চাঁদের আলোয় কচুরি ফুলের ভেসে যাওয়া

দিনের বেলায় বেশি ঘুমাই। দিনে ঘুমানোর প্রধান কারণ আমরা রাতকে বেশি ভালোবাসি। নিষিদ্ধ কালো রাতই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। প্রতিবছর আশ্বিন মাস এলেই আমাদের মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তা বাসা বাঁধতে শুরু করে।

অবশ্য মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তা বাসা বাঁধতে শুরু করে না বলে আমাদের বলা উচিত এই আশ্বিন মাস আমাদের সারা বছরের মাথাব্যথার মাস। অন্য কিছু কিছু সময়ও যে আমাদের মাথাব্যথা থাকে না, এ কথা বলা ঠিক হবে না। থাকে, বছরের অন্য কোনো কোনো সময়েও আমাদের যথেষ্ট মাথাব্যথা থাকে।

সাধারণত এ সময় রাষ্ট্র আমাদের ওপরে হুলিয়া জারি করে। আমরা সেই হুলিয়া মানতে চাই না। যদিও রাষ্ট্রের এই হুলিয়া জারি পরোক্ষভাবে আমাদের যাপিত জীবনের উন্নয়নেরই অংশ বলে দাবি করা হলেও এতে আমাদের জীবনের টিকে থাকার সংগ্রামের নাভিশ্বাস আরো বেড়ে যায়।

এখন যদিও বছরে একবার এই হুলিয়া জারি করা হয়, ভবিষ্যতে বছরে আরও বেশ কয়েকবার যে হবে না, আমরা জোর দিয়ে কেউ বলতে পারি না। শুনেছি, এই হুলিয়া আরও দীর্ঘ হবে। শুধু কি দীর্ঘ হবে? বছরের যে কোনো সময়, যে কোনো মাসেই হুলিয়া জারি হতে পারে।

আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে গভীর রাতে আমাদের ওপরে চাপানো রাষ্ট্রের হুলিয়া জারি ভাঙতে থাকি। মানি না। অবশ্য এসব কাজ আমরা আমাদের নিজেদের স্বার্থেই করি। রাষ্ট্রের চাপানো নিয়ম আমাদের অনেক বেশি নিরুপায় করে তোলে। নিয়ম ভাঙা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখি না অথবা খুঁজে পাই না।

অবশ্য রাষ্ট্রের হুলিয়া মানতে শীর্ষ মহল থেকে আমাদের জন্য বিকল্প উপায় বের করার চেষ্টা করে, কিন্তু চেষ্টা করলে কী হবে রাষ্ট্রের নিচের সারিতে যারা থাকেন তারা আমাদের নিয়ে ভাবেন না, অথবা আমাদের নিয়ে অত বেশি ভাবতে চান না।

রাষ্ট্রের মধ্যম সারির মানুষগুলো হয়তো আমাদের নিয়ে এই চিন্তা করতে পারে যে, রাষ্ট্র ও সমাজের তলানি স্তরের এসব মানুষদের ভেবে কী লাভ? আরে বাবা! আমরা তো কখনো আপনাদের কাছে গিয়ে বলতে যাইনি যে, ‘আমরা মানুষ। আমাদের নিয়ে একটু ভাবুন।’

মানুষ হিসেবে মানুষের যে অধিকার রাষ্ট্র তার নাগরিকদের দিয়েছে, আমরা সেই অধিকার রাষ্ট্রের কাছে কখনো চাইতে যাই না। তবে রাষ্ট্রযন্ত্রের মানুষের মুখগুলো এবং সমাজের উঁচুশ্রেণির মানুষগুলো আমাদের কখনো মানুষ ভাবুক আর নাই-বা ভাবুক তাতে আমাদের কোনো দুঃখ নেই। আমাদের তারা শুধু এই পৃথিবীতে জন্ম নেয়া কোনো নিম্নশ্রেণির প্রাণী ভাবলেই হবে। আমরা এর চেয়ে বেশি কিছু তাদের কাছে চাই না। যদি সেটাও তারা না ভাবতে চায়, তাতেও আমাদের কোনো কিছু করার নেই। অবশ্য ওপরের মানুষগুলো আমাদের যে মানুষ না ভেবে কিছু একটা ভাবে, এই ‘কিছু একটা’ ভাবাতেই আমরা খুব খুশি।

যে গল্প বলছিলাম, রাষ্ট্রের এই নিষিদ্ধকালে আমাদের জীবনযাপন একেবারেই মরণদশা হয়ে ওঠে। সেই দশার আর্তি বলতে গেলে দম বন্ধ হয়ে আসে। আমরা তবুও মাঝেমাঝে রেগে আগুন হয়ে যাই। কিন্তু বুকের ভেতরে জ্বলে ওঠা সেই আগুন সহজেই নিভে যায়। আমরা আর কখনো সে দাউ দাউ করে জ্বলা আগুন জ্বালাতে পারি না। যা আমাদের চিরকালীন ব্যর্থতা। শুধু আমরা নই, আমাদের পূর্বপুরুষেরাও ব্যর্থ, আমাদের উত্তরপুরুষ সফল হবে কি হবে না, এখনই জোর দিয়ে বলতে পারি না।

এ কথা সত্য যে, আমাদের ভেতরে কারও কারও বুকের আগুন মাঝেমাঝে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চায়। আমার খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, সময় সুযোগ পেলে আমাদের বুকের ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলা সে আগুন যে কোনো সময় বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। নিষিদ্ধকালে রাষ্ট্রের সব স্তরের নিরাপত্তা সংস্থা আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে নজরদারি শুরু করে। সে কী নজরদারি!

মনে হয় আমাদের ওপরে নজরদারি না করলে তাদের চাকরিটিই আর থাকবে না। তাই তারা নজরদারি, খবরদারিতে আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমরা তাদের নাম শুনলেই ভয়ে, আতঙ্কে লজ্জাবতীর মতো গুটিয়ে যেতে থাকি। নিষিদ্ধকালে আমাদের জীবনযাপনের কোনো কাজই করতে পারি না। কখনো কখনো আমরা মনে করি, আমাদের উচিত পালিয়ে যাওয়া, নয়তো ভয়ে সারা রাতের সব শ্রমের ফলাফলের বড় অংশ তাদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া।

বেশিরভাগ সময়ই আমাদের শ্রমের ফলাফল বিলিয়ে দিতে হয়। সেই বিলিয়ে দেয়াও ঘটে চুপি চুপি, মানুষ তো ভালো কাকপক্ষীও যাতে না জানে। ফলাফলের ভাগ বণ্টন অনেকটা সরকারি রিলিফ দেয়ার মতো সিরিয়ালমাফিক শুরু করতে হয়। আমরা কী আর করব। এই ভরা আশ্বিনে অথবা যে কোনো সময়েই আমাদের টিকে থাকার সংগ্রাম যেমন শুরু হয়, তেমনিভাবে আমাদের ঘায়েল করারও প্রতিযোগিতা শুরু হয়। রাষ্ট্রকর্তৃক জারিকৃত এই প্রজননকালে আমাদের কাছে তারা ধারাবাহিকভাবে আসতে থাকে।

অবশ্য আমাদের ভেতরই আমাদের শত্রু আছে। আমরাই একে অপরের ক্ষতির জন্য তাদের সহযোগিতা করে থাকি। তাই নিজেদেরও যে কিছু দোষ নেই সে কথাও জোর দিয়ে বলতে পারছি না।

নিজেদের গোত্রের লোকদেরও দোষ আছে, তাদের হাসির আড়ালে ভেতরে ভেতরে একে অন্যকে পুড়িয়ে ফেলার হিংসার দাবানল জ্বলতে থাকে। আমরা একে অন্যের মুখের হাসি বেশিক্ষণ দেখতে পারি না। আমরা লেগে থাকি, একে অন্যের পেছনে সময়ে অসময়ে লেগে থাকি। অন্যকে দিয়ে আমরা গোত্রের কাউকে ক্ষতি করার সুযোগ পেলে নিজেরাই নিজেদের ঘায়েল করি।

আমরা যখন রাতে কাজে নেমে পড়ি তখন আমাদের কাছে তারা এক এক করে আসতে থাকে। ওদের আসার সে কী ধারাবাহিকতা!

আমরা যখন পূর্ণিমার শরীর বেয়ে বেয়ে নেমে আসা সৌন্দর্যে স্নান করে পদ্মার ভরা বুকে চষে বেড়িয়ে রুপালি সোনা তুলি তখন ওরা আমাদের শ্রম চাষের ফলাফলের ভাগ নিতে আসে।

কখনো কখনো দলে দলে ওদের ধারাবাহিক আসার খবর আমাদের কানে এলে আমরা কেউ কেউ নৌকা নিয়ে পালিয়ে যাই। সবসময় তো আর পালিয়ে পালিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। আমরা কোনো না কোনো সময় ওদের হাতে ধরা খেয়েই যাই। ধরা খাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ থাকে না। আমরা ওদের কাছে পালাতে ব্যর্থ হয়ে উঠি।

ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অবশ্য অনেকগুলো যুক্তিযুক্ত কারণ আমি খুব সহজেই উপস্থাপন করতে পারি; কিন্তু এতগুলো যুক্তি দেখালে আমরা আর আমরা থাকি না। আমরা কখনো কখনো হয়ে উঠি আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী।

যাই হোক। আমাদের কাছে সন্ধ্যা-রাতের পরপরই ওরা দলে দলে আসতে থাকে। আমরাও মেনে নিই আমাদের ওপরে তাদের ধারাবাহিক জুলুম নির্যাতন। না মেনে নিয়ে কোনো উপায় নেই।

সন্ধ্যা-রাতের পরে পদ্মার ভরা বুকে যখন জোছনা ঝিলিক মেরে ওঠে তখন থেকেই আমাদের কাছে চেয়ারম্যানের খবর আসে। সে তার কিছু লোকজন আমাদের কাছে পাঠায়।

তাদের তো খুশি করতেই হয়। তাদের খুশি না করে, আমাদের কোনো উপায় থাকে না। তারা চেয়ারম্যানের লোক। চেয়ারম্যানের ইশারায় তারাই এই এলাকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের ভয়ে আমরা কখনো কোনো কিছু বলতে সাহস করি না। আমাদের ওপরে তাদের চাহিদা মেটাতে আমরা সবসময় চেষ্টার কোনো কমতি রাখি না।

শুধু কি তাই! এই চেয়ারম্যান আমাদের সংসদ সদস্যের খুব কাছের মানুষ। তাকে খুশি না করলে কী হয়! মাঝেমাঝে তো মাঝরাতে তিনি নিজেই আমাদের কোনো না কোনো ঘরে এসে হাজির হন। চেয়ারম্যানের বউ-ছেলে-মেয়ে সব ঢাকায় থাকে।

যখন তার গতরের ভেতরে রক্তের প্রবাহ শোল মাছের পোনার মতো খলবল খলবল করে নাচুনি কুদুনি দিয়ে ওঠে, তখন তিনি আমাদের পাড়ায় এসে হাজির হন।

অবশ্য তার কাছে আমাদের এই পাড়ায় যতগুলো ঘর আছে, সব ঘরেরই লোকজনের মুখ মুখস্ত। যেসব ঘরে ছিনালি গতরের মেয়ে আছে, সেসব ঘরেই তিনি ঘণ্টাদুয়েক এসে খায়েশ করে ফুর্তি করেন।

আমরা অসহায়, আমাদের ঘরের ছিনালি গতরের মেয়েদের দিয়ে সে তার গতরের আগুন নেভায়। আমরা প্রতিবাদ করার সাহস পাই না।

অবশ্য তিনি আমাদের মেয়েগুলোর ওপরে নিজে কখনো চাষবাস করে ফসল ফলান না। জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি ব্যবহারে তিনি আমাদের আইডল হতে পারেন। আমরা আসলে ভেতরে ভেতরে চেয়ারম্যান ও তার লোকজনদের খুব ভয় পাই। তাদের খুশি করার পেছনে আমাদের আরও কিছু কিছু কারণ আছে।

এই মুহূর্তে যদি বলি বলতে হয়, যখন আমাদের গোত্রের ভেতরে কখনো কারও মেয়ে, ছেলে এবং বউকে নিয়ে ঝগড়া, বিবাদ অথবা ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো ঘটনা ঘটে, তখন আমরা চেয়ারম্যানের কাছেই প্রথমে নালিশ নিয়ে যাই। তখন তিনিই হয়ে ওঠেন আমাদের সর্বময় কর্তা।

এই তো সেদিনের ঘটনা। ঘটনাটির এক মাস পার হয়নি। আমাদের পাড়ার যতীনের ছোট ছেলের বউ অঞ্জলিকে এক রাতে চুপি চুপি ঘরে এসে পাশের ঘরের সুবলের ছোট ছেলে মুকুন্দ চেটেপুটে খেয়েছে।

ঘটনাটি প্রথমে কেউ জানত না। একমাত্র সাক্ষী অঞ্জলির অসুস্থ শাশুড়ি। প্রথমে সে ঘটনাটি চেপে গেলেও দুই দিন পরে যখন তার ছেলে পদ্মার বুক থেকে বাড়ি ফিরে আসে, তখন সে অঞ্জলি ও মুকুন্দর ঘটনাটি প্রকাশ করে। মূলত তখন এই ঘটনা নিয়ে তুমুল হইচই পড়ে যায়। শুরু হয় ঝগড়া বিবাদ। শেষ পর্যন্ত ঘটনাটির সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। অঞ্জলি তো কিছুতেই পরকীয়া স্বীকার করতে চায় না; কিন্তু শাশুড়ি আর এই ছেলের বউকে রাখতে চায় না।

শেষ পর্যন্ত চেয়ারম্যানই সবার একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেই বিচার তো চেয়ারম্যান এখনও শেষ করেনি। ব্যবসার কাজে কাল সে খুলনায় যায় অথবা আজ বউ ছেলেমেয়ের টানে ঢাকায় যায়।

এভাবেই চেয়ারম্যান আজ সালিশ করবে, কাল সালিশ করবে করে করে ব্যস্ততায় দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত আমরা এইটুকু আশ্বস্ত হতে পারি যে, এই ঘটনার একটি সালিশ দরবার তিনি আমাদের ঠিকই করে দেবেন।

আমার ধারণা অবশ্য একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। কেন জানি আমি অনেকের মতো অনেক কিছুই বিশ্বাস করতে পারি না। এমনকি আমাদের এই চেয়ারম্যানকেও নয়। চেয়ারম্যানের লোকজনের পরেই আমাদের কাছে আসে পুলিশ।

থানার বড় সাহেব শুধু নিষিদ্ধকালেই নয়, চেয়ারম্যানের লোকজনের মতো রোজ রাতেই আমাদের কাছে পুলিশ পাঠান।

কখনো কখনো বড় সাহেব নিজেই দ্রুতগতির জলযানে চলে আসেন। তাদের দেখে পলাতে শুরু করি। কখনো কখনো পালিয়ে যাই আবার কখনো কখনো পালাতে পারি না। বড় সাহেব আমাদের কাছে এসে বলেন, ‘আজ রাতে তোদের এখানে বিশেষ অভিযান করতে এসেছি। আমার মাল বুঝিয়ে দে, নইলে তোদের বিপদ। আমি তোদের এখানে আসব, আমাকে আমার মাল বুঝিয়ে দিবি আর যদি না আসি থানায় মাল পাঠিয়ে দিবি। এই হারামির বাচ্চারা তোরা নাকি মাল ঠিকমতো দিতে চাস না?’

‘না, স্যার। ঠিকমতোই তো আমরা পাঠাই দেই।’

‘আমি তো ঠিকমতো আমার ভাগের মাল পাই না। তোদের বিরুদ্ধে আমার পুলিশ তো আমার কাছে নালিশ দেয়, তোরা নাকি মাল দিতে চাস না?’

আমরা কেউ কেউ আমতা আমতা করে বলতে থাকি, ‘না, স্যার। আমরা ঠিকমতোই আপনার নামে মাল পাঠাই দেই।’

‘শোন। আজ তোদের হুঁশিয়ারি করে গেলাম। পরে যদি ঠিকমতো আমার ভাগের মাল না পাই তাইলে তোদের সবাইকে পদ্মার বুকের রুপালি সোনা বিদেশে পাচারের মামলায় লটকাইয়া দেব।’

আমরা থরথর করে কাঁপতে থাকি। মনে হয় তিনি যত দ্রুত চলে যাবেন, ততই আমাদের মঙ্গল। এখনকার বড় সাহেবের চেয়ে আগের বড় সাহেব অন্য প্রকৃতির মানুষ ছিল।

পুরনো বড় সাহেবকে তো আমরা যে নিজেরা মাল পছন্দ করে দিতাম, তিনি সেই মালই খেতেন। কিন্তু এখনের বড় সাহেব নিজে বেছে বেছে মাল খুঁজে নেন। তিনি যখন চলে যান তখন আমাদের মন ভেঙে যায়। আমরা সবাই বলতে থাকি, ‘শালা, বাইনচোদ কোথাকার। কত কষ্ট করে রাত জেগে জেগে গতর খেটে সোনা তুলি, সেই সোনা শালারা ছোঁ মেরে নিয়ে যায়।’

আমরা রাগে দুঃখে ক্ষোভে গজগজ করতে থাকি। আমাদের এই গজগজানিটুকুই সম্বল। আবার রাত জেগে সোনা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

গভীর রাতে পদ্মার বুকে চাঁদের আলোয় আমরা যখন কচুরি ফুলের মতো ভেসে বেড়াই তখন কখনো কখনো আমার চোখের সামনে দলে দলে কচুরিপানা এসে ভাসতে থাকে। প্রতিটি পানাতেই ফুটে থাকে মুগ্ধতার কচুরি ফুল। রং-বেরঙের গোলাপ, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা, রক্তকরবী, শিউলির চেয়েও কচুরি ফুল আমায় বেশি মুগ্ধ করে।

চকচকে হালকা বেগুনি রঙের পাপড়িগুলোর কোনো কোনোটির মাঝে গাঢ় নীল রঙের নকশায় হলুদ ফোঁটাগুলো সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়িয়ে রাখে। কচুরি ফুলের এত বিচিত্র সৌন্দর্য মুগ্ধতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে না দেখলে বোঝাই যায় না। সবুজ কচুরি পাতার মাঝে ঝাড়বাতির মতো সৌন্দর্য ছড়িয়ে ফুটে থাকে। যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।

আমার অবশ্য সেই শৈশবের শুরুতেই, যখন আমি স্মৃতি ধারণ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হই, তখন থেকেই কচুরি ফুল আমাকে মুগ্ধ করে রাখে।

নদীর বুকে স্রোতের টানে ঝাঁকে ঝাঁকে কচুরিপানায় মাথা উচুঁ করে ফুলগুলো দুলতে দুলতে ছুটতে থাকে। যখন স্রোতের টানে ছুটতে থাকে, তখন এক একটি কচুরিপানা গায়ে গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে ছুটতে থাকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে কী ভীষণ সুন্দর লাগে!

আবার কখনো কখনো সেই ফুলের ডানায় চিত্রল প্রজাপতিরা মনের সুখে ঢেউয়ের তালে তালে দুলতে থাকে। কচুরি ফুলের ডানায় প্রজাপতির এমন সুখ দেখলে ঘরে থাকা আমার ময়নার কথা মনে পড়ে যায়।

আমার আশায় সারা রাত ঘরে জ্বলেপুড়ে মেয়েটি একা একা কাটিয়ে দেয়। এই চাঁদজাগা রাতে পদ্মার বুকে ভেসে ভেসে কখনো আমার চোখে-মুখে ময়নার মুখ ভেসে উঠলে আমিও জ্বলতে থাকি।

আবার কখনো কখনো দুশ্চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাই-ঘরে একা পেয়ে মুকুন্দর মতো কেউ কি আমার ময়না পাখিটিকে ফুসলিয়ে ফাসলিয়ে আদর করছে?’

যে গল্প বলছিলাম। শুধু কি চেয়ারম্যান আর পুলিশই আমাদের ধাওয়ার ওপরে রাখে, ব্যাপারটি কিন্তু তা নয়। দিন যত যায়, আমাদের রক্ত চোষাদের দল তত বেশি হয়। এখন শুধু চেয়ারম্যান আর থানার বড় সাহেব নন। একে একে জুটেছে মান্নান ও লস্কর দস্যুবাহিনী।

মান্নান ও লস্করকে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছিলাম। কিন্তু এখন তারা সরকারি দলের লোক। আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন এই লস্কর আমাদের সঙ্গেই প্রাইমারি স্কুলে পড়ত। শেষ পর্যন্ত লস্কর প্রাইমারির গণ্ডি পেরোলেও বেশিদূর এগিয়ে যেতে পারেনি। আমিও পারিনি। পড়াশোনায় খুব খারাপ ছাত্র হওয়ায় হাই স্কুলের পাঠ শেষ না করেই জীবনের প্রয়োজনে কাজে নেমে পড়েছি।

লস্কর ও মান্নানেরা রাতে পদ্মার বুকে যতদূর পর্যন্ত বন্দুক নিয়ে যেতে পারে, ততটুকুই নাকি তাদের মালিকানা! আমরাও বোবা মানুষের মতো বেঁচে আছি। ওদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না।

আমাদের ওপরে জুলুম করেই চলছে। আমরা মুখবুজে সব নীরবে সহ্য করেই যাচ্ছি। এই নিষিদ্ধ রাতে পদ্মার বুকে সারা রাত ভেসে বেড়িয়ে আমরা যখন কিছু ছোট-বড় রুপালি সোনার মুখ দেখি, তখনই ওরা এসে আমাদের নৌকায় হানা দেয়। আমাদের শ্রমের ফলাফল সব বন্দুকের মুখ ঠেকিয়ে নিয়ে যায়। আমরা কোনো সামান্য প্রতিবাদও করতে পারি না।

সন্ধ্যা-রাতের পর থেকেই দলে দলে এসে আমাদের শ্রমের বিনিময়ে পাওয়া সব চকচকে রুপালি সোনাগুলো নিয়ে যায়, আমরা তখন অনুনয়-বিনয় ছাড়া মুখ দিয়ে আর কোনো কিছুই বলতে পারি না। অথবা আমরা কোনো কিছু বলতে সাহস করতে পারি না।

আমার শুধু মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘আমি ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব। ওদের বন্দুক কেড়ে নিয়ে গুলি করে ঝাঁঝড়া করে দেব ওদের বুক। আমি একদিন ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবই দাঁড়াব।’

কিন্তু কখনোই আমি ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারি না। সেই সময় ও সুযোগ যদি কোনো দিন আমার সামনে এসে পড়ে, আমি অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব। মনের ভেতরে এমন সুপ্ত আশা লালন করে এলেও কবে কখন সুযোগ পাব, আমি বলতে পারি না। যদি কোনো দিন সেই প্রতিশোধের পথ পেয়ে যাই, আমি নির্বিঘ্নে ওই পথে হেঁটে যাব।

আমি আমার পূর্বপুরুষদের অপমান, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা আর নির্যাতনের প্রতিশোধ নেব। আমি আমার পরের প্রজন্মকে প্রতিশোধের পথ দেখাব। যদি সুযোগ পেয়ে যাই আমি অবশ্যই ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব।

আধা পূর্ণিমার রাত। দুইজন সহযোগীকে নিয়ে যখন পদ্মার বুকে আমরা চকচকে রুপালি সোনা তুলতে ব্যস্ত ঠিক তখনই লস্করের লোকজন এসে বলল, ‘এই তোদের নৌকায় তোলা সব মালগুলো আমাদের ট্রলারে উঠিয়ে দে।’ আমরা বলে উঠলাম, ‘না, দেব না। আমরা একটিও মাল আর তোদের দেব না। আমাদের এই দুঃসময় কালে সব যদি তোদের দিয়ে দেই, তাহলে আমাদের তো না খেয়ে মরতে হবে।’

‘তোরা না খেয়ে থাকলে আমাদের কী শালা।’ ওরা আমাদের নৌকায় হুড়মুড়িয়ে উঠে রাত জেগে পদ্মার বুকে ভেসে ভেসে; জালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে রুপালি সোনাগুলো তুলেছি, আমাদের সেসব সোনাভর্তি খাচিগুলো নিয়ে যেতে লাগল। আমরা ওদের বাধা দিতে থাকি। কিন্তু ওরা তো থামে না। আমাদের নৌকায় উঠে সব খাচিগুলো নিয়ে যাচ্ছে, আমরা বাধা দিচ্ছি।

আমাদের মাঝে চলতে থাকল ধাক্কাধাক্কি জোরাজুরি। আমরা কিছুতেই ওদের খাচিগুলো নিয়ে যেতে দিচ্ছিলাম না। কিন্তু ওরা কিছুতেই আমাদের খাচিগুলো ফিরিয়ে দিচ্ছিল না।

হঠাৎ বিকট গুলির শব্দ। আমি টের পেলাম আমার বুকেও একটি গুলি এসে ঢুকে পড়েছে। আমি আর কোনো কিছুই করতে পারি না। ক্রমেই আমার হাত-পা-মাথা অবশ হয়ে যাচ্ছে। আমি যেন আর দম নিতে পারছি না। কেমন করে যেন সবকিছু বদলে যেতে শুরু করল। অথচ আমি বুকের ভেতরে পুষে রাখা পুরনো ক্রোধ কিছুতেই জ্বলে ওঠাতে পারছি না। হঠাৎ আমার চোখের সামনে ময়নার মুখ ভেসে ওঠে। আহা! কী মায়াময়ী মুখ।

তাকিয়ে দেখি, শুধু আমি নই, আমার দুই সহযোগীও নৌকার গলুইয়ের কাছে চিত হয়ে পড়ে গেছে। একে একে আমরা সবাই জলে পড়ে যাচ্ছি।

আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। এত ভারী কষ্ট যেন বুকটা ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। শুধু কি ময়নার জন্য কষ্ট পাচ্ছি, ছয় মাস পরে ময়নার কোলজুড়ে যে আসছে, তার জন্যও ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি।

আধো চাঁদের আলোয় পদ্মার বুক আমাদের রক্তে লাল হয়ে উঠেছে। আমরা হয়তো কচুরি ফুলের মতো স্রোতের টানে একে অন্যের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে ভেসে যাচ্ছি দূরে বহুদূরে। কোথাও কেউ নেই। শুধু পদ্মার জলে আমার ময়না নিরন্তর আমায় খুঁজে ফিরছে। অথচ আমি তার ধারে কাছে কোথাও নেই।

 

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

নষ্টনীড়

প্রথম পরিচ্ছেদ   ভূপতির কাজ করিবার কোনো দরকার ছিল না। তাঁহার টাকা যথেষ্ট ছিল, এবং দেশটাও গরম। কিন্তু গ্রহবশত তিনি

কবিতা

বর্ষ-আবাহন

ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে দীপ্ত নীলে, শুভ্র রাগে প্রভাত রবি উঠল জেগে দিব্য পরশ পেয়ে, নাই গগনে মেঘের ছায়া যেন

একদিন খুঁজেছিনু যারে-

একদিন খুঁজেছিনু যারে বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে, মালতীলতার বনে, কদমের তলে, নিঝুম ঘুমের ঘাটে-কেয়াফুল, শেফালীর দলে! -যাহারে খুজিয়াছিনু মাঠে

চিরদিন শহরেই থাকি

চিরদিন শহরেই থাকি পড়ে থাকি পাটের আড়তে করি কেরানির কাজ—শুভে-লাভে যদি কোনোমতে দিন যায় চ’লে আকাশের তলে নক্ষত্রেরা কয় কোন্‌