জাকির তালুকদারের গল্প


দর্পণ-এর গল্পবিষয়ক বিশেষ সংখ্যা ‘শিশিরভেজা গল্প’-তে প্রকাশিত


জঙ্গনামা

জাকির তালুকদার


সুরুযের আগে বিছান না ছাড়ে যেই নারী
লক্ষ্মী কয় তার সাথে মোর চিরকালের আড়ি!

না ফোটা আলোর মধ্যে, শেষ আষাঢ়ের মেঘরঙা ভোরে হাজি সাহেবের খালের কালচে ঢালু মাটির পটভূমিকায় সাদা ধবধবে একটা তরুণী-শরীর পড়ে থাকতে দেখেও দেড়কুড়ি ছয় বছর আগের মতো এখন আর চমকায় না সোনাভান। সেই তরুণী-শরীরে সুতার বস্তরটি নেই, উরুসন্ধি থেকে লাল রক্ত গড়িয়ে গিয়ে মিশছে খালের ঘোলা পানিতে, ফর্সা সারা শরীরে দোগড়া দোগড়া কালচে হয়ে ওঠা দাগ, যেগুলির আসল রং লাল, সেই তরুণী-শরীর ঘিরে বাতাসে পাক খাচ্ছে আট-দশটা কাক আর নিদেনপক্ষে তিন-তিনটে শকুন। পুরো দৃশ্যটি ভয়াবহ। এই দৃশ্য নির্মাণের আগের কথোপকথন, যা আসলে এই দৃশ্যেরই অপরিহার্য অংশ, সেই কথাগুলিও কম আর্ত নয়। ‘আপনেরাও মুসলমান, আমিও মুসলমান, আপনেরা আমার ধর্মের ভাই! আপনারে আল্লা, আমার আল্লা এক। সেই আল্লার দোহাই!’ অন্যদিক থেকে সরাসরি অস্বীকার আসে। অস্বীকারই আসে। কথায় এবং আচরণে। তারপরে এই দৃশ্য। সেইসব কথা আর দৃশ্যটাকে একসাথে মিলিয়ে নিলে ভয়াবহতা আরো বেড়ে যায়। তবুও এখন আর দৃশ্যটি দেখে আগের মতো ভয় পেয়ে গলা ছলকে হৃৎপিণ্ড বেরিয়ে যাওয়ার মতো করে আঁত্কে ওঠে না সোনাভান। কেননা বার বার দৃশ্যটি দেখতে দেখতে সোনাভান এখন জেনে গেছে যে যতদিন সে বাঁচবে এই দৃশ্য দেখে যেতে হবে তাকে। আর এই দৃশ্যটি তার জীবনের সঙ্গে এমন অচ্ছেদ্য আঠায় আটকে আছে যে তাকে ছাড়ানোর মতো জ্বিন-ভূত তাড়ানো ওঝা ত্রিভুবনে জন্মায়নি। এখন তো তবু সোনাভান দৃশ্যটি দেখতে পায় কালে-ভদ্রে। আগে দেখত নিয়মিত, ঘন ঘন, প্রায় রোজ। কিন্তু এখন যেহেতু নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়ে ডুবে থাকার অবকাশ কমে আসছে সোনাভানের জীবনে, তাদের সবার জীবনে, তাই অনেকদিন পর পর যখন সোনাভান কোনো কারণে নিজের সঙ্গে কথাবার্তা বলার একটু অবকাশ পায়, কেবল তখনই এই দৃশ্য, এবং এই রকমের আরো কয়েকটি  দৃশ্য সে দেখতে পায়। এ এক আজব অবস্থা। দেখলে ভয় লাগে দুঃখ লাগে সমস্ত অস্তিত্ব ভেঙে কান্না জাগে, আবার বেশিদিন না দেখলে নিজের মধ্যে কোথায় যেন খালি খালি লাগে। মনে হয় কী একটা যেন অনেকদিন তার কাছে আসছে না, কী একটা যেন… কষ্টকর কিন্তু কাছে না থাকলে নিজেকেও মনে হয় না নিজের কাছে পুরোপুরি থাকা হয়। এখন অবকাশ এতই কম, যে নিজের সর্বনাশের কথা স্মরণে এনে দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেলতে বসারও সুযোগ পাওয়া যায় কী যায় না!

অবকাশ এতই কম!

এখন দ্যাখো তাদের গাঁয়ের মধ্যে হুড়মুড়িয়ে এসে ঢুকে গেছে গোটা দুনিয়াটা। কিংবা বলা যায়, তাদের যে গাঁ এতদিন ছিল দুনিয়ার এক কোণে, এতই কোণে যে তা দুনিয়ার সাথে না থাকারই মতো যেন, এখন সে নিজের আড় ভেঙ্গে দাঁড়িয়ে গেছে দুনিয়ার গায়ে গা লাগিয়ে। একসাথে এখন এত জিনিস নিয়ে ভাবতে হয় যে মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে ঝটপটানি তৈরি করে অস্থিরতা, কোনটা আগে কোনটা পরে তা ভেবে বের করতে বসারও যেন অবসর না দিয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা বিষয় চলে আসতে থাকে, আসতেই থাকে, আর অস্থির পেয়াদার মতো পা ঠুকতে থাকে উঠোনের মাটিতে- এখনই, আগে, সবাকার আগে, আমার দাবি মেটাও!

বচন মেনে সোনাভান তো সূর্যের আগে চিরকাল জেগে উঠেছে। সেই শৈশবে বুদ্ধি যখন কেবল ফুটি ফুটি করছে, তার মায়ের খালা, জোলেখা-নানি সেই বয়সেই মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল– মাগি মানুষ হয়ে জন্ম নিছু বইন, যে ধর্মেরই মানুষ হস না ক্যা, লক্ষ্মীর পায়ের পারা যদি না পড়ে ঘর-দুয়ারে, তাহলে সর্বনাশ! লক্ষ্মীর আশীর্বাদ ছাড়া জীবন চলে না। মিয়ামানুষের জীবন তো চলবি না এক পলও। গেলে সোয়ামীর ঘরে, যা ঘটে তার জন্যে দায়ী মাগ। তখন লক্ষ্মী যদি না থাকে ঘরে–উঠতেও ঝাঁটা বসতেও ঝাঁটা।

তো লক্ষ্মীকে সঙ্গে সঙ্গে রাখতে হলে মেয়েমানুষকে বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে সূর্যের আগে, মরদ তার চোখের ঘুম মুছে ফেলার আগেই তার জন্যে করে রাখতে হবে পানি-পান্তার বন্দোবস্ত। কিন্তু সেই পানি-পান্তা আবার পরিবেশন করা যাবে না নাপাক শরীরে, শরীরকে রাতে নাপাক বানিয়েছে যে পুরুষ তাকেই আবার খাবার বেড়ে দিতে হবে ধোয়া-পাখলা শরীরে ও কাপড়ে। তার আগে নিজের পেটে খিদা মোচড় দিলেও দাঁতে কাটা যাবে না একটাও দানা। তা নাহলে লক্ষ্মী থাকবে না ঘরে।

পেটে খিদা সামনে খাদ্য তবু স্বামীর আগে না খায়া যে মিয়ামানুষ খিদা চেপে মুখে দেয় পান।।

ওরে… লক্ষ্মী উঠিয়া বলে, ওরে নারী সতিসাধ্বী আজ হতে মাগো তুই আমার সমান।।

তখন পাকিস্তান আমল। সবকিছুতে হিন্দু-মুসলমান; হিন্দুয়ানি-মুসলমানি। কিন্তু লক্ষী দেবী তখনো গাঁয়ের সকল মেয়েমানুষের এজমালি সম্পত্তি। বারবাড়ি-দহলিজে তখন বেশরিয়তি-বেদাতি নিয়ে কথার ফুলঝুরি, সেসব ভেতরবাড়িতে ঢোকে কি ঢোকে না। জোলেখা-নানি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় সব– আরে লক্ষ্মী হলো লক্ষ্মী, তার আর হিন্দু-মুসলমান কী? দেখিস না শরিয়তি তর্ক নিয়ে যারা আসর কাঁপায়, তারাও নিজের বউ-বিটির গুণগান গাওয়ার সময় কয় যে মিয়াডা আমার খুব লক্ষ্মী, বউডা আমার খুব লক্ষ্মী।

তাই প্রতিবেশী কল্পনা-পুতুলদের বাড়িতে লক্ষ্মীর ব্রত-পাঁচালিতে সোনাভান নিত্য উপস্থিত। লক্ষ্মীর সরা কীভাবে সাজাতে হয় তার মুখস্ত। পুতুল কোনো কোনো সময় ভুলোমনে দিশা-বিশা না পেলে বোন কল্পনাকে জিজ্ঞেস করার বদলে বেছে নেয় সোনাভানের শরণ। লক্ষ্মীর সব গীত সোনাভানের ঠোঁটের ডগায় আপনাআপনি অধিষ্ঠান করে।

কিন্তু এত এত লক্ষ্মীর গীত গেয়ে শেষ পর্যন্ত– হলোটা কী? জীবন তো আছে সেই না থাকা জীবনের মতোই। আর মরণ তো একবার এসে পড়েছিল প্রায়। বেঁচে উঠেছে। বেঁচে থেকেছে। যদি তাকে কেউ বেঁচে থাকা বলে, তবে সেটা বেঁচে থাকা। সোনাভান তাকে কী বলে? কিছুই বলে না। দেড় কুড়ি ছয় বছরে সে বেঁচে আছে কি মরে গেছে তা নিয়ে কোনোদিনও একবিন্দু মাথা ঘামায়নি। শুধু সে জানে ব্রত-পাঁচালি তাকে বাঁচায়নি, মুসলমানীও তাকে বাঁচায়নি। তাহলে সে বেঁচে আছে কী দিয়ে? বেঁচে থাকার অভ্যাসে। আর যাই ঘটুক মরব না বেঁচে থাকব– এই জিদে। এই জিদে জিদেই বার বার খেদিয়ে দিতে চাওয়া সত্ত্বেও স্বামীর ঘর করে গেছে, অনিচ্ছুক সঙ্গমে স্বামীর কামনাকে তুষ্ট করে পেটে ধরেছে তিন ছেলে দুই মেয়ে, পাখির মতো দানা খুঁটে খুঁটে এনে তুলে দিয়েছে ছেলে-মেয়ের মুখে, বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের দুর্ভিক্ষ থেকে, বন্যা থেকে বাপের অবহেলা থেকে, কু-লোকের কু-দৃষ্টি থেকে। আর একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আশায়। আলাদা আলাদা জাতের মানুষের আলাদা আলাদা আল্লা আছে কি না? উত্তরটা জানতে পারলে তার মনের সব ধোঁয়াশাই কেটে যাবে। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত যাকেই জিজ্ঞেস করো, স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যেকেই বলবে, সবাইকে বানিয়েছে একই জন। তাকে যে নামেই ডাকো। কথাটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে চায় বটে। কিন্তু সোনাভানের ধন্দ যায় না।

এখন তো তার বলা চলে জীবনের সবচেয়ে অবহেলাহীন সময়। ছেলেমেয়েরা কেউ তাকে অবহেলা করে না, গাঁয়ের মানুষ এখন তাকে অবহেলা দেখানোর সাহস পায় না, আর যৌবনের অধিপতি সোয়ামী এখন বার্ধক্যে এসে তাকে অবহেলা দেখানোর সুযোগই পায় না। ছেলেরা জোয়ান, কর্মঠ, গ্রামদৃষ্টান্তে ভালো উপার্জন করে এবং মা-ভক্ত। এমন ছেলেদের মাকে অবহেলা দেখানো যার-তার কর্ম নয়। তো এই ভরভরন্ত জীবনেও এখন কাঁদতে বসে সোনাভান। কেন কাঁদে? না, যখন মাঝে মাঝে হাজি সাহেবের খালের ধারে নিঃস্ব, সুতার বস্ত্রহীন অবস্থায়, বেঁচে আছে না মরে গেছে বোঝা যায় না এমন অবস্থায় একটা যুবতী শরীর পড়ে থাকতে দেখতে পায়। আর তখন প্রশ্নটা এসে দগদগে ঘায়ের ওপর নখের আঁচড়ানি দিতে থাকে।

গঙ্গায় গেলে গঙ্গাজল হয় গর্তে গেলে কূপজল কয় ভেদ বিচারে…

কে যেন তাদের একটানে কুয়ো থেকে তুলে এনে ছেড়ে দিয়েছে ভরা কোটালের নদীতে। কুয়োর জীবন সংক্ষিপ্ত সীমাবদ্ধ, কিন্তু তার সঙ্গে সোয়াস্তি বলে একটা জিনিস তো থাকে। মাঝে মাঝে সেই জীবনেও যে ভাসন্ত প্লাবন আসে না তা নয়। বছরবর্ষার বান তো মাঝে মাঝে কিছুদিনের জন্য মাঠ-কুয়া-পুকুর সবকিছুকেই একাকার করে দেয়। জীবনে সেরকম হঠাৎ বান যে আসেনি তা তো নয়। এসেছে। কিন্তু সবাই জানত, এই প্লাবন সাময়িক। কোনো রকমে দাঁতে দাঁত চেপে কয়েকটা অমাবশ্যা-পূর্ণিমা পার করে দিতে পারলে আবার নিজের চেনা সীমানা ফেরত পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন, যে সর্বগ্রাসী জোয়ার এসেছে, তার কোনো ভাটি নেই। নিজের চার দেয়াল বলে কোনো জিনিসই যেন নেই। প্রতিদিন, বলা ভালো, প্রতি মুহূর্তেই একটা না একটা নতুন জিনিস যোগ হচ্ছে তাদের জীবনে। বিয়োগও কিছু না কিছু হচ্ছেই। কিন্তু যোগ হওয়ার পরিমাণ এত বেশি এবং এত দ্রুত, যে তার ধাক্কা সামলে-সুমলে হারানো জিনিসের তালিকা করতে বসার ফুরসতই জোটে না। আগে তো শীতকালে এসেছে যাত্রাপালা-সার্কাস-পুতুল নাচ-পালাপাঁচালি, বর্ষাকালে বেদের বহর, কোনো কোনো দিন হঠাৎ গাঁয়ে ঢুকেছে মনিহারি পশরার ফেরিঅলা। তারা এসেছে, গাঁয়ের জীবনে দুই-একটা বুদবুদ তুলেছে, তারপর চলে গেছে। কিন্তু এখন যা কিছু আসে, তারা মৌরসীপাট্টা জমিয়ে আসে। যে আসে সে আর ফিরে যায় না। ইরিধান এল, এনজিও এল, সুদ-কিস্তি-ঋণ এল, পল্লীবিদ্যুৎ এল, টেলিভিশন এল, ডিশ চ্যানেল এল, রাস্তায় ভ্যান-রিক্সা-ভটভটি এল, নদীতে স্যালোর নৌকা এল, সেচের নামে মাটির তলা থেকে পানি ওগড়ানোর মেশিন এল, মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান এল, দোকানে দোকানে বাহারি জিনিসের জোয়ার এল, ক্রিকেট এল, হাসিনা-খালেদার চুলোচুলি রাজনীতির খবর এল, ব্যাংক এল, দফাদার-চৌকিদারের জায়গায় পুলিশ এল, ইন্দিরা গান্ধী-ফারাক্কা এল, মোবাইল ফোন এল। এত এত সব জিনিস হুড়মুড়িয়ে যখন ঢোকে, তখন সোনাভানদের সীমাবদ্ধ ভাবনার মন খেই না হারিয়ে পারে! তা তোরা আইলি আইলি, নিজের মতো থাক। না তা থাকবে না। তুমি চাও বা না চাও, তোমার ঘরের মধ্যে ঢুকবে, সংসারের মধ্যে ঢুকবে, মনের মধ্যে ঢুকবে। আর তখন এতদিনের চেনা মানুষগুলোকেও অনেক কম কম চেনা মনে হবে। এমনকি পুরোপুরি অচেনাও হয়ে যাবে কেউ কেউ। আর টেলিভিশনের কল্যাণে, ডিশ অ্যান্টেনার কল্যাণে যাদের জীবনে সামনাসামনি দেখা হবে না কোনোদিনও, সেইসব মেয়ে-মরদের চেহারা হয়ে যাবে মুখস্ত। মেনে নিতে হবে এই সত্য যে ওরা ইশ্বরের মতো দূরত্বে থেকে ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করবে সোনাভানদের। কেউ কেউ জেলায় থাকে, কেউ কেউ রাজধানীতে, আর কেউ কেউ একেবারে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে। কিন্তু তবুও তারাই সোনাভানদের জীবনের রোজকার প্রতিটি মুহূর্ত ধরে টান দেয়। সোনাভানকে তাই পলে পলে ধন্দে পড়তে হয়। আচ্ছা এই যে সে আছে, এই যে জীবন সে যাপন করছে, তা কী সত্যি সত্যিই ঘটছে! না কি সে শুধু আছে খোয়াবের মধ্যে! যেমন ভাসা ভাসা ভাবে থাকা হয়, তা তো খোয়াবের মধ্যেই দেখতে অভ্যস্ত তারা। সে কি সত্যি সত্যিই জেগে আছে নাকি বিরাট এক ঘুমের মধ্যে আর স্বপ্নের মধ্যে পার করে দিচ্ছে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। তা নাহলে নিজের পেটের ছেলেকে পর্যন্ত মাঝে মাঝে অচেনা লাগবে কেন তার! সাবদুল, জায়েদুলকে অতটা আলাদা মনে হয় না। তারা যে কয়দিন পেরেছে গাঁয়ের এবতেদায়ী মাদ্রাসায় পড়েছে। দোয়া-কালাম শিখেছে কিছু, বাংলা লিখতে-পড়তেও শিখেছে, হিসাবটা-অংকটা করতে কারো পা ধরতে হয় না। তারা বিদ্বানও নয়, নিরক্ষরও নয়। নিজেদের জমিজমা চাষবাস নিয়েই থাকে, পাশাপাশি ব্যবসা। আয়-উন্নতি ভালো। সংসারী দুজনেই। এবং পরিবারঅন্তপ্রাণ। গাঁয়ের হিসাবে এমন ছেলেদেরই বলা হয়ে থাকে সোনার ছেলে। কিন্তু ছোট রিয়াজুলকে নিয়ে সোনাভান কোনো কুল-কিনারা পায় না। মাদ্রাসায় না পড়িয়ে ছোট ছেলেকে স্কুলে পড়িয়েছে সোনাভান। বড় দুই ভাইয়ের পুরো সায় ছিল তাতে। পরে কলেজে, এমনকি ইউনিভার্সিটিতে। বড় দুই ভাই যতটা পেরেছে, করেছে। ভাই পাশ দিয়ে একটা কেষ্টুবিষ্টু হবে, এটাই ছিল তাদের মনের আশা। কেননা তারা তো এটুকু অন্তত শিখেছে, লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে। ছোটভাই যদি গাড়িঘোড়ায় চড়ে, তাদের চড়তে নিক বা না নিক, ভাই যে চড়তে পারছে তাতেই তাদের শান্তি। তারা তো অন্তত বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে কীর্তিমান ছোটভাইয়ের কথা। তো সেই রিয়াজুল পাশ দিল বটে, কিন্তু গাড়িঘোড়া তো হয় না! তার জন্য আগে নাকি দরকার চাকরি, বড় চাকরি। সেই চাকরির জন্য দিতে হয় আরো বড় পরীক্ষা। সেই পরীক্ষাতেও কয়েকবার বসল রিয়াজুল। কিন্তু সেটা আর হয় না। পাশও হয় না, রিয়াজুলের চাকরিও হয় না। না হোক। মা-ভায়েরা সান্ত্বনা দেয়। পাশের গাঁয়ে কলেজ হয়েছে। ইস্কুল তো নিজেদের গাঁয়েই আছে। তুই বরং সেই চাকরিতেই ঢুকে যা। বাড়িতে অন্তত একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ তো থাকল। কিন্তু রিয়াজুল নাক সিঁটকায়। বেসরকারি স্কুল-কলেজের চাকরি আবার চাকরি হলো নাকি! এসব চাকরিতে ঢুকলে তার মান-মর্যাদা বলতে কিছু থাকবে না। তো তাহলে ব্যবসাপাতি কর। বিয়ে-থা করে থিতু হ। জমিজমা ঘর-গেরস্থালি তো রয়েছেই। সামনাসামনিই নাক কোঁচকায় রিয়াজুল। এটা একটা জীবন হলো! কুয়ার ব্যাঙের মতো চারপাশে দেয়াল তোলা জীবন। এখানে থাকলে সে নির্ঘাৎ দম আটকে মরে যাবে। সোনাভান ফোঁস করে উঠেছিল– এত বছর ভাইদের খাটনির পয়সায় শহরে বাবুগিরি করে বাতাস লেগে গেছে। গাঁয়ের বাতাসে নাক টানলে এখন গু-গোবরের গন্ধ পাও! যা ভাগ, তোর থাকা লাগবি না এই বাড়িত। যেটি তোর ভালো লাগে সেটি যায়া থাক। তোর মুখ আর আমরা দেখতে চাই না।

শেষে অনেক সালিশ-পরামর্শের পরে ঠিক হয়, রিয়াজুল তেলের দেশে যাবে। তেলের দেশে হোটেল ম্যানেজারের কাজ। অনেক বেতন। কোন দেশ? ইরাক। বাগদাদ। বাগদাদের নাম শোনামাত্র সোনাভান রাজি হয়ে যায়। বড়পীর আবদুল কাদের জিলানীর শহর। যে শহরের মাটিতে কবর হলে তার গোর-আজাব মাফ। বড়পীর কড়ার করিয়ে নিয়েছে আল্লাকে।

রিয়াজুল যেই ঢাকায় গিয়ে বাগদাদ যাওয়ার জন্য উড়াকলে উঠে উড়াল দিল, সেদিন থেকেই সোনাভানের মাথায় ঢুকল বাগদাদ। মনে আশা, জীবনে জাহেরি-বাতেনি গুনাহ তো কম হয় নি। যদি সুযোগ পাওয়া যায়, শেষ জীবনে রিয়াজুলের কাছে চলে যাবে। মরণের পরে যদি বাগদাদের মাটি নসিবে জোটে, অন্তত গোর-আজাব থেকে মাফ পাওয়া যাবে। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই বাগদাদ-বড়পীর-গোর আজাব মাফের চিন্তার সাথে সাথে আসতে শুরু করল নতুন আরো সব জিনিস। এল সাদ্দাম হোসেন। বাপের ব্যাটা সাদ্দাম। তার সাথে সাথে এল জর্জ বুশ।

কুয়ায় বাস করেও সোনাভান এখন আর কুয়ার জল নয়। সারা দুনিয়া ঢুকে গেছে কুয়ায়। নাকি তাদের কুয়াই হাত ধরে ফেলেছে সারা দুনিয়ার! তো দুনিয়ার সাথে যখন এইভাবে সংযোগ স্থাপন হয়েই গেল, তাহলে কোনো না কোনো ভাবে কি জানা যাবে না দেড় কুড়ি আর আটটি বছর ধরে জমিয়ে রাখা প্রশ্নটির উত্তর?

কোন পুকুরে কে ফেলেছে ঢিল, ঢেউ এসেছে এই ডোবাতেও সাবদুলের ভুঁই-নিড়ানো তখনো আদ্দেক বাকি। সেই সময় আলহাজ্ব ফজলুর রহমান খন্দকারের, তাদের মুখে মুখে ফজু খোনকারের, ডাক শোনা যায়। কামলা-কিষাণ বড় বেতালা করছে কয়েক বছর ধরে। এদিকে সবচেয়ে সুপ্রসবী জমিটা ফেলে রাখতে মন চায় না। তাই সাবদুল নিজেই নেমেছে ভুঁই নিড়াতে।

এবছর এই ঋতুতে সূর্যের মেজাজ খুবই কড়া। আকাশে উঠল কী আগুন ছিটানো শুরু করল। তাই বেলা বেড়ে উঠলে মাঠে থাকা এককথায় অসম্ভব। সলোক ফোটারও আগে তাই তারা মাঠে নেমে পড়ে। তা সলোক ফোটে ফজরের আজানেরও আগে। তখন মাঠজুড়ে থাকে পিঠে হাত বোলানোর মতো ঝিরঝিরে বাতাস। মাটিকেও রুক্ষ মনে হয় না ততটা। ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে নিড়ানি ঢুকিয়ে দেওয়া যায় ঘাস-আগাছার তলার মাটিতে। তো সলোকের সঙ্গে জমিতে এসেছে সাবদুল। কাজ করতে করতেই শুনেছে ভোরের আজান। আবছা আলোয় দুই-চারজন মুসল্লিকে যেতেও দেখেছে মসজিদের দিকে। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তারপরেই ভুঁই, আগাছা এবং নিড়ানির সাথে পুরোপুরি একাত্ম হয়ে পড়েছিল সে। আর কোনো দিকে মন দেবার অবসর ছিল না। তাই ভোরটা যে সকাল হয়ে ফুটে বেড়িয়েছে, লোক চলাচল শুরু হয়েছে মাঠপারের রাস্তায়, কচর কচর করে গরু-মোষের গাড়ি চলতে শুরু করেছে, বাইসাইকেলের টিং টিং বাজিয়ে দূরের চাকুরেরা চলতে শুরু করেছে নিজ নিজ অফিসের দিকে, নতুন গজিয়ে ওঠা অভ্যাসে বুড়োরা চা খাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছে রফিক-নবাবা-নিমাইয়ের চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে– এইসব কোনো কিছুই খেয়াল করা হয়ে ওঠে নি তার।

ফজু খোনকারের ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে সে কিছুক্ষণের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু তার পেছনটা পূর্বদিক, আর সূর্যটা বয়সে কিশোর হলেও ইতোমধ্যেই রোদের তীর ছুঁড়ে মারতে যথেষ্টই পারঙ্গম হয়ে উঠেছে, ফলে তার চোখদুটো ঝলসে যায় কিছু বুঝতে পারার আগেই। সে ঘাড়ের গামছা দিয়ে চোখ রগড়াতে শুরু করে এবং চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ঈষৎ অসহিষ্ণু কণ্ঠটা ফের শুনতে পায়– সাবদুলরে, এই দিক আয়!

সে চোখের ওপর থেকে গামছাসমেত হাত সরিয়ে কিছুটা বামদিকে হেলে সূর্যকে এড়িয়ে খোনকারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে– কী কন?

তোরা কী মানুষ! ইরাকে বোগদাদে বুশ শালা মুসলমানের পোন্দের মধ্যে বাঁশ ঢুকাচ্ছে, আর তুই পড়ে আছু ভুঁই নিয়া!

সাবদুল একটু হতভম্বই হয়ে পড়ে। ইরাকে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে আমেরিকার সৈন্যরা, একথা তারা সবাই এখন জানে, কিন্তু তার ভুঁই নিড়ানোর সঙ্গে এই বিষয়ের সম্বন্ধ বা বিরোধ কোনোটাই সে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সে তাই দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থাতে ফের প্রশ্ন করে বসে– কী কন?

ফজু খোনকারের গলা এবার আকাশ চিরে ফেলার উপক্রম করে– হারামজাদারা কানে শুনতে পাস না? আমেরিকা যে মুসলমান জাতিক শেষ কর‌্যা ফেলতিছে!

হতবুদ্ধি দশা কাটে না সাবদুলের। মাথা চুলকে বলে– তা আমি কী করব?

এই দিক আয়!

ফজু খোনকার এমনভাবে আহ্বান করে যেন সাবদুল তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই ইরাকে আমেরিকার মুসলিম-নিধন বন্ধ হয়ে যাবে।

সে কাছে গিয়ে দাঁড়ায়– কন কী করা লাগবি।

জেহাদ! জেহাদ করা লাগবি!

ধুশ! আমি ঐসব মারামারি-কাটাকাটির মধ্যে নাই।

ফজু খোনকার অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সাবদুলের দিকে তাকায়– মুসলমান হয়া এমন কথা বরতে পারিস!

সাবদুল তাকে বোঝানোর প্রয়াস পায়– আরে যুদ্ধ হচ্ছে হাজার হাজার মাইল দূরে ইরাকে। এই জাগাত বসে আমি-আপনে কী করতে পারে?

আমরা মিছিল করব।

খালি দুইজনে কি মিছিল হয়? একটু কৌতুকের সঙ্গেই বলে সাবদুল।

খালি দুইজন মানে? তুই কি চোখের মাথা খায়া রাখিছু? ওই দ্যাখ! উত্তর সিথানে তাকায় দ্যাখ! বুড়ির মাঠের দিক তাকায় দ্যাখ!

কথামতো সেদিকে তাকায় সাবদুল। বুড়ির মাঠের আলপথ দিয়ে কিছু লোক এগিয়ে আসছে। আলপথে যেহেতু পাশাপাশি একাধিক মানুষের পক্ষে হাঁটা সম্ভব নয়, তাই একের পেছনে আরেকজনের সারি এমনিতেই দাঁড়িয়ে যায়। তাই গোনা-গুনতিতে দক্ষ হলে দূর থেকেই মাথা গুনে ফেলা যায়। সাবদুলের এখন গোনা-গুনতির ইচ্ছা নেই। সে লাইনবন্দি লোকগুলিকে আসতে দেখে। তবে তার কাছে সংখ্যাটিকে খুব একটা বড় মনে হয় না। ফজু খোনকারের কথার ভঙ্গিতে মনে হয়েছিল হাজার হাজার, নিদেন পক্ষে শ’য়ে শ’য়ে লোক পিলপিল করে আসছে মিছিলে যোগ দিতে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মাত্র কয়েকজনকে। সে হতাশা চাপতে না পেরে বলেই ফেলে– খালি ওই কয়জন!

ফজু খোনকারের পিত্তি জ্বলে যায় যেন– খালি ওই কয়জন মানে? জানিস না খাঁটি মুসলমান একজনাই এক শ’ জন কাফেরের সমান। আল্লা-খোদার উপর এক চিমটি ঈমান থাকলে তোর মুখে এই রকম কথা আসতে পারে?

পর্যাপ্ত পরিমাণে ঈমান তার নেই, এই তথ্য জেনেও সাবদুলকে তেমন মুষড়ে পড়তে দেখা যায় না। সে একবার শুধু করুণ চোখে আধা-নিড়ানো জমিটার দিকে তাকিয়ে জোরে নিশ্বাস ফেলে– শালার একবেলার কাম পানিত গেল! কোথায় ইরাকে সাদ্দাম-বুশের লড়াই, তাতে তার কী আসে যায়? খালি ভাইটা অক্ষত থেকে মাসে মাসে টাকাটা পাঠাতে পারলেই হলো।

কিন্তু সোনাভান অত সহজভাবে নিতে পারে না। তার কাছে যুদ্ধ মানেই সেই রকম বিবস্ত্রা নারীদেহের ছবি ঘন ঘন দেখা। আর সেই প্রশ্নটা বারবার মনের মধ্যে উঁকি-ঝুকি মারা। আর কত মানুষের কত রকমের যে দুর্ভোগ তার কোনো লেখাজোকা নেই। মানুষ মরার কথা তো বলারই দরকার নাই। কারণ যুদ্ধ মানেই মানুষকে মানুষের মারতে আসা। সোনাভান তাই রোজ হাটের মোবাইলঅলা মোবারকের সাথে বন্দোবস্ত করে নেয়। রাতে দোকান বন্ধ করে ফেরার পথে যত রাতই হোক, সে সোনাভানের কাছ দিয়ে ঘুরে যাবে। সোনাভান এক মিনিট হোক আর পাঁচ মিনিট হোক, কথা বলবেই রিয়াজুলের সাথে। কথা ঘুরে-ফিরে সেই একই। বাবা যুদ্ধর কাছে য্যান যাস না! যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। অবস্থা তেমন বুঝলে সাথে সাথে টিকিট কিন্যা উড়াকলে উঠে বসিস। চাকরির চায়ে জীবন বড়রে বাপ!

একই কথা রোজ রোজ শুনতে যে রিয়াজুলের ভালো লাগবে না, এটা সোনাভানও বোঝে। কিন্তু সে আসলে কথাগুলো রিয়াজুলের মগজে গেঁথে দিতে চায়-ই, সেইসঙ্গে এটাও চায় যে তার সাবধানবাণী সবসময় টাটকা থাকুক রিয়াজুলের মনে।

আর একটা পরিবর্তন এসেছে সোনাভানের দৈনন্দিন জীবনে। টেলিভিশন এসেছে বাড়িতে কয়েক বছর হলো। ছেলের বউদের মন রাখতে সেই প্রথম একটা দিনই টেলিভিশনের সামনে বসেছিল সে। তারপরে আর সেদিকে ঘুরেও তাকায় নি। কারণ টেলিভিশন মানেই নতুন নতুন জিনিস দেখা, আর সেগুলি ঢুকে পড়া নিজের মনের মধ্যে, নিজের জীবনের মধ্যে। একজীবনে এত নতুন জিনিস তার মধ্যে হামলে ঢুকে পড়েছে যে, সে আর নতুন কোনো কিছুরই প্রবেশ বরদাস্ত করতে চায় না। তার মনের মধ্যে নতুন কোনো কিছু আর আঁটার জায়গা নাই। কিন্তু ইরাকে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সে দিনে অন্তত তিন বার খবরের সময় টেলিভিশনের সামনে বসবেই। সে ইরাকের যুদ্ধ দেখে না কি তার নিজের মনের মধ্যকার ছবিটাই বারবার দেখে কে জানে! কিন্তু যুদ্ধের খবর দেখার সময় সে এমন ভাবে শক্ত এবং লোহিতচক্ষু হয়ে যায় যে ছেলে বা ছেলের বউরা তার সামনে কোনো কথা উচ্চারণ পর্যন্ত করতে ভয় পায়। সে গোলাগুলি ছুটে চলার আগুনমুখো বোবারেখা দেখে, রাস্তায়-মাঠে-বাড়ির বারান্দায় মানুষের ছড়ানো-ছিটানো লাশ পড়ে থাকার ছবি দেখে, সেনাদলের দিগ্-বিদিক ছুটে চলা দেখে আর বিড় বিড় করে মন্ত্রের মতো কিছু একটা উচ্চারণ করে চলে। তার মুখের খুব কাছে কান নিয়ে গেলে শোনা যায় সোনাভান বলে চলেছে- হায় রে একই আল্লার ছিষ্টি করা জীব! হায় রে একই আল্লার তৈরি করা মানুষ! তারপর খবর শেষে উঠে যাওয়ার সময় দুই ছেলেকে রুটিনমাফিক মনে করিয়ে দেয়- রিয়াজুলেক ফোনে কোস্ সে য্যান যুদ্ধর কাছে না যায়!

শুধু টেলিভিশনে তো না, ইরাকের যুদ্ধের খবর এখন সবার মুখে মুখে। আমেরিকার সৈন্যরা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে বাগদাদের দিকে। এটাও নাকি সাদ্দামের ট্যাকটিস। সবগুলো ইহুদি-নাছাড়া সৈন্য যখন ঢুকে পড়বে ঠিক ইরাকের পেটের মধ্যে, ঠিক তখনই বেরিয়ে আসবে ইরাকের দুর্ধর্ষ ইসলামি রিপাবলিকান গার্ডবাহিনী। কচুচাটা করবে শত্রুদের। সেই বাগদাদও যখন বেদখল হয় হয় কিন্তু রিপাবলিকান গার্ড বাহিনীকে যুদ্ধে নামতে দেখা যায় না। উল্টো জানা যায়, আমেরিকার সোলজাররা এখন সাদ্দামকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে, তখন এই গাঁয়ের লোকে জেনে ফেলে যে সাদ্দামকে ধরা এত সোজা না। সে না কি ঠিক নিজের হুবহু চেহারার দশ-দশজনকে ডামি বানিয়ে রেখেছে। আমেরিকানরা বাপের জন্মেও টের পাবে না, যাকে তারা ধরবে, সে আদৌ সত্যিকারের সাদ্দাম নয়।

তারপর সেই দিনটি আসে।

সেদিন খুব ভোরে এক পশলা মিছিল হয়ে গেছে গাঁয়ের প্রধান রাস্তায়। ফজু খোনকার খুবই উত্তেজিত ছিল। টেলিভিশনে নাকি অনেক রাতে দেখিয়েছে যে আমেরিকার ইহুদি-নাছাড়া সৈন্যরা মাটিতে ফেলে কোরান শরীফে লাথি মারছে, কেউ কেউ নাকি পেশাবও করেছে ধর্মগ্রন্থের গায়ে।

মিছিলের কথা শুনে, আর ঘটনার কথা শুনে সেই যে সোনাভান টেলিভিশনের সামনে বসেছে, আর ওঠার নাম নেই। সাবদুলের ছেলেটা, তার বড় নাতি, কাল বায়না ধরেছিল তিলের নাড়ু খাবে। আজ তাকে তিলের নাড়ু বানিয়ে দেবার কথা সোনাভানের। কিন্তু এই প্রথম তার সন্তানরা দেখল, তাদের মা, তাদের দাদি, তাদের শাশুড়ি, পরিবারের কাউকে দেওয়া কোনো কথার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর পার হয় হয়! কিন্তু ফজু খোনকারের মিছিলে বলা সেইসব অপকার্মের চিত্ররূপ দেখা যায় না টেলিভিশনের পর্দায়। তখন মেজো ছেলে খবর আনে যে বাংলাদেশের সরকার টেলিভিশনে ঐসব ছবি দেখানো নিষেধ করে দিয়েছে। ঐসব দেখে বাংলাদেশেও ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠুক তা চায় না সরকার। তাহলে দেখার উপায়? উপায় আছে। যাদের ডিশের লাইন আছে, তারা অন্য চ্যানেলে দেখতে পাচ্ছে ঐ খবরের ছবি। সোনাভান সঙ্গে সঙ্গে হুকুম করে– সেই লাইন লাগা। এক্ষুণি!

এতদিন অনুরোধ করে করে সোনাভানের অনুমতি না পাওয়ায় বাড়িতে ডিশের সংযোগ নিতে পারেনি ছেলে-বউরা। আজ এই মওকা কে ছাড়ে!

মাগরিবের নামাজের পরে তসবিহ-ওজিফা বাদ দিয়ে টেলিভিশনের সামনে বসে সেই দৃশ্য দেখল সোনাভান। আরো দেখল– আমেরিকার সৈন্যরা মাটিতে ফেলে ইরাকি মানুষকে বুটে পিষছে আর চিৎকার করে কী যেন বলছে। কী কয় অরা?

ইংরেজি থেকে তাকে অনুবাদ করে শোনানো হয়। আমেরিকানরা চিৎকার করে বলছে– দেখতে পাচ্ছো তোমরা! তোমাদের আল্লার চাইতে আমাদের গডের শক্তি কত বেশি। আমাদের গড আমাদেরকে সবসময় বিজয়ী করছে। তোমাদের আল্লা তোমাদের বাঁচাতে পারছে না। রক্ষা করতে পারছে না তোমাদের।

অবশেষে দেড় কুড়ি ছয় বছর পরে সোনাভান তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায়। দেড় কুড়ি ছয় বছর ধরে যে ছেঁড়াখোঁড়া আপ্তবাণীটিকে বিশ্বাসের সুতো দিয়ে সেলাই করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল, তা এখন ফড়াৎ শব্দে ফেঁড়ে দুই টুকরা হয়ে যায়। টুকরাগুলোও আরো টুকরা টুকরা হতে থাকে। আর তখন তার সবকিছু এতই ফাঁকা, অর্থহীন আর শূন্য মনে হতে থাকে যে আজ রাতে মোবাইল ফোনে রিয়াজুলের কাছে সতর্কবাণী পৌঁছে দেবার কথাটাও তার আজ মনে থাকে না।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

লাল শাড়ি

অপরাহ্ণ থেকেই আদনানের মেজাজ যেন তাড়া খাওয়া শজারুর পুচ্ছ। দুপুরে কামরান সাহেবের সঙ্গে আদনানের মায়ের কথা কাটাকাটি হয়েছিল, কথা কাটাকাটির

হাসির গল্প

অনুস্বার বিসর্গ

দুই জামাই। বড় জামাই সংস্কৃত পড়ে মস্তবড় পণ্ডিত! ছোট জামাই মোটেই লেখাপড়া জানে না। তাই বড় জামাই যখন শ্বশুর বাড়ি

কবিতা

যুবা অশ্বারোহী

যুবা অশ্বারোহী, রাঙা কঙ্করের পথে কোন ব্যথা বহি ফিরিতেছ একা একা নদীতীরে–সাঁঝে। তোমারে চিনি না মোরা, আমাদের মাঝে তোমারে পাই

গাধা ও গরুর গল্প

এক ছিল ছিল কৃষক। তার ছিল একটি গাধা আর একটি গরু। কৃষক বোঝা আনা-নেওয়া ও চলাচলের বাহন হিসেবে গাধাকে ব্যবহার