উপন্যাসাংশ: “নিষিদ্ধ লোবানের ঘ্রাণ” // ইভান অনিরুদ্ধ

ইভান অনিরুদ্ধ একজন তরুণ কবি ও কথাসাহিত্যিক। তাঁর লেখা “নিষিদ্ধ লোবানের ঘ্রাণ” মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসে মধ্যবিত্ত জীবনের নানা টানাপোড়ন, প্রেম, গ্রাম্য রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়াদি উঠে এসেছে। নিষিদ্ধ লোবানের ঘ্রাণ উপন্যাসের অংশবিশেষ দর্পণের পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো। উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসটির দুটি অধ্যায়ে চিরায়ত শহুরে জীবনের দৃশ্যপট ফুটে উঠতে দেখা যায়। গ্রন্থটি আপনারা রকমারি থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।


…ছমাস হয়ে গেল আমি ঢাকায়। সবার থেকেই পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। নীলার সাথে তো আগে থেকেই যোগাযোগ হচ্ছিল না। এখন নীরার সাথেও কথা হয় না। মনে হলো এরকম বিচ্ছিন্নতাই এক ধরনের সুখ! আমি চাকরি আর এর পারিপার্শ্বিক জীবন নিয়ে মহাব্যস্ত হয়ে গেলাম।

বস ইজ অলওয়েজ রাইট– প্রাইভেট চাকরিতে এই কথা আজকাল খুব একটা খাটে না। তাই বস নামক প্রাণীটির সাথে বনিবনা না হওয়ায় আগের চাকরিটা অল্প কয়েকদিন করে ছেড়ে দিয়েছি। ছেড়ে দেওয়ার দুমাসের মাথায় এই চাকরিতে জয়েন করেছি- ম্যানেজার, এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন, হোয়াইট হর্স ফার্মা লিমিটেড। ছোটোখাটো ওষুধ কোম্পানি। জার্মানি থেকে ভিটামিন এবং হরমোনাল প্রোডাক্ট এনে এ দেশে মার্কেটিং করে। কোম্পানির রেপুটেশন ভালো। ইয়ারলি টার্নওভার সন্তোষজনক। এই কোম্পানির মালিকপক্ষে আছে দুজন– সুরজিত সেন, যিনি এমডি। আর অন্যজন তাঁর স্ত্রী দেবযানী সেন, ডিরেক্টর। সুরজিত সেনের বয়স চুয়ান্ন-পঞ্চান্ন হবে। গোলগাল চেহারা, মাঝারি সাইজের ভুঁড়ি, চোখের নিচে কালি জমেছে। বয়সের ভারে দুই গালের মাংস ঝুলে গেছে। দেবযানী সেনের বয়স আটাশ থেকে ত্রিশ হবে। গায়ের রং শ্যামলা, লম্বা এবং চোখে লেগে থাকার মতো আকর্ষণীয় ফিগার। সুরজিত সেন নিঃসন্তান। অফিসে অবশ্য অনেকেই রসিকতা করে আড়ালে আবডালে- এই বয়সে নাকি তার আসল ইঞ্জিন দুর্বল হয়ে গেছে। এই ইসুতে স্ত্রীর সাথে নাকি সম্পর্কটা ভেতরে ভেতরে খারাপ।

আমি অবশ্য এই চাকরিটা এনজয় করছি। কাজের চাপ কম, বেতনও সন্তোষজনক। আর রিল্যাক্স মুডে কাজ করা যায়। তবে মাসের পনেরো দিন বিভিন্ন জায়গায় অফিসের কাজে টুরের ভেতর থাকতে হয়। কখনো এমডি-র সফরসঙ্গী কখনো-বা ডিরেক্টরের সফরসঙ্গী। অফিসের কাজ শেষ হয়ে গেলে সুরজিত বাবু প্রায়ই আমাকে নিয়ে গুলশান ক্লাবে চলে যান। মাঝে মাঝে অফিসে তার নিজের রুমেই পুরোপুরি নেশা না হওয়া পর্যন্ত গিলতে থাকেন। আমার এসবে আগ্রহ বা অভ্যাস নেই।

সুরজিত বাবু যখন বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লিকুইড খান তখন আমি তাকে কেবল সঙ্গ দিই। তার কষ্টের কথা, কোম্পানিকে নিয়ে তার স্বপ্নের কথা শুনি। এসব কথা শুনতে শুনতে তার জন্য আমার কেমন জানি করুণা হয়!

– বরুণ, আমি কেন ড্রিঙ্কস করি তুমি জানো?

– না স্যার। তবে ইট’স ইনজুরিয়াস টু ইয়োর হেলথ।

– জ্ঞান দিচ্ছ নাকি? তোমার বয়স কত চলছে এখন?

– স্যার, অ্যাকোর্ডিং টু সার্টিফিকেট টুয়েন্টি এইট।

– ইয়োর এইজ ইজ ভেরি ক্লোজ টু দেবযানী, মাই বিলাভ্ড ওয়াইফ। হা, হা, হা।

– মে বী স্যার।

– তুমি কি এক পেগ খাবে? দামি ব্র্যান্ড, রাশান ভদকা। খাও না এক পেগ! মাথাটা ফ্রেশ লাগবে।

– নো থ্যাঙ্কস স্যার। অন্য একদিন ট্রাই করব।

– ইট’স আপ টু ইউ ম্যান। আই কান্ট ইনসিস্ট ইউ। আ”ছা, দেবযানীকে তোমার কেমন মনে হয়?

– স্যার, চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। এত লোড হলে ম্যাডাম খুব রাগ করবেন।

– হা, হা, হা। রাগ? আমার ওপর? শী নেভার ট্রাস্টস মি, বিলিভস মি, ইভেন লাভস মি। উই হ্যাভ জাস্ট অ্যা ফরমাল রিলেশন। দেয়ার ইজ নো রিলেশন অ্যাজ অ্যা কাপল। কই, বললে না তো, আমার স্ত্রীকে তোমার কেমন লাগে?

আমি চুপচাপ থাকি। এরকম অবস্থায় চুপচাপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। একপর্যায়ে আমি আর অফিসের পিওন ধরাধরি করে সুরজিত বাবুকে গাড়িতে তুলে দিই। তারপর তার বেডরুম অবধি পৌঁছে দিয়ে আমি নিজের বাসায় ফেরত আসি। এরকম কাজ আমাকে প্রায়ই করতে হয়। আমি এতে বোরিং ফিল করি না বা বিরক্ত হই না। কেননা বস হিসেবে সুরজিত বাবুকে আমি পছন্দ করি। লোকটা জটিল নয়, ইজি গোয়িং!


সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি এমন সময় দেবযানীর কল এলো মোবাইলে। আমি তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করলাম।

– গুড মর্নিং ম্যাম!

– গুড মর্নিং! আপনি এখন কোথায় আছেন?

– বাসায় আছি। অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি । কেন বলুন তো?

– আপনি অফিসে না গিয়ে সরাসরি বাসায় চলে আসুন। জরুরি কাজ আছে।

– ম্যাম, অফিসে বসের কিছু জরুরি ফাইল আপডেট করতে হবে।

– আমি বলছি আপনি আধাঘণ্টার ভেতর বাসায় আসবেন। আপনার বসের ফাইল আপডেট করার চেয়ে আমার কাজটা মোর ইম্পোর্ট্যান্ট! ও কে?

– ঠিক আছে ম্যাম, আমি আসছি।

দেবযানী আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই লাইন কেটে দিয়েছে। আমি ঝটপট তৈরি হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে ধানমন্ডি দশ নম্বর সড়কে সুরজিত সেন এবং দেবযানী সেন দম্পতির বাসায় চলে এলাম। ডোর বেল বাজাতেই দেবযানী নিজেই দরোজা খুলে আমাকে ড্রয়িংরুমে বসতে বলল।

কিছুক্ষণ পর দেবযানী ট্রেভরতি নাশতা এবং চা নিয়ে এসে আমার সামনে টি-টেবিলে রাখল। সে আরাম করে সোফায় বসল। সকালে গোসল করায় তার চেহারায় আলাদা একটা স্নিগ্ধতা ফুটে উঠেছে। পিঠের ওপর চুল খোলা, পরনে সাদা প্রিন্টের থ্রিপিস। নাশতার প্লেট আমার সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল– ঝটপট খেয়ে নিন। আপনাকে আমার সাথে সকাল এগারোটায় চিটাগাং যেতে হবে। আমার বান্ধবীর ছোটো ভাইয়ের বিয়ে। আপনার বস যেতে পারবে না। প্লেনে যাব, দুদিন পর ফিরব ট্রেনে। আপনি দুইটা টিকিট কনফার্ম করেন। আমার নাশতা খাওয়া শেষ হলে একটা খাম আমার হাতে দিয়ে বলল– এখানে দশ হাজার টাকা আছে। টিকিট কনফার্ম করে আমাকে ফোন দিবেন। ইচ্ছে করলে আপনার প্রয়োজনীয় কাপড় বা ব্যাগ সাথে নিয়ে নিতে পারেন।

আমি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে ভাবছিলাম– দেবযানী বিয়ের অনুষ্ঠানে তার হাজবেন্ডকে সাথে না নিয়ে আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছে? বিষয়টা সুরজিত বাবু কীভাবে নেবেন? পরে ভাবলাম– আমি এত জটিল ভাবনা কেন ভাবছি। এটা আমার চাকরির অংশ, এভাবে ভাবলেই তো হয়। তাছাড়া এই কয়েকমাসে আমি বুঝেছি- এই দুজন কেবল অভিনয় করে যাচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর। ভেতরে ভেতরে এই দুজন নরনারী খুব অসুখী- শারীরিক এবং মানসিক দুভাবেই।

আমি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের দুপুর বারোটার ফ্লাইটের টিকিট কিনে নিলাম। দেবযানীকে ফোনে জানিয়েও দিলাম। সে আমাকে বলল– আপনি অফিসেই থাকেন। সময়মতো আমি আপনাকে গাড়িতে উঠিয়ে নেব। ড্রাইভার আমাদেরকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করে আসবে। আমি বললাম– ঠিক আছে ম্যাম। আমি ততক্ষণে হাতের কিছু কাজ শেষ করে রাখি।

অফিসে ঢুকতেই অ্যাকাউন্ট ম্যানেজার ফরিদ সাহেব আমার রুমে এলো। টাকপড়া বয়স্ক মানুষ। সুযোগ পেলেই সে সুরজিত বাবু এবং দেবযানী সেন সম্পর্কে আদিম রসিকতা করে। এখনো হয়তো তাই করবে। হাতে করে সে আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে এসেছে। সেটা আমার সামনে টেবিলের ওপর রেখে বললÑ ভাই, চা খান। আপনি হলেন মালিকপক্ষের লোক। মালিকের চেয়ে মালিকের সুন্দরী বউয়ের খুব আপনজন। আমি তার দিকে হেসে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। ফরিদ সাহেব সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলল– ভাই, ইতিহাসে এইরকম বহুত ঘটনা আছে। অফিসের ম্যানেজারের সাথে সুন্দরী বসের প্রণয়লীলা। এই বলে সে খিকখিক করে হাসতে লাগল। আমি ধমক দিয়ে বললাম– আপনি থামেন তো। বুড়া বয়সে এসব চিন্তা করে কী মজা পান?

ফরিদ সাহেব একটু দম নিয়ে বলল- ভাই, আমরা বুড়া হয়ে গেছি, তাই এইসব চিন্তা কইরা মজা লই। আর আপনারা ইয়াং ম্যান। বসের বউয়ের সাথে কাম কইরা মজা লইবেন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম– আপনি এখন যান তো। আমার হাতে কিছু জরুরি কাজ আছে। ফরিদ সাহেব চলে যাওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল- সুরজিত বাবু একটা বুইড়া পাঁঠা। তার মাজায় এখন সেই জোর নাই। যা করার আপনিই করেন তার বউয়ের সাথে। আপার ক্লাসের এইরকম অল্পবয়সি মহিলারা একজন রিলায়েবল, এফিশিয়েন্ট সেক্স পার্টনার চায়। তারা লাইফটাকে এনজয় করতে চায়। আজকাল ভাই শরীরের সুখটাই হলো আসল। সুরজিত বাবু তার বউরে এই সুখ দিতে পারে না।

আমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে খুব দ্রুত ফরিদ সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমার সারা শরীর গরম হয়ে গেল তার এসব কথায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আরও একঘণ্টা আছে। আমি চেষ্টা করলাম হাতের কাজে মনোযোগ দিতে। কিন্তু ফরিদ সাহেবের কথাগুলো মাথার ভেতর হাতুড়িপেটা করছে যেন।

ভাবছি- ফরিদ সাহেবের মতো একজন বয়স্ক মানুষের ভেতরটা এত জঘন্য যৌন চিন্তায় ঢাকা কেন? নাকি এসব রগরগে কথার ভেতর দিয়ে নিজের ভেতরের অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষায় অক্ষম প্রকাশ ঘটায়? আসলে মানুষের ভেতরটা খুব জটিল। কে যে কেমন করে নিজের ভেতর যৌন সুখ খুঁজে পেতে চায় তা বলা কঠিন।

 

বি. দ্র. দর্পণে প্রকাশিত সকল লেখার স্বত্ব দর্পণ ম্যাগাজিন কর্তৃক সংরক্ষিত। দর্পণ থেকে কোনো লেখার অংশ অন্যত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে দর্পণের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক।

একই ধরনের লেখা

দর্পণে লিখুন

গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, মুভি পর্যালোচনা, বই আলোচনা, ভ্রমণ অথবা দর্পণের যে কোনো বিভাগে

লেখা পাঠানোর ইমেইল

editor@dorpon.com.bd
নিয়মাবলী জানতে ক্লিক করুন
ADVERTISEMENT
মাসওয়ারি
শিল্প ও সংস্কৃতি

জয়নুল আবেদিনের ২০ চিত্রকর্ম

এদেশে চিত্রশিল্পীদের মধ্যে যে কয়েকজন তাদের চিত্রকর্ম দিয়ে দেশ-বিদেশের মানুষদের কাছে পরিচিতি লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন অন্যতম।

রিভিউ – রহিমা আক্তার মৌ

জানি না কয়জন এমন নিয়ম মেনে আইডিতে ফ্রেন্ডের সংখ্যা বাড়ায়। যে যাই করুক আমি নিয়ম মেনেই এড করি। সেই প্রথম থেকেই

গল্প

বিবেক

শেষ রাত্রে একবার মণিমালার নাড়ি ছাড়িয়া যাওয়ার উপক্রম হইল। শিয়রে ঘনশ্যাম অত্যন্ত সজাগ হইয়াই বসিয়াছিল। স্ত্রীর মুখে একটু মকরধ্বজ দিয়া

গল্প

এক সকালের অপেক্ষায়

সময় পেলেই আমি জানলার ধারে গিয়ে বসি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই। স্কুলের ছুটি থাকলে দুপুরে ভাত খেয়ে উঠে। এক একদিন