সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার উন্মেষ ঠিক কবে ঘটেছে তা নির্ণয় করা কঠিন। ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদুবাস্তববাদ বা জাদুবাস্তবতা হচ্ছে বাস্তব এবং অ-বাস্তব উপাদানের সংমিশ্রণ। এর ফলে যা উৎপন্ন হয় তাকে আপনি পশ্চিমা সাহিত্যের কল্পকাহিনি বলতে পারবেন না; এটি নির্দেশ করে বাস্তবতার এক শৈল্পিক রূপ। ম্যাজিক রিয়েলিজম টার্মটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯২৫ সালে এক জার্মান শিল্প সমালোচক ফ্রানৎস রোহ কর্তৃক। তবে এর উপস্থিতি বহুকাল পূর্বের সাহিত্যেও পাওয়া যায়। হয়তো অনেক লেখক জেনে বুঝে কিংবা না জেনে না বুঝেও তার কল্পজগতে ভ্রমণ করতে করতে তার সাহিত্যকর্মে নিয়ে চলে আসেন জাদুবাস্তবতা; কিন্তু তিনি তা টেরও পান না। সুফিয়াতন্ত্র তেমনটি নয়। সুফিয়াতন্ত্রে কবি রিগ্যান এসকান্দার সচেতনভাবে জাদুবাস্তববাদকে তার কবিতায় ধারণ করতে চেয়েছেন। একারণে কাব্যগ্রন্থটির কোনো অংশ বা কোনো নির্দিষ্ট একটি কবিতা জাদুবাস্তববাদ ধারণ করে বা ধারণ করার চেষ্টা করে তা নয়, বরং সুফিয়াতন্ত্রের প্রতিটি ছত্র জাদুবাস্তববাদকে সফলভাবে প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। বাংলা কথাসাহিত্যে ইতোপূর্বে ম্যাজিক রিয়েলিজম নিয়ে কিছু সফল কাজের সন্ধান পাওয়া যায়, কাব্য সাহিত্যেও খোঁজ করলে অনেক কবিতা পাওয়া যাবে যেখানে সচেতন বা অচেতনভাবে জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ লক্ষ করা যায়, তবে বাংলা কাব্য সাহিত্যে সুফিয়াতন্ত্রই প্রথম কাব্যগ্রন্থ যেখানে একটি পুরো কাব্যগ্রন্থ সফলভাবে জাদুবাস্তববাদকে আলিঙ্গন করেছে দ্ব্যর্থহীনভাবে।
সুফিয়াতন্ত্র কাব্যগ্রন্থটি ২০২১ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। বইটি প্রকাশিত হয়েছে ঘাসফুল প্রকাশনী থেকে। ৫৬ পৃষ্ঠার কাব্যগ্রন্থটিতে স্থান লাভ করেছে ৪৬টি কবিতা। কবিতাগুলো গদ্য কবিতা। রিগ্যান এসকান্দার তার কবিতায় যে একটা শক্তিশালী কাব্যিক গদ্য গঠন করতে সমর্থ হয়েছেন তা তার পূর্বের কাব্যগ্রন্থ ‘দ্রোহশাস্ত্রবুলি’ থেকে বোঝা যায়; তবে সুফিয়াতন্ত্রে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। সুফিয়াতন্ত্র কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটির শেষ ছত্রত্রয়ের দিকে খেয়াল করুন।
কবিরাজ বলেছিল সাতটি পাথর ছুড়ে মারা শেষ হলে বিয়ের বার্তা আসবে। এ বিশ্বাসে সুফিয়াখালা গোলাপ হাতে হাসে। আর সুফিয়াখালাকে আমার ফিল্মের নায়িকার মতো লাগে। (কবিতা- জাদুটোনা, সুফিয়াতন্ত্র)
ছত্রত্রয় অতি সাধারণ গোছের। কোনো জটিল শব্দপ্রয়োগ নেই। তবে এমন এক ভাব এখানে ফুটে উঠেছে যা আপনার হৃদয়কে স্পর্শ করবে। এখানে এমন একটা স্বর লুকিয়ে আছে, যা পাঠককে খুঁজে বের করতে হাঁসফাঁস করতে হয় না। জাদুবাস্তববাদ সেই ভাবকে করেছে আরও গভীর।
সুফিয়াতন্ত্র কাব্যগ্রন্থে কবি যে তার কৈশরের প্রিয় চরিত্র সুফিয়াখালাকে কেন্দ্র করে তার কবিতাগুলো রচনা করেছেন তা সুস্পষ্ট। তিনি এমন এক আবহের মাধ্যমে সুফিয়াতন্ত্রের কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু উপস্থাপন করেছেন যাতে করে যে কারো মনে হবে, সুফিয়াতন্ত্রের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে সুফিয়াখালা এবং কবির কৈশর একাকার হয়ে আছে। বিষয়বস্তুগুলো/কাহিনিপটসমূহ কবিতাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হলেও আবহ এক অখণ্ডতা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। কৈশরের নানা আবেগ অনুভূতি কবিতার পরতে পরতে। ধরুন জাদুটোনা কবিতাটির ওই শেষ লাইনের কথাটি- ‘আর সুফিয়াখালাকে আমার ফিল্মের নায়িকার মতো লাগে।‘ এখানে সরাসরি কবি যে কিশোর তা ব্যক্ত হয়নি (কাব্যগ্রন্থের কোথাও কোথাও তা সরাসরি ব্যক্ত করা হয়েছে), তারপরেও এটা বুঝতে পারা যায় এটি কৈশর বয়সেরই একটি অনুভূতি। কিশোর হৃদয়ই বিভিন্ন নারীকে নায়িকা ভেবে কল্পনার জগতে ভাসে। কবি তার ভাবনা এবং ভাবে কৈশরকে সচেতনভাবে টেনে এনেছেন।
এবার আসা যাক সুফিয়াতন্ত্রে জাদুবাস্তববাদ সম্পর্কে। জাদুবাস্তববাদ সম্পর্কে মার্কেজ বলেছিলেন, ‘আমি সব সময়ই এটা দেখে মজা পাই যে আমার কাজের বড় প্রশংসাগুলো আসে কল্পনার জন্য। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, আমার লেখালেখির মধ্যে একটি লাইনও নেই, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।‘
জাদুবাস্তবতা আসলে এরকমই। যেটাতে কল্পনা আর বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার, এখানে যেন চলে বাস্তবতা আর জাদুর ঠাণ্ডা লড়াই। জাদু বা কল্পনা এখানে প্রকটভাবে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, কেননা কল্পনাকে এমনভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয় যাকে বাস্তব বলে মনে হয়। রিগ্যান এসকান্দারের সুফিয়াতন্ত্র কাব্যগ্রন্থের ‘আতরওয়ালা’ কবিতাটির কথা বিবেচনায় নিয়ে দেখেন।
তখন আমার খেলার বয়স। হোমিওপ্যাথির শিশির ভেতর সুফিয়াখালার চুলের বাসনাগুলো পুরে রাখি আমি। আর আমার কৈশরজুড়ে সুফিয়াখালার চুলের সুঘ্রাণভর্তি শিশিগুলো সাজিয়ে রাখি দক্ষ আতরওয়ালার মতো। পুষ্পহীন মৌসুমে মহল্লার যুবকের কাছে আমার এসব সুঘ্রাণভর্তি শিশির কদর বাড়ে। তারা আমার কাছ থেকে শিশিভর্তি আতর কিনে নেয়, আর বিকেল হলে নতুন পাঞ্জাবিতে আতর মেরে মুজিবর উকিলের বাড়িতে টহল দেয়। আমার আতরের প্রশংসা করে। (কবিতা- আতরওয়ালা, সুফিয়াতন্ত্র)
উপর্যুক্ত কবিতায় লক্ষণীয় যে, কবি একটি কাল্পনিক রূপক কাহিনি উপস্থাপন করছেন এবং কাহিনিটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য প্রতিটি লাইনে তিনি সচেতনভাবে শব্দ প্রয়োগ করছেন। প্রথমেই কবি এখানে বললেন, সুফিয়াখালার চুলের বাসনা তিনি একটি শিশিতে পুরে রাখছেন। কথাটি অবাস্তব। চুলের বাসনা যেমন অবাস্তব তেমনি শিশিতে পুরে রাখাটাও একটি অবাস্তব কল্পনা ব্যতীত কিছু নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কবি সেই শিশিগুলো সাজিয়ে রাখছেন, আমাদের মাঝে বোধ জাগছে শিশিগুলোতে সম্ভবত সুগন্ধী চুলের সুবাস আছে। পরবর্তীতে মহল্লার যুবকেরা যখন সেই শিশিভর্তি আতর কেনে, আমাদের ভাবনা আরও সুদৃঢ় হয়। পাঞ্জাবিতে আতর মাখার সাথে সাথে যেন প্রমাণিত হয়, শিশিতে আতরই ছিল। আতরের প্রশংসা করছে অনেকে বিষয়টা জেনে, আতরওয়ালার অস্তিত্বে আমাদের বিশ্বাস আসে। কিন্তু বাস্তবে কোনো আতর নেই, আতরওয়ালা নেই। বাস্তবে আছেন একজন সুফিয়াখালা এবং একজন কমবয়সী কবি। কবিতাটি পাঠ করে তাদের উপস্থিতিও আমরা অস্বীকার করতে পারি না।
আবার যদি ‘পায়রা’ কবিতার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়– দেখা যায় একটি পায়রা উড়তে উড়তে আকাশে পৌঁছে গিয়ে চাঁদের কাছ থেকে জ্যোৎস্না ধার করে নিয়ে আসে, যে জ্যোৎস্নায় সুফিয়াখালা রূপবতী হয়ে ওঠে। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য জাদুবাস্তবতায় কল্পনার একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও সেই কল্পনা একসময় মোড় নিয়ে বাস্তব ধর্মের কাছে চলে আসে। যেমন সুফিয়া খালা যে রূপবতী তা বাস্তব, অথচ চাঁদ থেকে ধার করে আনা জ্যোৎস্নায় সে রূপবতী হয়েছেন তা অবাস্তব। কবি রিগ্যান এসকান্দারের ভাষায় ‘পায়রা’ কবিতার শেষের তিনটি লাইন,
জেনেছি পায়রাগুলো আকাশে উড়তে উড়তে পৌঁছে যায় চাঁদের কাছে, চাঁদটা ঠুকরে ঠুকরে খায় সারা রাত ধরে। তাই পায়রাগুলোর ঠোঁটে ঠোঁটে জ্যোৎস্না লেগে থাকে।
জ্যোৎস্না লেগে থাকা ঠোঁটে পায়রাগুলো সুফিয়াখালার গালে চুমু খেলে–
সুফিয়াখালার রূপ জ্যোৎস্নার মতো ধীরে ধীরে আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। (কবিতা- পায়রা, সুফিয়াতন্ত্র)
আবার কখনো কখনো দেখা গেছে ব্যতিক্রমও, বাস্তবতা আছড়ে পড়েছে কল্পনা আর বাস্তবতার সংমিশ্রণের মধ্যে, সেখান থেকে কবিতাটিকে আর তোলা হয়নি চরম বাস্তবতায়, তবে সেই অবাস্তব-বাস্তবের সংমিশ্রণের মধ্যেই স্থাপন করা হয়েছে এক রূঢ় বাস্তবতা।
উদাহরণস্বরূপ ‘জীবন্ত’ কবিতাটির শেষ তিনটি লাইন:
কৈশোরে আমাকেও কী এঁকেছিল সুফিয়াখালা? সেই থেকেই কী আমি কবিতা লিখতে শুরু করি? মাছ ও ফুলের মতো জীবন্ত হয়ে উঠি, বাক্যে সাঁতার কাটি, শব্দে দোল খাই। (কবিতা- জীবন্ত, সুফিয়াতন্ত্র)
এই যে কল্পনা আর বাস্তবতার খেলা রিগ্যান এসকান্দার সুফিয়াতন্ত্রে খেলেছেন তা এককথায় অনবদ্য। আপনাকে মানতে হবে, সুফিয়াতন্ত্র একটি উন্নতশ্রেণির সাহিত্যকর্ম।
সুফিয়াতন্ত্র নিয়ে লিখতে গেলে, প্রতিটি কবিতা নিয়ে একেকটি গদ্য রচনা করা সম্ভব। কেননা সুফিয়াতন্ত্রে একেকটি কবিতায় একেকটি কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। একেকটি কবিতার বিষয়বস্তু, রূপকতা এবং জাদুবাস্তবতার গভীরতা নিয়ে বিস্তর ভাব প্রকাশ করা ছাড়া সুফিয়াতন্ত্রের আলোচনা সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়।
সুফিয়াতন্ত্রের পঠন বিষয়ে বলতে গেলে নির্দ্বিধায় বলা যায় কবিতাগুলো সুপাঠ্য, এর ভাষা সহজবোধ্য; তবে কবিতার ভাব দুর্বোধ্য এবং রূপক আশ্রয়ী। ভাব দুর্বোধ্য হলেও জাদুবাস্তবতার ম্যাজিকের জন্য পাঠককে অবাক করে দেবার সক্ষমতা এর রয়েছে। বোধের পার্থক্যের কারণে এই কবিতাগুলো কারোর কাছে গাঁজাখুরি কাহিনিকাব্য মনে হতে পারে; আবার কারো কাছে অমূল্য রতন মনে হতে পারে। তবে বাংলা কাব্য সাহিত্যে জাদুবাস্তববাদের নিদর্শনস্বরূপ একটি অনন্য সংযোজন বলে আজ কিংবা কাল সমালোচকেরা এটিকে গ্রহণ করে নেবেন বলে উপলব্ধি করি।