ তো অন্যের জীবনও কেড়ে নেয় নির্দ্বিধায়। তাই যে কোন পরিবর্তন বা প্রগতিশীল চিন্তাকে কৌশলে ধর্মবিরোধী হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা করেন প্রগতিশীল ব্যক্তিরা। এতে ধর্মীয় অনুভূতি নিজেদের পক্ষে চলে আসে। রাষ্ট্রও সাধারণত ধর্মীয় অনুভূতির বাইরে যায় না। ধর্মকে ব্যবহার করলে রাষ্ট্রকেও ব্যবহার করা যায়। তখন রাষ্ট্র, ধর্ম আর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি একাকার হয়ে চিন্তার বিকাশ বা বিবর্তনের পথকে রুদ্ধ করে। প্রগতিশীল চিন্তার চর্চা বাধাগ্রস্ত হয়। সমাজ গতিশীল না হয়ে স্থিতিশীল হয়ে পড়ে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় যারা সুবিধাভোগী তাদের সুবিধা আরও বেড়ে যায়।

প্রগতিশীল শক্তি ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির এই বিরুদ্ধ অবস্থান শাসকগোষ্ঠীর জন্য স্বস্তিদায়ক। দুই শক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলতে থাকলে শাসকশক্তি অনেকটা নিরাপদ থাকে। শাসকগোষ্ঠী তখন কৌশলগত ভূমিকা পালন করে। কখনো প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে অবস্থান নেয়। কখনো প্রগতিশীলতার পক্ষে অবস্থান নেয়। এই অবস্থান প্রকৃত অবস্থান নয়। আসলে শাসকশক্তি কারো পক্ষে অবস্থান নেয় না। শাসকশক্তি চায় সবাই তার পক্ষে থাকুক। প্রগতিশীল শক্তি সব সময় তার পক্ষে থাকতে পারে না। আর প্রগতিশীল শক্তির দাবিগুলোও শাসকশক্তির মনোপুত হয় না। কারণ দাবিগুলোর সাথে যে পরিবর্তনের বিষয় যুক্ত থাকে কিংবা নতুন যে আইডিয়া যুক্ত থাকে তা শাসকগোষ্ঠীর জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। অপরদিকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির দাবিগুলোর সাথে পরিবর্তনের কোন বিষয় কিংবা নতুন কোন আইডিয়া যুক্ত থাকে না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট না হলে তারা পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়। পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া শাসকগোষ্ঠীর পক্ষেও সহজ ও ঝুঁকিমুক্ত। কিন্তু প্রগতিশীলদের দাবি অনুযায়ী নতুন ব্যবস্থা চালু করা কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। এই বাস্তবতায় শাসকগোষ্ঠী সব সময় প্রতিক্রিয়াশীলদের দিকেই হেলে থাকে। আর প্রগতিশীলদের চিন্তা সমর্থন করলেও তা বাস্তবায়ন করে না।

আলোচনাটি তাত্ত্বিক। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম দেখা যেতে পারে। তবে ব্যতিক্রম ক্ষেত্রটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সৃষ্টি হয় এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে বলে তা সাধারণ চিন্তাকে পাল্টে দিতে পারে না। যে কোন সাধারণ চিন্তার একটি নিজস্ব পরিমণ্ডল থাকে। সেই নিজস্ব পরিমণ্ডলকে কেন্দ্র করেই চিন্তাশক্তি আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়। প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার যেমন একটি নিজস্ব পরিমণ্ডল আছে, প্রগতিশীল চিন্তারও আছে নিজস্ব পরিমণ্ডল। তবে প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা তার সীমাবদ্ধ পরিমণ্ডল অতিক্রম করে না বা করতে চায় না। বিধিবদ্ধ কিছু আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়কে ঘিরে তা আবর্তিত হয়। কিন্তু প্রগতিশীল চিন্তা ক্রমশ তার নিজস্ব পরিমণ্ডলকে প্রসারিত করে নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটায়। প্রগতিশীল চিন্তার এমন একটি বিবর্তন প্রক্রিয়া আছে যে বিবর্তন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে নতুন নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটে। এ কারণেই প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা ও প্রগতিশীল চিন্তার মাঝে পার্থক্য স্বীকৃত ও সুস্পষ্ট।

প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধশক্তি যে প্রতিক্রিয়াশীলতা- এটা সর্বজনস্বীকৃত। চিন্তাচর্চার বৈপরীত্ব থেকেও তা প্রমাণিত হয়। প্রতিক্রিয়াশীলতা ও প্রগতিশীলতার স্বরূপ ও সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে বলা যায় প্রতিক্রিয়াশীলতা ও প্রগতিশীলতা চিন্তাচর্চার দুটি ধারা। দুটি প্রধান ধারা হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। বর্তমান বিশ্ব চিন্তাচর্চার এই দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। শুধু বিভক্তই হয়নি, এই দুটি ধারার মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছে পুরোদমে। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে প্রতিক্রিয়াশীলগোষ্ঠী নিজ অবস্থান পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছে। ধর্মীয় অনুভূতির সঙ্গে পারলৌকিক জীবনের হিসাব-নিকাশ যুক্ত বলে ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষ সহজেই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পাশে দাঁড়ায়। অপরদিকে প্রগতিশীলগোষ্ঠী আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করার ঘোরবিরোধী। এ ব্যাপরে ধর্মের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করেন না প্রগতিশীলগোষ্ঠী। ফলে ধর্মবিশ্বাসী সাধারণ মানুষ প্রগতিশীলদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ধর্ম যে ব্যক্তিগত পালনীয় বিষয় এবং আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার যে প্রতিক্রিয়াশীলগোষ্ঠীর একটি কৌশলগত বিষয় সেটা বুঝতে পারেন না সাধারণ মানুষ। প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশে এটি একটি বড় বাধা। প্রগতিশীলরাও অনেক ক্ষেত্রে শতভাগ প্রগতিশীল নন। আহমদ ছফা তাঁর সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৯৭) গ্রন্থে বলেছেন ‘যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশো ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবী করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।’ বাকি বিশ ভাগকে তিনি কোন ভাগে রাখেননি। একই সাথে ছফা এ কথাও বলেছেন যে, ‘দিনে দিনে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যে হারে সংগত হচ্ছে এবং মৌলবাদের প্রতাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা তার বিরুদ্ধে কোন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ রচনা করতে পারেননি। আমাদের জনগণ তাদেরকে চরিত্রহীন, ভ্রষ্ট, সুযোগসন্ধানী এবং আগ্রাসী শক্তির সহায়ক হিসেবে এরই মধ্যে চিহ্নিত করে ফেলেছেন।’ আহমদ ছফার শেষ লাইনটি সর্বাংশে সত্য নয়। প্রগতিশীলদের তিনি যেভাবে বিভাজন করেছেন সেটাও সর্বজনস্বীকৃত নয়। তবে প্রগতিশীল বলে চিহ্নিত অনেকেরই আদর্শবিচ্যূতি ঘটেছে। অনাকাক্সিক্ষত হলেও নানা কারণে ব্যক্তির আদর্শবিচ্যূতি ঘটতে পারে। তাই বলে আদর্শিক চিন্তা ব্যর্থ হয়ে যায় না। যে কোন চিন্তা বা মতবাদ বেঁচে থাকে তা বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষার ওপর। প্রগতিশীল চিন্তার প্রতিষ্ঠা বা প্রগতিশীলতা অর্জনের জন্য যে সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষা সেই আকাঙ্ক্ষাই নির্মাণ করে যাবে প্রগতিশীল চিন্তাচর্চার গতিপথ।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি

কাণ্ডারী হুশিয়ার!

১ দুর্গম গিরি কান্তার-মরু দুস্তর পারাবার লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুশিয়ার! দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভূলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে

বধূ-বরণ

এতদিন ছিলে ভূবনের তুমি আজ ধরা দিলে ভবনে, নেমে এলে আজ ধরার ধূলাতে ছিলে এতদিন স্বপনে! শুধু শোভাময়ী ছিলে এত

মাছের লেজ

তিন-চার বছর আগের কথা। তখন আমি ঢাকা পল্লবীতে থাকি। মিরপুর সাড়ে এগারো বাসস্ট্যান্ডের সাথে আমার বাসা। একদিন সকাল দশটায় বউকে

গল্প

বেনামী ক্ষরণ আর কিছু জিজ্ঞাসা

­ ইসরাত জাহানের গল্প: বেনামী ক্ষরণ আর কিছু জিজ্ঞাসা আজাদের কথা… এক খড়খড়া দুপুরে ময়মনসিংহ শহরের খোলা রাস্তায় চোখের সানগ্লাসটা