মহামারীর কবলে বর্তমান সমাজ মৃতপ্রায় হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে দৌড়াচ্ছে, কোথায় গিয়ে যে থামবে তা কেউ বলতে পারছি না, তাছাড়া বলতে পারার কথাও নয়, একটা অজানা আতঙ্ক বর্তমান সমাজকে গ্রাস করছে, বলতে গেলে আতঙ্কের চোরাবালিতে পড়ে বর্তমান সমাজ চিৎকার করছে, বাঁচার শেষ চেষ্টা ও করছে, একটু অক্সিজেনের জন্য ছটফট করছে, তার সঙ্গে সঙ্গে সমান্তরালে বেড়ে চলেছে দুর্নীতির সাঁড়াশি আক্রমণ।
মহামারীর কবলে বর্তমান সমাজের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবে সবচেয়ে কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়েছে সমাজের খেটে খাওয়া মানুষজন। প্রায় সারাবছর তারা লকডাউন-এর কবলে গৃহবন্দী হয়ে আছে, কোনোরকমে আধ পেটা খেয়ে জীবন ধারণ করছে। বর্তমানে করোনার আতঙ্কে থেকে ক্ষুধার আতঙ্ক তাদের কাছেই যেন বিভীষিকা, আগামী দিনগুলো তারা কিভাবে বাঁচবে সংসারকে কিভাবে বাঁচিয়ে রাখবে এই চিন্তায় তাদের ঘুম উড়ে গেছে।
অনেকে আবার লকডাউন-এর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে, বর্তমানে এছাড়া তাদের কাছে তো আর কোনো পথ খোলা নেই। এদিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবস্থা আরো ভয়াবহ, মহামারী আতঙ্কে তারা সব বাড়ি ফিরে এসেছে, সারাবছর কর্মহীন হয়ে বাড়িতে আশঙ্কায় দিন গুনছে, পেট তো মানে না, আর পেটে গামছা বেঁধেও জীবন বাঁচে না। তাই তারা করোনা এবং লকডাউনের ভ্রকুটি উপেক্ষা করে সংসার বাঁচানোর তাগিদে আবার পুরনো কর্মস্থলে যেনতেন প্রকারে ফিরে যেতে চাইছে।
মহামারীর আতঙ্ক এবং লকডাউনের যাঁতাকলে সবচেয়ে সঙ্গিন অবস্থা ছাত্রসমাজের, দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজের ঝাঁপ বন্ধ, পড়াশোনা প্রায় লাটে ওঠার জোগাড়। অনলাইনে নামে পড়াশোনা এবং পরীক্ষা ব্যবস্থাকে কোনোরকম বাঁচিয়ে তোলা একটা ব্যর্থ চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। বলতে গেলে আমাদের এই উপমহাদেশে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামো এখনো ঠিক মতো গড়ে ওঠেনি।
বর্তমানে বিশ্বসমাজ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। এই উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি দেশ দুর্নীতিতে একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছে, বর্তমানে মানুষজন রাতারাতি ধনী হতে চাইছে, একে অপরের থেকে বেশি অর্থবান ও প্রতিপত্তিশালী হতে চায়, এই মানসিকতা দুর্নীতিকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাছাড়া বর্তমানে ভোগবাদী মানসিকতা বহুগুণ বেড়ে গেছে, যার ফলে মানুষ দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে, সহজ পথে আরও বেশি করে অর্থ কমানোর জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। দুর্নীতির নোংরা খেলার যেন প্রতযোগিতা লেগেছে বর্তমান সমাজে, সরকারি-বেসরকারি প্রায় সমস্ত প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির নোংরা খেলা চলছে। বর্তমানে করোনা মহামারীতে সবচেয়ে দুর্নীতি চোখে পড়ছে চিকিৎসা ক্ষেত্রে, করোনা আতঙ্কে মানুষজন যখন বিভ্রান্তির মত দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে, তখন বেসরকারি নার্সিং হোমগুলি ফাঁদ পেতে বসে আছে, কখন ফাঁদে একটা শিকার এসে পড়ে। বর্তমান খবরের কাগজ খুললেই এসব দুর্নীতির খবর চোখে পড়ছে, রহস্যজনকভাবে নেগেটিভকে পজিটিভ দেখিয়ে ভয় ধরিয়ে নোংরা খেলার সংবাদ যেমন সমাজে মূল্যবোধ হারানোর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ। তাছাড়া এসব বেসরকারি নার্সিংহোমের গড় বিল দশ থেকে কুড়ি লাখ টাকার কম নয়, অনেক সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবার এদের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে এমন সংবাদ আজকাল আকছার শোনা যাচ্ছে। শুধু করোনা চিকিৎসায় নয় অন্যান্য চিকিৎসা পরিসেবাতেও নানা দুর্নীতির খবর শোনা যায়, অকারণে প্রসূতিকে সিজার, অতিরিক্ত ওষুধ, ডাক্তার নার্স ইত্যাদি বিল ধরনের নোংরা খেলা তো আছেই। শুধু চিকিৎসা পরিসেবায় নয় সমাজের সমস্ত সেবা ক্ষেত্র দুর্নীতিতে ভরে গেছে, বর্তমানে ঘুষ না দিলে কোন সরকারি পরিসেবা পাওয়া যায় না, ভাবতে অবাক লাগে যাদের মাসে ৫০ হাজার টাকা মাইনে তারা নির্লজ্জভাবে সমাজের গরিব মানুষকে হয়রানি করে ঘুষ আদায়ের জন্য অভিনব খেলায় মেতে উঠেছে। এর কারণ একটাই ভোগবাদ সমাজের আকর্ষণ, যার জন্য সব মূল্যবোধ ও নৈতিকতা ইত্যাদিকে বিসর্জন দিয়েছে এই মেকি সমাজের মানুষ।
এখন প্রশ্ন হলো কেন সমাজ আজ দুর্নীতি দ্বারা পূর্ণ? কেন এই দুর্নীতিকে রোখা যাচ্ছে না? কেন সমাজের চারদিকে খুনখারাপি ধর্ষণ রাহাজানির মতো ঘটনা ঘটছে, প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে, সাধারণ মানুষের কাছে এগুলো গা সহা হয়ে উঠেছে? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই– ভোগবাদী মানসিকতা, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বোধের বিকাশ, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সমাজের বিধিবদ্ধ এবং বিধিবদ্ধ সংগঠনের ব্যর্থতা!
আমরা জানি সমাজ একটা নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিষ্ঠান, সমাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য থাকে বিধিবদ্ধ ও অবিধিবদ্ধ সংগঠন, পুরস্কার ও তিরস্কার এর ব্যবস্থা। বর্তমানে এগুলি দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুর্নীতিতে জড়িত শীর্ষ ব্যক্তিদের শাস্তি হয় না, সরকারি পক্ষ থেকেও তাদের আড়াল করার একটা চেষ্টা শুরু হয়, যাই হোক দুর্নীতি দমন যেভাবেই হোক করতে হবে তা না হলে আমরা দুর্নীতির সাগরে ভেসে যাব। আজ বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এই উপমহাদেশের প্রায় সবকটি দেশ-ই রয়েছে, এহেন পরিস্থিতিতে দুর্নীতি দমন করতে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রকগুলোকে আরো বেশি ক্ষুরধার করতে হবে। সমাজে মূল্যবোধ ও নীতিবোধের চর্চা বাড়াতে হবে, সর্বোপরি নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে, গণমাধ্যমগুলোকে আরো সজাগ থাকতে হবে, দুর্নীতিবাজরা যাতে কোনোরকম পৃষ্ঠপোষকতা না পায় সে ব্যাপারে সকলকে সজাগ থাকতে হবে, অনেক সময় সরকারি পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিষয়টি উপেক্ষা করা হয়।
সবশেষে আমরা বলতে পারি বর্তমানে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়া, এর জন্য সম্মিলিত শক্তির জাগরণ খুবই জরুরী, নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু করতে হবে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে আরো বেশি করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, বিধিবদ্ধ এবং বিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাকে যথেষ্ট শক্তিশালী করতে হবে, হারিয়ে যাওয়া নীতিমালা ও মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনতে হবে, সমাজে মূল্যবোধের চর্চা তিরস্কার এবং পুরস্কারের চর্চা ও প্রয়োগ বাড়াতে হবে, তবেই বর্তমান সমাজের যে সংকট, সমাজতাত্ত্বিকরা যাকে সমাজের অসুখ বলেছেন তা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো।