উপন্যাস পাঠ: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’


উপন্যাস পাঠ: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’

ওয়াহিদুর রহমান শিপু


বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ একটি অসাধারণ উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় উপন্যাস।

‘আরণ্যক’ কোনো ধারাবিশিষ্ট স্বতন্ত্র কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত হয়নি। আবার বঙ্কিম সাহিত্যের মতো বিভূতি সাহিত্যে নারীচরিত্র উজ্জ্বলতা পায়নি। আরণ্যকে একজন নারী চরিত্রের দেখা মেলে, ‘কুন্তা’ এই কুন্তা হচ্ছে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী দেবী সিংহের বিধবা পত্নী। এটি তার একমাত্র পরিচয় নয়, সে কাশির খ্যাতনাম্নি এক বাঈজির কন্যা। দেবী সিংহ কুন্তার রুপের মোহে আছন্ন হয়ে তাকে পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করেছিলো। আরণ্যকের আরেক খল চরিত্র রাসবিহারীর সঙ্গে দেবী সিংহ মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলো। অতপর দু’ তিনটি সন্তান রেখে সে অকালেই মরে যায়। বাঈজির কন্যাকে বিয়ে করার কারণে দেবী সিংহের আত্মীয়দের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি হয়।

এক কথায় বলতে গেলে ‘আরণ্যক’ উপন্যাস বিভূতিভূষণের এক অনবদ্য সৃষ্টি। এই উপন্যাস সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল রাজশেখর বসু মন্তব্য করেছিলেন, বইটি পড়লে ঘরে বসেই হাওয়া বদলের কাজ হয়। এটা রাজশেখর বসুর রসিকতা নয়। তিনি বইটি পড়ে যে মোহাচ্ছন্ন হয়েছেন তাই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলেন। বিভূতিভূষণের প্রত্যেক উপন্যাসের একটা বিরাট অংশ জুড়ে থাকে প্রকৃতি। আরণ্যক রচনায় লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা পরিলক্ষিত হয়েছে দারুণভাবে। এই বিখ্যাত উপন্যাসটি তিনি ১৯২৪ সালে লিখেন। তখন তিনি পাথারিয়া ঘাটা এস্টেটের এসিস্টেন্ট ম্যানেজার ছিলেন। ঐ সময়ে ঘোড়ায় চড়ে তিনি ভাগলপুর পুর্নিয়ার গহীন বনাঞ্চলে দিনের পর দিন পরিভ্রমণ করেন। কখনো কখনো পরিভ্রমণকালে গহীন অরণ্যে পথ হারিয়েছেন। এই পরিভ্রমণ আর পথহারানো তাঁকে যেনো নেশায় পেয়ে বসিয়েছিলো। তখনই তিনি অরণ্যভূমি আর বিচিত্র পরিবেশ নিয়ে লেখার কথা ভাবলেন। শুধু কি ভাবলেন, যেই ভাবা সেই কাজ! স্মৃতির রেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে তিনি বলেছেন, মাথার ওপরে তারা এখানে-ওখানে-এখানে উঁচু নিচু ঢিবি। বালিয়াড়ি অন্ধকার। বিশাল নির্জনতা যেন চারপাশের জঙ্গলে আকাশের নক্ষত্র জগৎ তার রাজত্ব বিস্তার করছে যেটাকে বলে, Vast winderness. .. এই জঙ্গলের জীবন নিয়ে লিখবো–একটা কঠিন শৌর্যপূর্ণ, ব্রাত্য জীবনের ছবি।

অন্যত্র তিনি আবার আরণ্যক সম্পর্কে লিখেছেন–

— কিন্তু যখন জঙ্গল ছেড়ে বাড়ি ফিরলাম তখন জঙ্গলের স্মৃতি আমার নিকট মধুর হয়ে গেলো।  পাথর থেকে যেন সংগীত নিষ্যন্দিত হলো; এবং আদিবাসীদের ভাষা যেন বাংলাভাষার চেয়েও মিষ্টি হতে লাগলো। নিষ্ফল কামনা-ভাবনা রাশিকে উদ্দীপ্ত করতে থাকলো এবং তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকায় তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ায় জন্যই আমাকে অরণ্যক লিখতে হলো। আরণ্যক উপন্যাস কী না তাতে সাহিত্য বোদ্ধাগণ তর্কের অবতারণা করেছেন। এই জন্য বিভূতি বাবু উপন্যাসের শুরুতে বলছেন, “ইহা ভ্রমন বৃত্তান্ত বা ডায়েরি নহে– উপন্যাস”। লক্ষ করি এই বইয়ে বহু মানব চরিত্র সৃজিত হলেও অখণ্ড কোনো কাহিনি তৈরি হয়নি। কিন্তু নিসর্গপ্রেমী ঔপন্যাসিকের নিসর্গ-সন্দর্শনের কারণে কিরুপে অরণ্য শুধু প্রকৃতির লীলাভূমি হয়ে থাকেনি বরঞ্চ একটি বন সত্তার সফল উণ্মেষ ঘটেছে। এই বন–সত্তার প্রাণচাঞ্চল্য–প্রাণোচ্ছল শরীর বেয়ে যে এক মোহনীয় কাব্যরস নিয়ত নিঃসৃত হয়েছে যা এতকাল ছিলো অশ্রুত, অনাবিষ্কৃত তো বটেই। সেই বনভূমি, বনফুল, বৃক্ষ, তরু, গুল্মের সাংগীতিক বহিস্বর ও সুরের মূর্ছনা পাঠকের অন্তরাত্মার ভেতরে পৌঁছে দিয়েছেন দক্ষহাতে।আরণ্যক উপন্যাস কী না তাতে সাহিত্য বোদ্ধাগণ তর্কের অবতারণা করেছেন। এই জন্য বিভূতি বাবু উপন্যাসের শুরুতে বলছেন, “ইহা ভ্রমণ বৃত্তান্ত বা ডায়েরি নহে– উপন্যাস”।  যেহেতু গতানুগতিক কোন কাহিনী অবলম্বনে উপন্যাসটি বিরচিত হয়নি উপরন্তু এখানে রয়েছে বিচিত্র মানব চরিত্রের সমাহার। লক্ষ্য করি এই বইয়ে বহু মানব চরিত্র সৃজিত হলেও অখণ্ড কোনো কাহিনি তৈরি হয়নি। কিন্তু নিসর্গপ্রেমী ঔপন্যাসিকের নিসর্গ– সন্দর্শনের কারণে কিরূপে অরণ্য শুধু প্রকৃতির লীলাভূমি হয়ে থাকেনি বরঞ্চ একটি বন সত্তার সফল উন্মেষ ঘটেছে। এই বনসত্তার প্রাণচাঞ্চল্য-প্রাণোচ্ছল শরীর বেয়ে যে এক মোহনীয় কাব্যরস নিয়ত নিঃসৃত হয়েছে যা এতকাল ছিলো অশ্রুত, অনাবিষ্কৃত তো বটেই। সেই বনভূমি, বনফুল, বৃক্ষ, তরু, গুল্মের সাংগীতিক বহিস্বর ও সুরের মূর্ছনা পাঠকের অন্তরাত্মার ভেতরে পৌঁছে দিয়েছেন দক্ষহাতে।

আরণ্যক পাঠ করতে গিয়ে আমি হারিয়ে গেছি এক গহীন গহীন বোধের জঙ্গলে, যেখান থেকে বের হবার প্রচেষ্টা আমি এখনো করে যাচ্ছি।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

লোকজ ঠাকুর

এই ঝুলন্ত আসমান লাল হয়ে গেলে একজন লোক পথ চলে; গাছ-পালা, লতা-পাতা ও বন-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে, লাল মাটিকে পেছনে ফেলে,

গল্প

অসম

আমার ভবিষ্যতের ভাবনায় গ্রামের মানুষের কৌতুহলের সীমানা অনেক বড় ছিল। তারা প্রায়ই আমাকে নিয়ে অতিবাস্তবপ্রসূত বাণী নিসৃত করত। বড় হয়ে

পটভূমির

পটভূমির ভিতরে গিয়ে কবে তোমার দেখেছিলাম আমি দশ-পনেরো বছর আগে;—সময় তখন তোমার চুলে কালো মেঘের ভিতর লুকিয়ে থেকে বিদ্যুৎ জ্বালালো