অসমাপিকা

তার সাথে আমার পরিচয়টা খুব বেশি দিনের ছিলো না। পরিচয়ই বা কীভাবে বলি– কখনোতো কথাটিও বলা হয়নি তার সাথে। বছর দুয়েক মতো তাকে দেখেছিলাম– কলেজ গণ্ডিতে। আমরা সহপাঠী ছিলাম। প্রথম কলেজে পদার্পণে যৌবনের প্রথম প্রেম পরশ বুলিয়েছিল আমার হৃদয়ে। কাঁচা প্রেমে সবকিছুই মিষ্টি লাগে। তাই শিক্ষিকার প্রশ্নের জবাব না দিতে পারায় ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে যেতেও এতটুকু দ্বিধা লাগেনি। তাহলে শোনো বলি–

সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছে আজই প্রথম। প্রথম কলেজ ক্লাস– তাই একটু উৎকণ্ঠা কাজ করছিলো ভেতরে। অসংখ্য শিক্ষার্থীর ভিড়ে আমরা কয়েকজন বন্ধু মাঝের দিকেকার বেঞ্চে বসেছিলাম। বাংলা দ্বিতীয় পত্রের শিক্ষিকা সমাপিকা ক্রিয়া বিষয়ক আলোচনা করছিলেন, এমন সময় কানে মৃদু একটা হাসির শব্দ ভেসে আসলো। এদিক সেদিক তাকাতেই দেখি– আমাদের ডান দিকের বেঞ্চে লিকলিকে রজনীগন্ধার মতো সরুদেহী এক উর্বশী বসে হাওয়ায় দোল খাচ্ছে, সে হাস্নাহেনার মতো মৃদু শব্দে হেসে যাচ্ছে। জানতে পারিনি সেদিন তার এতো হাসির হেতু কি ছিল; কিন্তু এটা জানতে পেরেছিলাম– এ গন্ধা যার ঘরে গন্ধ ছড়াবে সে কখনো প্রেম সংকটে ভুগবে না।

হঠাৎ পাশ থেকে আবির গায়ে ঝাকুনি দিয়ে বলে উঠলো– ইরম, ম্যাডাম ডাকছে। হকচকিৎ হয়ে ম্যাডামের দিকে তাকালাম। শকুনের চোখের মতো প্রখর দৃষ্টি দিয়ে তিনি আমাকে বোঝার চেষ্টা করছেন– এতক্ষণ আমি কি করছিলাম। উঠে দাঁড়ালাম, তিনি জানতে চাইলেন– এতক্ষণ কী বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিলো। প্রাইমারি স্কুলের শিশুরা পাঠ সম্পূর্ণ না করতে পারলে লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমান এবং ভয়ে যেভাবে মাথা নিচু করে থাকে, আমিও তেমনটিই করলাম। শুধু এইটুকুই মনে করতে পারলাম– তিনি সমাপিকা ক্রিয়া বিষয়ক আলোচনা করছিলেন। পরবর্তীতে আর কোনো বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন কি না, এটা আমার জানা ছিলো না। তাই আমিও সেই অবুঝ শিশুদের দলে যোগ দিলাম, ফিরে যাবার বৃথা চেষ্টা করলাম– ফেলে আসা সোনালী শৈশবে। ফলশ্রুতিতে আমাকে ক্লাসরুম থেকে বের করে দেওয়া হলো। পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে যাবার সময় আর একবার রজনীর দিকে তাকালাম। দেখি– ঘাড় বাঁকা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার দিকে ফিরে তাকতেই মৃদু একটা হাসি দিয়ে অন্য একজনের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। এতক্ষণ যে অপমান বা লজ্জাবোধ নিজের মধ্যে নিয়ে ক্লাসরুম থেকে বের হচ্ছিলাম, সবকিছু যেন নিমিষেই কোথাও হারিয়ে গেলো।

এভাবে অনেক দিন চলতে থাকে। এর থেকে বেশি কেউ এগুতে পারিনি। কখনো আমি এগিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে ফিরে এসেছি, হয়তো কখনো সেও এমনটিই করছে। আজ অবধি তার নামটিও জানতে পারিনি। হঠাৎ সেদিন সে সামনে এসে দাঁড়ালো। হ্যামলেটে বসে কফিতে ফুঁ দিচ্ছিলাম। প্রথমে চিনতে পারিনি। ছোট ছোট ফুল আঁকা সাদা নীল শাড়ীতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। চোখে চোখ পড়তেই প্রাণটা আঁতকিয়ে উঠলো। রজনীর গন্ধ আবার অনুভব করলাম। ফিরে পাবার আনন্দে হারানোর শঙ্কা বার বার গ্রাস করতে লাগলো নিজেকে। আমার দিকে সেই মৃদু হাসিটা ছড়িয়ে দিয়ে বলল– বসব? আমি কিছু না বলতেই সামনের চেয়ারটি টেনে বসে পড়ল। আমার কাছে আবার জানতে চাইলো– আমি তার জন্য কফি অর্ডার দিয়েছি কি না। তার এমন সরব প্রশ্নে কিছুটা থতমততে পড়ে গেলেও নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে আর একটা কফির অর্ডার দিলাম।

কফি শেষ হয়েছে প্রায় ঘন্টাখানেকের মতো হবে। দুজনে ছোট ছোট কাটা কাটা বাক্যে কিছু কিছু ভাব প্রকাশ করছিলাম। তার মধ্যে একটা কথা আমাকে খুবই আন্দোলিত করেছিল। আমার সমস্ত বিবেকটাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তার সাথে কথা বলার জন্য যখন আর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছি না তখন সে মলিন মুখে জিজ্ঞাসা করল– এখনো কি সাহসটুকু সঞ্চার করতে পারলে না। কলেজে পড়াকালীন ভেবেছিলাম– হয়তো এগুলো আবেগ। কিন্তু যত দিন যেতে থাকে আবেগগুলো ভালোবাসার রূপ নিতে থাকে। তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি।

সেদিন তার সে কথায় কথা বলার মতো কথা আমার ছিল না। প্রাইমারি স্কুলের শিশুরা পাঠ সম্পূর্ণ না করতে পারলে লজ্জায়, ঘৃণায়, অপমান এবং ভয়ে যেভাবে মাথা নিচু করে থাকে, আমিও তেমনটিই করলাম। কিছুক্ষণ পরে সেই বলে উঠলো– বিয়ে করেছো তাহলে! আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম। রজনী একটু দম ধরে রেখে আক্ষেপের একটা হাসি দিল। যে হাসিতে একদিন আমার সমস্ত পৃথিবী রঙিন হয়ে থাকত, সেই হাসিতেই আজ আবার আমার সমস্ত পৃথিবী পাপবোধে জ্বলজ্বল করতে লাগল। কিছু বলার মতো শক্তিটুকুও সেদিন আমার কণ্ঠে ভর করেনি। তাই নিরব স্বাক্ষী হয়ে মাটিমুখো হয়ে বসেছিলাম। আবার জানতে চাইলো– কোনো ছেলে মেয়ে হয়েছে? আমি বললাম– দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। রজনী আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল– কনগ্রাচুলেশন! তাহলে তো তোমার সুখের সংসার। বাই দ্যা ওয়ে, ভালো থেকো। পিছন থেকে বহুবার ডাকার চেষ্টা করেও সেদিন ডাকতে পারিনি। কফির খালি পেয়ালার মতো আমার জীবনের পেয়ালাটাও মনে হলো শূন্য হয়ে গেলো।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
গল্প

অতনু ফিরে যাবে

এটা কি আগে এখানে ছিল, না ছিল না? একটা বেঁটে মতো গম্বুজ, তার সবদিকই নানারকম পোস্টারে মোড়া, একটা বড় ফিল্মের

গল্প

বৃষ্টিযাপন

ঘরের বাইরে দু’পা বাড়াতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, ঘটা করে ভিজিয়ে দিলো। বাড়ির গেইটের সাথে রাস্তা। আবার ঘরে ঢুকে যেতে পারতো। ঘরেও

গল্প

মা টাকি এবং একটি ঢোঁড়া সাপের গল্প

হঠাৎ করে এমন একটি কাণ্ড ঘটে যাবে বিমলার কল্পনায় আসেনি। বেড়ার সঙ্গে টানানো ফ্রেমহীন আয়নার কাচটি টনটনে শক্ত মাটিতে পড়ে

কবিতা

এই সব দিনরাত্রি

মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ড়ুবে যাওয়া ভালো। এইখানে পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারা দেশে এখানে আশ্চর্য সব মানুষ