পৃথ্বী-পুরাণ


একটা গাছ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে লতাপাতারা গলাগলি করে বলে : চুপ, একদম নিশ্চুপ ভ্রমরার বোল্লার টুপ।

টুপ করে ঘুম আসে না বনি আদমের। চুপ করে না সন্তানরা। গরমে ঘুম হারাম হয়ে যায়। ছেলেকে ঘুম পাড়াতে গুনগুন করে গান ধরে : আল্লাহ মেঘ দে পানি দে; ছায়া দে রে তুই আল্লাহ; মেঘ দে পানি দে; উত্তর দিকে চাইয়া দেখো মেঘের ফোঁটা পড়ে; আল্লাহ মেঘ দে পানি দে।

কী দুর্দান্ত ছিলো তার শৈশবের সময়টা। কী সুন্দর দিন ছিলো। মেঘের পানিতে ক্ষেতখামার বিলটিল ভরে গেলে বুকের নিচে কলাগাছ নিয়ে সাঁতার দিয়ে বলতো : নানিগো নানি; খালো কী পানি; কলা গাছ দিয়া বউ বানাইয়া দিলা বউয়ের নাইকা বুনি।

এসব শুধুই স্মৃতি, ফ্রেমে বাঁধায় করে রাখার মতো স্মৃতি। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছেলেবেলার পথ-ঘাট, ঘর-বাড়ি, গ্রাম-গঞ্জের ছবি অথবা প্রথম ঘরের স্ত্রী আর বাচ্চাদের ঘর-সংসার। তখন বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। কিন্তু তার এ ব্যথা, এ কথা প্রকাশ পায় না কখনো। বিশেষ করে তার বর্তমান সময়ে এসব কথা মনে করাও পাপ। কারণ, এই বর্তমান তাকে রাজ্যের সুখ দেয়; দেয় অজানা দুঃখের প্রহর।

ভ্যাপসা গরম লাগে। আসমানে চলে কালো কালো মেঘের মাতম। আওড়াকাওড়া বাতাসে লিচুগাছ, কাঁঠালগাছ মাটির সাথে মিশে যেতে চায়। ঝোপঝাড়ের উপরে ঝুলে থাকা মস্ত আসমান কানা হয়ে শিল-ঠাডা পড়তে থাকে সেকেন্ডে সেকেন্ডে। মরার মেঘ তো আসে না। তখন ভাড়াকরা বাসার জানালা খুলে বাহিরে তাকিয়ে থাকে বনি আদম। পাশে থাকে তার ছেলে রায়হান; কিন্তু তার মেয়ে নূরনাহার কোথায়? রাজকন্যার মতো সুন্দর এই মেয়ের জন্য আশেপাশের ছেলেরা পর্যন্ত তাকে সালাম দিতো। অথচ নিশুতি রাতের এই সময়ে তাকে না ঘুমিয়ে থাকতে হচ্ছে।

চিন্তার ঝুলির মুখ খুলে যায় যেন। গ্রামের এক কোণে রেখে আসা প্রথম ঘরের মেয়েরা কী করে? ছনের ঘর কী যুদ্ধ করে পেরে ওঠে শিল-তুফানের সাথে? অথবা তার কোহিনূরও কী হারিয়ে গেছে? অনেক অনেক প্রশ্ন তার মনের ভেতরে হারিয়ে যায়। অথবা বুদবুদের মতো মিলিয়ে যায় চিন্তার দিঘিতে। কখনোবা বিরাট দীর্ঘশ্বাস অজান্তেই বেরিয়ে আসে। তখন তার ছেলে গলায় জরিয়ে ধরে আব্বু আব্বু করে। সে দারুণ আবেগে ছেলেকে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে আবার বাহিরে তাকায়।

অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না; শুধু বাতাস আর শিল পড়ার শব্দ। মনে পড়ে গতকাল রাতের সেই রহস্যময় সময়টা। একটু সচেতন হলে একটু আগে বাসায় ফিরতে পারলে আজ হয়তো এতো কষ্ট হতো না অথবা আজ থেকে শুরু হতো না পাপের ফল ভোগ করা। তার মনে হয় মানুষের মন ভাঙা আর মসজিদ ভাঙা সমান অপরাধ। পাপ করলে শাস্তি পেতেই হবে।

গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে; রাত বারোটায় ডিউটি শেষ করে বাসায় ফেরার সময় ছোপ ছোপ অন্ধকারে সাপের মতো লতানো রাস্তা পেঁচিয়ে ধরে গিলে ফেলতে চেয়েছিলো যেন। সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঠাডার শব্দে হাত-পা স্তব্ধ হয়ে যায় যেন; যেন রাস্তার মায়াজালে পড়ে তারা। তখন দ্বিতীয় ঘরের বউ হাওয়া বেগম তাকে সাহস দেয় : আরে ডরাইয়োনা; আমগরে কানাওরা ধরছে মনে হয়।

বনি আদম ও হাওয়া বেগম সন্তানের কথা ভেবে আরো বিচলিত হয় অথবা সন্তানের কথা মনে আসে না। কিন্তু কেউ কিছু না বললেও একজন আরেক জনকে সাহস দিয়ে বাসার গলি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।

এইতো কিছুদিন আগেও এখানে এতো গলি ছিলো না; এখন পুরাণ ঢাকার মতো অসংখ্য গলি। পাঁচশো গজ পর পর এক একটা চৌরাস্তা।

বনি আদম ও হাওয়া বেগম কয়দিন আগে এসেছে বলে বাসার গলি খুঁজে বের করতে পারে না। স্থায়ী বাসিন্দাদেরও মাঝে মাঝে খটকা লাগে। কারণ, কিছুদিন আগেও এখানে ছিলো গ্রামীণ পরিবেশ। তখন কাঁঠালের বাগান, লিচুর বাগান আর ধান গাছের বাতাসে মানুষের কলিজা জুরিয়ে যেতো। কিন্তু একদিন এখানে টাকাওয়ালারা আসে এবং অনেক টাকার লোভ দেখিয়ে বিঘার পর বিঘা জমি কিনে, গজারি গাছ কাটে, কাঁঠাল গাছ কাটে, তাল গাছ কাটে, গাব গাছ কাটে, বাঁশ ঝাড় কাটে। অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় একটার পর একটা মিলফ্যাক্টরি। এসব মিলফ্যাক্টরিতে চাকরি নিতে আসে বনি আদম ও হাওয়া বেগমের মতো হাজারো মানুষ।

অনেক অনেক বাসার প্রয়োজন পড়ে বলে চৌধুরী-খান-সুলতানরা তাদের গাছগাছালি-লতাপাতা-ঝোপঝাড় কেটে ডুবা-পুকুর, খেত-খামার, বিল-ঝিল ভরে আধাপাকা বাড়ি বানায় অথবা প্লট বানিয়ে বিক্রি করে। এসব প্লটে এক একটা বিল্ডিং এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে দানবের মতো। রাস্তার অলিতে-গলিতে দোকানপাট দাঁড়িয়ে যায়।

যেসব ছেলেদের ঘরে ইঁদুর মরে থাকতো সেসব ছেলেরা দামি দামি বাইক নিয়ে ছোটে আতালে-পাতালে। যেসব মেয়েরা কিংবা তাদের বড়ো আপুরা বছরে একবার সেলোয়ার কামিজ পেতো তারা বিজ্ঞাপনের মডেলের মতো প্যান্ট-শার্ট পরে সাইকেল চালায় অথবা স্কুটি নিয়ে কলেজে যেতে চায় অথবা রাস্তায় রাস্তায় চক্কর দেয় অথবা স্কুটি কিনে দেওয়ার জন্যে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে।

এসব কথা বনি আদমের ভাবনায় আসে কিনা বোঝা না গেলেও তার জীবনযাত্রার পরিবর্তন তাকে অন্য মানুষে রূপান্তর করেছে। নাকি দিব্যি ভালো আছে সে? নতুন বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে ! জানালার পাশে বসে শীত শীত লাগে তার।

আবারো মনে পড়ে গতকালের রাতের কথা। গতকাল রাতে চক্কর দেয়া রাস্তার মধ্যে তারা রাস্তা খোঁজে। কুণ্ডলী পাকিয়ে বাতাস আসে। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় তারা যেন মানুষের ছায়া দেখতে পায়। নাকি গাছের ছায়াকে মানুষের ছায়া মনে হয়? মনে হয় ছায়াটা তাদের সামনে হাটে। নাকি রাস্তার পাশে পলিব্যাগ উড়ে আসে? তবু তাদের মনে হয় বাতাস শো শো করে বলে : ফিরে যা; যেখানে ছিলি সেখানে ফিরে যা।

বনি আদম ভাবে, এই কথাগুলো তার মনের কথা কি? তার কি ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না? তখন তারা ভালো করে বাতাসের শব্দ লক্ষ করে। না; কিছু শোনা যায় না।

তখন তারা আলোচনা করে, আসলে বাতাসের সাথে মনে মনে যে কথা মিলিয়ে নেয়া হয় বাতাস যেন সেই কথাই বলে। তবু তারা ভয় পায় অথবা ভয় না পাবার ভান করে। তবু তারা কোমর ভাঙা কুত্তার মতো লেছুর দিয়ে আগায়।

ঘরে আছে ছেলে মেয়ে, ওরা কী করছে কে জানে অথবা তাদের কথা মনেই থাকে না তাদের অথবা এ ভয়ের সময়ে ময়মনসিংহে রেখে আসা তিন মেয়ের জন্য বনি আদমের চিন্তা না হলেও দ্বিতীয় ঘরের মেয়ে নূরনাহারের জন্য চিন্তা না করলে চলে না। কারণ, জামাইয়ের চেয়ে দুই ইঞ্চি উঁচু দুধের মতো সাদা হাওয়া বেগমের মেয়ে নূরনাহারের জন্য চিন্তা না করার ক্ষমতা দুই ইঞ্চি নিচু বনি আদমের নেই।

নূরনাহার যেন সত্যিই এক নূরের নাম; মা-বাবা দুজনেই প্যারাডাইস মিলে চাকরি করে বলে ঘরে বসে বসে ছোট ভাই রায়হানকে নিয়ে টিভি দেখে অথবা বাড়িওলির ঘরে ফুটফরমাইশ করে। অথবা তারা শিল-তুফান-ঠাডার রাতে তাদের ছেলে মেয়ের জন্য চিন্তা করলেও মনের কোন এক কোণায় একটা সান্ত্বনা পায় : বাড়িওলি লোক খারাপ না; মাইয়ারে দিয়া ফুটফরমাইশ করাইলেও বাড়িওলি জ্যাতা থাকতে বাড়িওয়ালা বা বাড়িওয়ালার ছেরার জন্য ডর নাই।

যে বাড়িওলি বাড়িওলার চেয়ে দুই ইঞ্চি লম্বা সেই বাড়িওলা শ্রীপুর উপজেলা নির্বাচনে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হলেও বাড়ির ভেতরে মাতাব্বরি করতে পারে না। নির্বাচনের সময় তার প্রতিপক্ষরা বলে বেড়াতো : এক মণ ধানের দুই মণ চুচা চৌধুরীর বউ চৌধুরীর চাইতে উঁচা।

এই চৌধুরীরর বাসায় ভাড়া থাকা বনি আদম ঝড়-তুফান কমার জন্য অপেক্ষা করে। আল্লাহ্ই জানে নূরনাহার কোথায় আছে, কী করছে। গতকাল রাতে আরেকটু আগে ফিরতে পারলে কী নূরনাহারকে ঘরে পাওয়া যেতো?। কিন্তু গতকাল তারা তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছে; কুত্তার মতো লেছুর দিয়ে চার রাস্তার মোড়ে পৌঁছে প্রিক্যাডেট স্কুলে একটু জিরিয়ে নিয়েছিলো শুধু। তার ছেলে মেয়ে এই স্কুলেই পড়ে; কী সুন্দর মেয়ে তার ! কী চঞ্চল ! স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বাড়িওলির মেয়ের পুরনো প্যান্ট-শার্ট পরে খেলতে যায়। তাকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে একজন ভাড়াটিয়ার মেয়ে। কোন এক গ্রামের মেয়ে।

প্রত্যেক দিন বিকেলে বাসার সামনের গলিতে খেলে সে। তখন তার দিকে অনেকে চেয়ে থাকে ডরভয় ছাড়াই। মোড়ের চায়ের দোকান থেকে আশিক ও মজনু করে : ইস; আহ্, ও।

হঠাৎ করে মেয়েটির নিতম্ব চওড়া হয়ে যাওয়া দেখে চায়ের দোকানদার পর্যন্ত হাসফাস করে, আহারে মাইয়াটা ক্যামনে বড় হইয়া গ্যালো; হেইদিন না এরে কুলে নিলাম আমরা। তাকে তারা কোলে নিয়েছে কি-না তা জানা যায় না; তবে বর্তমানে তার প্রতি অনেকের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।

তখন বনি আদম তার মেয়ের প্যান্ট-শার্টের দিকে চেয়ে থাকে; মোমের আগুন পালাই পালাই করে আর বাহিরের পরিবেশ শান্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

গতকাল রাস্তার ঘোরের মধ্যে পড়লেও তারা চেষ্টা করেছে অনেক। তুফানের ঠেলায় তারা যেন উড়ে যাবে। মনে হয় আবার সামনে পড়ে ছায়াটা আর বাতাসের সাথে অস্পষ্ট শব্দ : ফিরে যা; যেখানে ছিলি সেখানে ফিরে যা।

বনি আদমের সব সাহস বাতাসের সাথে মিলিয়ে যায় এবং বউকে জাপটে ধরে। বউও তাকে শিশুর মতো বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখে। অসংখ্য ছায়া যেন তাদের সামনে পড়ে; নাকি গাছের ছায়াকে দানবের মতো লাগে? তবু তারা আগায়।

গ্রামে থাকার সময় শিল-ঠাডার দিনে তারা আল্লাহ্-বিল্লাহ্ করতো এবং নানি-দাদিরা উঠানের মধ্যে শিল পাটার শিল দিতো ঢিল। এতে কাজ না হলে নুনের বয়াম থেকে এক খাব্লা নুন ছিটিয়ে বলতো : দোহাই আলীর; দোহাই আলীর।

তবুও শিলের আকার নুনের মতো ক্ষুদ্র না হলে তারা বলতো : এইগুলা আল্লাহর দেওয়া গজব; দ্যাশ ভইরা গ্যাছে পাপে; কিয়ামতের বেশি দেরি নাই।

অথচ আজ তারা শিলের সাথে যুদ্ধ করে বাসায় ফিরছে। এক সময় তারা বাসার গলি পর্যন্ত আসে। এখানেই নূরনাহার ও বাড়িওলির মেয়ে এক্কাদোক্কা খেলার সময় চায়ের দোকানে বসে থাকা আশিক ও মজনু লক্ষ করে। তারা আফসোস করে বলে : দ্যাখছস মাইয়াটারে? মাল হইছে একটা; এক্কেবারে ঠাসা; শালার একবার যদি।

তারা এইটুকু বলে ঠোঁট কামড়ে ধরলে পাশের বাড়ির বাড়িওয়ালার ছেলে রিপন বলে : সবার আগে আমি বুকিং দিলাম; তরা এইদিকে চাইবি না।

তাদের মধ্যে এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়; কিন্তু তারা আবার এক সাথে হাসাহাসি করে এবং কয়েক দিনের মধ্যে নূরনাহারের সাথে রিপন ভাব জমায়। মেয়েটাও রিপনের সাথে কথা বলে আর ভাইয়া ভাইয়া করে এবং ছেলেটা তাদেরকে আইসস্ক্রিম কিনে দেয় এবং বাতির আযানের পরে তাদের সাথে যোগ দেয় কাউন্সিলরের বড়ো ছেলে। সে নূরনাহারের গালে হাত দিয়ে বলে : কিরে তগোর পড়াল্যাখা নাই? সারা দিন ঘুরসফিরস; আমার কাছে আসিস; অঙ্ক-টঙ্ক বুঝাইয়া দিমুনে।

তখন উত্তরের আসমানে কালো কালো মেঘের পাশে থাকে পশ্চিম আসমানের লাল লাল মেঘ। নূরনাহার ও তার সঙ্গীরা আঙুল তুলে বলে : এই দ্যাখ; দ্যাখ; হাসান হোসাইনের রক্ত।

নূরনাহারের ফর্সা গালেও টুসটুস করে রক্ত; যেন হাত দিয়ে টোকা দিলেই ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসবে। তার কপাল খামচিয়ে পড়ে থাকা চুলগুলো বারবার চোখের সামনে চলে আসে। এ চুলগুলোকে একটা ঝাকুনি দিয়ে সরিয়ে দেয়ার সময় এক পায়ে লাফ দেয়ার সময় থলথল করে তার শরীরে বিভিন্ন অংশ এবং একটা নাচের ছন্দ আসে তার শরীরে। ফলে আশিক ও মজনুর বুকের ভেতরে ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে। তাই তারা ঝিম মেরে বসে থাকে অথবা খিচ খেয়ে পড়ে থাকে।

রিপন ও জীবন খেয়াল করে বলে আশিক ও মজনুর চোখের বালি হয়ে ওঠে তারা। তাই তারা নূরনাহারকে নিয়ে দলাদলি করে। গালাগালি করে। মারামারি করে। খুনোখুনি করে। এসব ব্যাপার বনি আদম ও হাওয়া বেগমের কানে আসে না। তবে তারা নূরনাহারকে বাহিরে বের হতে নিষেধ করে। স্কুটির পিছনে উঠতে নিষেধ করে। সাইকেলের পিছনে উঠতে নিষেধ করে। কিন্তু তাদের চোখের আড়ালে নূরনাহার বাড়িওলির মেয়েদের মতো সবকিছুই করে। অথচ এই মেয়েটার জন্যই যতো চিন্তা।

তুফানের রাতে দ্রুতপদে রুমে ঢোকার সময়ও সেই কথাটা যেন কানে আসে : ফিরে যা; যেখানে ছিলি সেখানে ফিরে যা।

রুমে ঢুকেও পাওয়া যায় না মেয়েটাকে। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে; দরজাটা মিশানো। এরকম রাতে মেয়েটা যাবে কোথায়? তাই শিল আর ঠাডা একটু কমলে হাওয়া বেগম পাগলের মতো এখানে-ওখানে খোঁজে। বাড়িওয়ালি বলে : আইজকা আমার কাছে আসে নাই।

বাড়িওয়ালির মেয়ে বলে : দিন খারাপ হওয়ার আগেই নূরনাহার রুমে চইলা গ্যাছে।

গতকালের দুর্যোগের কথা নিয়ে বনি আদম জানালার পাশে বসে একটানা ভাবতে থাকে। তার মনে হয় গতকাল রাতের চেয়ে ভয়াবহ রাত কাটেনি জীবনে। দুরন্ত শৈশবে কতো রাত কতো ভাবে কেটেছে কিন্তু এরকম টেনশনে কাটেনি কখনো।

আজ সারা দিনেও মেয়েটার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আজ মেয়েটা সাইকেলের পিছনে ওঠেনি কিংবা এক্কাদোক্কাও খেলেনি কিংবা সুরে করে বলেনি : বিড়িতে নাই আগুন; পাইলাম একটা বাগুন; বাগুনে নাই বিচি; পাইলাম একটা কেচি; কেচিত নাই ধার; পাইলাম একটা হার; হারে নাই লকেট; পাইলাম একটা পকেট; পকেটে নাই টাকা; ক্যামনে যামু ঢাকা ।

তাই আশিক ও মজনুর মন খারাপ হয়। চায়ের দোকানদারের মনটাও ছ্যাৎ ছ্যাৎ করে। তখন উত্তরের আসমানে কালো কালো মেঘ জমে। তবুও তাদের বুকের ভিতরে হাচর-পাচর করা কমে না। তবুও নূরনাহার তিড়িংবিড়িং করে আসে না। তবে দুনিয়া অন্ধকার করে আসলে খবর আসে : নূরনাহারকে কোথাও খুইজ্যা পাওয়া যাইতাছে না; কাইল রাইত থেইকাই পাওয়া যাইতাছে না।

এই বাড়ি সেই বাড়ি বান্ধবীর বাড়ি কোথাও নাই। নাই। নূরনাহার নাই। এখানে নাই। সেখানে নাই। ল্যাংড়া কাঁঠাল গাছে নাই। মাথা ভাঙা লিচু গাছে নাই। মিলফেক্টরির সামনে নাই। বাউন্ডারিকরা প্লটে নাই। আসমানেও নাই।

চায়ের দোকানদার ও একজন ক্রেতা বলাবলি করে : মাইয়াটা ভাইগ্যা গ্যাছেগা।

আশিক মজনুকে বলে : মামা শুনছোনি খবর? পাখিতো উড়াল দিছে; এই মাগি যে এতো হট আছিন আগেতো বুঝতে পারি নাই; বুঝতে পারলে; ইস; শালার কপালটাই খারাপ।

এইটুকু বলে তারা দাঁত কামড়ে ধরে। তবে নূরনাহার কার সাথে ভেগে গেছে তা নিয়ে তারা চিন্তা করে। একেক জন একেক জনের নাম বলে। পাশের বাসার জয়নালের মা বলে : একজনের লগে যায় নাই; দুইজনের লগে গ্যাছে; উত্তর পাড়ার জমজ ভাই সাগর ও টগর নূরনাহারকে ভাগাইয়া লইয়া গ্যাছে; কয়েক দিন ধইরা সাগর ও টগর এইদিকে চক্কর দিছে।

তখন আসমান ভেঙে আসে। শিল-ঠাডা নেমে আসে। বনি আদমের ধ্যান ভাঙে; গতকাল রাতের কথা আর আজকের দিনের কথা ভাবতে ভাবতে শ্মশানঘাটের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে পাগল বাবার কথা। তাই বউয়ের সাথে আলোচনা করে শিল-ঠাডা পড়া বন্ধ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে।

এই সময়টুকু রায়হানের পাশে বসে মুখস্থ সুরা-কেরাত পড়ে। কিন্তু রাত নিশুতি হলে খবর পাওয়া যায় আজকের ঠাডায় এই নগরে তের জন মানুষ মারা গেছে।

তখন তাদের স্বপ্ন-কল্পনায় শুধু অতীত হানা দেয়। বনি আদমের মনে পড়ে তার বড়ো বউ ও তিন মেয়ের কথা; তাদেরকে বঞ্চিত করার মতো পাপ কাজ করেছে সে। আল্লাহ্ মাফ করবে কেন? কী দোষ ছিলো তার বড়ো বউয়ের? বউ না হয় একটু কালো ছিলো; কিন্তু তার মনতো সাদা; আর মেয়েদেরইবা কী দোষ?

হাওয়া বেগম ভাবে, অন্যের সংসার নষ্ট করার কী দরকার ছিলো? দেশে কী পুরুষ মানুষের অভাব ছিলো? সে এতো ভালো হলে বড়লোক স্বামী তাকে ছয় মাস পরে তাড়িয়ে দিয়েছে কেন?। না হয় সে একটু  অশিক্ষিত ছিলো, না হয় জাতে জাতে একটু বেমানান ছিলো; কিন্তু রূপ যৌবন দিয়ে সব পুষিয়ে দিতো সব। কিন্তু রূপের মোহ ও দেহের টান শেষ হয়ে গেলে ডিভোর্স দিয়েছে তাকে। এক পুরুষ তার সাথে এমন করেছে বলে সে আরেক পুরুষের সংসার ধ্বংস করে দেবে কেন? তাই এই পুরুষের সাথে প্রেম করা কিংবা তাকে বিয়ে করে এখানে চলে আসার শাস্তি তাদেরকে পেতে হবে।

এভাবে হাজার হাজার অপরাধবোধ তাদেরকে জাপটে ধরে। তখন মানুষের কথাগুলো উথাল দেয় মনে : সাগর ও টগরের সাথে নূরনাহারকে কথা কইতে দেখছে চায়ের দোকানদার গেসু।

এভাবে অনেক অনেক ভাবনা তাদেরকে ডাবিয়ে দেয়; তবে এক সময় আসমান পরিষ্কার হয়। তারা পা টিপে টিপে হাঁটে। রাত কয়টা বাজে তা জানে না। হাঁটতে হাঁটতে শ্মশানঘাটে পৌঁছায়। যদি পাগলবাবার দেখা পাওয়া যায়। পায়ের আওয়াজ পেয়েই সব বলে দিতে পারবে। মেয়ের খোঁজ পাবার জন্য এরকম ভয়ংকর জায়গায় যেতেও দ্বিধা করে না বনি। অথচ নিজ গ্রামে পড়ে আছে কালো কালো তিনটা মেয়ে। বনি আদম ভাবে আর থর থর করে কাঁপে। বাহিরের কাঁপুনির চেয়ে ভেতরের কাঁপুনি অনেক কাঁপানো। শ্মশানঘাটের কাছাকাছি পৌঁছালে একটা শব্দ পাওয়া যায় যেন; কে যেন হাসে। না কোন শব্দ নাই; শ্মশানঘাটে হাসবে কে? নাকি পিশাচ হাসে? গতকাল রাতের ছায়াটা বুঝি তাদের সামনে পড়ে। তারা ভালো করে লক্ষ করে; না ছায়া আসবে কোথা থেকে? নাকি গাছের ছায়াকে তারা ভুল করে বারবার মানুষের ছায়া মনে করছে। কখনো কখনো নিজেদের ছায়াও তাদের চোখের সামনে পড়ে। তবু তারা তাদের মনকে বোঝাতে পারে না। তখন শ্মশানঘাটের ঝোঁপে মানুষের গোঙানির শব্দ হয়; সাথে সাথে বনি আদম বউকে ঠেসে ধরে। বউ দাঁত কামড়ে পড়ে থাকে।

কিছুক্ষণ তব্দা লেগে পড়ে থাকার পরে একটু শোধ আসলে তারা উল্টা বেগে দৌড়ায় এবং তাদের মনে হয় কে যেন বলছে : ফিরে যা; যেখানে ছিলি সেখানে ফিরে যা।

তখন পুরো নগর তব্দা লেগে থাকে। আসমান, জমিন, কাঁঠালগাছ, লিচুগাছ দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আসমানের চাঁদ যেন চোখ রাঙায়। তারারা যেন থুথু ফেলায় তাদের মাথায়। নিশুতি রাতের নগরকে সাপের মতো পেঁচানো রাস্তা কষে ধরে যেন। তাদের মাথার ভেতরে প্রতিধ্বনি হয় : ফিরে যা; যেখানে ছিলি সেখানে ফিরে যা।

তারা বাসায় ফিরলেও মাথা থেকে প্রতিধ্বনির কথা মুছে যায় না। মনে হয় তারা অন্য এক জগতে বসবাস করছে। নিজের বাসাকেও অচেনা লাগছে। মনে হয় আদম ও হাওয়ার মতো তারাও তাদের পাপের শাস্তি পাচ্ছে। তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছে ভিন্ন কোন রাজ্যে। মনে হয় অতীত তাদের না পেলেও আল্লাহ্ কিন্তু ছাড়বে না। তখন ইচ্ছে করে ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে এক দড়িতে ঝুলে পড়তে।

তখন তুফান ছুটে। মনে হয় তারা উড়ে যাবে। মাথা ঘুরছে যেন; ভূমিকম্প শুরু হয়েছে নাকি? মাটির নিচে ডেবে যাবে যেন। অথচ রাত বাড়েও না কমেও না। এক সময় তারা ঝিমাতে থাকে। রাতও ঝিমাতে থাকে।

কোন রকমে সকাল হয়। মানুষের চেঁচামেচিতে তাদের ঘুম ভাঙে। রাতের কথা স্মরণে আসলে মনে হয় স্বপ্ন দেখেছে তারা। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের শোধ ফিরে আসে এবং কে যেন চিৎকার করে বলছে শ্মশানঘাটের ঝোপে নূরনাহারকে পাওয়া গেছে। এরকম ভয়ংকর রাতে মেয়েটা ওখানে গেলো কেন?

শ্মশানঘাটে মানুষের ঢল নামে। পুলিশ আসার আগে সাংবাদিক আসার আগে আশিক ও মজনু মোবাইলে মেয়েটার ছবি তুলে। তখন বনি আদম ও হাওয়া বেগমকে কাছি দিয়েও বেঁধে রাখা যায় না : ও মা মারে, ক্যামনে আমার এই সর্বনাশ হইলো? ও আল্লাহগো; ও মাগো; ও বাবাগো।

আশিক ও মজনু তাদের ছবি উঠায়। কেউ কেউ ভিডিও করে। ফেইসবুকের কারণে নূরনাহারের ছবি মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষকে আকর্ষণ করা এই বিষয়কে চ্যানেলগুলো লিড নিউজ করে।

ঠাডা পড়ার খবরকে আড়াল করে এই বিষয়ে ফেইসবুকে চলে নিন্দার ঝড়। দেশের সব যুবক ফেইসবুকে নূরনাহারকে তার আপন বোন ডেকে পোস্ট দেয়। মাওনা চৌরাস্তায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। মানববন্ধনের ছবি ফেইসবুকে আপলোড করা হয়। কয়েক দিনের মধ্যে এই আন্দোলন পুরো দেশে ছড়িয়ে যায়। দেশের সমস্ত মানুষ নূরনাহারের ঘটনা নিয়ে মাতালের মতো মাতাল হয়। গভীর রাতের টকশোতে, পত্রিকার কলামে, শাহবাগের আন্দোলনে, ক্যাম্পাসের শহিদ মিনারে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। কিন্তু একটা প্রাণীও ধরা পড়ে না; তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মেয়েটির মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা যায়নি।

এই খবর জানার পর দেশের মানুষ কোনভাবেই মানতে চায় না। তারা আশাহত হয়। কিন্তু তখন ঠাডা পড়ার বিষয় তাদেরকে আরো মাতাল করে তুলে। দেশের আনাচে-কানাচে দিনে দুপুরে ঠাডা পড়তে থাকে। কয়েক দিনের মধ্যে সারা দেশে ঠাডা পড়ে সাতশো ছিআশি জন মারা যায়। এই নগরেই মারা গেছে একশো একাত্তর জন। এতো মানুষ মারা গেলে আশিক ও মজনু নতুন শ্লোগান বানায় : যার মাথায় ঠাডা পড়ে তার মাথা স্বর্ণ হয়; যার মাথায় শিল পড়ে তার মাথা পোক্ত হয়।

রাম-সামের মাথায় ঠাডা পড়ে শিল পড়ে; কিন্তু মেঘ পড়ে না। তখন মেঘ নাই মেঘ নাই করতে করতে জয়নালেম মা বলে : মেঘের মা মরছে ওৎকরি; মেঘ গ্যাছে বাপের বাড়ি।

এই বিষয় নিয়ে দেশের বুদ্ধিজীবীরা সভা-সেমিনার করে। দেশ নূরনাহারের খবর ভুলতে বসে। তবে একটা নামকরা দৈনিকে খবরটা জীয়ে থাকে।

একদিন দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ হয় এবং সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার ড. আব্দুল্লাহ্ আল মামুন সাংবাদিকদের জানায় : নূরনাহারের পেন্টি, ভেজাইন্যাল সোয়াব ও ডিএনএ নমুনায় তিন ব্যক্তির বীর্য পাওয়া গেছে।

চৌধুরী ও খানেরা এই খবর পড়লে তাদের কান ও শরীর গরম হয়ে যায় এবং একটা তৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরে তার। সেই সাথে ঠাডা ও শিল পড়া বন্ধ হওয়ার তৃপ্তি যোগ হয়।

কয়েক দিনের মাথায় শুরু হয় মেঘ। মেঘ আর মেঘ। এক দিন। দুই দিন। তিন দিন। এভাবে একুশ দিনেও মেঘ থামে না।

ছাব্বিশ দিন পরে মেঘ একটু থামলে খবর আসে ফয়সাল নামের চার বছরের একটা শিশু ড্রেনে পড়ে গেছে; এই ড্রেনে মিলফ্যাক্টরির রঙব্যারঙের পানি পড়ে।

সাতাশ দিন পড়ে মেঘ থামলে শিশুটি কাগজের নৌকা ভাসাতে গিয়ে স্রােতের মধ্যে পড়ে যায়। মানুষকে আকর্ষণ করা নিউজটি টিভিতে সরাসরি দেখা যায়। দেশের মানুষ কাম-কাজ ফেলে টিভি দেখতে থাকে। আবুল, কাশেম, জব্বাররা উত্তেজিত হয়ে শিশুর লাশ খোঁজে।

কিছুক্ষণ পরে খবর আসে শিশুটি ড্রেনে পড়ে নাই এবং শিশুটির খালা কোলে করে নিয়ে আসে তাকে এবং টিভিতে জ্যান্ত শিশুর ছবি দেখা যায়। ফলে সাগর-টগররা বিরাট এক এ্যাডভেঞ্চার থেকে বঞ্চিত হয় এবং তারা বুকের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করে।

আরো কিছুক্ষণ পরে খবর পাওয়া যায় চার-পাঁচ বছর বয়সের একটা শিশুর লাশ উদ্ধার করছে সাধারণ মানুষ। আবারো জাহানারা-আমেনারা হুমরি খেয়ে পড়ে। বন্ধ টিভি চালু হয় এবং তা থেকে শিরিনা-আমিনারা চোখ ফেরায় না। টিভিতে শিশুর নিথর দেহ দেখা যায়। তখন হাওয়া বেগম প্যারাডাইস মিলের দিক থেকে বিলাপ করতে করতে আসে। রায়হান পানিতে ক্যামনে আসলো? ক্যামনে পড়লো? আনু-রাণু-বানুরা উত্তেজিত হয়; তারা এরকম এ্যাডভেঞ্চার আশা করে নাই।

অন্য দিকে আসমানে চলে মেঘের আওড়াকাওড়া চলাফেরা। রানা-সানারা একটা চাপা তৃপ্তি ও উত্তেজনা নিয়ে বাড়ি ফিরে অথবা টিভির চ্যানেল চেঞ্জ করে অথবা সুইচ অফ করে।

ছেলে ও মেয়েকে হারিয়ে বনি আদম ও হাওয়া বেগম পাগলের মতো করে। তারা একজন আরেক জনকে জরিয়ে ধরে বিলাপ পারে। তাদের মনে হয় আল্লাহ্ নিজ হাতে তাদেরকে শাস্তি দিচ্ছে। ঘরে গেলেই সব শূন্য মনে হয়; মনে হয় এক এক করে তারাও মারা যাবে।

হাওয়া বেগমকে নিয়ে নানা কথা প্রচলিত হয়; কমন কথার একটা হলো : পরের ঘরে আগুন দিলে আগুন পড়ে নিজের ঘরে; যে পরের জামাই নিয়া ঘর করে তার বিচার আল্লাহ্ করে।

রাত নিশুতি হলে তাদের ঘরের ছাদে চলে মেঘের মাতম। সেই মেঘ যেন বলে : ফিরে যা; যেখানে ছিলি সেখানে ফিরে যা।

বনি আদম ফিরে যাবার চিন্তা করে। টুপ করে পালিয়ে যেতে মন চায়। মৃত্যুর কথা বারবার মনে পড়ে, কিয়ামতের আলামত চোখের সামনে ভেসে ওঠে যেন। তার আচার-আচরণে ব্যাপক পরির্তন আসে। তার এই আচরণ দেখে বন্ধু রুস্তম সুরে সুরে বলে : সোনার চান আদম মিয়া; এই হাটে আম নাইকা; লও জাইগা আমগাইচ্ছা।

ঊনচল্লিশ দিনেও মেঘ না থামলে অস্থির হয়ে ওঠে জাহিদ-জুবেদা-খোদেজারা। বনি আদম  মেয়েদের কাছে ফিরে যাবার চিন্তা করে, সেই চিন্তা মনের কোণেই লুকানো থাকে। সে জানে, হাওয়া বেগম তা জানতে পারলে রোজ কেয়ামত নেমে আসবে।

চল্লিশ দিনের মাথায়ও মেঘ কমে না। হাওয়া বেগম নতুন বিপদে পড়ে। এই মেঘের মধ্যে বনি আদমকে পাওয়া যাচ্ছে না। অবশ্য চার দিন আগে সে পাগলের মতো আচরণ করে; পরনের জামা-কাপড় পর্যন্ত খুলে ফেলে এবং বড়ো বড়ো চোখ করে হাওয়া বেগমকে মারতে আসে।

বনি আদম যেদিন বাসায় ফিরে আসে না সেদিন সকালে প্রেমিক পুরুষের মতো আচরণ করেছে; অনেক দিন পরে বউকে জরিয়ে ধরে কপালে চুমুও খেয়েছে। ছাতা মাথায় করে দোকান থেকে মোমবাতি ও ম্যাচ আনার কথা বলে আর ফিরে আসে না।

মেঘ মাথায় নিয়ে হাওয়া বেগম এখানে-সেখানে খোঁজ করে; কোথাও নাই সে; সেও নূরনাহারের মতো হারিয়ে গেছে যেন, গ্রামের বাড়িতে সন্ধান করেও পাওয়া যায় না তাকে।

এই মেঘ তুফানের মধ্যে স্বামী-সন্তান হারিয়ে ভাড়াকরা বাসায় হাওয়া বেগম রূপযৌবন নিয়ে কাচুমাচু করে দিন কাটায়। অচেনা চোখ তাকায় তার শরীরের দিকে; ইচ্ছে করে পোড়া শরীর কেটে কুকুর বিড়ালকে খাওয়াতে। এই শরীরের কারণেই তাকে কতো জায়গায় হেনন্থ হতে হয়েছে।

বাড়িওয়ালা রেইনকোট পরে যখন-তখন রুমে ঢুকে বনি আদমের খোঁজ করে। তখন মেঘ আরো বাড়ে। মেঘের পানিতে রাস্তা-ঘাট একাকার হয়ে যায়।

হাওয়া বেগমেরও দিন-রাত একাকার হয়ে যায়। বন্যার পানিতে ভেসে যাবে যেন, তার চেয়ে বেশি বন্যা দেখা দিয়েছে মনের গহিনে।

এতো কিছুর জন্য কে দায়ী? নাকি কোন দুষ্ট গ্রহের ফের কাটাতে পারছে না সে? হাজারো প্রশ্নবোধক শব্দ তার দরজায় কড়া নাড়ে। মরার পুরুষ মানুষের ওপর ঘৃণা জন্মায় কিংবা কখনো ইচ্ছে করে পুরুষ মানুষের শেষ দেখে নিতে। গ্রামে ফিরে যাবার মতো অবস্থা কোথায়? ইচ্ছে করে উড়নাটা গলায় বেঁধে ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়তে।

হঠাৎ করে বিশাল বিশাল মেঘের ফোঁটা পড়ে। এক একটা ফোঁটাতে দেড় দুই সের পানি হবে, শিল পড়ে পাহাড়ের মতো, ঠাডা পড়তে থাকে সেকেন্ডে সেকেন্ড। পানি আর পানি, তুফান আর তুফান। বিদ্যুৎ গ্যাস ঘর বাড়ি দোকান পাট ভেসে যাচ্ছে। রাম-সাম-যদু-মধুরা ভেসে যেতে থাকে। ঘর-বাড়ি দালালকোঠা মেসাকার হয়ে যায়। এক এক করে রহিম-করিম-কুসুমরা পানিতে ভেসে যায়।

এক সময় পুরো দেশ সাগরের অতলে হারিয়ে যায়।


 

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
বই

রিগ্যান এসকান্দারের “সুফিয়াতন্ত্র” এবং “জাদুবাস্তববাদ”

সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার উন্মেষ ঠিক কবে ঘটেছে তা নির্ণয় করা কঠিন। ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদুবাস্তববাদ বা জাদুবাস্তবতা হচ্ছে বাস্তব এবং অ-বাস্তব

গল্প

কাকা কাহিনী

ষাটোর্ধ্ব বয়সের অনেক কাহিনীই আজ তাঁর নিজের কাছে অজানা। ভাবতে বসেও কোনো কুল কিনারা হয় না। সবকিছু আবছা আবছা লাগে।

কবিতা

আমি কিংবদন্তির কথা বলছি

আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি। তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল তাঁর পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল। তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা

গল্প

স্বপ্ন কিংবা বাস্তব বিভ্রাট

মাঝে মাঝেই একটা দুর্বিষহ স্বপ্ন আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। স্বপ্ন এলে ভয়, রোমাঞ্চ আর অনিশ্চয়তা আমাকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলে।