গল্প পাঠপ্রতিক্রিয়া: কাজী মহম্মদ আশরাফের ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’


গল্প আলোচনা: কাজী মহম্মদ আশরাফেরতৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’

আদনান সহিদ


দর্পণ ‘ঈদ সংখ্যায়’ গল্প আলোচনা করার ইচ্ছায় কয়েকটা গল্প পড়তে পড়তে চোখ আটকে গেল কাজী মহম্মদ আশরাফ এর ছোটগল্প, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’-তে। খেয়াল করলাম গল্পটি দর্পণ-এ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু গল্পটি পড়ার পর মনে হলো অতি সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতি, যুদ্ধাবস্থা,আগ্রাসন কিংবা যুদ্ধকালীন চরম সংকট ও দুর্দশার এক খন্ডচিত্র ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ গল্পে ঠিকঠাক উপস্থাপিত হয়েছে যেন।

‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ মূলত কোনও এক যুদ্ধাবস্থায় বোমারু বিমানের আঘাতে নিহত বাবার রেখে যাওয়া তিন মেয়ে ও তাদের মায়ের গল্প,তাদের ভয় ও আতঙ্কের গল্প, অনেক হারানোর গল্প এবং সেই হারানো থেকে আবার নতুন করে কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যয় সৃষ্টির গল্প। যুদ্ধের ঠিক পরপরই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম, বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে আসা তিন মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ের নিয়মিত লেখা ডায়রি থেকে পাওয়া যুদ্ধকালীন অবস্থার নানা দিক নিয়ে গল্পটির বর্ণনাকৌশল এগিয়েছে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে স্বামীহারা স্ত্রী ও পিতৃহীন তিন মেয়ের জীবন যুদ্ধকে লেখক আরেক ‘নতুন যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

গল্প শুরুতেই দেখতে পাই যুদ্ধ মানে আশা ভঙ্গের গল্প। বড় মেয়েটির স্কুল পাস করে বিদেশে চলে যাওয়ার, বিজ্ঞানী হবার কিংবা এমন এক যন্ত্র আবিষ্কারের স্বপ্ন যাতে কোনও মানুষ আর মারা যাবে না ইত্যাদি স্বপ্নে পানি ঢেলে দিয়ে মা তাকে জানান পৃথিবীর সমস্ত মানুষ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের সারানোর ওষুধ পৃথিবীর কোনো গোডাউনেই নেই কিন্তু ‘একদিনে না, এক ঘন্টাতেও (সব মানুষকে) মেরে ফেলার মত অস্ত্র মানুষ আবিষ্কার করে রেখেছে!’

মা’র এই কথায় মেজো মেয়েকে আমরা দমতে দেখি না। প্রাইভেট কার বাস-ট্রেনে মানুষ মারা গেলে অস্ত্রে এত কিসের ভয় মা’র? আছে! মা’র অজানা নানা শঙ্কা, আহাজারি আছে মনের ভেতর।

তিনি মেয়েদের কিভাবে বুঝাবেন যে:

যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা
যুদ্ধ মানে আমার প্রতি তোমার অবহেলা।‘’ (নির্মলেন্দু গুণ)

এই ‘শত্রু শত্রু খেলার ফাঁদে’ পড়েই তাদের বাবা যে এক প্রকার অনিচ্ছাকৃত অবহেলা করে তাদের ছেড়ে চলে গেছেন যোজন যোজন দূরে! বাবা হয়তো চলে গিয়ে বেঁচে গেছেন। কিন্তু মা’র কাছে ফেলে যাওয়া মেয়েগুলোকে যদি কেউ খাবারের লোভ দেখিয়ে ধরে নিয়ে যায়, পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়, দালালের হাতে তুলে দেয়? তাঁর সর্বক্ষণ দুশ্চিন্তা তিনি যদি মারা যান মেয়েদেরকে কে আশ্রয় দেবে?খাবার দেবে? স্কুলে পড়ার খরচ দেবে? মূলত, যুদ্ধাবস্থায় মানুষের কোনো চিন্তা হয় না, যা হয় সবই দুশ্চিন্তা!

শুধু কি তাই? যুদ্ধ নষ্ট করে দেয় শৈশব, স্কুল, খেলাধুলা নির্মল আনন্দ। গল্পে আমরা দেখতে পাই, মেজ ও ছোটমেয়ে গুলির খোসা এবং যুদ্ধাস্ত্রের ভাঙ্গা টুকরা সংগ্রহ করে। পরে তার বিনিময়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে জুস, চিপস কিনে খায়। মেজ মেয়ের খেলনা হয় রক্তমাখা বোমারু বিমানের ভাঙ্গা অ্যালুমিনিয়াম শিট দিয়ে বানানো চাকার গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স। সেই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সে আবার ডাক্তার সেজে মানুষকে আশার বাণী শোনায়,

 আমি ডাক্তার। তোমাদের কোন ভয় নাই। আমি এসে গেছি ওষুধ নিয়ে।’

যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজের মত বাঁচা যায় না, শিখতে হয় বাঁচার বিশেষ উপায়– এই নির্মম সত্যটিও উঠে এসেছে ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ গল্পে। বোমারু বিমানের লেজ কোন দিকে থাকলে বোমা কোন দিকে পড়তে পারে, কোন দিক দিয়ে বিমানটি ফিরে যেতে পারে ইত্যাদি রেডক্রসের রেস্কিউ টিম ওয়ার্কসপ করে রীতিমতো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাসিন্দাদের শিখিয়েছে। তাই তো বিমান হামলা থেকে বাঁচতে মেজ মেয়েকে দেখা যায় অনুমান করে ম্যানহোলের ভিতর লুকিয়ে পড়তে।

পাঠক, ঘেন্না হচ্ছে?

মজার ব্যাপার, এই ম্যানহোলে কিন্তু কোনও ময়লা নেই । কারণ, যুদ্ধাতঙ্কে জনশূন্য মহল্লায় ‘মানুষ না থাকলে ময়লা আসবে কোথা থেকে!’ এইতো জীবন এখানে। জীবনের জন্য এখানে জীবন থেকেই পালাতে হয়!

তবুও আমরা বাচঁতে চাই। যেকোনও পরিস্থিতিতে বাঁচতে চাই। মরার মত বাঁচতে চাই না। বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। তাই তো বড়মেয়ের ডায়েরির শেষের দিকের পৃষ্ঠায় বাঁচার মতো বাঁচার একটু আকুতি ফুটে ওঠে:

 ‘এর চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো। মা আমাদের নিয়ে হতাশ কিন্তু আমরা নিজেদের নিয়ে হতাশ নই। পৃথিবীতে মানুষের উপায়ের অভাব নেই। কোনোভাবে একটু পড়ালেখা করতে পারলে কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকতে পারবোই।’

আচ্ছা, ভাবুন! প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ আমাদের সেই সুযোগ দেয় কিনা? আজ যদি রাশিয়া-ইউক্রেন, আফগানিস্থান-আমেরিকা, ফিলিস্তিন- ইজরাইলসহ পৃথিবীর নানা দেশে বিদ্যমান আগ্রাসন, সংঘর্ষ, মৃত্যু উপত্যকার দিকে তাকাই তাহলে কি দেখি? আমরা কি খুব আশাবাদী হতে পারি? যুদ্ধ কি কখনো ইতিবাচক কিছু বয়ে নিয়ে আসে? ধ্বংস, মৃত্যু ,বিরহ, রক্ত, চিৎকার আর্তনাদ ছাড়া?

সেজন্যই হয়ত গল্পের শেষাংশে বড় মেয়ের ডায়েরিতে অতি সাবধানী মায়ের ভবিষ্যৎ পরিণতির শিহরিত বিবরণ দেখতে পাই দ্বিধান্বিত কলমের আঁচড়ে:

গতকাল দেখলাম অনেকগুলো ইঁদুর মারার ট্যাবলেট কিনে এনেছেন মা।…সবার বাসাতেই ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে গেছে। কিন্তু এতগুলো ট্যাবলেট কেনার কি প্রয়োজন মা জানে শুধু। কোথাও ওষুধ পাততেও দেখলাম না।”

‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ বস্তুত যুদ্ধ নামের ভয়াবহ এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের বাস্তবচিত্র। দেশ, কাল, সীমানার উর্ধ্বে গিয়ে যুদ্ধ যে সবসময়ই ধ্বংস ও মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে আসে তা-ই মা ও মেয়েদের মর্মস্পর্শী কথামালায় বর্ণিত হয়েছে ছোট্ট এই গল্পে। যুদ্ধকে ‘শত্রু মুক্তি’ কিংবা ‘স্বাধীন হবার উপায়’ যে নামেই ডাকা হোক না কেন– যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি সকল যুগের সকল কালে একই ছিল, একই থাকবে। বৃটিশ যুদ্ধকবি এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধা উইলফ্রেড ওয়েনের যুদ্ধবিরোধী কবিতায়ও আমরা এই প্রতিফলন দেখতে পাই,

এতোসব যদি (যুদ্ধের ভয়াবহতা) জ্ঞাতই হতে

প্রিয় বন্ধু আমার,

অতোটা উজ্জীবিত হয়ে

সন্তানদের নিকট সোল্লাসে উল্লেখ করতে না যুদ্ধের গরিমা–

দেশের জন্য আত্মত্যাগ কতোই না মধুর মানানসই!’

[কবিতা: ডুলসে এট ডেকোরাম এস্ট’ (দেশের জন্য আত্মত্যাগ), অনুবাদ- আদনান সহিদ]

‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ গল্পটি পড়ে দেখুন তো এই কবিতাংশের একটি গদ্যরূপ দেখতে পান কি না?

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
কবিতা

দুঃখনদী

মাহমুদ হায়াত এর দুটি কবিতা দুঃখনদী দুঃখনদী বারোমাস আমি না হয় ভেসেই গেলাম জলে তুমি শুধু ভালো থেকো সুখগুলো সব

বিবেকানন্দ

জয়, তরুণের জয়! জয় পুরোহিত আহিতাগ্নিক, জয় জয় চিন্ময়! স্পর্শে তোমার নিশা টুটেছিল, উষা উঠেছিল জেগে পূর্ব তোরণে, বাংলা আকাশে

গল্প

লাশ

আশরাফ পিন্টুর দুটি অণুগল্প: “লাশ”, “বিধির লিখন” লাশ লাশ নিয়েই সে ব্যস্ত থাকে সব সময়। প্রতিদিন লাশ আসে পাঁচ-সাতটা করে।