শোনায় সমস্যা

ইদানিং আমার শোনায় সমস্যা হচ্ছে। এই কথা জানার পরে অনেকে মুচকি হেসে বলবেন এই বয়সেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে কেমনে বাকি জীবন চলবে। শত্রুরা অবশ্য খুব একটা স্বস্তি নিয়ে বলবে যা শালা উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। খোঁড়া হয়েছিস তো একদম মোক্ষম জায়গায়। অনেকে যারা শুভাকাঙ্ক্ষী তারা অবশ্য খানিকটা সান্ত্বনা দিয়ে বলবেন আরে চিন্তা করো না আজকাল অনেক হারবাল টারবাল বের হয়েছে। শুনেছি ওসবে নাকি কাজ হয়। একটু চেষ্টা চিকিৎসা কর ঠিক হয়ে যাবে। আসলে শত্রু মিত্র উভয়েই আমাকে ভুল বুঝেছেন। আমি আসলে যে সমস্যার কথা বলেছি সেটা ওই সমস্যা না আমি বুঝিয়েছি শোনায় সমস্যা অর্থাৎ হিয়ারিং প্রবলেম।

এখন প্রশ্ন হল আমি কি তবে কানে কম শুনি? মোটেও না। দুএকবার এই সন্দেহ আমারও হয়েছে। তাই বেশ বড়সড় বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছি। তারা বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর রায় দিয়েছে আমার কানে কোনো সমস্যা নেই। তবে সমস্যা কি? সমস্যা হল আমি শুনি ঠিক আছে তবে ভুল শুনি।

কি ধরনের ভুল। একটু উদাহরণ দেই। আমার বড়মা মানে আমার বাবার নানি কিছুদিন আগে গত হয়েছেন। খুব স্নেহ করতেন আমাদের। তারই কোলেপিঠে মানুষ হয়েছি আমি। আমার সেই বড়মা শেষ দিন পর্যন্ত বেশ সুস্থভাবে হাঁটাচলা করে গেছেন। তার সবদিকেই ঠিক ছিল শুধু সমস্যা ছিল চোখে। তবে তার কান ছিল টনটনে। রাতের বেলা তার ঘুম হত কম। একটু টুকটাক শব্দ হলেই উনি বুঝতে পারতেন।

আমাদের ঘর লাগোয়া ঘরে যিনি তখন থাকতেন তার নাম আমজাদ হোসেন। সম্পর্কে আমার ভাই হন। উনি স্কুলের দপ্তরির চাকরি করেন মানে ঘণ্টা বাজান। যেহেতু ইনকাম কম তাই চাকরির পাশাপাশি হোমিওপ্যাথ প্র্যাকটিস করেন। গ্রামের লোকের ছোটখাট সমস্যায় টুকটাক ওষুধ দেন। তো একদিন রাত্রে এক লোক তার কাছে এসেছেন সমস্যা নিয়ে। সমস্যাটা অবশ্য জটিল। অন্ডোকোষে ব্যাথা।

সকালে নাস্তা করছিলাম। ড্রইং রুমে গান চলছিল। নতুন হোম থিয়েটার কিনেছি। ব্লু টুথ সুবিধে সম্বলিত সাউন্ড বক্স। বেশ আরাম আয়েশ করে গান শোনা যায়। রুমের এক কোণায় সাউন্ড বক্স। নো প্রবলেম। অন্য কোনা থেকে ফোন টিপে দিলেন। ব্যাস গান চালু হয়ে গেল। গান চলছিল বাংলা গান। আমি খোলা জানালা, তুমি ওই দখিনা বাতাস আমি নিঝুম রাত তুমি কোজাগরী আকাশ । গান শোনার এক পর্যায়ে বউ জিজ্ঞেস করল ‘আচ্ছা কোজাগরী মানে কি? একটু বিপদে পরে গেলাম। কোজাগরী শব্দটির সাথে আমি অপরিচিত। তাই আমতা আমতা করে বললাম কোজাগরী বলে কি কোনো শব্দ আছে? বউ বেশ কনফিডেন্টের সাথে বলল আরে আছে, আমি কোথায় যেন পড়েছি। আমি শব্দটা একটু ভালোভাবে শুনতে বউকে বললাম গানটা প্রথম থেকে চালু করতে বললাম। হ্যাঁ কোজাগরই শোনা যায়। তবে এটা নিয়ে আমি একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ফেললাম। বললাম এটা আসলে হবে তুমিকো জাগরি আকাশ। গানে একসাথে গায় বলে তুমিকো জাগরি শোনা যায় কোজাগরী হিসেবে। বউ খানিকটা সন্দেহ নিয়েই আমার এই গাঁজাখুরি ব্যাখ্যাটা মেনে নিল। বউ মেনে নিলেও আমার মনে খুঁতখুঁত করছিল। কোজাগরী শব্দ বলে শব্দ থাকতেও তো পারে। যেহেতু গুগোল মহাশয় হাতের কাছেই আছে তাই সন্দেহ কাটাতে সার্চ দিলাম এবং আমার ভুল ভাঙ্গল। কোজাগরী শব্দ আসলেই আছে এবং এর চমৎকার একটা অর্থও আছে। কোজাগর বা কোজাগরী শব্দের আক্ষরিক অর্থ “কে জেগে আছ?”

শরৎকালের পূর্ণিমার রাত্রি বৎসরের সবচেয়ে উজ্জ্বল রাত্রি। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই রাতে ধনসম্পদ, প্রাচুর্য, সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মী বিষ্ণুলোক হতে পৃথিবীতে নেমে আসেন এবং মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে “কে জেগে আছ?” এই প্রশ্ন করেন (নিশীথে বরদা লক্ষ্মী কোজাগর্তিভাষিণী- অর্থ নিশীথে বরদাত্রী লক্ষ্মীদেবী কে জেগে আছ বলে সম্ভাষণ করেন)। যে সেই রাতে লক্ষ্মীব্রত করে জেগে থাকে দেবী তার কাছ থেকে সাড়া পান এবং তার গৃহে প্রবেশ করে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করেন। কোজাগর বা কোজাগরী শব্দের আক্ষরিক অর্থ “কে জেগে আছ?” তবে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথি এবং ঐ তিথিতে অনুষ্ঠিত লক্ষ্মীপূজাকে যথাক্রমে কোজাগরী পূর্ণিমা এবং কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা বলে অভিহিত করা হয়। তাহলে কোজাগরী আকাশ হল ঐ সময়কার আকাশ। যাক ভুল ভাঙ্গল।

বউকে কথাটা বলতেই হই হই করে উঠল। বলল আমি না জেনেও তাকে ভুলভাল বুঝাই এইসব আরকি। অভিযোগ মাথা পেতে নিলাম। তবে গানের এই ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার পেছনে কিছু কারণ আছে। গান শুনতে গিয়ে আমি প্রায়শই ভুলভাল শুনি। দুএকটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন। শাহ আব্দুল করিমের একটি বিখ্যাত গান আছে

তুমি বিনে আকুল পরাণ
থাকতে চায় না ঘরে রে
সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে

ঐ গানের একটা লাইন আছে– “তোমার  প্রেম-সাগরে তোমার করিম যেন ডুবে মরে”। আমি প্রায় বছর দুয়েক এই লাইনটি শুনেছি এরকম ভাবে “তোমার রুপে মশা ঘোরে…। কই প্রেম সাগরে, কই মশা ঘোরে। বোঝেন তাইলে কি অবস্থা। ছোটবেলা থেকে অবশ্য আমার একটু শোনায় সমস্যা অর্থাৎ হিয়ারিং প্রবলেম। খুব মন দিয়ে শুনলেও অনেক কিছু ভুল শুনি তাই এরকম হয়েছে। যাই হোক ভুল ভাঙল যখন বিষয়টা আমার ইউনিভার্সিটি’র রুমমেটকে বললাম। সে বেশ একচোট হেসে নিল। তারপর বলল ওটা মশা ঘোরে হবে না হবে প্রেম সাগরে। তাই বলি যার রূপে মশা ঘোরে তার রূপ নিয়ে আব্দুল করিমের এত আকুলি বিকুলি যাবেন কোন দুঃখে। রুচিরও তো একটা ব্যাপার আছে।

এবার আমার রুমমেট আরেকটা গান নিয়ে তার সংশয়ের কথা জানালো। এটাও তখনকার সময়ের বেশ হিট গান। কোন এক বাংলা সিনেমায়ও সেটা যুক্ত করা হয়েছিল। গানের কথা গুলো এরকম ‘ ভালো বাসবো বাসবো রে বন্ধু তোমায় যতনে…। ঐ গানের একটা লাইন আছে এরকম ‘দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা। এই লাইন নিয়ে আমার রুমমেট বলল আচ্ছা রুমমেট এই যে গানে বলে “দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ কেন চোষ না” এই লাইনের মাহাত্ম কি? এবার ঠা ঠা করে আমি এক চোট হেসে নিলাম। তারপর বললাম ওটা হবে “রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা”। রুমমেটও একচোট হেসে নিয়ে বলল, “আমি ভাবলাম যৌবনের ব্যাপার স্যাপার হতেও পারে রূপ কেন চোষ না।”

বুঝলাম আমার একার শুধু শোনায় সমস্যা না অনেকেই শোনার সমস্যায় ভোগেন অর্থাৎ হিয়ারিং প্রবলেম।

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
কবিতা

পর্তুলিকা ও অন্যান্য কবিতা

জ্যোৎস্নাগাঁথা জ্যোৎস্নার তাপে পুড়ে যাওয়া রাতে, একদিন আমার ব্যালকনিতে নামবে লুণ্ঠন করতে জানা জালিম চাঁদ। গভীর স্নান নেবে হাস্নাহেনার ঘ্রাণে।

গল্প

একটি বিড়ালের আত্মকথা

হঠাৎ মেঝেতে খসখস একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ব্যথাতুর ঝাপসা চোখে দেখলাম কে যেন একজন পাশ কেটে চলে গেল।

চলছি উধাও

চলছি উধাও, বল্গাহারা- ঝড়ের বেগে ছুটেশিকল কে সে বাঁধছে পায়ে!কোন্‌ সে ডাকাত ধরছে চেপে টুটি!-আঁধার আলোর সাগরশেষেপ্রেতের মতো আসছে ভেসে!আমার

গল্প

প্রাণ ভরিয়ে

সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আজও ডান পাটা দু’বার হড়কে গেল। তবু বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে মেট্রোটা পেলাম। এমনিতেই আজ অনেক দেরি হয়ে